একুশে ফেব্রুয়ারি ২০২১ প্রভাত ফেরির উদ্দেশ্যে নাতনি বর্ণমালার হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ৮০ বছরের থুরথুরে বৃদ্ধ জামাল হোসেন।
একহাতে শক্ত করে ধরে রাখে নাতনি বর্ণমালার হাত আর অন্য হাতে লাঠি। পরনে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি আর কাঁধ জুড়ে রয়েছে রঙহীন মলিন হওয়া একটি চাদর।
বেশ কিছুটা পথ গাড়িতে চড়ে আর বাকি পথ পায়ে হেঁটে যখন জামাল হোসেন শহীদ মিনারের সামনে এসে পৌঁছাল তখন মিনারের সামনে প্রচুর ভিড়। সবাই যেন কালো সাদায় নিজেকে সজ্জিত করেছে আর হাতে হাতে বাহারি ফুল। যতদূর চোখ যায় তা দেখে জামাল হোসেনের মনে হতে লাগল সে যেন কালো স্রোতের সাগরের সামনে দাঁড়িয়ে।
বর্ণমালা এতো ভিড় দেখে বুঝতে পারলো, তার বৃদ্ধ দাদাকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তাই সে তার দাদাকে সরিয়ে খানিকটা দূরে গিয়ে একটা গাছের ছায়ায় বসলো।
মাথার উপর সূর্যের আলো উঁকি দেওয়া শুরু করেছে। আস্তে আস্তে ভোরংর আলোর মূর্চ্ছনায় রাতের অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। প্রকৃতিতে যে অদ্ভুত এক শান্তি বিরাজমান তা বর্ণনার নয় উপলব্ধির।
বর্নমালা খেয়াল করেছে এই ফেব্রুয়ারি মাসটি এলেই তার দাদা কেমন জানি ভাবুক হয়ে উঠে। একেবারে চুপচাপ হয়ে যায়। অথচ প্রচুর কথা বলতে ভালোবাসেন দাদা। বই পড়েন, গল্প করেন, গান করেন, সারাক্ষণ কিছু না কিছু বলতে থাকেন। সবচেয়ে বেশি বলেন,
বর্ণমালা তুই কি জানিস তোর জন্য আমি কি হারিয়েছি?
এরপর আর কোন উত্তর মেলে না, কেমন উদাস হয়ে যান দাদা। কিছুক্ষণ পর বলেন এগারো বছর যখন তোমার বয়স হবে তখন বলবো, কেমন?
বর্ণমালা মাথা নেড়ে সায় দেয় ।
গত মাসে বর্ণমালার এগারো বছর বয়স হলো। আর আজ এই প্রথম দাদা তাকে নিয়ে ভাষা শহীদদের মিনারের সামনে এলো। অন্যরা দাদা একা বা বাবাকে নিয়ে আসতেন। কিন্তু আজ তাকে নিয়ে এসেছে। বর্ণমালা ভিতরে ভিতরে ভীষণ উত্তেজিত, শহীদ মিনারে সে ফুল দিবে ভেবে। ফুলের কথা মনে পড়তেই বর্ণমালা খেয়াল করে, তারা কোন ফুল নিয়ে আসেনি। তবে তারা কি দিবে মিনারের সামনে?
এমন সময় জামাল হোসেন বর্ণমালার নাম ধরে ডাকেন।
বর্ণমালা
জি দাদা ভাই
আমার একটা কাজ করে দিবে তুমি
অবশ্যই করে দিবো দাদাভাই।
জামাল হোসেন পাঞ্জাবির পকেট থেকে অনেক পুরানো আর মলিন একটা কাগজ বের করে বর্ণমালার হাতে দিয়ে বলেন,
সাবধানে খুলো, না হয় ছিঁড়ে যাবে।
বর্ণমালা সাবধানে কাগজের ভাঁজ খুলে দেখে একটা চিঠি। লেখাগুলো কেমন ঝাপসা হয়ে গেছে।
দাদাভাই এটা কার চিঠি?
তুমি কি এটা আমার জন্য পড়ে দিবে, বর্ণমালা?
বর্ণমালা বড় বড় করে পড়া শুরু করে চিঠিটা।
বেশ তাড়াহুড়ো করেই চিঠিটা লিখছি তোমার জন্য। কারন আমার হাতে সময় খুব কম। একটা খুব জরুরী কাজে বাইরে যেতে হচ্ছে। জানি না তোমার কাছে ফিরে আসতে পারবো কি না, তবে ফিরে আসতে না পারলেও তোমার জন্য আনতে যাচ্ছি বাংলা বর্ণমালা। এই বর্ণমালা দিয়ে তুমি খেলবে। তাকে যেমন ইচ্ছে তেমন সাজাবে। মনের সুখে বকবে, সুর লাগাবে, আপনজনদের ডাকবে, কথা বলবে। কি দারুণ ব্যাপার হবে তাই না?
আমি ফিরে আসি না আসি এই বর্ণমালা তোমার কাছে ঠিকই আমি পৌঁছে দিবো। তুমি এর ভীষণ রকম যত্ন করবে কেমন?
বুকে-মনে- মননে ধারন করবে। আর সেই বর্ণমালা দিয়ে নিজেকে তৈরি করবে।
আমি এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামান্য একজন কেরানি । কিন্তু আমি চাই তুমি এই বিশ্ববিদ্যালয়তে তোমার জন্য আনা বর্ণমালা নিয়ে পড়বে আর সবাইকে সঠিকভাবে তা শিখাবে।
তোমার মনে হয়তো প্রশ্ন আসতে পারে আমি কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি?
এতো কিছু তুমি এখন বুঝবে না। সবে তো এগারো বছর বয়স তোমার। শুধু জেনে রেখো, আজ একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। আজ ঐতিহাসিক কিছু ঘটতে যাচ্ছে। হাজার হাজার ছাত্র শিক্ষকের সাথে আমার মতন অনেক ছাপোষা মানুষও থাকবে সে আন্দোলনে। হয়তো আমাকে কেউ জানবে না, চিনবে না। কিন্তু বাবা তুমি তো জানবে, তোমার বাবা তোমার জন্য রাখা বর্ণমালাকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে গিয়েছিল।
ওই যে স্টাফ কোয়ার্টারের বাইরে মিছিলের শব্দ শোনা যাচ্ছে বাবা। আমার এখন যেতে হবে।
আমি হয়তো থাকবো না তোমার পাশে তোমার যত্ন নেওয়ার কিন্তু তোমার সারা জীবনের স্বাধীনভাবে কথা বলার জন্য এতটুকু ত্যাগ আমার স্বীকার করতে হবেই বাবা।
আর যদি ফিরে আসি, বাব বেটা মিলে মনের সুখে বর্ণমালাকে নিয়ে খেলবো কেমন?
মনে রেখো আমি ফিরে না আসলেও তোমার বাংলা বর্ণমালা তোমার কাছে ঠিকই ফিরে আসবে। তার যত্ন নিও।
ইতি
তোমার বাবা
মোজাম্মেল হোসেন
কেরানি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
২১/০২/১৯৫২।
চিঠি পড়া শেষ করে বর্ণমালা তার দাদার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে।
জামাল হোসেন নাতনির চোখের প্রশ্ন বুঝতে পেরে, বলতে শুরু করেন,
আমার বাবা ছিলেন আমার সবচেয়ে বড় আশ্রয়, আমার খেলার সাথী, আমার বন্ধু। সে বাবাকে হারিয়ে আমি যেন দিশেহারা হয়ে পরলাম আর আমার দুঃখিনী মা হলেন অবলম্বন হারা।
সেদিন পুলিশের গুলিতে অনেক ছাত্রও নিহত হয়েছিল। আর কিছু সাধারণ মানুষ, তাদের মধ্যে ছিলো পরিচয়হীন আমার বাবা। সামান্য একজন কেরানি সেদিন কেউই তাকে চিনতে পারেনি। পুলিশ স্টেশনের বাইরে পরে থাকা বাবার লাশ যখন উদ্ধার করি তখন দিনের আলো নিভে অন্ধকার নেমে এসেছে।
সেই অন্ধকার আমাদের জীবনে এমনভাবে এসেছিল যে, পুরা একটা বছর বুঝতে পারিনি, রুটি জোগাড় করার জন্য রাস্তায় নামবো না বাবার বলা শেষ কথা রাখার জন্য বর্ণমালা কে অর্জন করবো।
খাদ্যের অভাবের সাথে পাল্লা দিয়ে অন্য কোন অভাব পেরে উঠে না, এই কথাটা ভীষণভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম তখন।
তবে সেই দুর্দিনে মাথার উপর ছায়া হয়ে এসেছিলেন বাবার বন্ধু রমেন্দ্র কাকা।
কাকার ছোট্ট টিনের চালের ঘরের বারান্দার এক কোণে আমাদের জন্য চারকোণা একটা জায়গা আর দুবেলা আহারের ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল। আর সেসময় ততটুকুই আমাদের জন্য অনেক কিছু ছিলো।
ওই ছোট্ট একটা ঘরে হিন্দু মুসলমানের কোন ভেদাভেদ ছিলো না। একপাশে আমার মা আজানের ধ্বনি শুনে যেমন নামাজ পড়তেন ঠিক তেমনি অন্য পাশে কাকিমা সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালাতেন।
এরপর আর পিছনে ফিরে তাকায়নি, বাবার চিঠিকে বুক পকেটে রেখে বর্ণমালাকে রক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি।
নিজ কন্যার নাম রাখতে চেয়েছিলাম বর্ণমালা কিন্তু দুই পুত্রসন্তান হওয়াতে সে আশা পূরণ হয়নি কখনো। কিন্তু তোমাকে যখন তোমার বাবা আমার কোলে তুলে দিয়ে বলল, বাবা কি ডাকবে তোমার নাতনিকে।
বর্ণমালা’ আমার স্বাধীন সুন্দর পবিত্র বর্ণমালা। যাকে আমি প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসি।
বর্ণমালা এবার বুঝলে তো তোমার জন্য আমি কি হারিয়েছি?
আমি হারিয়েছি আমার বাবাকে, আমার আশ্রয়কে।
বর্ণমালা আজ থেকে আমার উপর থাকা দায়িত্বটা আমি তোমায় দিতে চাই।
মনে রেখো একদিনের জন্য এই দায়িত্ব না। এই দায়িত্ব প্রাণে মননে ব্যক্তিত্বে, চলনে বলনে কথায় ধারন করতে হবে, পালন করতে হবে।
বর্ণমালা দাদার হাতে হাত রেখে মাথা নাড়ায়।
বর্ণমালা বুঝে গেছে বাংলা ভাষার প্রতি ভাষা শহীদদের প্রতি কিভাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়। কিভাবে শ্রদ্ধা জানাতে হয়।
এই দায়িত্ব কালো পোশাকে আর ফুল দেওয়ার মধ্যে নেই এই দায়িত্ব হৃদয়ে ধারণ করতে হয়।
বৃদ্ধ জামাল হোসেন স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। আজ নতুন প্রজন্মের উপর বর্ণমালার দায়িত্ব দিয়ে সে নিশ্চিন্ত।
বৃদ্ধ জামাল হোসেন উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে হাজারো ভিড়ের মাঝে মাথা উঁচু করে রাখা শহীদ মিনার। হঠাৎ করেই ঝাপসা চোখে সে দেখতে পায়, তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
এই হাসি সে বহুদিন পর দেখতে পেল, বহুদিন পর….
এ জাতীয় আরো খবর..
অসংখ্য ধন্যবাদ