আমি শেলী, নোয়াখালী আমার জন্মস্থান হলেও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। পড়াশোনায় খুব একটা ভালো ছিলাম না, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স মাস্টার্স করেছি।
আব্বা ব্যবসায়ী ছিলেন। বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে আব্বার আতর,তসবি আর জায়নামাজের দোকান।
আমরা তিন ভাইবোন, বড় দুইভাই বেশিদূর লেখাপড়া করেননি, অল্প বয়সে আব্বার সাথে ব্যবসায় ঢুকেন।
বড় ভাইয়ের বিয়ে খুব ধুমধাম করে হয়, ভাবি ঢাকার মেয়ে, ভাইয়া নিজের পছন্দে বিয়ে করেছেন।
বিয়ের কিছুদিন পর ভাইয়া ভাবি আলাদা হয়ে যান, আব্বার সহায়তায় একই ব্যবসা শুরু করেন আলাদা দোকান নিয়ে।
সব কিছু চলছিল ছিমছাম। আমি যখন অনার্স থার্ড ইয়ারে উঠি, তখন থেকে বাসায় পাত্র দেখা শুরু হয়।
কিন্তু একমাত্র মেয়ের জন্য মনের মতো পাত্র মেলাতে মেলাতে একবছর চলে যায়। আমিও অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ক্লাস শুরু করি।
হঠাৎ সে সময় পরিবারের উপর এক দূর্যোগ নামে, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে আব্বা স্ট্রোক করেন।
বাম হাত আর বাম পা প্যারালাইজড হয়ে এক রকম বিছানায় পড়ে যান।
এরপর আব্বার ভাড়া দোকান হাত ছাড়া হওয়া, ছোট ভাইয়ার আলাদা ব্যবসা গোছানোর ঝামেলা , আর বড় ভাইয়ার উদাসীনতা সব কিছু মিলিয়ে আমার বিয়ের আলোচনা পিছিয়ে যায় তিন বছর।
সময় তো থেমে থাকে না, বয়স হচ্ছে, আমার বিয়ের ব্যবস্থা করার জন্য ভাইদের কাছে আম্মা রোজ রোজ কান্নাকাটি করেন। বড় ভাইয়া সংসারের খরচ দিত কিছু, কিন্তু আমরা থাকতাম ছোট ভাইয়ার সাথে।
ব্যবসা কিছুটা গুছিয়ে ছোট ভাইয়াও নিজের মতো বিয়ে করে নিলেন। আম্মা খুব হইচই করতে চাইলেন। বোনের বিয়ে না দিয়ে ভাইয়া নিজের সংসার গোছানোয় খুব কষ্ট পান আম্মা। কিন্তু আমি নিষেধ করি। ছোটভাইয়ার বাসায় থেকে ভাবির সাথে সম্পর্ক খারাপ করলে আমাদেরই সমস্যা হবে। আমার চাকরি নেই, আব্বা বিছানায়, এ অবস্থায় সব অন্যায় ই ন্যায়।
নিজের ওপর খুব জিদ হয়, কেন সময় থাকতে পড়ালেখা মন দিয়ে করলাম না। না বিয়ে হচ্ছে, না কোথাও চাকরি।
ঠিক এমন এক অনিশ্চিত সময়ে আমার পরিচয় হয় শামিমের সাথে, বলতে গেলে একদম হঠাৎ করে।
চাকরি না হওয়ায় হাত খরচ চালানোর জন্য আমি এজিবি কলোনিতে কয়েকটা টিউশনি করতাম।
ভালো জায়গায় পড়ালেখা না করায় ভালো টিউশনি জোগাড় হতো না, একদম ছোট বাচ্চার হাতেখড়ি দেওয়াটাই আমার কাজ, বেতনটাও কম।
টিউশনি শেষে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরি। এমনই একদিন হেঁটে বাসায় ফিরছি, হালকা বৃষ্টি পড়ছে, ছাতা নেই বলে একটু জোরেই হাঁটছিলাম, হঠাৎ পাথরে হোঁচট খেয়ে একবারে রাস্তায় পড়ি। ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের নখ উল্টে গিয়ে রক্ত ঝরছে, স্যান্ডেলটাও ছিড়ে যায়।
লজ্জা আর ব্যথায় ককিয়ে উঠি, এমন সময় হঠাৎ একটা হাত এগিয়ে আসে,
“আপু কিছু মনে না করলে ধরবো? ব্যথায় দাঁড়াতে পারছেন না।”
উপায় নেই, হাতটা ধরেই পাশের ডিসপেনসারিতে যাই, নখটা পড়ে গিয়েছে, রক্ত বন্ধ করে ব্যান্ডেজ করে দেয় ফার্মেসীর লোক, সাথে টিটেনাস ইনজেকশনও দেয়।
সব মিলিয়ে কত,খরচ আসলো জানতে চাইলে বলে, সাতশো পঞ্চাশ টাকা। আমার গায়ের লোম গুলো যেন শিরশির করে ওঠে, ব্যাগে সব মিলিয়ে পাঁচশ টাকা হবে।
যে ছেলেটা নিয়ে এসেছিল, এক ফাঁকে দোকান থেকে কখন বের হয়ে গিয়েছে টের পাইনি।
“ভাই আমার কাছে পাঁচশ হবে এখন, আপনার বিকাশ নাম্বার দেন, আমি বাকি টাকা বিকাশ করে দেব।”
অসহায় লাগলেও এখন করার কিছু নেই।
“আপা বিল যা লাগে লাগুক,সেটা ভাই দেখব কইছে।”
“আপনেরে নিয়া আসলো না, শামিম ভাই। আপনের জুতা সেলাইতে গ্যাছে।”
তখন খেয়াল হলো, ছেঁড়া জুতার পাটিটা নেই।
“ভাই ওনাকে আমি চিনি না, আমার বিল আমি দেব। আপনি পাঁচশ রাখেন, বাকিটা বিকাশ করে দেব।”
ফার্মেসীর লোকটা গড়িমসি করছে, আর আমি পালাতে পারলে বাঁচি।
একটা বাচ্চা ছেলে আমার বিল কেন দেবে।
হ্যাঁ একনজর দেখেই বুঝেছি ছেলেটার বয়স বেশি না, পঁচিশ হবে হয়তো, আমার উনত্রিশ চলছে, অবশ্যই আমার চাইতে বয়সে ছোট হবে।
এর মাঝেই ছেলেটা ফিরে আসে, পলিথিনের ভেতর সেলাই করা একপাটি স্যান্ডেল।
আমার আপত্তির মুখেও বিলটা সে নেয় না, জোর করে পাঁচশ দেই।
মিষ্টি মুখে পরিচয় দেয়
“আমি শামিম আপু, বাকি বিল নিয়ে আপনার ভাবা লাগবে না, পাঁচশই ঠিক আছে, ডিসপেনসারিটা আমাদেরই।”
সেই শুরু, রোজ দেখি শামিম ডিসপেনসারি সামনে, আমার জন্য অপেক্ষা করে। হাঁটতে হাঁটতে গল্প করি আর মনকে শাসন করি।
নিজের চাইতে চার বছরের ছোট ছেলের প্রতি কেন টান হয়, কেন কড়া গলায় দাঁড়াতে না করতে পারি না।
এককান দুইকান হয়ে কথা বাসাতেও পৌঁছে, ভাই ভাবি তো বটেই, আব্বা আম্মাও বিরোধিতা করেন।
তাদের মতে শামিম শুধু টাইম পাস করছে, বিয়ের কথা বললেই পল্টি দেবে।
শামিমের প্রতি কি এক অগাধ বিশ্বাস। আজ হাঁটতে হাঁটতে যখন শামিমের হাতের সাথে আমার আঙ্গুল গুলো টোকা খায়, নির্লজ্জের মতো প্রশ্ন করি
“শামিম, আমাকে বিয়ে করবে?”
শামিম কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকায়, তারপর স্পষ্ট করে বলে,
” না! আপনার চেহারাটা আনার মৃত বড়বোন শোভা আপুর মতো, তাই প্রতিদিন কিছুটা পথ হাঁটি আপনার সাথে, কথা বলি। আপনার মনে এসব আসবে জানলে কখনো কথা বলতাম না।”
সেই শেষ, শামিমকে আর কোনদিন দেখিনি ডিসপেনসারির সামনে। নিজের মুখটা আয়নায় নিজেরই আর দেখতে ইচ্ছে হয় না।
ভাবিরা আড়ালে মুখ টিপে হাসে।
অবশেষে আম্মার কান্নাকাটিতে ভাইদের টনক নড়ে।
তিনমাসের মাথায় আমার বিয়ে হয় আহসানের সাথে।
আমার চেয়ে নয় বছরের বড় আহসানের এটা দ্বিতীয় বিয়ে। বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে প্রথম স্ত্রী আর সন্তান দু’জনকেই হারায় আহসান।
আহসানের হাত ধরে আমি চলে আসি নোয়াখালীর এক প্রত্যন্ত ইউনিয়ন ‘ধানসিঁড়িতে’। ইতি হয় আমার শামিম অধ্যায়ের।
আহসান ব্যবসায়ী, স্টিমারঘাটে ভাতের হোটেল আছে, পড়ালেখা বেশিদূর করেননি, তবে আয় রোজগার ভালো। আমার জন্য এরচেয়ে ভালো সমন্ধ আর জোগাড় কিভাবে হবে, এই অনেক।
বাড়িতে আহসান ছাড়া আমার দুই অবিবাহিত ননদ, আর শ্বশুর শাশুড়ি থাকেন।
দেখতে দেখতে বিয়ের কয়েক মাস চলে যায়। এখন পর্যন্ত আমার ননাস জুঁই আপারর সাথে দেখা হয়নি। জুঁই আপার বিয়ে হয়েছে হাতিয়ায়, নদী না রীতিমতো সমুদ্রের কিছু অংশ পাড়ি দিয়ে হাতিয়া থেকে নেয়াখালী আসা যাওয়া করতে হয়।
তাছাড়া আমার বিয়ে হয়েছে একদম আয়োজন ছাড়া দ্বায়সারা বিয়ে, আহসানেরো দ্বিতীয় বিয়ে, তাই কোন উৎসব হয়নি আর বর্ষাকালে বিয়ে হওয়াও জুঁই আপাও আসতে পারেনি।
শুনেছি আপার স্বামী মারা গিয়েছেন বিয়ের আট বছর পর। স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র ছেলে নিয়ে আজ সাত বছর সব অত্যাচার সহ্য করে স্বামীর ভিটায় পড়ে আছেন। শ্বশুরবাড়ির পরিবেশ নাকি খুব বৈরী।
তার উপর এখন নাকি খারাপ বাতাসের আছর হয় আপার উপর। তাই হঠাৎ হঠাৎ পাগলের মতো আচরণ করেন।
আম্মা সময়ে সময়ে আপার কথা তুলে কান্নাকাটি করেন। আমি দু একদিন ডাক্তার দেখানোর কথা তুলেছি, কিন্তু তিনি খুব বিরক্ত হোন।
দিন রাত খোনারের কাছে তাবিজ পড়া, জাদু কাটানোর আয়োজন আরও কি সব হাবিজাবি করেন আপার জন্য ।
প্রচন্ড রকম কুসংস্কারচ্ছন্ন একটি পরিবার।
সবার হাতে, কোমরে তাবিজ পরা।
আমি আসতে না আসতে আমাকেও পরানো হয়েছে। বেশি বয়সের বউ, তাড়াতাড়ি যেন সন্তান হয়, সেই আশায় এই তাবিজ।
তাবিজের গুণে না, আল্লাহর ইচ্ছায় আমি এখন সন্তান সম্ভবা, তবে এখন পর্যন্ত ডাক্তার দেখানো হয়নি।
এমনি সময়ে একদিন তুমুল বৃষ্টিতে জুঁই আপার আগমন। আপার হাত পা বেধে বাড়ির উঠানে এনে ফেলেন একদল লোক। উপস্থিত লোকদের মাঝে আপার শ্বশুর আর ভাসুরো ছিলেন।
দিনদিন নাকি আপার পাগলামি বেড়ে চলেছে, যখন তখন বটি নিয়ে বের হন, রাতে দুই রকম গলায় কথা বলেন।
আপার ছেলেকে আনা হয়নি, তাদের নাতি তাদের কাছে থাকবে। শুধু আপাকে রেখে তারা চলে যাবেন। পাগল, ভুতে ধরা, আর বিধবা অপয়া ছেলের বৌকে বাড়িতে রাখার প্রশ্নই নাকি উঠে না।
” জুঁই ও জুঁই। আম্মারে কি হইছে আম্মা, আল্লাহ কি হইলো আমার মাইয়ার?”
শাশুড়ি থেকে থেকে বিলাপ করছেন, তবে কাছে যাচ্ছেন না।
আপা কাউকে চিনছে না, কেমন উদভ্রান্ত দৃষ্টি।
হাত পা এখনো বেঁধে রেখেছেন সবাই।
কাল না কি পাশের কোন গ্রামে নেবে, কোন এক কবিরাজের কাছে। আমি যতই বলি ডাক্তার দেখাতে হবে কেউ পাত্তা দেয় না। উল্টো পোয়াতি অবস্থায় আপার কাছে যেতে নিষেধ করে।
আহসান গম্ভীর হয়ে দাওয়ায় বসে আছেন, কিছুই বলেছেন না। এই কয়েকমাসে লোকটাকে পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও এতটুকু বুঝেছি তিনি খুব ভালো মনের একজন মানুষ। গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত একজন ব্যবসায়ী হয়েও আমাকে সম্মান দিয়েছেন, আজ পর্যন্ত কোনদিন জোর করেননি, স্বামিত্ব ফলাননি। প্রাকৃতিক নিয়মে আমরা কাছে এসেছি, এখন আমার গর্ভে ওনার সন্তান।
সাহস করে রাতে আহসানকে অনুরোধ করি
” আপাকে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিলে ভালো হয়, এসব কবিরাজি চিকিৎসা ভুয়া।”
আহসান সহসা কোন উত্তর দেয় না। তবে আমাকে বেশি চিন্তা না করে ঘুমাতে বলে।
সন্তান সম্ভবা হওয়ার পর থেকে আহসান আমার বেশ যত্ন করে।
সকালে সবাই রেডি হচ্ছে, ভ্যান আসলে পাশের গ্রামে রওনা দেবে। আমি একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আছি।
হঠাৎ একটা ব্যাগ নিয়ে আহসান উঠানে এসে দাঁড়ায়।
” ‘আম্মা’ ‘আব্বা’, আপা আর শেলীরে নিয়া শহরে যাবো,
শেলীর ডাক্তারি পরীক্ষা দরকার, আর আপারে একজন ভালো মানসিক ডাক্তার দেখাব।”
সবার তীব্র আপত্তির মুখে আমাদের গাড়ি রওনা দেয়। আমাকে সামনের সিটে দেয়, আপাকে শক্ত করে ধরে আহসান মাইক্রোবাসের পেছনে বসে। কিন্তু আপা আজ যেন একদম শান্ত।
আট মাস পর কোলে একফালি চাঁদ নিয়ে বাড়ির ওঠোনে বসে আছি। আপার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন আম্মা।
সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত আপা পুরোপুরি সুস্থ না হলেও, সবার যত্ন আর ভালোবাসায় আগের চেয়ে অনেকটা ভালো।
দীর্ঘদিনের একাকিত্ব, অপমান, আর অত্যাচারের ক্ষতটা একদিনে যাবে না। তবে আমাদের ভালোবাসায় আপা এখন অনেকটা ভালো আছেন, ঔষধ আর চিকিৎসা চলছে।
আহসান চেষ্টা করছে আপার ছেলে হাবিবকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে, আমি জানি আহসান পারবে।একবারও ভালোবাসি না বলা মানুষটা এখন আমার ভালোবাসার মানুষ।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply