পাশের ফ্ল্যাটের চিৎকার-চেঁচামেচি ক্রমশ বেড়েই চলেছে। যত দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে, আচ্ছা এরা কি আমাকে শান্তিতে থাকতে দেবেনা। যখনই একটা ছবি মনোযোগ দিয়ে আঁকতে যাই, শুরু হয়ে যায় এদের চেঁচামেচি। শব্দ আমার অসহ্য লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয় পুলিশ কমপ্লেইন করি। আরে তোদের স্বামী-স্ত্রীতে যদি না বনে তাহলে আলাদা হয়ে যা না এত চিৎকার করার কি আছে। বিরক্তিকর
-আফরিন, চলো আমরা বাসাটা বদলে ফেলি
-কেন ,আবার কি হয়েছে ?অফিস থেকে ফিরে হ্যান্ড ব্যাগটা রাখতে রাখতে বলে উঠলো আফরিন।
-ওই পাশের ফ্ল্যাটের চিৎকার-চেঁচামেচি আমার আর ভালো লাগেনা
-শোনো হাসিব, দেখো তুমি সারাদিন তোমার ছবি নিয়ে ব্যস্ত থাকো, সংসারে কোনরকম কন্ট্রিবিউশন করো না। আমি নিজে একা বাজার , রান্না, ইনকাম সব করছি। তারপরেও ১/২ মাস পর পর তোমার এইসব আজেবাজে কমপ্লেইন। গত এক বছরে আমরা তিনটা বাড়ি বদল করেছি। আমার পক্ষে আর সম্ভব না , সম্ভব হতো যদি বিষয়টা লজিক্যাল হতো। শব্দ, চেঁচামেচি তোমার ভালো লাগে না ।
-তুমি লেকচার দেয়া শুরু করেছো কেন আর এত শব্দ করে জোরে কথা বলছো কেন?
– আমি জোরে কথা বলছি না কিন্তু এখন আমি বলবো, তোমার যন্ত্রণায় কাজের লোক রাখতে পারিনা। কারণটা কি ভীষণ হাস্যকর, শব্দ করে রান্নাবান্না করে ,মশলা বাটাবাটি করে, থালা বাসন ধোয়, কাপড় কাচে, তোমার ভালো লাগে না। অফিস থেকে এসে সমস্ত কাজ আমাকে করতে হয়। তোমার যন্ত্রণায় ফোন ভাইব্রেসন দিয়ে রাখতে হয়, কথা বলতে হয় অন্য রুমে গিয়ে। তুমি আসলে সিক ,তোমার ডাক্তার দেখানো দরকার।
প্রচন্ড জোরে দরজা লাগিয়ে আফরিন চলে গেলো
হাসিব ভাবতে লাগলো এত জোরে দরজা লাগানোর কি আছে ?আশ্চর্য!!
হ্যাঁ ও শব্দ পছন্দ করে না এটা সত্যি কথা কারণ ছবি আঁকার সময় সেটা মনোযোগ নষ্ট করে দেয় কিন্তু এটা ঠিক অসুস্থতার পর্যায় পরেনা যেমনটা আফরিন বলে গেলো। মেয়েরা বোধহয় ঝগড়ার সময় কোন লজিক খুঁজে পায়না। কিংবা হয়তো ওর ওপর আফরিনের প্রচন্ড রাগ কারন ও রোজগার করে না কিন্তু তার মানে এই না যে আফরিন চাকরি না করলে চলবে না, হাসিবের বাবা প্রচুর টাকা-পয়সা রেখে গেছেন তাছাড়া গ্রামে জায়গা জমিও আছে। আফরিন এমন ভাবে কথা বলে যেন সে পথের ফকির। আর মেয়েটার ভয়েস খুব কড়া, কি দেখে যে বাবা-মা পছন্দ করেছিল, শুধু সুন্দরী হলেই হয় নাকি?
বিয়ের মাস ছয়েক পরে বাবা যখন বিছানায় পড়ে গিয়েছিলেন স্ট্রোক করে, এই মেয়ে আবার যথেষ্ট যত্ন করতো। হাসিবের কাছে অবশ্য পুরোটাই ফেইক লাগতো।
বাবা স্ট্রোকের কারণে বিছানায় পড়ে দিয়েছিলেন কিন্তু তার মৃত্যু হয়েছিল বিছানা থেকে পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য। হাসিব তখন ছবি আঁকছিল পাশের রুমে। একটা কাজের মেয়ে ছিল তখন কি যেন নাম, সেই ফোন করে আফরিন কে খবর দিয়েছিল আর ও সাথে সাথে অফিস থেকে চলে আসে। একটা বৃদ্ধ মানুষ এভাবে মারা গেল পুলিশ এ নিয়ে কোন সমস্যা করলো না কিন্তু আফরিন কেন যেন সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর লাশ নেওয়ার সময় হইচই এই জিনিসটা হাসিবের কাছে ভালো লাগেনি।তার মানে এই না যে ও শব্দ পছন্দ করে না। নিজের বাবা মারা গেছে , খারাপ তো লাগবেই। কিন্তু আফরিনের মনে হলো ও বাবার লাশের সাথে যেতে চাইছে না কারণ একটাই, ওই শব্দ। হাসিব জানে না বেঁচে থাকতে বাবা ওকে কি কানপড়া দিয়ে গেছেন। বাবা বেঁচে থাকতেও তো সারাক্ষণ শব্দ করতেন, এটা চাই ,ওটা চাই, পানির গ্লাস কোথায়, বৌমাকে কেন চাকরি করতে হয়, তুই অপদার্থ, হাসিবের এসব অসহ্য লাগতো। ও একদম ছবি আঁকতে পারতো না, যাইহোক বেলা শেষে শব্দের অবসান হয়েছে। এখন শান্তি।
-খেতে এসো, খাবার তৈরি হয়েছে
-তুমি খেয়ে নাও ,খাবার ঢেকে রাখো, আমি কাজ শেষ করে এসে খাচ্ছি।
-কি এমন কাজ করো তুমি শুনি, কিছুই তো করছো না সামনে একটা খালি কাগজ নিয়ে বসে আছো
-আফরিন প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো, তুমি যাও আমি পরে খেয়ে নেব
-কেন খাবার সময় শব্দ হবে, আমি এটা ওটা টানবো, তোমার বিরক্ত লাগে তাই তো?
-তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে আফরিন , প্লিজ যাও।
-শোনো কাল থেকে আসমা আসবে কাজ করতে, দয়া করে এটা নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করবে না, কাজ করলে শব্দ হবেই।
-আবার কাজের লোক??
– আমি একা একা আর পারছিনা হাসিব, আমিও একটা মানুষ, এত পরিশ্রম আর নিতে পারছি না।
-তুমি চাকরি ছেড়ে দাও
-বসে খেলে রাজার ভান্ডারও ফুরিয়ে যায় তুমি জাননা, আর হ্যাঁ এটা সত্যি আমি তোমার সাথে ২৪ ঘণ্টা সুনসান শ্মশানের মতো অবস্থায় থাকতে পারবো না, কারন আমি সুস্থ মানুষ। সুস্থ মানুষের কথা বলার জন্য আরেকটা মানুষের প্রয়োজন হয়। বলতে বলতে আফরিন কেঁদে ফেললো।
-থামো তো এতো শব্দ করে কান্না করার কি আছে?
আফরিন আবারো সজোরে দরজাটা লাগিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল এটা কেন করে ও? অসহ্য
আফরিন জীবন থেকে চলে গেলে খুব ভালো হতো, কিন্তু সেটা সম্ভব না।
পরদিন থেকে শুরু হয়ে গেল, আসমার ধুমধাম মসলা পেষা, প্রেসার কুকারের সিটি, বাসন-কোসনের শব্দ ,নাহ আর নেওয়া যাচ্ছে না।
মেয়েটা ভয়ে কুঁকড়ে আছে, পুলিশ অফিসার ভালো করে লক্ষ্য করলেন,
-বলো তুমি কি হয়েছিলো?
-স্যার, ওই বাড়ির স্যার মনে হয় পাগল, কাজ করার সময় সামান্য শব্দ হলেই আমাকে গালমন্দ করতো। আর আজ তো ছুড়ি নিয়ে তাড়া করেছে, আমি দরজা বন্ধ করে বসেছিলাম, পরে ম্যাডাম এসে আমাকে বাঁচায়, আপনাদেরকে খবর দেয়।
-শুনেছি তুমি ওই বাড়িতে আগেও কাজ করতে?
-জ্বী স্যার, স্যারের আব্বা যেদিন মারা গেলেন তারপরে আমি ঐ কাজ ছেড়ে দেই
-কেন?
-স্যার শব্দ পছন্দ করেনা, আর উনার আব্বা সারাক্ষণ কথা বলতেন, আসলে একা একা বিছানায় শুয়ে থাকতেন তো, নড়ার শক্তি ছিলনা, যেদিন উনি বিছানা থেকে পড়ে গিয়ে মারা যান সেদিন আমি স্যারকে ওই ঘরে ঢুকতে দেখেছিলাম পরে কাপড় মেলতে ছাদে চলে গিয়েছিলাম।
-বলতে কি চাচ্ছো?
-স্যার আমার মনে হয়,জানিনা স্যার, আমি কিছু দেখি নাই আমাকে ছেড়ে দেন
-আগে কাজ ছেড়ে দিয়েছিলে এখন আসলে কেন আবার?
ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে, ম্যাডাম খুব ভালো মানুষ একা হাতে সংসার সামলাতে উনার নাকি খুব কষ্ট হচ্ছিলো। আর আমারও কাজের দরকার ছিল। গরীব মানুষ স্যার আমি, দুইটা বাচ্চা আছে।
হাসিবকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে অবশ্য মেন্টাল এসাইলামে রেখেছে। আমি আফরিন, পাগলের সাথে আর যাই হোক সংসার করা যায়না, তাছাড়াও হিমেলকে কথা দিয়েছিলাম তো, জীবনের প্রথম প্রেম। হাসিবের খানিকটা শব্দভীতি সম্পর্কে শশুর আব্বা আগেই আমাকে বলেছিলেন, আসলে আমাকে নিজের মেয়ের মতো দেখতেন কিনা। দশ হাজার টাকা ছুড়ে দিলাম আসমার দিকে, সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পেরেছে মেয়েটা পুলিশের কাছে, সাহস আছে । আগেও একবার ঠিক এরকমভাবে দিয়েছিলাম যখন আমার শশুর আব্বা মারা যান।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply