রান্নাঘরে মসলা ব্লেন্ড করতে করতে শাশুড়ী মায়ের ডাক এলো- “নিসা, এদিকে শুনে যাও।”
আগামীকাল কুরবানির ইদ। ভীষণ ব্যস্ততা। আমি হাত ধুয়ে দৌড়ে শাশুড়ী মায়ের ঘরে গেলাম। দেখি হাতে একটা শাড়ি আর পাশে কয়েকটি শপিং ব্যাগ নিয়ে মেঝেতে বসে আছেন। আমাকে বললেন, “দেখতো মা,শাড়িটা কেমন। এটা শশির জন্য কিনেছি।”
শশি আমার একমাত্র ননদ।
আমি মুখে একটা হালকা হাসি দিয়ে মাকে বললাম, “হ্যাঁ মা খুব সুন্দর!” বলে আবার রান্নাঘরে এলাম।
বুকের ভেতর কেমন মোচর দিচ্ছে। আমার আম্মুও হয়তো আমার জন্য কিছু কিনেছে!
আমরা দুই বোন। আমাদের কোনো ভাই নেই। বড় আপুর বিয়ে হয়েছে এক বছর আগে। আপুর শশুড়বাড়ির লোকজন ভীষণ কড়া।
আমার বিয়ে হয়েছে একমাস হলো। এই প্রথম আব্বু আম্মুকে ছাড়া ইদ। আমি তবুও একা নেই, এখানে সবাই আছে। কিন্তু আব্বু-আম্মু একা একা ইদের দিন কি করবে এটা ভেবেই চোখের কোণে জল এলো।
একটু বাদেই আমার হাসবেন্ড রাসেল এলো রান্নাঘরে। কানে মোবাইলটা লাগিয়ে দিয়ে বললো- ” আব্বু-আম্মু ফোন করেছে,কথা বলো।” আব্বুর মুখে ইদ মোবারক শুনেই গলাটা ভারী হয়ে এলো। তবুও কাঁপা গলায় ইদ মোবারক বললাম। আব্বু বললেন, “ইদের দিনতো অনেক ব্যস্ত থাকবি, তাহলে পরদিন শাশুড়ীর অনুমতি নিয়ে জামাইকে সাথে নিয়ে চলে আসিস।”
তারপর আম্মুর সাথে কথা বলতেই আম্মু কেঁদে দিলো। আমি আর কথা বলতে পারলাম না।
ডাইনিং এ আমার শাশুড়ী মা বললেন, “বুঝলে বৌমা, আজকেই সব হাতের কাজ সেরে রাখো। কালকে আমাদের মাংস সকাল সকালই আসবে। ওদিকে আবার দুপুর পরই তোমার ননদ-ননদাই চলে আসবে, সময় পাবে না।”
আমি রাতের মধ্যেই মোটামুটি সব কাজ আজকেই সেরে রাখলাম। আমার উনি আবার খুব সাহায্যপরায়ন লোক। নিজের জামা কাপড় নিজেই আয়রন করে রেখেছেন,সাথে আমার কাপড় গুলোও গুছিয়ে রেখেছেন।
পরদিন সকালে শুধু লুসি-পাউরুটি, মিষ্টি খাবার গুলো করলাম। কিছু মাংস চলে এলেই ঝাল খাবার গুলো তৈরি করে ফেললাম। অবশ্য সব আমি একা করিনি, একজন সাহায্যের লোকও ছিলো। সকালে হালকা কাজের পর আমার শাশুড়ী মা তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। আমাকেও টুকটাক কাজ বুঝিয়ে দিলেন। মাত্র ক’দিন হলো এ বাড়িতে,তাই এখনো ঠিক করে আমার শাশুড়ী মাকে বুঝে উঠতে পারি নি।
চুল চিরুনি করছিলাম, হটাৎ করে আব্বু আম্মুর কথা মনে পড়ে মনটা কেমন যেন করে উঠলো। নিজেরা কিছুই তৈরি করে খাবেনা,হয়ত সবকিছু আমার আর আপুর জন্য ফ্রিজে রেখে দিবে। হাজার বললেও শুনবে না। চাইলেও কেন এক ছুট্টে তাদের কাছে যেতে পারছি না! এসব ভাবতে ভাবতে আমার ননদ-নন্দাই চলে এলো। ওদিকে আমার হাসবেন্ডও বাকী মাংস নিয়ে চলে এসেছে। আমার শাশুড়ীমা মেয়ে-জামাইকে দেখে খুশিতে আত্মহারা। আমার বাবা-মাও হয়ত এতটা খুশি হতো।
আমার ননদ-নন্দাই ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলো। আমার শাশুড়ীমা তাদের তুলে খাওয়াচ্ছিলেন। আমি বাকি কাজ শেষ করতে যাবো তখনি তিনি আমাকে ডেকে হাতে একটা শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “এটা তোমার জন্য।” আমি ব্যাগ খুলতেই দেখি আমার ননদের শাড়িটা সেখানে। অমনি বললাম, “মা এটাতো শশির শাড়ি।” তিনি তখন এক ফালি হাসি দিয়ে বললেন, “আমার আরো একটা নতুন মেয়ে এসেছে বাড়িতে, তাই দুই মেয়ের জন্য একসাথে একই শাড়ি কিনেছি।” কথাটা শুনে আমার চোখে পানি ছলছল করে উঠলো। তারপর বললেন, “আর কোনো প্রশ্ন না করে চটপট শাড়িটা পরে নাও, তারপর রাসেলকে সাথে করে আব্বু-আম্মুর কাছে যাবে। আমার ছেলেটাতো এখন তাদেরও ছেলে, ছেলের দায়িত্ব পালন করতে হবেতো।”
শুনে নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। তবু্ও বললাম, “মা, অনেক কাজ তো বাকি আছে, তুমি একা কী করে করবে?” তখনই আমার ননদ এসে বললো, “আমি আছিতো ভাবি আর কাজের লোকটাও বিকেলে চলে আসবে। সবাই মিলে করে ফেলবো,তুমি একদম চিন্তা করো না।”
আমি রেডি হয়ে ঘর থেকে বের হতেই দেখি রাসেলের হাতে দুটো ব্যাগ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ব্যাগে কি?” বললো, “আমার নতুন বাবা-মা এর জন্য উপহার।” আমি অবাক হয়ে বললাম, “এসব কখন কিনলে?” সে একটা শয়তানি মুচকি হাসি দিয়ে বললো, “তুমি এসব বুঝবে না।” বের হওয়ার সময় মা রাসেলকে বললেন, “মন দিয়ে শোন, এখন তোর দায়িত্ব শুধু একদিকে নয়, দুই দিকেই। কোনো ত্রুটি যেনো না থাকে।” আমি শুধু সবার কথা শুনে একটু পর পর অবাক হচ্ছি।
আমার বাপের বাড়ি বেশি দূরে নয়। এক ঘন্টার রাস্তা। বাড়ি গিয়ে গেট খুলতেই আম্মু আনন্দে কেঁদে ফেললো। ওদিকে আব্বু বলছে, “কিরে, ও বাড়িতে কাজ ফেলে চলে আসলি নাতো?” ওমনি রাসেল বললো, “না বাবা, আম্মু নিজে থেকে হুকুম দিয়েছে।”
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে আমার ননদ ফোন করে বললো, “ভাবি তোমাকে খুব মিস করছি।” আমি বললাম, “আব্বু আম্মুকে নিয়ে চলে আসো।”
পরদিন সকাল বেলা বড় আপু-দুলাভাই চলে এলো। তার খানিক পরেই দেখি আমার শশুড়-শাশুড়ী, ননদ-নন্দাই হাজির। আমাদের বাড়িতে চাঁদের হাট লেগে গেলো। রাতে এক ঘরে দেখি আব্বু-আম্মু তার বেয়াই-বেয়াইনদের সাথে গল্প করছে আর আমার দুই বাবা মাঝে মাঝে অট্টহাসি দিচ্ছে। দেখে আমার শান্তির আয়ু বেড়ে গেলো। এদিকে আমরা কয়েক ভাইবোন মিলে মাঝরাত পর্যন্ত আড্ডা দিলাম।
ঘুমাতে গিয়ে রাসেলকে বললাম, “জানো,আমি খুব ভাগ্যবতী।” সে মুচকি হেসে বললো, “ভাগ্যিস আমাকে বিয়ে করেছিলে।” আমি হো হো করে হেসে ফেললাম। মনে মনে দোয়া করলাম সকল পরিবার যেনো সারাজীবন এভাবেই হাসতে থাকে।
— রুবাইয়া তাসলিমা
[ এটা একটা কাল্পনিক গল্প মাত্র। যদিও আমাদের দেশে সামাজিক প্রথা অনুযায়ী মেয়ে বাপের বাড়িতে ইদ করলে মান-সম্মান থাকে না। তবুও সব ঘরে ইদ হোক পরিপূর্ণ। আত্মাকে শুদ্ধি করতে সবাই হোক একে অপরের পরিপূরক]
সবাইকে ইদ মোবারক।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply