1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:১০ পূর্বাহ্ন

# আমাদের পরিবার — কামরুন নাহার মিশু

  • আপডেট টাইম : সোমবার, ২ আগস্ট, ২০২১
  • ১৬৯ বার

আজ সকালে নাস্তা করতে বসে আমার মেয়েটা চোখের নোনাজলে বুক ভাসিয়েছে।
হৃদয় নিংড়ানো এমন শোক, এমন কান্না যে, কোনো সান্ত্বনা বানী দিয়েই সেটা কমানো যাবে না। তাই কমানোর ব্যর্থ চেষ্টা আমি করিওনি।
ছেলেটা তো নাস্তাই করেনি। দুই বালিশের ভাঁজে মুখ ডুবিয়ে কেবল নাক টেনে গেছে।
আমি চুপচাপ ওদের দেখছি। কিছুক্ষণ পর পর ওদের দাদু এসে সান্ত্বনা দেন, ওদের বড় জেঠিমা কোলে নিয়ে ছেলেকে বাহির থেকে ঘুরিয়ে আনেন।
ওদের এমন শোক, দুঃখ, কষ্ট আর কান্নার একটাই কারণ, ওদের ছোট জেঠিমা, জেঠু, ওহী ভাইয়াসহ নানু বাড়িতে বেড়াতে গেছে।
কে আমার মেয়েটাকে কদম ফুল বলে আদর করবে। কে আমার ছেলেটার সাথে বল খেলবে। কে আমার ছেলেটাকে হুন্ডায় করে সারা বাড়ি ঘুরিয়ে আনবে।
(হুমায়রার জেঠিমা ওকে কদম ফুল ডাকে, কারণ তার চুল খাড়া খাড়া কদম ফুলের মতো। ওহী ভাইয়া ওদের সাথে বল খেলে, জেঠু হুন্ডায় করে ঘুরিয়ে আনে।)
আলহামদুলিল্লাহ ঈর্ষনীয় সৌভাগ্য নিয়ে আমার বাচ্চাদের জন্ম হয়েছে।
অবিশ্বাস্য এক পারিবারিক বন্ধনের ভেতর দিয়ে ওরা বড় হচ্ছে।
আমার মেয়ে আমার চেয়ে কোনো অংশে কম ভালোবাসে না ওর জেঠিমাদের। আমার ছেলেতো চোখ বন্ধ করে বলে
” মা আমি বড় জেঠিমার কাছে থাকব। তুমি নানু বাড়িতে আপুকে নিয়ে বেড়াতে যাও।”
আমি জানি আমি মরে গেলে সে তার বড় জেঠিমার কাছে থাকতে পারবে।
আমার চেয়ে কোনো অংশে কম যত্ন বা ভালোবাসবে না বড় ভাবী ওকে। কোনো কোনো দিক দিয়ে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসবেন। আমি তো ভুল হলে বকা দেই, ভাবী বকবেনও না।
পড়াবেন, খাওয়াবেন, ওয়াশরুমে নিয়ে পরিষ্কার করিয়ে আনবেন, আবার বুকে নিয়ে ঘুমও পাড়িয়ে দেবেন।
হুমাইরা তো বলে
” মা আমি তোমার পরে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি ছোট জেঠিমাকে।”
আমি প্রায় গিয়ে দেখি ও ভাবীর গলায় ঝুলে আছে, বুকের ভেতর মুখ লুকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আমি বিরক্ত করি না, ঈর্ষাও করি না। এমন অপূর্ব দৃশ্য দেখে আমার ভালো লাগে।
হুমাইরা কোনো কিছু খেতে চেয়েছে বা পছন্দ করেছে সেটা কোনোভাবে ওর জেঠুদের কানে গেলেই হলো।
দিন শেষ ওর জেঠুরা সব এনে হাজির করবে ওর দাদুর রুমে।
একদিন হুমায়রা লিচু খেতে চেয়েছে, আম্মা সাথে সাথে ফোন করে ওর বাবাসহ সব জেঠুর কাছে খবর পাঠিয়ে দিয়েছেন।
রাতের দশটা বাজে ৬০০লিচু এনে ওর দাদুর খাটে সবাই জড়ো করেছে। একজন ২০০ আর সবাই ১০০ করে।
হুমাইরা হয়তো ১০ টা লিচু খেয়েছে। কিন্তু সব যে ওর জন্য এনেছে সেটাই বড় কথা।
এরকম শত উদাহরন আছে। শুধু হুমাইরা নয়, এবাড়ির প্রত্যেকটা বাচ্চা তার চাচা-চাচী, জেঠা-জেঠী, দাদু আর ফুফুদের কাছে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ।
এমন শুদ্ধ ভালোবাসায় কোনো লোক দেখানো মনোভাব নেই, নেই কোনো বাধ্যবাধকতা। অন্তর থেকেই সবাই সবাইকে পছন্দ করে।
আমার মেয়েকে যদি কেউ বলে
“তোমরা কয় ভাই বোন?”
সে কোনো কিছু চিন্তা না করেই বলবে
” নয় ভাই, বোন।”
সবাই অবাক হবে কী ভাবে নয় ভাই- বোন হয়!
এবার সে হেসে বলবে
” আমাদের রুমে আমরা দুইজন থাকি।”
তখন সবাই বুঝতে পারে। নয় ভাই -বোনের রহস্য।
আমার বাচ্চাদের আরবী পড়ায় ওর ওহী ভাইয়া। বাংলা পড়ায় ওর বড় জেঠিমা। রান্না করে খাওয়ায় ওর মেজ জেঠি মা।
হুমায়রার ছোট জেঠু ওকে মা ডাকে, সেজো জেঠু খালামনি।
কী মমতা,কী স্নেহ, কী ভালোবাসা সে ডাকে!
ওদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওদের পরিবার। ওদের বাবা ভদ্রলোক তো এককাঠি উপর দিয়ে যান। তিনি নিজের পরিবারকে এত পছন্দ করেন যে এই বাড়ির ছাদে উড়ে আসা কাক, ঝরে পড়া হলুদ পাতা সবই তার প্রিয়।
আপনি কৌশল করেও তাদের সম্পর্কে একটা দোষের কথা বলতে পারবেন না। তিনি চট করে মেজাজ খারাপ করে ফেলবেন।
আমি দশ বছর বিবাহিত জীবনে ও গুজুরগুজুর, ফুসুরফাসুর করিনি ভয়ে।
দেখলাম এবাড়িতে এসব এল্যাউ হবে না।
আমার মেয়েকে যদি কখনো বলি
” নুরজাহানের মা বুয়া কী বিরক্তিকর!”
সে সাথে সাথে প্রতিবাদ করবে
” কী বলো মা খালা কত কষ্ট করে আমাদের জন্য রান্না করেন!”
সে গভীর মমতায় নুরজাহানের মা বুয়ার পাশে বসবে, গল্প করবে। সে এখনো বুঝেনি এরা বাহিরের কেউ। ভাবছে খালা দাদুর মতোই বয়ষ্ক একজন মানুষ।
প্রথম প্রথম এ বাড়িতে এসে এসব হজম করতে আমার কষ্ট হয়েছে। আমি একক পরিবারে বড় হয়েছি। আমার আব্বারা তিন ভাই তিন বাড়িতে থাকেন।
আমার মা, চাচী, জেঠি একজন একজনের সাথে কথা বলেন না। তিনজন জা কখনো একই অনুষ্ঠানে একত্রিত হয়ে একসাথে বসে গল্প করেননি। অথচ আমরা এককাপ চাও সবাই একসাথে টেবিলে বসে খাই। আমার বড় জা প্রাইমারির শিক্ষক। তিনি অফিস থেকে না ফেরা পর্যন্ত মেজো জা দুপুরের খাবার খান না।
অথচ আমার বাপ, চাচা, জেঠাও কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া একটা শত্রু শত্রু মনোভাব।
আমরা কখনো ছোটবেলায় লাফিয়ে জেঠার কোলে উঠে বসিনি। বড় গলায় অধিকার নিয়ে জেঠাতো ভাই বোনকে ” ভাইয়া” বলে ডাকিনি।
আমরা বউরা এক একজন এক এক পরিবার থেকে এসেছি। এক একজনের ব্যক্তিত্ব এক এক রকম। আমার সাথে তো কারো মনের মিল হয় না।
যতই মতের অমিল হোক, একজায়গায় আমরা সবাই ঠিক। আমরা সবাই সবাইকে মূল্যায়ন করি , শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। বৃহৎ স্বার্থের জন্য আমরা ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করি।
এসব কিছুর একক কৃতিত্ব আমার শাশুড়ির। মানুষ এক বউ নিয়ে একঘরে থাকতে পারেন না। তিনি পাঁচ বউ নিয়ে একঘরে থাকেন।
অামাদের হয়তো অনেক কিছু নেই। আমাদের যা আছে তা কারো নেই। আমাদের আছে বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সুন্দর পরিবার।
May be an image of 2 people, people sitting and indoor

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..