একটা ছবির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে যিশু বললো,
“এই ছবির মেয়েগুলো কারা?”
“দেখি.. ও। এরা আটকে ছিল তিন মাস পাকিস্তানি আর্মিদের একটা ক্যাম্পে। আমি তখন মিরপুরের ওদিকটায় আরও কিছু ছবি তোলার জন্য একদল পুলিশের সাথে ঘুরছিলাম, তখন এদের উদ্ধার করা হয়।” বললেন এক সময়ের তুখোর ফটোগ্রাফার রশীদ খান।
যিশু বললো, “আমার মোবাইলে এই ছবিটা তুলতে পারি?”
“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আপনি সবগুলোর স্ন্যাপ নিন। আজকাল কে আর এসব দেখতে চায় বলুন। কত ছবি নষ্ট হয়ে গেছে। স্বাধীন হবার পর অবশ্য বিভিন্ন পত্রিকায় এসব ছাপা হয়েছে। কিছু পুরস্কারও পেয়েছি। এই অ্যালবাম টাই শুধু আছে বাদ বাকি ছবি মুক্তিযোদ্ধা ভিত্তিক বিভিন্ন সংগ্রহশালা নিয়ে নিয়েছে।”
“আচ্ছা এদের কি হয়েছিল? কোথায় আছে বলতে পারেন?”
“যতদুর জানি এদেরকে যার যার ঠিকানায় পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। মুজিব হত্যার কিছুদিন পর আমি লন্ডন চলে যাই। বিশ বছর পরে দেশে আসি। আপনার বাবার কোন ছবি থাকলে রেখে যান আমি চেষ্টা করবো খুঁজে দেখতে কোথাও তার কোন নাম আছে কিনা।”
“ঈশ্বর চন্দ্র বিশ্বাস, তাইতো? মি. যিশু, আপনি কি কিছু ভাবছেন? আমি কি বললাম কিছুই তো শুনেন নি।”
“আই এম সরি রশিদ সাহেব। আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম। আসলে এই ছবিটা আমার মনে হচ্ছে আমার পরিচিত কেউ আছে। কোথায় যেন দেখেছি।”
“আচ্ছা, আপনার বাবা সম্পর্কে যা জানেন বলেন আমাকে।”
“আমার বাবা অক্টোবরের শেষের দিকে যুদ্ধে যান। আর ফিরে আসেনি। দেশ স্বাধীন হবার পরে তার এক সহযোদ্ধা আমার মাকে তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে। তারপর মাকে নিয়ে আমার দিদা কলকাতায় চলে যান। আমার জন্ম বাহাত্তরের মে মাসে।”
“দেখুন ত্রিশ লক্ষ শহীদের সবার নাম এখনো তালিকা ভুক্ত করা হয়নি। এটা প্রায় অসম্ভব কাজ। আর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য যারা বেঁচে আছেন তাদের পরিচয় নিয়েই অনেক সমস্যা হচ্ছে আর যারা শহীদ হয়েছে.. বুঝতেই পারছেন। আর তো পঞ্চাশ বছর পরে এই প্রথম, তার খোঁজে আসলেন।”
যিশুর মাথায় ওই ছবিটাই ঘুরেফিরে আসছে। রশীদ সাহেবের কোন কথা কানে ঢুকছে না। কি আছে ছবিটায়!
“আপনার নাম কে রেখেছে? বাবার নাম ঈশ্বর, ছেলের নাম যিশু ব্যাপারটা মিলে গেল না একদম?”
“হুমম। যেদিন প্রথম স্কুলে গেলাম, ক্লাস টিচার বলেছিল, ঈশ্বরের পুত্র যিশু। তুমি কি বেথেলহেম থেকে এসেছো বাবু?”
“তখন অবশ্য এই কথাটির মানে বুঝিনি। আচ্ছা ভাই ,আমি তাহলে আজকে উঠি।”
“ঠিক আছে আপনার বাবা এই দেশের জন্য জীবন দিয়েছে.. আমরা তাে ঋণী আপনার কাছে। আমি কোন খবর পেলে আপনাকে অবশ্যই জানাবাে।”
যিশু নিজের হােটেলে চলে এলাে। আট তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাে রাজধানী ঢাকা। ভাবছে এই দেশের একজন শহীদ আমার বাবা, অথচ সে অন্য দেশের নাগরিক। সেই ছােট বেলা থেকেই বাংলাদেশে আসার ইচ্ছা অথচ এই পঞ্চাশ বছর বয়েসে প্রথম আসলাে!
কত কথা মনে পরছে আজ। তার দিদা দাদু, এই দেশেই তাদের জীবন কেটেছে। দেশ ভাগের পরে তার দিদার আত্নীয়রা বেশীর ভাগ চলে গেছিলো ভারতে, তারা যায়নি। তার দাদুকে সবাই বােঝাতাে, এখানে থেকে লাভ নেই যে কোন সময় বিপদ হতে পারে এতাে গুলাে ছেলেমেয়ে নিয়ে তখন কি করবে।
তার দাদু বলতাে, “দেখাে নিজের মা থাকতে কেউ সৎ মায়ের কাছে যায়? তােমরা যাও। এতদিন পরে ইংরেজদের গােলামী থেকে মুক্ত হয়েছি এখন আবার আরেক যায়গায় যাবা শিকড় গাড়তে?”
যিশুর মা একমাত্র মেয়ে ছিল ওর দাদু হরিপদ দত্তের। তিন ভাইয়ের একবােন। ওর মামারা তিন ভাই, অমল, বিমল ও কমল। বড় ছেলে অমল কলকাতেই থাকতাে নিজের কাকার সাথে। কাকার দোকোন ছিল, সেখানেই কাজ করতাে। দেশ ভাগ হবার পরেও ওখানেই থেকে যায়। ওর মা শুভ্রার জন্ম তাে দেশ ভাগের পরে হয়েছে। মা বাবা ভাইদের অনেক আদরের। এসব কথা ওর বড় মামীর কাছে শােনা।
মুক্তিযুদ্ধের আগে মাত্র দুইবার কলকাতা গেছে শুভ্রা। প্রথম বার বড়দাদার বিয়ের সময়। খুব আনন্দ করেছিল। আসতেই চায়নি। অমল তখন নিজের ছােট দুই ভাইকেও রেখে দেয়। ওর বাবাকে বুঝালাে, এখানে থাকলে পড়াশোনাটা হবে। বিমল কমল ও আনন্দের সাথে থেকে গেলাে। মনক্ষুন্ন হয়ে দেশে চলে আসে হরিপদ। কিন্তু দুই বছর পরেই যখন নাতনী কল্যানীর জন্মের পরে আবার যায়, তখন ছেলেদের লেখাপড়া ভালাে হচ্ছে দেখে মনটা খুশী হয়েছিল। অমলও দমদমে জায়গা কিনে ঘর তুলেছিল নিজের বাড়িতে। তাছাড়া দেশে তখন সারাদিনই ছাত্র আন্দোলন হয়, বরং ওখানেই ভালাে আছে। ওর দিদা তাে মনে মনে ভেবেই রেখেছিল ছােট দুই ছেলেকে তাদের গ্রামেই বিয়ে করাবে। তাহলে দেশের প্রতি টান থাকবে। শুভ্রা তখন মাত্র হাইস্কুলে উঠেছে। বিমল কমল প্রতি দূর্গা পূজোতেই বাড়ি আসতাে। শুভ্রার জন্য কত রকম শাড়ি নিয়ে আসতাে। সেইসব শাড়ি পরে বান্ধবীদের মনে ইর্ষা জাগাতাে।
ওই সময় খুব কম মেয়েই বি.এ. পড়তাে। ওর মায়ের অনেক সখ ছিল মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার কিন্তু শুভ্রার এককথা পড়াশোনা শেষ করে আনেক বড় কিছু হবে। ভাইদের নিয়ে আসা পত্রিকাগুলােতে ইন্দিরা গান্ধীর ছবি দেখে ওর ইচ্ছেটা আরও প্রবল হয়ে উঠতো। ভাইয়েরাও উৎসাহ দিত। ঊনসত্তর সালে শেষবার এসেছিল শুভ্রার ভাইয়েরা। অমলের ছােটমেয়ে মাধুরীর তখন এক বছর। অনেক ধুমধামে সেবার পূঁজো হয় দত্ত বাড়ীতে। তখন কি কেউ ভেবেছিল আর কোনদিন ফেরা হবেনা জন্মভূমিতে।
শুভ্রার বৌদি অলকা ওকে নিয়ে যেতে চেয়ছিলো। কিন্তু পড়াশােনা বাদ দিয়ে বেড়াতে যেতে চায়নি শুভ্রা।
তারপর সব কিছু এলােমেলাে হয়ে গেলাে। যুদ্ধের শুরুতেই শুভ্রাকে দ্রুত পাত্রস্থ করে হরিপদ। তারপর যুদ্ধের সময়ই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরলােক গমন করে। ওদিকে যুদ্ধে গিয়ে আর ফেরেনি শুভ্রার স্বামী!
নাহ্ আর ভাবতে চায়না যিশু। কি হয়েছে, আজ শুধু মায়ের কথা মনে পরছে। দরজায় কেউ নক করছে। খুলে দেখে শােভন দাঁড়িয়ে।
“দাদা সেই কখন থেকে ফোন করে যাচ্ছি। কোথায় ছিলেন?”
“ওহাে খেয়াল করিনিতাে। বস তুমি।”
“চলেন কালকের পােগ্রাম ঠিক করি.. কোথায় কোথায় যাবাে।”
“কাল তো আমি চলে যাবাে।”
“যেতেই হবে? মানে, আপনি না বললেন এক সপ্তাহ থাকবেন? এখন তিনদিন থেকেই——“
“পরে আসবাে। হঠাৎ করে কিছু ভালাে লাগছেনা।”
“আর একটা দিন থাকেন, কিছুই তাে দেখলেন না। আপনার সাক্ষাৎকারটা ও নেয়া হলনা।”
“আরে আমার কথা কি লিখবে আর কে ই বা পড়বে। আর আমার বাবার কথাও তেমন কিছু জানিনা। শুধু জানি তিনি একজন শহীদ মুক্তিযােদ্ধা। বাবাকে নিয়ে আমার ভীষণ গর্ব হয়। কিন্তু তার কোন গল্প জানি না।”
“আচ্ছা আপনার কথাই বলেন। গল্পের মত করেই বলেন, আমি আমার মত করে সাজিয়ে লিখে নিব।”
“একদিকে দেশ স্বাধীন হলাে আর আমার মা আর দিদার কপাল পুড়লাে। তারা ইন্ডিয়াতে চলে গেলাে। আমার মা প্রবল শােকে স্থবির হয়ে গিয়েছিল। আমাকে আমার বড়মামীই লালন পালন করেছে। আমার মা নিশ্চুপ হয়েই থাকতাে। বড়মামী একই থালায় খাবার নিয়ে আমাকে আর মাকে খাইয়ে দিত আর বলতাে শুভ্রা তােমার ছেলেকে একটু খাইয়ে দাও। মা কখনােই তা করতেন না। আমার যত আবদার মামী আর দুই দিদির কাছেই ছিল। বড়মামা আর দিদা মায়ের কাছে বসে বসে কথা বলার অনেক চেষ্টা করতাে। মায়ের কোন ভ্রক্ষেপ ছিল না। অন্য দুই মামা স্টাবলিসড হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিল।”
“আমার চার বছরের সময় মা মারা যায়। মায়ের আদর পাইনি তাই কোন কষ্টও হচ্ছিল না। বড়মামি আমাকে কোলে নিয়ে বলেছিল খােকা একটু কাঁদো, মায়ের জন্য কাঁদতে হয়। আমার কান্না পায়নি। কোনদিনই আমি মায়ের জন্য কাঁদিনি। মামী বলতাে খােকা আমি মরলেও কি তুই কাঁদবিনে। তখন আমি জোরে কেঁদে দিতাম। এখনও প্রয়াত মামীর কথা মনে হলে চোখে জল চলে আসে। মায়ের মৃত্যুর কিছু পরে আমার দিদাও চলে যান। এই পরিবারটিতে অনেকদিন কোন আনন্দ ছিল না।”
“তারপর মেঝমামা ছােটমামা বিয়ে করল। বাড়ীটাকে দোতালা করলো।নতুন মামীরা আসলাে বাসায়। কল্যানীদি, মাধুরীদি তারাও বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ী গেলাে। জামাই বাবুদের নিয়ে বেড়াতে আসতাে। অনেক জমজমাট হয়ে গেলাে বাসাটা। নতুন নতুন মামাতাে ভাইবােনরা আসলাে। আমি হয়ে গেলাম সবার বড়দা। জামাই বাবুদের বাড়িতে আমাকেই যেতে হত বিভিন্ন তত্ত্ব নিয়ে।”
“এখন আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তেমন আলােচনা হয়না। কিন্তু তখন মুক্তিযােদ্ধার সন্তান হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে খুব ভালাে লাগতাে। চোখের সামনে ভাসতাে। অসীম সাহসী এক যুবক রাইফেল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে শত্রুদের দিকে। আবার ভাবতাম বুলেট বিদ্ধ আমার বাবা লুটিয়ে পরছে মাটিতে, খুব কষ্ট হত তখন। আর প্রচন্ড ঘৃণা করতে থাকি পাকিস্তানি আর্মিদের। যার গুলিটা আমার বাবার বুকে লেগেছিল, তাকে যদি কখনাে পেতাম।”
“বাংলাদেশের যে কোন সাফল্যে নিজেকেই সফল মনে হয়। ভারত বাংলাদেশ খেলা হলে বিপাকে পরে যাই। আমাকে নিয়ে সবাই মজা করে তখন। স্কুল ফাইনাল পাশ করার পর থেকেই বাংলাদেশে আসতে চাই। সেই আসতে আসত আমার বয়স ঊনপঞ্চাশ হয়ে গেল!”
“আপনার পরিবারের কথা বলুন।”
“আমার স্ত্রী আর আমি একই কোম্পানিতে আছি। আমার একমাত্র সন্তান আমার মেয়ে। ওর নাম বাংলা। এবার ও’লেভেল দিবে। এখন আমরা দিল্লীতে সেটেলড। আর আমাদের দমদমের বাড়িতে এখন শুধু কল্যানীদি থাকে। বড়জামাই বাবুর মৃত্যুর পর দিদি তার ছেলে মেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে। ছুটিছাটায় সবাই ওখানেই বেড়াতে যাই। আমিও দিল্লী থেকে দমদম আসি। এবারও ওখানে একদিন থেকে তারপর বাংলাদেশে আসলাম।”
বলেই যিশু আবার মােবাইলে তােলা সেই ছবিটা দেখতে লাগলাে। এই ছবিটায় কি যেন আছে।
“শােভন, তােমার জন্যই আমার দেশে আসা হয়েছে। আমি তাে মুজিব শতবর্ষে আসতে চেয়েছিলাম। তারপর করােনায় সব বন্ধ হয়ে গেলাে। একদিন আমার মেয়ে তোমার পেজটা দেখালাে। আইডিয়াটা ভালাে লেগেছে।”
“মুক্তিযােদ্ধা এবং বিরাঙ্গনাদের উত্তরসূরী” অনেকেই কিন্তু যােগাযােগ করছে। তবে বিদেশ থেকে আপনিই প্রথম এলেন। বিশ্বের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আরও অনেকেই আসবে। তবে একটা কথা মুক্তিযােদ্ধাদের পরিবার যেভাবে আগ্রহ দেখাচ্ছে বিরাঙ্গনাদের পরিবার থেকে কেউ আসছেনা। কয়েকজন জানিয়েছে তাদের পরিবার নিয়ে কথা বলবে কিন্তু পরিচয় গােপন রাখতে হবে। আমি ঠিক করছি একশ পরিবারের ঘটনা নিয়ে একটি করে বই ছাপাবাে। এভাবে যতদিন পারি।”
একদমে কথাগুলাে বললাে শােভন।
“আশির্বাদ করি, তুমি অবশ্যই সফল হবে। আর যে কোন সহযােগীতায় আমাকে পাবে।”
“চলাে একসাথে ডিনার করি। রুমেই খাবার দিতে বলি, কেমন?”
শােভন বুঝে গেলাে কিছু একটা হয়েছে। এই দুদিন তাে বিভিন্ন রেষ্টুরেন্ট ঘুরে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সব খাবার খেলাে। আজকে তবে?
“দাদা, আরও তিনজনকে পেয়েছি যাদের কাছে পুরােনাে ছবি ডকুমেন্ট আছে, যাবেন?”
“আমি আবার আসবাে, জরুরী একটা কাজে যেতে হবে কলকাতা। জানাে, আমার নাম যিশু বলে আমি খ্রিষ্টের জীবন নিয়ে অনেক পড়াশােনা করেছি। তারপর মুহাম্মদ, বুদ্ধ, কনফুসিয়াস—–। সব বিখ্যাত মহামানবদের জীবন আমাকে খুব আকৃষ্ট করে। এটা ঠিক পুরাে পৃথিবীর দুঃখ কষ্ট সমস্যা গুলাে একই রকম। মানুষই মানুষের সবথেকে বেশী ক্ষতি করে, মানুষই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। যখন সমস্যা বেশি হয়, তখন একজন ত্রানকর্তা আসে। বাংলাদেশে যেমন শেখ মুজিব।”
“আপনার মেয়ের নাম বাংলা। তাতেই বুঝা যায় এই দেশটাকে আপনি কত সম্মান করেন।”
“ঠিক বলেছাে। আর তেমনি ঘৃণা করি পাকিস্তানিদের। একবার যদি আমার বাবার হত্যাকারীকে পেতাম। এখনাে এসব ছেলে মানুষি ভাবনা ভাবি! কোথায় যেন পড়েছি গড় হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে শহীদেরা আছে। তাই প্রথম এসে মাটিতে পা দিতেই আমার সংকোচ হচ্ছিল। দুটো দিন তােমাকে নিয়ে অনেক ঘুরলাম। আবার এসে আমার গ্রামের বাড়িতে যাবাে।”
পরদিন দমদমের বাসায় সরসরি নিজের ঘরে গিয়ে ট্রাংক থেকে পুরােনাে একটা অ্যালবাম বের করে মােবাইলের ছবির সাথে মিলিয়ে দেখছে যিশু।
“খােকা… খােকা…”, ডাকতে ডাকতে কল্যানী এসে বললাে, “তুই কখন এলি? হাত মুখ ধুলিনা, কিছু মুখে দিলিনা? কি হয়েছে খােকা তুই কাঁপছিস কেন!”
ওর হাতে সেই শেষবার পূঁজোয় গ্রামের বাড়ি সবাই গেছিল তখনকার তােলা একটা ছবি। তখন তো আর এত ছবি ছিলনা কারাে।
“দিদি মােবাইলের এই ছবিটা আমার মায়ের মতো লাগছে না?”
স্তব্ধ হয়ে দেখলাে কল্যানী।
“এই ছবি তুই কোথায় পেলি?”
“এটা আমার মা কিনা তুমি বলা?”
চিৎকার করে উঠলাে, “বলাে দিদি, এটা আমার মা ই তাে? কি হয়েছিল মায়ের? সত্যিটা বলাে।”
“লক্ষী ভাই আমার এতাে বছর আগের কথা জেনে কি হবে?”
“তুমি না বললে আমি বাসা থেকে চলে যাচ্ছি, আর কোনদিন আমার মুখ দেখবে না।”
“তােকে কোথাও যেতে হবেনা, আমি সব বলছি। কিন্তু তুই কাউকে এই কথা বলবি না। চুপ করে শুনবি।”
“আমার তখন দশ বছর। বাসার সবাই অস্থির হয়ে ছিল। হঠাৎ যুদ্ধ শুরু হওয়ায় ঠাকুরদাদের কোন খােঁজই নিতে পারছিলেন না বাবা কাকারা। যুদ্ধ শেষ হবার পর ছােট কাকা গ্রামের বাড়ি যায়। গিয়ে দেখে ঠাকুমা একা বাড়িতে। আরও তিনমাস আগেই হানাদাররা ঠাকুরদাকে মেরে ফেলে। আর পিসিকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। আহত অবস্থায় ঠাকুমাকে ফেলে রাখে। বাবার বন্ধু ফিরােজ কাকা ঠাকুমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে রাখে। যুদ্ধ শেষ হবার পর ঠাকুমা নিজের বাড়ি চলে আসে। ছােট কাকা নানা যায়গা খুঁজেও পিসিকে পায়নি। ডিসেম্বরের শেষ দিকে একদল
সেচ্ছাসেবক পিসিকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। ছােটকা তখন সবাইকে নিয়ে চলে আসে এখানে। ডাক্তার দেখে বলেছিল পিসি শকে চলে। গেছে হয়তাে তাের জন্মের পরে কথা বলবে।
কিন্তু পিসি আর কোনদিন কথা বলেনি। আর আমার বাবা লােকলজ্জার ভয়ে বাবা সবাই কে বলতাে যুদ্ধের শুরুতেই পিসির বিয়ে হয়েছিল আর মুক্তিযুদ্ধে
তার স্বামী মারা যায়। আসলে এরকম কিছুই হয়নি।”
“তাহলে আমি কে, কে আমার জন্মদাতা? যাদেরকে ঘৃণা করে এসেছি আমার গায়ে কি তাদেরই রক্ত?” হাহাকার করে উঠলাে যিশু।
“উফ্ফ! কেন আমি গেলাম বাবার খােঁজে! আমি নােংরা, অপবিত্র! মৃত্যু ছাড়া আমার আর কোন রাস্তা নেই।”
“খােকা একথা বলতে নেই। তুই আমার ভাই। বাবা সবসময় মাকে বলতাে, অলকা তােমার তাে ছেলে নেই ভগবান ওকে দান করেছে তােমায়। তুই এই পৃথিবীর একজন মানুষ। এর চেয়ে বড় পরিচয় আর কি হতে পারে?”
“আমার ভেতরটা কেমন লাগছে দিদি।” ডুকরে কেঁদে উঠলাে যিশু।”
“আমি জানি, কিন্তু তুই কাউকে বলবিনা এই কথা। তাের অন্য মামীরাও কিন্তু জানে না।”
“একজনকে বলবাে দিদি। শােভন ছেলেটাকে বলতে হবে যে আমি একজন বিরাঙ্গনার সন্তান। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।”
“আচ্ছা, তুই আয় আমি তাের খাবার রেডি করি।”
“মা— মাগাে —- ওমা!”
বলে কাঁদতে লাগলাে যিশু। এই প্রথম মায়ের জন্য ওর বুক ছিঁড়ে কান্না আসছে।
মিথিলা সাবরীন জুবলী
বাড্ডা, ঢাকা।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply