প্যারিস অনেকক্ষণ ধরে ভার্সিটির গেটে দাঁড়িয়ে আছে। সামিরার জন্য অপেক্ষা করতে করতে সে বিরক্তির শেষ ধাপে পৌঁছে গেছে। ইচ্ছে করলেই সে ভেতরে চলে যেতে পারে কিন্তু সে সেটা করবে না।জায়গায় জায়গায় ছেলে মেয়েদের ছোট ছোট জটলা পাকিয়ে আছে। সেই জটলা গুলোর মধ্যে কিছু কিছু উত্ত্যক্ত পার্টিও দেখা যাচ্ছে।সে গেটে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ ধরে ভেতরের পরিবেশ দর্শন করছে। কিছুটা তার ভেতরেও আয়ত্ত করে নিচ্ছে। ভবিষ্যতে তার জন্য কি কি অপেক্ষা করে আছে, মোটামুটি তার একটা ধারণা এতক্ষণে হয়ে গেছে। অবশ্য তাতে তার তেমন একটা মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না। তার এখন যত চিন্তা ঐ আহাম্মক, মাথামোটা সামিরাকে নিয়ে।এই মেয়েকে ফেলে যদি সে ভেতরে চলে যায় তাহলে ওই মেয়ের টিকিটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। একেতো আজ তাদের প্রথম দিন দ্বিতীয়ত ভার্সিটির উত্ত্যক্ত পার্টি।এতক্ষন যাবৎ অনেক ছেলেমেয়েই তাদের দ্বারা নাস্তানাবুদ হচ্ছে। যার অধিকাংশই তার চোখে, কানে আসছে। অবশেষে তার মাথামোটা বান্ধবী তার চোখের সামনে হাজির।
সামিরার চোখে মুখের প্রফুল্লতা দেখে যে কেউ বলতে পারবে, যেন সে কোন ফ্যান্টাসি কিংডমে ঢুকে পড়েছে। আপাতত তার থেকেও কোনো অংশে কম না।
অদূরে ফাইজান চৌধুরী তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে নবীনদের স্বাদরে স্বাগতম জানাবার জন্য বিভিন্ন অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করে চলেছে। মাঝে মাঝে তার চোখ গেইটে দাঁড়ানো ব্ল্যাক ড্রেস পড়া মেয়েটার দিকেও যাচ্ছে।এখন শুধু অপেক্ষা তার আগমনের। মেয়েটা কাছাকাছি আসতেই সে আর দেরী করলো না।
হেই ব্ল্যাক ড্রেস, কাম হেয়ার!
ছেলেটার ডাকে মেয়েটা মৃদু পায়ে হেঁটে অতি ভদ্র আঙ্গিকে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।তার চেহারা দেখে তার অভিব্যক্তি কি তা বোঝা গেল না।
মেয়েটি নিঃশব্দে মাথা উপরনিচ ঝুঁকিয়ে হ্যাঁ বুঝালো।
এবারের প্রশ্নেও মেয়েটি কিছু বলল না। ব্যাগের থেকে নোটবুক বের করে নাম লিখে তাকে দেখালো।
সাথে সাথেই ফাইজনের একজন চামচা আলী হাত বাড়িয়ে নোটবুকটি কেড়ে নিল।
ছ্যাঁ! এমন বিশ্রী হাতের লেখা!এরকম ওয়ান টুর বাচ্চারা কেমনে ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে গেল।এই কথা বলেই আলী নাকছিটকিয়ে নোটবুকটি ফাইজানের হাতে ধরিয়ে দিল।
সামনের মেয়েটা যে বাকপ্রতিবন্ধী, এতক্ষণে তাদের দলের সবার বোঝা হয়ে গেছে। কেউ কেউ তো খুবই দুঃখ প্রকাশ করল,এত সুন্দর একটা মেয়ে কিন্তু কথা বলতে পারেনা। একেতো কথা বলতে পারে না সাথে নামটাও মেয়েটার সাথে যায় না।রাকিব তো শেষমেষ বলেই ফেলল,
দোস্ত, নামটা কেমন জানি কাজের বেটি কাজের বেটি ফিলিংস!
রাকিবের বলায় ফাইজান তার দিকে কটমট চাহনি নিক্ষিপ্ত করলো।যেনো তাকে এখনি চোখ দিয়ে গিলে খাবে।তার তো বসন্ত শুরু হওয়ার আগেই হাওয়ায় ভেসে গেলো।আজকের দিনের জন্য তার কতদিনের প্ল্যানিং, কতদিনের স্বপ্ন।আজি তো সে তার জীবনসঙ্গী নির্ধারণ করতে চেয়েছিল।তাতেই যেন এক বালতি পানি পড়ল। যাও মেয়েটা মন মত পছন্দ হল কিন্তু তার এত ক্ষুত,সে কোনটা দিয়ে কোনটা ঢাকবে!মেয়েটা না হয় কথা বলতে পারে না,সেটা অবশ্য সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা। কিন্তু মেয়েটার মা বাপ কি রকম বেয়াক্কেল? এরকম একটা নাম রাখতে হয়? রাকিব তো খারাপ বলেনি,রহিমা নামটা শুনলে সত্যি সত্যিই তার আগে কাজের বেটি সারনেম হিসেবে চোখে ভেসে উঠবে।
প্রেম করার আগেই সে ছ্যাঁকা খেয়ে ফেললো।আাপাতত সে তার মনের দুঃখকে ফ্ল্যাশ করে বাকপ্রতিবন্ধী মেয়েটাকে বিনয়ের সাথে বিদায় দিলো।অবশ্য যাওয়ার আগে তাকে যে কোন সমস্যায় সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি ও দিলো।
আর এদিকে প্যারিসের কৃতকর্মে সামিরার জ্ঞান হারাবার অবস্থা।
তুই মাইরি আসলেই একটা জিনিস। কেমনে পোলা গুলারে কোন কিছু না করেই বাঁশ দিয়ে আসলি!
আমাকে কেউ ঠেকাবে এমন কারো এখনও জন্ম হয় নি!
পরে যদি ধরা খাস তখন কি করবি?
সেটারও ব্যাকআপ প্ল্যান আছে। তুই বাচ্চা মানুষ, অতসব তোর মাথায় ঢুকবে না।আপাতত তুই ক্লাসে মনোযোগ দে।
এক সপ্তাহ যাওয়ার পর প্যারিসের ব্যাকআপ প্ল্যান সত্যি সত্যি কাজে আসলো। কারণ ফাইজান তাকে বান্ধবীদের সাথে কথা বলতে দেখে ফেলেছে।ফাইজান যখন আগুন চোখে তার দিকে তেড়ে আসলো তখন সে যতটা উদ্যমে এসেছিল ততটা উদ্যমে সে নিভে গিয়েছিল।এবারও সে কাজের বেটি রহিমা ওরফে প্যারিসকে দ্বিতীয়বার কোন সমস্যায় পড়লে তাতে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরে আসলো। অবশ্য সাথে করে কিছু বসন্তের প্রজাপতিও নিয়ে গেল।
প্যারিসের মা রানু বেগমের অনেক শখ ছিল বিয়ের পরে প্যারিসে হানিমুনে যাওয়ার। তখন তার স্বামী মিনহাজ শিকদার তার বউয়ের শখের হানিমুনে এক বালতি পানি ঢেলে তাকে কক্সবাজারে ডুব দিয়ে এনেছিল।সে সময় রানু বেগম চোখের দেখা প্যারিস না দেখলেও সর্বক্ষণ তার স্বপ্ননগরী প্যারিসকে চোখের সামনে রাখবার অন্য এক পদ্ধতি অবলম্বন করলেন। তাই তো উঠতে-বসতে ঘরের আনাগোনায় চারিদিকে শুধু প্যারিসের পদাচারণ। কিন্তু আজকাল তিনি এই প্যারিসের অত্যাচারে যারপরনাই অতিষ্ঠ। রানু বেগম অতিষ্ঠ হলেও মিনহাজ শিকদার এই অতিষ্ঠতা খুবই মন দিয়ে উপভোগ করেন।
প্যারিসের প্রধান কাজ হলো বাইরে যা কিছুই সে করুক না কেন, ঘরে এসে একমাত্র বাবাকে তার আদি অন্তর পুঙ্খানুভাবে বর্ণনা করা সাথে কিছুটা ম্যাগী মসলা মিশিয়ে। আর তার বাবাও তা গোগ্রাসে গিলে ফেলেন।
অন্যদিকে প্যারিসের বড় ভাই ফারিশ শিকদার সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে কখন না জানি তার বোন কোন অঘটন ঘটিয়ে আসে।কারণ তাকে সেটা অঘটন থেকে শুদ্ধি করে ঘটন করতে হয়। এইতো কিছুদিন আগে পাশের বাসার রমজানের কথায় সে চমকে গিয়েছিল। পাড়া-প্রতিবেশী সবাই জেনে গেল কিন্ত সে এখনো জানতে পারল না কখন তার বিয়ে ঠিক হয়েছে!অবশ্য এটা নতুন কোন বিষয় না। এর আগেও এই মেয়ে আরো নানান পদের চমকপ্রদ ঘটনা ঘটিয়েছে।যার ফলাফলের ভাগীদার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে হয়, মাঝে মাঝে তার পিতা-মাতা ও সেই ফলাফলের আংশিক অংশীদার হয়। এই মেয়ে অতি আদরে বাঁদর বনে গেছে। এই বাঁদর মেয়েটার জ্বালায় আজ পর্যন্ত তার একটা প্রেম করা হয়ে উঠলো না। এখন তো বিয়েও সেখান থেকে বাদ পরল। বাকি জীবন বোধ হয় তাকে চিরকুমার ই থাকতে হবে ।
ফাইজান আরেকটু পর মনে হয় বোমের মত ব্লাস্ট হবে।
কারণ আর কিছু না তার বসন্তের প্রজাপতি ওরফে কাজের বেটি রহিমা ওরফে প্যারিস। গত সপ্তাহে যখন সে জানতে পারল তার বসন্তকুমারী টনসিলের অপারেশনের কারণে এতদিন কথা বলতে পারেনি, তখন তার মনে যেন হাজার রঙের প্রজাপতি উড়া শুরু হয়েছে।তৎক্ষণাৎ সে ভেবে নিল তার এই না হওয়া প্রেম কুমারীর নাম রাখবে প্রজাপতি।কিন্তু আজ সে জানতে পারল এতদিন যাবৎ যে নাম নিয়ে তার হাজার হাজার না হওয়া দুশ্চিন্তা ছিল সবি এখন বেকার।আজ সে তার একটা রফাদফা করেই ছাড়বে। হলো ও তাই! অবশ্য সেটা প্যারিসের না স্বয়ং ফাইজানের।কারণ এই মেয়ে পুনরায় তাকে বোকা বানিয়ে ছেড়ে দিল। আর ফাইজান ও তার না হওয়া প্রেম কুমারীর নামের ব্যাখ্যা শুনে ফাটা বেলুনের ন্যায় চুপসে গেল।সাথে কিছুটা টক ঝাল বিশিষ্ট আফসোস ও যোগ হলো। অবশ্য পুরোটা ঝাল গিয়ে পড়ল প্যারিসের মাতা পিতার উপর।
প্যারিসের ভাষ্যমতে, তার এই ঐতিহাসিক নাম নাকি তার মা-বাবার বড়ই প্রিয়। তাকে যদি কেউ এই নামে না ডেকে অন্য নামে ডাকে তাহলে তারা নাকি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তাদের একমাত্র আদরের নামের আদরের মেয়ে বলে কথা! তাই প্যারিস তার মা-বাবার প্রদত্ত নামটি সবাইকে বলে বেড়ায়। কারণ সে চায় না তার কারণে তার একমাত্র মা বাবা মানসিকভাবে কোন আঘাত পাক। কিন্তু ফাইজান এটা বুঝতে পারল না, প্যারিসের মা-বাবা না হয় সামান্য দুঃখ পাবে! তাই বলে কি কেউ সামান্য নামের জন্য মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে?মনে মনে সে প্যারিসের উদ্ভট ফ্যামিলি নিয়ে দ্বিধায় পড়লো।
দু-এক দিন পরে প্যারিস আর ফাইজান আবার মুখোমুখি হলো। যেখানে ভার্সিটির মেয়েরা তাকে একনজর দেখার জন্য মুখিয়ে থাকে সেখানে এই মেয়ে সোজা তাকে নাকচ করে দিল!এবারও সে তার একটা রফাদফা করার জন্য এসেই,নতুন করে আবার একবুক হাহাকার নিয়ে ফেরত গেল। এতদিন ধরে যে সে একটা বিবাহিত মেয়ের পিছনে ঘুরঘুর করছিল, সেটা ভাবতেই তার নিজের প্রতি ঘৃনা লাগলো। শেষমেষ সে কিনা অন্যের বউকে প্রপোজ করতে গেল! ভাগ্যিস এই খবর সে এখনো কাউকে জানায় নি! তাহলে তো তার বন্ধুরা সবাই তার খিল্লি উড়াতে একবিন্দু ও পিছপা হতো না।
থাক,সে না হয় তার না হওয়া প্রেমের কষ্ট নিজের বুকের ভিতর দাফন করে ফেলবে।
তিন বছর পর,
ফারিশের বন্ধুর সাথে তার একমাত্র বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে।অসংখ্য পাত্র দেখার পর শেষে এই একজন বর্তমানে টিকে আছে।কারণ এর আগে সবাই তার বোনের কাছে বোল্ড আউট হয়ে চলে গেছে।বর্তমানে যে আছে সে ও বোধহয় চলে যেত কিন্তু তার এই বন্ধু প্যারিসের সকল কীর্তিকলাপ জেনেই রাজি হয়েছে। তাই তো সবকিছু ঠিক হওয়ার পর, বিয়ের দিন তারা সবাই মিলে প্যারিসকে চমকে দিবে বলে ঠিক করে রেখেছে। তার বোন ই সবাইকে চমক দিয়ে আসছে,এবার তার নিজে চমকে যাবার পালা।অবশ্য এই পরিকল্পনাও তার হবু বরের,যার মুখ এখনো সে দেখেনি।
যথারীতি তিন কবুল বলে কাগজে সই করে প্যারিসের বিয়ে হয়ে গেল। এতদিন মিনহাজ শিকদার তার একমাত্র মেয়ের ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়ে আসছেন,তাই আজ তিনি চুড়ান্ত পর্যায়ে এসে সেটা তার মেয়ের উপর এপ্লাই করলেন।এবং সেটা যথাযথভাবে কাজেও দিলো।যার দরুন আজ তার আদরে বাঁদর বনে যাওয়া মেয়ের বিয়ের ফুল ফুটলো।
বাসর ঘরে প্যারিস তার সদ্য বিয়ে করা স্বামীকে শায়েস্তা করার জন্য মনে মনে বিভিন্ন রকম ফন্দী আটছে।দেখা যাক তার ফর্মূলা কোনটা আজ কাজে আসে!
অবশেষে তার সদ্য বিয়ে করা স্বামীকে দেখে তার পিলে চমকে গেলো।তাও সে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে সামনের মানুষটাকে সেটা বুঝতে দিলো না।
দেখুন,আপনার জন্য আমার অনেক কষ্ট লাগছে।আমার পরিবার যে এতবড় মিথ্যে আপনার থেকে লুকাবে আমি তা জানতাম না।আপনি তো আগে থেকেই জানতেন আমি বিবাহিত।আর এখন….
প্যারিসকে কথা শেষ করতে না দিয়ে ফাইজান নিজেই বললো,
আর এখন নিশ্চয় তুমি প্রেগনেন্ট!আর আমার তাতে ও কোন সমস্যা নেই।তুমি যদি দশ বাচ্চার মাও হও তাতেও আমার কোন আপত্তি নেই।
এদিকে ফাইজানের কথায় প্যারিসের মূর্ছা যাবার অবস্থা। কারণ মনে মনে সে এটাই বলতে চেয়েছিল।তার আগেই এই ছেলে সেটা বলে ফেললো।
আর এবার ফাইজান তার বসন্তকুমারীর কানে কানে বললো,
বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান
এবার ঘুঘু তোমার বধিব পরাণ।
(সমাপ্ত)
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply