“স্যার, আমার মনে হয় না এমন কোনো মানুষ পাওয়া যাবে, যে এত টাকার লোভ সামলাতে পারবে! এই পর্যন্ত যে তিনজন আসলো সবাই তো ব্যাগটা নিয়েই পালানোর পায়তারা করছিল।”
“তুমি একটু বেশি কথা বল সাদেক। আমি আজ ভোর হবার আগপর্যন্ত দেখতে চাই।”
সাদেক আলী চুপ হয়ে গেল, এমন মহীরুহ ব্যক্তিত্বের কথায় দ্বিমত করার সাধ্য তার নেই, তা যতই খেয়ালীপনা হোক না কেন! কাঁচুমাচু মুখে কিছু তেল দিয়ে টিকে আছে এতদিন।
শহরের বড় রাস্তার পাশের একটা ঘুপচি মতো জায়গায় চাপা উত্তেজনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজন, দৃষ্টি নিবন্ধ স্ট্রিট লাইটের নীচে রাখা চামড়ার কালো রঙের ব্যাগটায়। ব্যাগের চেইনের অর্ধাংশ খোলা, একটু ভালো করে তাকালেই টাকার বান্ডিলের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। প্রায় ঢাউস সাইজের টাকা ভর্তি ব্যাগের লোভ সামলানো খুব দুঃসাধ্য ব্যাপার। এখন পর্যন্ত তিনজন সেটা দেখেছে, কেউ লোভ সামলাতে পারেনি, লোভের খেসারতও দিয়েছে ওরা। যাই হোক এখন আরেকজন আসছে এদিকে, এই লোক লোভ কে পরাস্ত করতে পারে কিনা সেটা পর্যবেক্ষণে মন দিল। ব্যাগটার কাছাকাছি এসে আগন্তুকের হাঁটার গতি শ্লথ হলো, আশেপাশে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল কেউ আছে কিনা। রাত তিনটা ছাড়িয়েছে, দু’একটা গাড়ি যাচ্ছে লম্বা বিরতিতে। আগন্তুকের চোখে-মুখে দ্বিধার ছাপ স্পষ্ট। এবার নীচু হয়ে বসল সে, চেইন পুরোটা খুলে হাতড়ে হাতড়ে দেখল। চেহারার রঙ উড়ে গেছে প্রায়। আগন্তুকের অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছে এটাতে টাকা না টুকরো করা লাশ আছে যেন!
চেইনটা লাগিয়ে নিল ভালো মতো, এরপর আশেপাশে তাকিয়ে ব্যাগটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। লুকিয়ে থাকা দু’জন চোখে চোখে কথা বলে নিল, সাদেক আলী আগন্তুকের চোখ এড়িয়ে বেরিয়ে এলো ঘুপচি থেকে, রাস্তা ধরে হেঁটে আগন্তুকের সামনে এসে দাঁড়ালো।
“এই যে ভাই, এখানে দাঁড়িয়ে কী খোঁজেন?”
প্রায় চমকে ফিরে তাকায় আগন্তুক।
“আপনি কী এখানকার লোক?”
“হ্যাঁ, কোনো সমস্যায় পড়েছেন?”
কিছুটা সন্দিগ্ধ চোখে সাদেকের দিকে তাকাল সে,
“আসলে এই ব্যাগটা কুড়িয়ে পেয়েছি, এটা নিয়ে কী করব বুঝতে পারছি না, আমি এখানকার নই আসলে।”
“কেন? কী আছে ব্যাগে?”
গলা খাদে নামিয়ে প্রায় ফিসফিসিয়ে আগন্তুক বলল,
“আপনি কতটা বিশ্বাসযোগ্য জানি না। তবুও বলছি, কাছাকাছি থানা কতদূর হবে বলুন। এটা জমা দেয়া খুব ইম্পর্ট্যান্ট।”
এবার পাশ থেকে কেউ ভরাট গলায় বলে উঠল,
“ওটা ফেরত দিতে হবে না, তোমার পুরষ্কার এটা।”
আগন্তুকের বিস্ময়টা স্পষ্ট ঠিকরে বেরোচ্ছে অবয়বে। দ্বিতীয় লোকটাও বেরিয়ে এসেছে।
“মানে? কী বলছেন এসব। দেখুন আমি কোনো ঝামেলা চাই না। এটা আপনারাই রাখুন নাহয় আমি চলে যাই।”
“তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? এটা আমরাই রেখেছিলাম, ছোট্ট একটা পরীক্ষার জন্য। আমাদের পরীক্ষায় তুমি পাশ করেছ। তাই এটা তোমার।”
দ্বিতীয় লোকটা থেমে আবারও বললেন,
“তোমার নাম কী?”
“শফিক…”
ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরে এমন একটা কর্তৃত্ব ছিল যে শফিক চাইলেও সেটাকে অবজ্ঞা করতে পারল না।
“আমি আহমেদ খালিদ। আমাদের সাথে চলো এখন, বাকিটা যেতে যেতে বলছি।”
শফিকের এবার বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে পড়ল, জনপ্রিয় লেখক আহমেদ খালিদ এত রাতে টাকার ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে খামখেয়ালি করছে এটা জেনে অভিব্যক্তি যেমন হবার কথা তেমনই হচ্ছে। খালিদ সাহেব যুবকের ভ্যাবাচেকা খাওয়া অভিব্যক্তিতে সন্তুষ্ট হলেন। অন্যের চোখে নিজের জন্য ভয় বা সমীহ দেখতে তাঁর বড় ভালো লাগে! এটুকুতেই এমন অবস্থা এরপরের কথা শুনলে এই ছেলের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তাই ভাবছেন খালিদ।
২.
পরেরদিন দুপুরের দিকে খালিদ সাহেব কেয়ারটেকার আহাদকে দিয়ে শফিককে ডাকিয়ে আনলেন।
দুপুরের এই সময়টায় অলস বসে থাকতে ভালো লাগে না। বিশাল স্টাডি রুমে বসে আছেন তিনি। টুকটাক লেখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
শফিক আসতেই টেবিলের পাশে রাখা আরেকটি চেয়ারে বসতে ইঙ্গিত করলেন। শফিকের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন খালিদ, ও যেন কোথাও কুঁকড়ে গেল ভেতরে ভেতরে। লোকটার ভেতরে আভিজাত্য ফুটে আছে প্রকটভাবে।
“রিল্যাক্স করে বসো, শফিক। তোমার ব্যাপারে কালই সব জেনে নিলাম। তার অবশ্য প্রয়োজন ছিল না। তুমি এত টাকার লোভ যেহেতু ছাড়তে পেরেছ নিশ্চয়ই সৎ ই হবে!”
শফিকের চমকে উঠাটা যেন নজরে পড়ল খালিদের।
“আমাকে এখানে রেখে দিয়েছেন কেন জানতে পারি?”
“সবই জানবে আস্তেধীরে। এই যে আমার বিশাল ধনসম্পত্তি দেখছ, এই বিশাল বাড়িটা, এমন আরও কয়েকটা বাড়ি আছে আমার। ব্যাংকে কত টাকা আছে এর হিসেব আমারও মনে নেই ঠিকঠাক। কিন্তু আমার সমস্যা কী জানো?”
মুখে কথা যোগাল না শফিকের শুধু মাথাটা দুপাশে নাড়ালো। খালিদ সাহেবের মুখে বিচিত্র হাসির রেখা,
“এত বিশাল ধনসম্পত্তি রেখে যাবার মতো উত্তরাধিকারী নেই। আমার চারপাশে যারা আছে এদেরকে আমি খুব একটা বিশ্বাস করি না। তাই আমি এসব এমন একজনকে দিয়ে যেতে চাই যে লোভের ঊর্ধ্বে। সত্যিকারের একজন গুড সোলকে এসবের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে যেতে পারলে আমার আত্মাও শান্তি পাবে।”
“এজন্যই এসব করলেন কাল?”
“হ্যাঁ, এক সপ্তাহের মধ্যে এই বাড়িটা ছাড়া আর সব তোমার নামে হয়ে যাবে।”
“আপনার…”
“আর কিছু শুনতে চাই না। যাও এখন।”
শফিক গোবেচারা মুখ করে বেরিয়ে গেল। বিচিত্র হাসিটা আরেকবার খেলে গেল লেখকের অবয়বে।সবার অলক্ষ্যে শফিকের মুখেও ফুটল বিচিত্র হাসি!
৩.
আটদিন পরের এক বিকেলে ও-ই বাড়ি থেকে অনেক দূরের একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে শফিক। এতবড় রাজত্ব ওর ভাগ্যে ছিল এটা এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। একটু খানি অভিনয়ের এতবড় পুরষ্কার! নিজের অভিনয় প্রতিভা নিয়ে অবশ্য ওর কোনো দ্বিধা নেই। এককালে থিয়েটার করত, কিন্তু ভাগ্যের ফেরে ছেড়ে দিতে হয়েছে অভিনেতা হবার স্বপ্ন। সাদেক আলী যখন এই প্রস্তাব নিয়ে ওর কাছে গেল, প্রথমেই ও না করে দিয়েছিল। এমন পাগলও হয় নাকি!
জীবনের সামনের পথটা কেমন হবে সেই ভাবনায় যখন বুঁদ হয়ে ছিল তখনই সাদেক আলীর আগমন, আহমেদ খালিদের লিগ্যাল এডভাইজার।
“কংগ্রাচুলেশনস শফিক। তোমার অভিনয় দারুণ ছিল। ওই বুড়ো লেখক ধরতেই পারেনি। এবার এটাতে সাইন করে নিজের পাওনা বুঝে নাও।”
“কী লেখা আছে এতে?”
“বুড়োর উইল অনুযায়ী সে মরার পর সব সম্পত্তি তোমার নামে হয়ে যাবে, তার সিক্সটি পার্সেন্ট তুমি আমার নামে স্ব-ইচ্ছায় লিখে দিচ্ছ। ফোরটি পার্সেন্ট তোমার! ভাবতে পারছ কী পাচ্ছ?”
“সেটা তো সে মরার পরে, তোমার দেখছি অনেক তাড়া!”
“কারণ বুড়ো আজ-কালের মধ্যে মরবে, সব সেট করা আছে।”
“সে কী! কীভাবে মরবে?”
“তোমার এতো কথার কী কাজ? নিজের কাজ কর?”
“নিজেরটাই করছি। ভেবে দেখ সাদেক ভাই। বল কিন্তু এখন আমার কোর্টে!”
বিটকেলে একটা হাসি ফুটল শফিকের অবয়বে, লোভ চকচক করছে সেখানে। সাদেক কটমট করে তাকিয়ে হার মেনে নিল, আপাতত এটাকে সহ্য করতেই হবে, সময় হলে এটাকে ছেঁটে ফেলতে হবে।
প্ল্যান শুনে ক্রুর হাসি খেলে গেল শফিকের মুখে, সাদেকের ব্যবস্থা তো ও করেছেই, যেখানে পুরোটা ও পাচ্ছে সেখানে যেচে পড়ে আরেকজনকে কেন দিতে যাবে? এই প্ল্যানে যদি বুড়োকেও সরানো যায় তবে এই বিশাল রাজত্ব এখনই হাতে আসবে। তারপর শান্তি আর শান্তি! সোমা নিশ্চয়ই এবার আর ওকে ফেরাবে না!
সাদেক তাড়া লাগায়, শফিক উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“দু-একদিন রাজত্বটা উপভোগ করি, তারপর নাহয় সাইন করি।”
শফিকের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকল সাদেক, ভুল করে ফেলেছে, মহা ভুল! শুধরানো দরকার সব হাতের বাইরে যাবার আগেই। তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে এলো, গাড়িতে উঠে বুঝতে পারল ফলো করা হচ্ছে ওকে। স্পিড বাড়িয়ে দিল, কিছুটা যাবার পর বুঝতে পারল ব্রেক কাজ করছে না, ঘামতে লাগল সহসা, নিজের ভুলের খেসারত তবে এভাবেই দিতে হলো, নিজের স্ত্রী আর প্রিয় কন্যার ছবিটা চোখে ভেসে উঠল শেষবারের মতো।
৪.
পরেরদিন ঘুম ভাঙতেই সাদেকের মৃত্যুসংবাদ পেলেন আহমেদ খালিদ।
“আহাদ, কিছু জানতে পারলে?”
“গাড়ির ব্রেক ফেইল হয়েছিল, আর পেছন থেকে যে ট্রাকটা ধাক্কা দিয়েছে সেটার ড্রাইভার ধরা পড়েছে। আমাদের টিমের কাছে শেষপর্যন্ত মুখ খুলেছে সে। শফিক করিয়েছে এটা।”
“ড্রাইভারের স্বীকারোক্তি পুলিশকে পাঠিয়ে দাও। একটা খুন আর জালিয়াতির জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি যেন হয় এটা দেখ। আরেকটা কথা, সাদেকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ পাঠিয়ে দিও।”
আহাদ সব খুব ভালোভাবেই করল, বুড়োর গুড বুকে তো ওকে থাকতেই হবে।
ব্রেক ফেইল টা যে আহাদই করিয়েছে এটা ধামাচাপা পড়ে গেছে সুন্দরভাবে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলে, সেই কাঁটা আবার উপড়ে ফেলা গেছে। উকিলটা সারাদিন জোঁকের মতো লেগে থাকত বুড়োর সাথে, তাই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল আহাদ।
নিজের হ্যান্ড রাইটিং স্কিলটা এবার কাজে লাগানোর সময় এসে গেছে। অন্যের লেখা কিংবা সিগনেচার কপি করা ওর জন্য বা হাতের খেলা, আসলেই বা হাতের।
সব শেষ করে ছাদে দাঁড়াল আহাদ, নিজের লক্ষ্য থেকে আর মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে আছে। বুক ভরে শ্বাস টেনে নিল, কিন্তু নিঃশ্বাস ফেলার সময় পেল না, আচমকা ধাক্কায় পড়ে গেল নিচে, মাথাটা বাড়ি খেল পাশের দেয়ালে, পড়ার পর সেখানে রাখা ভাঙ্গা কাঁচ গেঁথে গেল ভেতরে। ফলাফল মৃত্যু।
লেখক আহমেদ খালিদ এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, যে ধাক্কা দিয়েছে তাকে পাঠিয়ে দিলেন গা ঢাকা দিতে। ওর ব্যবস্থাও দ্রুত করতে হবে। স্বাক্ষী রাখা একেবারে পছন্দ নয় উনার।
৫.
মানুষ লোভে পড়লে ঠিক কতটা নিচে নিজেকে নামিয়ে আনতে পারে এটা দেখতে চেয়েছিলেন। ইমাজিনেশন পাওয়ার খুব ভালো তাঁর, কিন্তু সামনা-সামনি দেখে সেটা কলমে ফুটিয়ে তোলা অন্য ব্যাপার। কু-রিপুর তাড়নায় চালিত মানুষের ভেতরটা পড়তে চেয়েছিলেন সরাসরি। এরজন্যই সাজিয়েছেন গেমটা। সবাই ভেবেছে তিনি ঘুঁটি, সবাই তাঁকে খেলাচ্ছে। কিন্তু একেবারে প্রথম থেকে সব ছক কেটে সাজিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। সবাই সেই তৈরি করা ছকেই হেঁটেছে। এই যে এতো মৃত্যু এসবে আহমেদ খালিদের কিছু আসে যায় না। তাঁর ভাষায়, দুনিয়া থেকে কিছু লোভী চলে গেলে দুনিয়ার কোনো ক্ষতি হয় না বরং লাভই হয়।
সাথে নিজেরও লাভ, লেখার কিছু উপাদান পাওয়া গেল। এর আগেও মাঝে মাঝে এমন খেলা সাজিয়েছেন, বাজি ধরেছেন, বাজি জিতেছেনও প্রত্যেকবার।
নিজেই নিজেকে মনে মনে নাম দিয়েছেন, “কোল্ড ব্লাডেড সাইকোপ্যাথ’।
নিজের ওষুধ খেয়ে নিয়ে লিখতে বসে গেলেন, এত কষ্টার্জিত সম্পদ শুধু শুধু হাতছাড়া করার কোনো মানেই হয় না। যেটা কোনো একসময় অন্যের ছিল, আরেকটা খেলায় পাশার দান পাল্টে বনে গেছেন রাজা।
“কী ব্যাপার, ঘুম আসছে কেন এতো।”
বুকে ব্যথাটাও বাড়ছে ক্রমশ। হুট করে উঠে দাঁড়ালেন লেখা ছেড়ে, ওষুধের ঝুড়িটা হাতে নিলেন, কিন্তু পানি নেই। পা আর চালাতে পারলেন না, সেখানেই ঢলে পড়লেন।
নিজের বুদ্ধির প্রতি প্রবল আত্মবিশ্বাসী হয়ে গিয়ে খেয়ালই করেননি নিজের তৈরী মজবুত জালে নিজেই আটকে যেতে পারেন। আহাদ আজই তাঁর ওষুধগুলো বদলে দিয়েছিল সুনিপুণ দক্ষতায় তাঁর নজর এড়িয়ে।
পরেরদিন সংবাদপত্রের শিরোনাম হলো,
‘জনপ্রিয় থ্রিলার লেখক আহমেদ খালিদের রহস্যজনক মৃত্যু’।
(সমাপ্ত)
………….
(১২/১২/২০২০ এ আমার লেখা থ্রিলার জনরার প্রথম গল্প)
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply