বিবর্ণ,মলিন সুরম্য প্রাসাদসম বাড়িটির মুল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অচেনা এক তরুণী। কালের বিবর্তনে দেয়াল খসে পড়া, ঝাড় জঙ্গলে আবৃত এ বাড়ির আশেপাশে ভুত প্রেতও হেঁটে যেতে ভয় পায় ,এমন কথা এখানকার লোকের মুখে মুখে শোনা যায়।
দূর থেকে কিছু লোকজন দেখে সরে যায়। যার যার ঘরে ফিরার তাগিদে কোথায় কি হচ্ছে দেখারও যেন সময় নেই।
লাঠিতে ভর দিয়ে এক বৃদ্ধ এগিয়ে আসে, বেশ দূরত্ব রেখেই কথা বলে বৃদ্ধ–
-কে গো তুমি মা?
নীরব চাহনী মেয়েটির_ এক নজর দেখে আবার মুখ ঘুরিয়ে নির্বাক দৃষ্টিতে বাড়িটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
বৃদ্ধ আপাদমস্তক দেখে নিল একবার। শহুরে পোশাকে এই মেয়েকে আগে কখনও এই অঞ্চলে দেখা যায়নি। শহর অঞ্চল থেকে এখানে কেউ আসেও না। মেয়েটির সঙ্গে কাউকে দেখাও যাচ্ছে না কিংবা গাড়ি বা কোন বাহনও নেই। অবশ্য এখানে রাস্তাঘাটের যা অবস্থা গাড়ি ঘোড়া চলাচলের অবস্থা নেই বললেই চলে।
উত্তরের আকাশে কালো মেঘ জমে ঝড় বৃষ্টির আভাস দিচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে মেঘের গর্জন। ঝড় হবে, তুমুল ঝড়। নিহারের অন্তরের ঝড় হয়ত এর চেয়ে আরও প্রবল। আরও বেশি তোলপাড়। সে কথা অন্য কেউ না বুঝলেও নবীন বোঝে।মেরুদণ্ডহীন নবীন কেবল বুঝতেই পারে নিহারের কষ্ট ,এর বেশি কিছু করতে পারে না।
মুল রাস্তায় এসে বাস থেকে নেমে, পায়ে হেঁটে এখানে এসেছে। বৃদ্ধের কথার উত্তর না দিয়ে ভাঙ্গাচোরা মুল ফটক পেরিয়ে ভেতরে পা রাখে নিহার।
বৃদ্ধ হা হা করে ওঠে ।
–কী করেন মা ? হায় হায় ওইখানে মানুষ যায়? যাইয়েন না। একবার ঢুইকলে আর কেউ বাইর অইতে পারে না ওইখান থেইকা।
অগত্যা থামতে হল।
— আপনি?
— আমি এই গেরামে থাকি।
– বলছি কে আপনি? আপনার পরিচয়?
-আমার পরিচয় দিলে আপনি কি চিনবেন মা? তার আগে আপনার পরিচয়টা দিলে ভালা হইত।
– আশ্চর্য ! বলছি আপনি কে আগে বলুন।
– উনি এই গাঁয়ের একজন মুরুব্বি। সকলে মানে। ওই তো ক্রোশ খানেক দূরে উনার বাড়ি।
কে যেন একজন আগ বাড়িয়ে কথাটা বলল।
— বেশ। বুঝেছি আপনারা এবার যান। আমি এই বাড়িতে ঢুকব ।
-কী সর্বনাশ! এই বাড়ি খালি পইড়া আছে আইজ থেইকা হইলেও একশ বছর হইব।। এর মাঝে কোন মনুষ্য এইখানে প্রবেশ করেনাই।
— অদ্ভুত কথা বলছেন আপনারা। প্রবেশ করেনাই আজ করবে। আমি প্রবেশ করব।
ততক্ষণে তুমুল ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। এই ঝড় উপেক্ষা করেও প্রায় সাত আট জন নারী পুরুষ জড়ো হয়ে গেছে। বিস্মিত চোখে ওরা অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখছে যেন।
নিহার কারো কথায় কর্ণপাত না করে আবার পা বাড়ায়।
এবার এক নারী কণ্ঠের আর্তচিৎকারে থেমে যেতে হল।
— দাঁড়ান ! যাবেন না । ভেতরে যাবেন না।
বিস্ফারিত চোখে তাকাল নিহার। অল্প বয়সী একটা মেয়ে। তারই বয়েসী হবে হয়তো। পরনে সালওয়ার কামিজ। ওড়না দিয়ে মাথা পেচিয়ে বৃষ্টির পানিতে না ভেজার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
আশ্চর্য হয়ে ভাবছে নিহার ! নিজের ইছেয় এখানে এসেছে। এখানেও বাধা। ঘরে বাইরে চতুর্দিকে বাধা আর বাধা । এই মানুষগুলোর কি স্বার্থে ঘা দিয়েছে সে? ওরা কেন এভাবে তার কাজে বাগড়া দিতে আসছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
মেয়েটা এবার ধীর কণ্ঠে বলে–
–আপনি কে আমরা জানি না। কিন্তু আপনাকে অনুরোধ করছি, বাড়ির ভেতরে যাবেন না।
বেশ গুছানো ভাষায় কথা বলল সে।
নিহার ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে এবার– কেন বলবেন কী?
— সেকথা আপনাকে পরে বুঝিয়ে বলছি। আপনি এসেছেন , এ বাড়িতে ঢুকতেও চাইছেন, এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। ঝড় হচ্ছে , অন্ধকার হয়ে এসেছে চারিদিকে, আপনি বরং আজ আমার বাড়িতে চলুন। সেখানে বসে ধীরে সুস্থে আপনাকে সব বলব।
কোনোরকম হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে নিহার বলে —
– আমাকে আজই ফিরতে হবে। তাই জামা কাপড় পালটাবো না।আপনি আমার একটা উপকার করবেন প্লিজ?
প্রবল বেগে ঝড় শুরু হয়ে গেছে। ঝাঁঝালো কর্ণবিদারী শব্দে কোথাও বাজ পড়লো।
ঘোর অন্ধকার করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কিছুক্ষণ আগেও মনে হয়েছিল বৃষ্টি থেমে যাবে। নিহার মনে সংশয় নিয়ে রঞ্জনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়।
– নিশ্চয় করব দিদি, তবে বলছি কি শোনো, আমাদের বাড়িতে তোমার কোন কষ্ট হবে না গো।ঐ দেখ কেমন করে ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে।
মেয়েটার আন্তরিক কথাবার্তায় নিহার আর এক প্রস্থ অবাক হল।
ঝোঁকের মাথায় হঠাৎ চলে আসা যে ঠিক হয়নি তা বেশ বুঝতে পারছে।তবে শুরু যখন করেছে শেষ তো করতেই হবে। ভীষণ বাজখাই শব্দে আবার বজ্রপাত হলো। দুহাতে কান চেপে ধরে নিহার।
-এই বৃষ্টি থেমে যাবে। আমাকে আজই ফিরতে হবে। ঐ বাড়িতে কেউ কি থাকে না ? আমাকে একবার ভিতরে যেতে দিন না প্লিজ। ঝড় বৃষ্টি থেমে গেলে আমাকে একটু ভেতরে পৌছে দিলেই হবে।
– আপনি বড্ড বেশি জেদ করছেন।
নিহারের গায়ে এখনো ভেজা কাপড়। রন্জনার দাদাকে প্রথম একনজর দেখেছিল দরজার সামনে। কথাটা শুনে একরকম অপমান বোধ হতে লাগলো। মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে অনড়ভাবে।
রন্জনার দাদা এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি। এখন বললো। প্রথম পরিচয়ের পরই এমন বিরক্তি প্রকাশে বাধ্য হতে হলো।
—সেই থেকে একই কথা বলেই চলেছেন। আজই যাব। আজই যাব। আমরা গরীব হতে পারি। হতে পারে আমাদের কুঁড়েঘরে আপনার এক মুহূর্তও থাকা দায়। কিন্তু ভাই আমরাও তো মানুষ। আপনাকে এমন বিপদে ফেলতে তো পারি না।
– চুপ করতে পারলাম কই। বড় লোকেরা তোর ঐ আন্তরিকতার মূল্য বুঝবে না কখনো। তার চেয়ে দিয়ে আয় ঐ জংলা ভুতুড়ে বাড়িতে। মজাটা বুঝুক।
—এই যে মিস্টার..ঘাড় ঘুডিয়ে বলে ওঠে নিহার..
-মিস্টার রজত ! আমাকে ভুতের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই বুঝলেন !
হাহা শব্দ করে হেসে ওঠে রজত। ভুতের ভয় নেই তো কি। একটুখানি বজ্রপাতের শব্দেই ভয়ে আটখানা হা হা হা।
– হাসবেন না বলছি। তা ছাড়া বড়লোক গরীব লোক ! এসব কী বলছেন আপনি ? এখানে থাকতে আমার কষ্ট হবে তাই বা কখন বললাম।
আমার আজকের মধ্যেই ফিরতে হবে তাই তো ..
ওর কথার মাঝেই রজত বলে —কিন্তু ফেরা হবে না। ঘড়িতে কটা বাজে একবার দেখেছেন?
নিহার টেবিল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে। দ্রুত নিজের মোবাইল সেটের দিকে তাকিয়ে মিলিয়ে দেখলো সাড়ে সাতটা বেজে গেছে।
– ঝড় বৃষ্টি কখন থামবে তার ঠিক নেই। এখানে সন্ধ্যা মানেই রাত। এবার বলেন ঝড় থামার পরেও আপনার হাতে কি ঐ বাড়ির রহস্য উদঘাটন করে নিজের গন্তব্যে ফিরে যাওয়ার মত সময় থাকবে?
রজতের কথায় সম্মতি দিল নিহার।
– স্যরি,আসলে এতটা সময় কখন পার হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি।
রঞ্জনা ততক্ষণে ঝালমুড়ি আর পাকোড়া ভেজে নিয়ে এসেছে। সাথে তিন কাপ চা।
-দিদি এসো তো। এবার জমিয়ে আড্ডা হবে।
ওরা দু ভাই বোনের আন্তরিকতায় মুগ্ধ নিহারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষা নেই। কয়েক ঘন্টার পরিচয়ে এতটা আপন করে নিয়েছে নিহারকে ভাবতেই চোখে পানি এসে যাচ্ছে।
রাতের খাবারে লাল চালের ভাতের সাথে আলুর ভর্তা , ছোট মাছের ঝোল,ঘন ডাল।পরিবেশন করতে গিয়ে কত কি বলছে রন্জনা, যেন কতকালের চেনা।
– দিদি আজ কোনোরকম খাও। কাল তোমার জন্য অনেক মজার মজার রান্না করব। দাদা হাট থেকে বড় একটা মাছ এনে দেবে তো। দিদিকে মুড়োঘন্ট রেধে খাওয়াব।
– মানে? আমি কি কালও এখানে থাকব নাকি!
– ওমা তোমার ভুতুড়ে বাড়ির রহস্য সন্ধানে কদিন লাগে আগে দেখ।
রন্জনার জামা কাপড় পরে নিয়েছে নিহার। টিনের চালের ঘরে দুটো মাত্র কামড়া।
ছোট্ট উঠানঘেরা বাড়িটার চারপাশে গাছগাছালি ঢোকার পথেই খেয়াল করেছিল নিহার। যে দরজা দিয়ে ঢুকেছে তার পরেই লম্বা টানা বারান্দা। সেখানে চেয়ার টেবিল বসানো। একপাশে হ্যারিক্যেন জ্বলছে। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুতের লাইন থাকলেও বেশির ভাগ সময়েই সংযোগ থাকে না। আর ঝড় বৃষ্টি হলে তো আরও খারাপ অবস্থা।চারপাশে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা বাড়ি। মেঝেটা মাটি দিয়ে লেপটানো। কাঠের জানালাগুলো। লোহার শক্ত শিক দিয়ে গড়া। বাড়িটির অবস্থা তেমন উন্নত না হলেও নিহার অবাক হয়েছে একটা বিষয়ে। আসবাবপত্রগুলোতে একটা ঐতিহ্যের ছাপ আছে।
যে খাটে এখন নিহার আর রঞ্জনা পাশাপাশি শুয়ে আছে, সেটা সেগুন কাঠের কারুকাজ করা। মোটা গদি আর তোষকে বেশ আরামদায়ক বিছানা। এরা যেভাবে নিজেদের গরীব বলছে বা বাড়িঘরে দারিদ্রতার ছাপ রয়েছে, তাদের চালচলন, ব্যবহার্য জিনিষপত্রে তা নেই, বরং আভিজাত্যের ছাপ অনুভব করছে নিহার।
-দিদি এবার বল চৌধুরীবাড়িতে কেন এসেছ? কী কাজ তোমার ওখানে ?
এতক্ষণ বিভোরে এসব ভাবছিল নিহার। রঞ্জনার কথায় চিন্তাভঙ্গ হয়।
নিহারের ভালো লাগছে মেয়েটাকে। ধীরে ধীরে মনের গভীরের তীব্র কষ্টটা অনেকটা হালকাবোধ করছে সে।
হাসল। কতদিন,কতকাল পর হাসতে পারল নিহার, তা বলতে পারবে কেবল সময়ের দিনপঞ্জী।
-আচ্ছা রঞ্জনা, তোমরা দু ভাইবোন ছাড়া আর কেউ নেই এখানে? এই যাহ্ ! নাম ধরে বলে ফেললাম। তুমি করেও..
– এ মা! তাতো বলবেই। তুমি যে আমার দিদি গো ..
– বলছি। তার আগে তোমার কথা শুনি… এই অজ গাঁয়ে ওই পোড়োবাড়িটা দেখার জন্য ছুটে আসার রহস্যটা তো শুনি।
দুজনে দুজনের প্রশ্নের উত্তর কেন যেন এড়িয়ে চলেছে ওরা । আসলে আজকের বৃষ্টিমুখর রাতটা নিহারকে বারবার অন্যমনস্ক করছে। ভাবছে, কাল সকালে সব গুছিয়ে বলবে রঞ্জনাকে।
– রঞ্জনা, জানালাটা একটু খুলে দেবে ? বৃষ্টি দেখবো।
-বৃষ্টির জলে বিছানা ভিজিয়ে,ঠান্ডা লাগিয়ে জ্বরটর বাধিয়ে রহস্য অভিযান পিছিয়ে যাবে বলে দিলাম ..
গলা বাড়িয়ে পাশের ঘর থেকে কথাটা বলে রজত।
নিহার কপট বিরক্তি নিয়ে বলে-
– তোমার দাদা রত্নটি এখনো জেগে আছেন?
রঞ্জনা হেসে বলে— দাদা ঘুমোবে সেই শেষরাতে। সারা রাত জেগে পডাশোনা করে। আরও কত কী যে তার কাজ। বাদ দাও ওসব। তোমার কথা বল এবার।
– সত্যি করে বলতো রঞ্জনা! ঐ বাড়িতে কে বা কারা থাকে?
– সত্যি করেই বলছি দিদি , কেউ থাকে না।
-দেখ দিদি। বিজলী চমকায়। আমার ভীষণ ভালো লাগে বিজলী দেখতে। তবে ভয়ও লাগে।
নিহার জানালার বাইরে চোখ ফেলে। ক্ষণে ক্ষণে বিজলীর আলোয় অনেকদূর নজরে পড়ে। বড় বড় গাছগুলো নড়ছে। কোনো কোনোটা ভেঙ্গেও পড়েছে হয়ত। কাল যাবার আগে একবার ঘুরে দেখা যাবে গ্রামটাকে ।
রাত বাড়ছে। রঞ্জনা আর ওর দাদা আসলে কে? কী করে ? কিছুই জানে না নিহার। বেশ ক্লান্ত হয়েই মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। নিহারকে আনন্দে রাখার অভিপ্রায়েই যেন ইচ্ছে করে একটু বেশিই রাত জেগেছে আজ। কিন্তু কেন? এত অল্প সময়ে নিহারের জন্য এতটা মমতা অনুভূত কেন হল মেয়েটার অন্তরে ?
টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ। একটানা সুরের মত লাগছে শুনেতে। হৃদয়ের কোথাও কান্নার শব্দের মত বাজছে।
হঠাৎ বজ্রকন্ঠে কে যেন হুংকার দেয় —
“খবরদার! খবরদার বলছি, ওখানেই থামো। আর এক কদম এগুলে গুলি করে বুক ঝাঝড়া করে দেব“।
প্রচন্ড শব্দে আর একটা বজ্রপাত আর বিজলীর চমকে একাকার হয়ে আওয়াজটা মিলিয়ে গেল। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে চমকে জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেলে নিহার। বিজলীর আলোয় একনজরে অনেকদূর চোখে পড়ে। বাতাসের ঝাপটায় গাছগাছালির আদিগন্ত দুলুনী ছাড়া আর কিছুই নজরে এলো না।
—-
চলবে…
Leave a Reply