1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫২ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
# আহারে # খোরশেদ ।। সমাজে নতুন অপরাধী চক্র তৈরী হচ্ছে কিন্তু ভবিষ‍্যতে এদের রক্ষা করবে কে??।। – – – আশিক ফারুকী “অতঃপর” __ সালমা আক্তার বীরাঙ্গনা নই আমি মুক্তিযোদ্ধা – – – শাহনাজ পারভীন মিতা জলপাই রঙের স্বাধীনতা – – – আরিফুল হাসান প্লাস্টিকের উৎপাদন বন্ধ করতে হবে – উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ান হাসান – – – স্বাধীন আজম –   টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি, স্বপ্নমায়া – – – – মাহজাবীন আহমেদ বুড়ি মরে গেল – – – মোঃ আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমাম প্রযুক্তির দুনিয়ায় শিক্ষার্থীদের এখন উন্নত জীবন গড়ার দারুণ সময়:– ————–টিপু সুলতান লেখক ও সমাজ চিন্তক ডায়াবেটিস নিয়ে সচেতনতাই পারে ডায়াবেটিস রোগ নির্নয় ও রোগের চিকিৎসা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা – – – ডা: সাদিয়া আফরিন 

রঙের মানুষ, রঙিন মানুষ > লাল একটা কম্বলের গল্প – – – লুৎফর রহমান রিটন

  • আপডেট টাইম : সোমবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০২২
  • ১৬৬ বার
আমার ছেলেবেলাটা খুব শাদামাটা ছিলো। রঙিন ছিলো না। কিন্তু আমার পছন্দ ছিলো রঙ। উজ্জ্বল রঙ। আমার চারপাশ অনুজ্জ্বল, ধুসর ছিলো। চারপাশের মানুষগুলোও ছিলো কেমন রঙহীন ফ্যাকাসে। কিন্তু কল্পনায় আমি রঙিন ঝলমলে একটা জগৎ নির্মাণ করে নিয়েছিলাম। আমার স্বপ্নগুলো রঙিন ছিলো। কল্পনাগুলো রঙিন ছিলো। কিন্তু জামাগুলো রঙিন ছিলো না। খুব বেশি রঙ থাকে না মধ্যবিত্ত পরিবারে। আমি জন্মেছিলাম মধ্যবিত্ত পরিবারেই।
কল্পনায় আমি আমার নিজের জন্যে বর্ণিল একটা ভুবন নির্মাণ করে নিয়েছিলাম বলে আমার তেমন দুঃখ ছিলো না। আমার কোনো অভিযোগ ছিলো না। প্রাচুর্য ছিলো না বলে আমার কোনো বেদনাও ছিলো না। আমি বুঝে গিয়েছিলাম আমাকেই খুঁজে নিতে হবে আমার স্বপ্নের ঠিকানাটা। আমি তাই বালক বয়েসেই একা একা ভর্তি হয়েছিলাম কচি-কাঁচার মেলার ছবি আঁকার ক্লাশ শিল্পবিতানে। অনেকগুলো জলরঙের কৌটো থেকে হরিদাশ বর্মণ নামের এক শিক্ষক বড় একটা শাদা থালার চারপাশের উঁচু রেলিং টাইপের দেয়ালে বাটার নাইফের মতো একটা চামচে করে লাল, নীল, হলুদ, কালো আর শাদা কিছু জলরঙ তুলে দিয়েছিলেন আমাদের ক’জনকে। সেই রঙগুলো ছিলো দুর্দান্ত রকমের উজ্জ্বল। নিজের কল্পনার রঙিন জগতটি আমি ফুটিয়ে তুললাম কার্টিজ পেপারের খসখসে মোহনীয় শরীরের ওপর।
অতঃপর আমার কল্পনার জগতটি ইজেলে থাকা ক্লিপবোর্ডে সাঁটা কার্টিজ পেপারেই মূর্ত হতে থাকলো দিনের পর দিন। আমি পেয়ে গেলাম আমার স্বপ্নলোকের চাবি। মধ্যবিত্ত আমার জগতটি বর্ণাঢ হয়ে উঠেছিলো তখন থেকেই।
মধ্যবিত্তের ধুসর দেয়াল টপকে আমি বর্ণালি এক ঝলমলে জগতের বাসিন্দা সেই তখন থেকেই। অতঃপর ধিরে ধিরে আমার সামর্থ অনুযায়ী আমার জামাগুলোও হয়ে উঠলো রঙিন। কৈশোর পেরুনোর পর অনুজ্জ্বল রঙহীন জামা আর পরিনি আমি। আমার জামাগুলো কখনোই দামি ছিলো না। কমদামি ছিলো, কিন্তু রঙিন ছিলো। যৌবনে আমার প্রিয় পাঞ্জাবিগুলো কখনোই ম্যাড়ম্যাড়ে অনুজ্জ্বল ছিলো না। হয়তো কমদামি ছিলো, কিন্তু ঝলমলে রঙিন ছিলো। আমার শার্ট-সোয়েটার-পাঞ্জাবিগুলোর রঙ কখনো ফ্যাকাসে হয়নি।
একসময় লুঙ্গি পরতাম। আমার লুঙ্গিগুলোতেও ছিলো রঙের ছড়াছড়ি। বাটিক প্রিন্টের লুঙ্গি এবং বিছানার চাঁদর কিনেছি কলকাতা থেকে। পরবর্তীতে ঢাকার নিপূণ নামের দোকান থেকেও কিনেছি প্রচুর লুঙ্গি, বাটিক প্রিন্টের।
আমার উজ্জ্বল রঙ প্রীতির বিষয়টা অনেকেরই জানা। হাতিরপুলের ইস্টার্ণ প্লাজায় গেলে কোনো কোনো দোকানি দূর থেকে চিৎকার করে আমাকে ডেকে নিয়ে আমার হাতে তুলে দিতো গাঢ় হলুদ কিংবা গাঢ় কমলা রঙের ফুলস্লিভ শার্ট–‘এইটা স্যার আপ্নের লিগা রাইখা দিছি। আপ্নেরে মানাইবো।’
ঢাকা শহর দাবড়ে বেড়ানো আমার ‘হোন্ডা এইটি’ নামের প্রিয় বাইকটির রঙ ছিলো লাল। এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে খুব চমৎকার একটা ল্যান্ডফোন ছিলো টুকটুকে লাল রঙের। ইস্টার্ণ প্লাজা থেকে কিনেছিলাম। মেইড ইন ইটালি। ১৯৯৭ সালে প্রথমবার জাপান গিয়ে ‘টোকিও হ্যান্ডস’ নামের শপিং প্লাজা থেকে লাল বলপেন কিনেছিলাম শ খানেক। ঢাকায় ফিরে বন্ধুদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিলাম সিংহভাগ। পত্রিকায় কাজ করার সময় সঙ্গে একটা লাল বলপেন থাকতোই থাকতো। খুবই লাল একটা ঝর্ণা কলম প্রিয় একজন উপহার দিয়েছিলো। অনেক আদরে কলমটাকে এমন যত্নে রেখেছিলাম যে ওটা দিয়ে আর লেখাই হয়ে ওঠেনি। কানাডায় বেড়াতে এলে প্রকাশক বন্ধু ফরিদ আহমেদকে নিয়ে আমার লালটুকটুক স্যাভ্রোলেট কেভিয়ারে ঘুরে বেড়িয়েছি অটোয়ার নানা প্রান্তে। ফরিদ ভাই খুব বিস্মত হয়ে স্মৃতিচারণ করছিলেন–‘রিটন ভাই আপনার কি মনে আছে বহুদিন আগে আপনি একবার আমাকে বলেছিলেন গাড়ি কিনলে একটা লাল গাড়ি কিনবো। দেখেন, আপনি কিন্তু লাল গাড়িই কিনেছেন! আপনি আপনার স্বপ্নের গাড়িটাই পেয়েছেন।’
এখন, এই লেখাটা লিখছি যখন ল্যাপটপে, খেয়াল করে দেখি আমার ব্যবহৃত মাউসটাও সেই লাল রঙেরই। ওটার দিকে তাকিয়ে মনে পড়লো, ওয়ারির বাড়িতে আমার প্রথম কেনা ফ্রিজারটাও লাল ছিলো! আহারে লাল তোকে আমি কতো ভালোবাসি!
০২
কৈশোরে চমৎকার একটা বই পড়েছিলাম। বইয়ের নাম ছিলো ‘রঙ’। লেখক ধীমান দাশ গুপ্ত। দারূণ পছন্দ হয়েছিলো বইটা। ওখানেই পড়েছিলাম, একটা অধ্যায়ে, রঙের ব্যবহার নিয়ে। কথাগুলো ছিলো অনেকটা এরকম–আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা আর্টিস্ট জানে আকাশ আঁকতে নীল কতোটা হালকা হতে হয়। কতোটা শাদা মেশাতে হয় নীলের সঙ্গে। পাশ করা আর্টিস্টের আঁকা আকাশের সঙ্গে একটা শিশুর আঁকা আকাশের অনেক পার্থক্য। শিশুর আঁকা আকাশ অনেক বেশি নীল। শিশুদের আকাশ থাকে চকচকে নীল। ওরা যে আকাশটাকে কল্পনায় দেখে সেটা বাস্তবে দেখা আকাশের চাইতেও অনেক বেশি গাঢ় থাকে। ছবি আঁকতে গিয়ে রঙের ব্যবহার করতে গিয়ে শিশুরা থাকে বেপরোয়া, বেহিশেবী আর স্বাধীন। সেই স্বাধীনতা থাকে না পাশকরা আর্টিস্টের। শিখিয়ে দেয়া বুকিশ আকাশটাকেই আঁকতে হয় তাঁকে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বেড়াজালে বন্দি হয়ে পড়ে তাঁর কল্পনার স্বাধীনতা। পাশ করা আর্টিস্টের সবুজ মাঠ আর শিশুদের সবুজ মাঠের তাই দু’রকম সবুজ। শিশুদের সবুজ মাঠ আরো বেশি গাঢ়। আরো বেশি ঘন।
মানুষের রঙ প্রীতির কতো নমুনা আমাদের চারপাশে!
কতো কতো রঙিন মানুষ আমাদের চারপাশে!
একটা ঘটনার বয়ান করি। ঘটনাটা কয়েক বছর আগের। ২০১৫ সালের এক শীতের সকালের।
শিশুসাহিত্যিক ফরিদুর রেজা সাগরের পাঠকপ্রিয় চরিত্র ‘ছোটকাকু’। ছোটকাকু সিরিজেই তাঁর লেখা প্রায় তিন ডজন বই প্রকাশিত হয়েছে। চ্যানেল আইতে প্রতিবছর ছোটকাকু সিরিজ থেকে গল্প নিয়ে নাটক নির্মাণ করেন বিখ্যাত অভিনেতা আফজাল হোসেন। এই নাটকের কারণেও ছোট কাকু খুব প্রিয় একটি চরিত্র ছোটদের কাছে। ঢাকায় ‘ছোটকাকু ক্লাব’ও আছে একটা। এই ক্লাব থেকে অসহায় শিশু-কিশোরদের উপহার দেয়া হয় ছোটকাকুর লোগো মুদ্রিত ব্যাকপ্যাক, খাতা, কলমসহ আরো কিছু সামগ্রী। একটি প্রতিষ্ঠান বাজারে ছেড়েছে ছোটকাকু ক্যান্ডিও। ছোটকাকু ক্লাবের পক্ষ থেকে বিতরণ করা হয় শীতবস্ত্রও।
২০১৫ সালের শীতের এক সকালে তেমনই একটি শীতবস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম আমরা অনেকেই। দরিদ্র শিশুকিশোর এবং তাদের অভিভাবকদের হাতে শীতের কম্বল তুলে দিতে এসেছিলেন প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী, অভিনেতা আফজাল হোসেন, মন্ত্রী তারানা হালিম, শিল্পী ফাহমিদা নবী, লেখক মাহফুজুর রহমান, আনন্দআলো সম্পাদক রেজানুর রহমানসহ কয়েকজন ব্যাংকার। আর সাগর ভাই তো ছিলেনই। চ্যানেল আই ভবনের পেছনেই একটা বস্তি আছে। ওখানকার দরিদ্র শিশুরা এবং তাদের অভিভাবকরা সকাল সকাল এসে জড়ো হয়েছিলেন।
ছাতিম তলায় সামান্য কিছু আনুষ্ঠানিকতার পরে শুরু হয়েছিলো কম্বল বিতরণ। ছোটকাকু ক্লাবের একটা ব্যানারের সামনে একটা টেবিলের ওপর থরে থরে সাজানো অনেক কম্বল। দু’রঙের কম্বল ছিলো সেদিন, টকটকে লাল আর চকচকে নীল। কম্বলগুলো খুব নরম আর মোলায়েম ছিলো। বেড়ালের মতো তুলতুলে কম্বলগুলো আমরা সবাই তুলে দিচ্ছিলাম ওদের হাতে। আমাদের সহযোগিতা করছিলো চ্যানেল আইয়ের কিছু কর্মী। কোনো রকম বিশৃঙ্খলা না করে লাইন ধরে সবাইকে আসতে দেয়া হচ্ছিলো আমাদের কাছে।
আমার কাছে আসা মাঝবয়েসী একজন ভাঙাচোরা লোককে একজন সহকারী শনাক্ত করলো এইভাবে–স্যার এরে দিয়েন না। অয় তো কম্বল বেঁইচা দিবো স্যার!
সহকারী ছেলেটার কথা আমলে না নিয়ে লোকটার হাতে একটা কম্বল তুলে দিলাম আমি। তারপর ছেলেটাকে বললাম, প্রয়োজন বলেই লোকটা সকাল সকাল এসে লাইনে দাঁড়িয়েছে। এখন তার ঘরে যদি খাবার না থাকে তাহলে সে যদি এই কম্বল বিক্রি করে দিয়ে কিছু খাবার কেনে তাহলে অসুবিধে কোথায়? শীতের কষ্টের চাইতে খিদের কষ্ট বেশি।
সহকারী এইবার বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়লো–জ্বি স্যার।
কম্বল বিতরণ চলছে। অপুষ্টিতে ভোগা ছোট ছোট ছেলে আর মেয়েরা এসেছে। ওদের মা আর বাবারা এসেছে। তাদেরও শরীর জীর্ণশীর্ণ। অপুষ্টির শিকার তারাও। আমি ছিলাম একেবারে ডান দিকের শেষ মাথায়। বাঁ দিক এসে অতিথিদের হাত থেকে কম্বল নিয়ে আমাকে অতিক্রম করেই ওরা হাসি মুখে খুশি মনে ফিরে যাচ্ছে যার যার বাড়ি।
ছোট্ট একটা মেয়ের হাতে কম্বল তুলে দেবার সময় লক্ষ্য করলাম আমার বাঁদিকের একজন অতিথির হাত থেকে নীল কম্বল পেয়ে বয়স্ক একজন লোক কম্বলটা ফিরিয়ে দিয়ে লাল কম্বল চাইলো। আর তক্ষুণি ব্যস্ত একজন সহকারী ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে তাঁকে তিরস্কার করলো–আরে যান তো! লাল কম্বল চায়। যান যান।
মন খারাপ করে লোকটা নীল কম্বলটা নিয়েই চলে গেলো।
ছোট্ট মেয়েটাকে বিদায় করে দ্রুত আমি ছুট লাগালাম প্রস্থান গেইটের দিকে। নীল কম্বল নিয়ে চলে যাওয়া লোকটাকে থামালাম গেইটের কাছাকাছি গিয়ে–চাচা একটু দাঁড়ান।
লোকটা দাঁড়ালো।
আমি বললাম-আপনিই বোধ হয় একটা লাল কম্বল চেয়েছিলেন তাই না?
খোঁচা খোঁচা শাদাকালো দাঁড়ি, চাপা বসে যাওয়া বিধ্বস্ত চেহারা, ময়লা জামা পরা হাড্ডিসার শরীরের প্রবীন লোকটা খানিকটা ভীত হয়ে পড়লো আমার প্রশ্নে। খুব দ্রুত ভাবতে চেষ্টা করলো আমার প্রশ্নের উত্তরে কোনটা বলা উচিৎ, হ্যাঁ নাকি না! হ্যাঁ বললে আমি যদি কম্বলটা কেড়ে নিই!
দ্বিধাদ্বন্দে তালগোল পাকিয়ে লোকটা বললো–হ, মানি, না। আমার নীল কম্বলই চলবো।
আমি হেসে ফেললাম–না চাচা আপনার নীল কম্বলে চলবো না। আপ্নের লাগবো লাল কম্বল। আপ্নে লাল ভালোবাসেন। আসেন আপ্নে আমার লগে। শীতের রাইতে লাল কম্বল গায়ে দিয়া ঘুমাইবেন ঘুমটা আরামের হইবো।
আমার কথায় গরিব মানুষটা ছোট্ট একটা শিশুর মতো খুশি হয়ে উঠলো আর সেটা দেখে আমার চোখ সত্যি সত্যি ঝাপসা হয়ে গেলো। আহারে রঙিন মানুষ!
আমার পেছন পেছন আসতে আসতে লোকটা বললো, বাজান আপ্নেও তো লাল ভালোবাসেন!
চমকে আমি পেছন দিকে তাকালাম–জানলেন ক্যাম্নে?
হাসতে হাসতে লোকটা বললো–আপ্নে তো পইরাই আছেন লাল একটা জামা!
ভাগ্যবঞ্চিত সেই বুড়োর কথায় আমার পৃথিবীটা আরো বর্ণিল হয়ে উঠেছিলো অপরূপ সেই শীতের সকালে!
মানুষ গরিব হলেই তার পৃথিবী ধুসর হয় না।
অটোয়া ০৯ জানুয়ারি ২০১৮

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..