স্কুল ছুটির পর বই খাতা ফেলে দুহাত মেলে ভোঁ দৌড় দিয়ে ক্রিকেট মাঠে যাবার জন্য যেভাবে সারাদিন প্রহর গুণতাম, তার চেয়ে বেশি ব্যাকুলতা সাজিয়ে আগ্রহ মাখিয়ে আবেগ জমিয়ে প্রতীক্ষা করতাম নারায়ণ স্যারের ক্লাসের জন্য।
তিনি যেন বয়স লুকিয়ে, কিশোরত্ব জাগিয়ে, কল্পনার নাও ভাসিয়ে, নব জীবনের গান গেয়ে, মনস্তত্ব সাজিয়ে, হাজির হতেন ঐ আমাদের বয়সীদের কাতারে।
মাথার সামনের অংশে দশ বারটা মতো চু্ল ছিলো উনার। চুলগুলো না থাকলে যে কোন গেরস্ত ঘরের গৃহবধূ অবলীলায় তাঁর মাথায় পরাটা বানাতে পারতেন। প্রতিটি চুল পাঁচ ছ ইঞ্চি মতো লম্বা। কোমলমতিদের মতো নারিকেল তৈল মাখিয়ে ডান পাশে বাঁকিয়ে সিঁথি পেড়ে আসতেন স্কুলে। ঐ চুলগুলো যেন জেদী প্রেমিক প্রেমিকার মতো শত বিরহে না ছাড়ার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে একে অপরকে জড়িয়ে থাকতো। দিনের সময় বাড়ার সাথে সাথে সূর্যালোকের মতো নারিকেল তেলের শক্তি কমে যেতো। ধীরে ধীরে চুলের বন্ধন আলগা হতো। ফ্যানের তীব্র বাতাসে ঐ দশ বারটা চুল টিলার মতো হয়ে গোছা আকারে চক্রাকারে ঘুরতো আকাশপানে। বারবার ঠিক করতে যেয়ে লজ্জা পেয়ে হার মানতেন তিনি। সব শেষে, লাজ ঝেড়ে হাল ছেড়ে নিজেই উপভোগ করতেন চুল উড়াউড়ির দৃশ্য। ঠোঁটের কোণায় হাসির ক্ষীণ রেখা জেগে ধীরে ধীরে দখিনা হাওয়ার মতো সারা মুখে ছড়িয়ে পড়তো। আহ! সৌন্দর্য!
ক্লাসে ঢুকতেন গাম্ভীর্য আর চাতুর্যের দ্বি-মনন নিয়ে। মুহুর্তেই শ্রাবণ ধারার মতো মুখমণ্ডল থেকে ঝরে পড়তো সব গাম্ভীর্য। শ্রেণীকক্ষের প্রতিটি কোণা জেগে উঠতো উনার আগমনী বার্তায়। চলন্ত পাখার মতো ক্লাসের চারদিকে ঘূর্ণায়মান থাকতেন তিনি। পিছনের বেঞ্চে বসে থাকা দুষ্টু ছেলেরাও তাদের দুষ্টামি কিছু সময়ের জন্য দূর আকাশের কোন ব্যাংকে জমা রেখে সমস্ত কৌতূহল স্যার কে বিলিয়ে দিতেন।
কী দারুণ সব উদাহরণ দিয়ে শিখিয়ে দিতেন কালাধিকার, ভাবাধিকরণ , সন্ধি, সমাস ও বিভক্তি; কী চমৎকার সব যুক্তি; কী অদ্ভুত ব্যাকরণ-ভক্তি; এসবই স্যারের শক্তি; মাপার নাই কোন নিক্তি; উপমার নাই উক্তি।
(বিঃ দ্রঃ নীচের ছবির তিনজনই আমার স্কুল জীবনের প্রিয় শিক্ষক। ছবির ডানে শ্রদ্ধেয় নারায়ণ স্যার।)
Leave a Reply