ট্রেন ঝিকঝিক আওয়াজ তুলে ছুটছে তুমুল বেগে। ঢাকা থেকে খুলনা। বান্ধবী মিলার বিয়ে। ওরা থাকে খুলনায়। ঢাবিতে একই ডিপার্টমেন্টের ছিলাম আমরা। মিলা হলে থাকতো। আমি মামার বাসা থেকে ক্লাসে যেতাম। বন্ধুত্ব বোনে গড়িয়েছে কীভাবে যেন। দুজনের মায়েরা সখী বনে গেছে। বাবারা হয়েছে পরম শুভাকাঙ্ক্ষী।
— কোনো উৎসবে যাচ্ছেন বুঝি?
ফার্স্টক্লাস চেয়ার কোচের মুখোমুখি সীটে বসেছি আমি। সম্মুখে বসা কালো কুচকুচে নিগ্রোদের মত তেলতেলে স্কিনের এক সুদর্শন গোছের ভদ্রলোক বসা। বয়স অনুমান করা মুশকিল। ত্রিশ হতে পারে। চল্লিশ হলেও আশ্চর্য হবো না। আবার পঁচিশ শুনলে থমকে যেতে পারি। আমি ঊনত্রিশ কিনা তাই। প্রশ্নটা তিনিই করেছেন। পাশাপাশি দুই সীট, মুখোমুখি মিলিয়ে চার। চার সীটের মাঝে টি টেবিল মত একটা থাকে হুক ঠেক দিয়ে পাতা যায় আবার ফোল্ড করেও রাখা যায়। চেয়ার কোচ কম্পার্টমেন্টে থাকে। ছোট্ট পরিবার হলে সুবিধা। স্বামী-স্ত্রী দুই বাচ্চা তেমন আর কী।
ভদ্রলোকের প্রশ্নের উত্তর দেবো কিনা ভাবতে গিয়ে এসব ভেবে নিয়েছি। কী যে অকারণ চিন্তা করি আমি।
একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে তিন মিনিট কে খায় ভাবছেন হয়ত ভদ্রলোক। হাসলেন সুন্দর করে। অস্বাভাবিক কালো বলে কী দাঁতগুলো ঝিনুকের মত ধবধবে সাদা লাগছে। দেখে মনে হয় না বাজে অভ্যাস আছে। ঐ যে স্মোক কিংবা ড্রিংক। সেসবে নজর আছে দাঁতগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে না। একদম নিট এন্ড ক্লিন ঝকঝকে দাঁত। আচ্ছা আজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমি ব্রাশ করেছিলাম তো! ভদ্রলোকের দাঁত দেখে কেমন হীনমন্যতায় পেয়ে বসলো আমাকে।
— হাতের পাতায় বোধহয় সদ্য মেহেদীর প্রলেপ মাখা। দেখে মনে হলো তাই জিজ্ঞেস করা। বিয়ে?
ধ্যাৎ! সোজা ডাবল না সিঙ্গেল জেনে নেয়ার এরচেয়ে সহজ বুদ্ধি ছেলেদের মাথায় ঢোকে না। রাগ লাগছে।
— হ্যাঁ, বিয়ে। দেখে কনে মনে হয়?
ভদ্রলোক নিভে গেলেন বুঝি আমার সাবলীল জবাব শুনে। মুখ ফিরিয়ে বাহির পানে তাকালেন।
আনমনে বললেন,
বলেই চুপ।
যেন এই কম্পার্টমেন্টে উনি ছাড়া আর কেউ নেই। একটা ধানি জমি অতিক্রম করছে আমাদের ট্রেন। আরেএএ
আমাদের ট্রেন বলছি কেন, ধ্যাৎ!! আমার সাথে কেউ নেই। আমি একা।
ডাইনিং কার থেকে ব্রেকফাস্ট দিতে এসেছে। আমি স্যান্ডউইচ আর চা নিয়েছি। ভদ্রলোক শুধু কফি নিলেন। ওনার পাশের সীটে কোনো প্যাসেঞ্জার বসেনি। আমারটাও খালি। স্যান্ডউইচে কামড় দিতে গিয়ে লজ্জা লাগছে। ইশারায় ওনাকে সাধছি উনি চিবুক নাড়িয়ে “না” বলে দিলেন। এবার নিশ্চিন্তে কামড় বসিয়েছি স্যান্ডউইচে।
ছোট্ট একটা স্টেশনে একমিনিটের জন্য ট্রেন থামলে কয়েকজন যাত্রী উঠলো। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।
বেশ মিষ্টি একটা জুটি আমার সীটের পাশে দাঁড়িয়ে উসখুস করতে করতে বসে পড়লো। বউটা আমার পাশে, বর বসলেন ভদ্রলোকের পাশে। নব বিবাহিত জুটি মনে হয়।
মেয়েটি সবুজ কাতান পরেছে। হাতে মেহেদীর টকটকে রঙ। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে কথা বলছে। দেখে মায়াই লাগছে। কিন্তু কিছু করার নেই। ঐ কালো মানিক আমার কিছু লাগে না যে এদের মিলন ঘটাতে ওনার পাশে যেয়ে বসবো।
ব্রেকফাস্ট শেষ।
হ্যাণ্ড ওয়াশ করা দরকার। উঠলাম, ওয়াশ রুমে যাবো। বেসিনে হাত ধুয়ে ফেস টাওয়ালে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসছি, সামনে পড়লেন কালো মানিক।
অস্বস্তি নিয়ে জানতে চাইলেন,
— কী নাম আপনার?
একটু রেগে গিয়েছি। অনধিকার চর্চা একদম পছন্দ না আমার। গলার স্বর একটু ঝাঁঝালো হয়ে উঠল।
— বলুন তো, এত কিছু জানতে চাইছেন কেন?
উনি সপ্রতিভ হয়ে দ্বিধাহীন উত্তর করলেন,
— কই এতকিছু! মাত্রই তিনটে।
— হ্যাঁ, কিন্তু একটা অপরিচিত মানুষের জন্য এই তিনটে প্রশ্নের উত্তর, ব্যক্তিগত অনেক কিছু ফাঁস করে দেয়।
— ইশশ কী রাগ! থাক বলতে হবে না আসুন।
— আসুন মানে!! আপনি আমার জন্য ওয়েট করছিলেন?
— হ্যাঁ। এই অপূর্ব সুন্দর মেয়েটির পিছু নিয়েছিল একজন হ্যাণ্ডসাম যুবক। দেখে ঈর্ষা হলো। তাই নিতে এলাম।
— বারে, আমার সহযাত্রীর সাথে অন্য কারো ভাব মেনে নেবো কেন?
আমি কথা হারিয়ে ফেললাম ভদ্রলোকের স্পর্ধা দেখে। একটু কী স্বস্তি লাগছে মনে! ধ্যাৎ, কেন!
উনি নির্দ্বিধায় বললেন,
— অনেকখানি…আকাশসম আশ্চর্য আরেকটু করে দিই?
— না বললে, মনে হয় না শুনবেন। দিন করে দিন। আজকে আমার আশ্চর্য হবার দিন।
উনি ভারি মিষ্টি করে ফের হাসলেন। ভাবছি, এবার খুলনায় গিয়েই ডায়াবেটিস চেক করাতে হবে আমার। কালো মানিকের মাত্রাতিরিক্ত মিষ্টি হাসি দেখতে দেখতে ডায়াবেটিকে আক্রান্ত হতে বেশি দেরি নেই। পৌঁছতে এখনো কত ঘন্টা বাকি।
— নবদম্পতিকে পাশাপাশি বসিয়ে রেখে এসেছি। পদ্ম এই মেয়েটি কী আমায়, তার পাশে বসতে দেবে?
অজ্ঞান হওয়ার দশা হলো আমার। মাথা ঘুরছে। উনি ঘাবড়ে গেলেন।
— আরে কী হলো! আপনি ঠিক আছেন? এই শুনছেন এই মেয়ে….
কিছু না বলে, শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে দুই পাশের সীট ধরে ধরে নিজের নির্দিষ্ট আসনে এসে বসেছি।
উনি এলেন না।
কম্পার্টমেন্টের শেষ মাথায় যেখানে আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেখানেই আছেন। নির্নিমেষ চোখের দৃষ্টি আমার দিকে তাক করা।
ইশারায় আমার পাশের সীট গ্রহণ করতে বললাম। উনি হ্যাঁ হু সঙ্কেত না দিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
এলেন না ঘন্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও। কিছুক্ষণ হলো সেখান থেকে চলে গেছেন। কোথায়, জানি না। খারাপ লাগছে।
অমন অভদ্রোচিত আচরণ করা ঠিক হয়নি। না করে উপায় ছিল না। আমাকে পদ্ম বলল কেন!
অনেকক্ষণ কেটে গেলে আসছে না দেখে, কিউরিসিটি চেপে বসেছে মাথায়।
ওয়াশ বেসিনের দিকে এগুচ্ছি। উনি কী আছেন ওখানেই। উঁকি দিয়ে দেখি ট্রেনের খোলা দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
খানিকটা চমকে গেলাম
ওনার সাথে একটি তরুণীকে দেখে। শাড়ী পরা বাসন্তী সাজে সেজেছে তরুণী। দেখতে শ্যামবর্ণের তবে এক কথায়
নজরকাড়া সুন্দরী। খোঁপায় কাঠগোলাপের মালা গোঁজা রূপবতী মেয়েটিকে, কালো মানিকের পাশে দারুণ মানিয়েছে। দুজনেই অনাবিল হাসি হেসে হেসে গল্পকথায় মশগুল।
আমি নীরবে
পিছু হটে নিজের সীটে এসে বসেছি। চোখ দুটো ভিজে উঠছে বুঝতে পেরে মুখে ওড়না দিয়ে ঘুমোবার ভান করছি।
ভয়ংকর খারাপ কথা। চিনি না, জানি না, কোথার কোন কয়লা সুরত লোকের জন্য আমার চোখে জল! দু’কথায় ভালো লাগা জন্মায় কীভাবে? ঘোড়ার ডিম তাও যদি ভালো কোনো আলাপ দিয়ে শুরু হত। এমনিতেই দাদীর রোগ পেয়েছি, কালো রঙ দুই চক্ষের বিষ। এক কালোর অজুহাতে কত কত ছেলেদের প্রেমপত্র ফিরিয়ে দিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। আর এই লোক যাকে দুই দন্ড ঠিক করে দেখিইনি, তার কথায় প্রভাবিত হচ্ছি। এসব কী! চেষ্টা করেও ঘুম আসি আসি করে আসছে না। আফসোস, ট্রেনে কেন আসছিলাম আমি? কোন দুঃখে!
একটু পর মুখোমুখি বসা নতুন বউটি আমায় ডাকলো। মুখের ওড়না সরিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়েছি। উনি বললেন,
— আপু, আপনাকে শ্যামল ভাই ডাকছেন।
বেশ অবাক হয়েছি। এই নামে কাউকে চিনি না। জার্নিতে আমার সাথে কেউ নেই।
— ঐ যে আপনারা মুখোমুখি বসেছিলেন তখন। কালো করে হ্যাণ্ডসাম ভাইয়াটি। উনি। আপনি চেনেন না!
— না। পরিচয় নেই। জাস্ট প্যাসেঞ্জার আমরা। আপনাদের মত।
— ওহ, আমরা ভেবেছি আপনারা হাজব্যাণ্ড ওয়াইফ। ভাইয়া খুব অমায়িক মানুষ। আমাদের দুজনকে সীট ছেড়ে দিয়ে পাশাপাশি বসালেন। এখন বুঝেছি উনি আপনার পাশে বসেননি কেন। সরি আপু।
— ইট’স ওকে। ভুল হয়ে যায়। ওনার নাম শ্যামল বুঝি!
— হ্যাঁ। এতক্ষণ ওনার সাথে গল্প করে এলাম আমরা।
— ঐ বেসিনের দিকে ট্রেনের খোলা দরজার ওখানে। আড্ডা জমে উঠেছে। আমার মাথা ব্যথা করছিল বলে, চলে এসেছি। আসার সময় ভাইয়া বললেন, আপনি ফ্রি থাকলে যেতে। বিয়ের গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে একটা দল যাচ্ছে খুলনায়। ভাইয়া সম্ভবত তাদের সাথের কেউ। আলাপে মনে হলো। আপনি যান না, জয়েন করুন। ভালো লাগবে।
— না ভালো লাগবে না। মাথাটা ধরে আছে।
— ওহ, তাই! প্যানাডল আছে। নেবেন? বেটার ফিল করবেন।
— নিয়েছি। আমার কাছে প্যারাসিটামল আছে।
— বাহ ভারি মিষ্টি নাম তো! মা শা আল্লাহ, আপনি দেখতেও নামের মতই। আমি রোকসানা। ইনি আমার হাজব্যাণ্ড সুমন। আমাদের একসপ্তাহ হলো বিয়ে হয়েছে। খুলনায় বাবার বাড়ী বেড়াতে যাচ্ছি। আপনি?
— বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে যাচ্ছি।
বিয়ের কথা বললাম না পাছে শ্যামলের সঙ্গী ভেবে বসে। এই মেয়ের বেশি ভাবার রোগ আছে মনে হয়। একটু এড়িয়ে গেলাম।
আমার অনাগ্রহ দেখে রোকসানা বরের সাথে গল্পে মশগুল হলো। কী মিথ্যুক মেয়ে। বলল মাথা ব্যথা। অথচ জমিয়ে ইটিশপিটিশ করছে বরের সাথে।
ওড়নায় মুখ ঢেকে ঘুমোবার চেষ্টা করছি। মাথাটা সত্যিই ধরেছে।
প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে খোলা মাঠে ট্রেন থামলো। আমি সীট থেকে ছিটকে পড়তে যাচ্ছিলাম। কেউ একজন দু’হাতে আগলে নিল।
মুখের ওড়না সরিয়ে ভয় পাওয়া চোখে চেয়ে দেখি, কালো মানিক ধরে আছেন।
— আপনি ঠিক আছেন? কোথাও লাগেনি তো!
আস্তে-ধীরে নিজেকে ছাড়িয়ে সরে বসলাম। সামনের সীটের জুটিদের দেখছি। ওরাও ভড়কেছে। ব্যথা পায়নি। অন্যান্য যাত্রীরা হৈচৈ চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে। সবাই দৌড়াদৌড়ি করে নেমে যাচ্ছে ট্রেন থেকে।
রোকসানাকে কোলে তুলে নিলেন সুমন। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে মেয়েটি।
ওরা ট্রেন থেকে নামতে যাচ্ছে। যাওয়ার পথে পেছন ফিরে রোকসানা আমার নাম ধরে চেঁচিয়ে ডাকলো,
— পদ্মরাগ আপু, নেমে এস তাড়াতাড়ি।
— ট্রেন এক্সিডেন্ট করেছে। তাড়াতাড়ি এস।
ওরা নেমে গেল। মোটামুটি সবাই চলে গিয়েছে। শ্যামল যায়নি।
— আপনি বসে যে? যান নেমে পড়ুন।
— আমার মুখে পদ্ম নাম শুনেই কী তখন অমন রিএক্ট করেছিলেন? ওটা কাকতালীয় ছিল। মাত্রই জানা হলো আপনি পদ্ম, পদ্মরাগ। সরি!
— কাকতালীয় বললেন। সরি কেন?
এরপর কথা খুঁজে পাইনি। কাঁচের গ্লাস খুলে বোঝার চেষ্টা করছি কতটা ক্ষতি হলো। দুটো বগি লাইনচ্যুত। মন খারাপ হয়ে গেল। না জানি কত মানুষ হতাহত হয়েছে। এ বেলায় ট্রেন ছাড়বে বলে মনে হয় না।
— না, আপনি যান। আমি এখানেই থাকি।
— রিস্ক হয়ে যাবে। কম্পার্টমেন্টে কেউ নেই।
— ট্রেন সিকিওরড ট্রান্সপোর্ট, ডোন্ট অরি। আপনি যান।
শ্যামল গেলেন না। একটু পর জানালার ফাঁক গলে বাইরের ধূ-ধূ মাঠের দিকে তাকিয়ে আচমকাই বললেন,
— পদ্ম শুনুন,
বাসন্তী শাড়ী পরা মেয়েটি আমার আপন ভাগ্নী হয়। ওরই বড় ভাইয়ের বিয়ে। কনের বাড়ী গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে যাচ্ছি আমরা।
অবাক বিস্ময়বোধ লুকোতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হলো আমার। কিছু না বলা অভদ্রতা। অস্বস্তি এক অনুভূতি লজ্জায় কুঁকড়ে দিল তবু কন্ঠে একরাশ জড়তা নিয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,
উনি মৃদু হাসল। বলল,
— আপনাকে চলে আসতে দেখে ফেলেছিলাম। ডাকিনি কারণ, আপনার জেলাসী মনোভাব ভালো লাগছিল আমার।
এইবার আমি কোথায় যাই। কোন তেপান্তরে লুকোই, মাঝি পথ দেখাও। ধরা পড়ে যাওয়া চোরের মত মুখ দেখানোর কোনো ইচ্ছে নেই। চোখ সরিয়ে বাহির পানে চেয়ে আছি। কেন জানি মনে হল, উনি আমার থেকে কিছু শোনার অপেক্ষায় আছেন। সামনের সীট শূন্য অথচ উনি আমার পাশেই বসে।
বেশ সময় নিয়ে আস্তে করে বললাম,
— জেলাস, একটি সম্পর্ক তৈরির পর আসে। আপনি বেশি ভাবছেন।
আমার বলা শেষ না হতেই
ঝট করে আমাকে নিজের দিকে ফেরালেন শ্যামল। চমকে উঠে ওনার চোখের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলাম। ভীষণ অপ্রস্তুত।
ওনার রুক্ষ হাতের করতলে
আমার গাল দুটো নিয়ে শ্যামল চুপ করে আছেন। কোনদিকে চেয়ে আছেন জানি না। এদিকে আমার নত চোখ জলে ভাসছে, কিছুটা ভয়, অস্বস্তি মিশ্রিত লজ্জায়।
আমার সত্যিই তখন অকারণ জেলাস ফিল হচ্ছিলো। এটা কী অপরিচিত কাউকে বলার মতন কথা। কীভাবে বলি? মরে গেলেও বলবো না।
বেহায়া চোখের পানি ফাঁস করে দিচ্ছে সব। ধ্যাৎ!
হাত সরিয়ে নিলেন তিনি। আঁচলে চোখ মুছে নেব, উনি বাঁধা দিলেন। বললেন,
— থাকুক।
পদ্ম গাল জলে ভেসে থাকুক। সুন্দর লাগছে!
কী করব আমি? কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলাম। হঠাতই দুই সীটের মাঝখানের দূরত্ব ঘুচিয়ে আমার খুব কাছে এসে বসলো শ্যামল। ভদ্রলোক গোছের মানুষটিকে বেপরোয়া হতে দেখে মনেমনে হাসছি। এরপরের ঘটনাগুলো অদ্ভুতরকম সুন্দর। আমাদের ট্রেন এক্সিডেন্টে পতিত, সে কথা দুজনের কারোরিই মনে রইল না।
কথায় কথায় জানা হয়ে গেল, আমার বান্ধবী মিলাই শ্যামলের ভাগ্নে বউ হতে যাচ্ছে। মোবাইলে নতুন বউয়ের ছবি দেখালে নিশ্চিত হলাম। শেষপর্যন্ত
বান্ধবীর মামাই জুটল কপালে, আর কেউ ছিল না ধরাধামে!! নিজের আবেগের লাগাম ধরে চুপচাপ শ্যামলের গল্প শুনছি। নিজেকে খোলা বইয়ের মত মেলে ধরলেন আমার সামনে।
আমার টুকু
বলার পালা যখন এল, ততক্ষণে আমাদের ট্রেন খুলনা রেলওয়ে প্লাটফর্মে। আমার নিজের কথা আর হয়নি বলা।
.
মিলার গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে শ্যামল, মামা শ্বশুর হয়ে এসেছেন ছেলেপক্ষের সাথে। মেয়েপক্ষের অনেক অবিবাহিত মেয়েরা মিস্টার ব্যাচেলর কালো মানিকে মজতে সময় নেয়নি।
এক বিয়ের বাতাসে নাকি অনেক বিয়ের লগ্ন বসে। বত্রিশ বছর বয়সী পাত্র শ্যামলের জন্য, শ্যামলের মা, বোন বেশ কয়েকজন মেয়ের মায়ের সাথে আলাপ জমিয়ে নিলেন।
শমী
নামের একুশ বছরের এক সদ্য যুবতী ললনার সাথে শ্যামলের বিয়ে পাকা হয়ে গেল মিলার বৌভাতের আগেই। পাশাপাশি দুজনকে মানিয়েছে যেমন, নামেও কী অপূর্ব মিল। শ্যামল, শমী।
খুব সতর্কতার সাথে শ্যামল নামক সাবজেক্টটা মলাট বন্দী করে দিয়েছি। প্রত্যেক মেয়ের জীবনে একটা সময় আসে, যখন রূপ গৌণ হয়ে গিয়ে বয়স সত্যিই একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়।
আমার’চে ভালো কে জানে।
নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি সবদিক থেকে, যেদিকে শ্যামলের বিচরণ। প্রতিটি মুহূর্তে শমীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির নজর উদ্বিগ্ন হয়ে ঘুরে ফিরেছে চারদিক। আমি যতবার শ্যামলের দিকে এগোবো ভেবেছি, ততবার শমীকে পেয়েছি ওর পাশে। পাত্রপাত্রীর মায়েরা ইচ্ছে করেই দুজনকে কাছাকাছি রেখেছে পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে। শমী পরবর্তী প্রতিটি অনুষ্ঠানে শাড়ী, গয়নায় কনের মত করে সেজেছিল। শ্যামল যদিও বরের মত সাজেনি। হলুদের অনুষ্ঠানে সাদা ধুপিয়ান সিল্কের পাঞ্জাবী পরেছিল শ্যামল। বাকি সবগুলোতে ফেডেড জিন্স, ক্যাজুয়াল টি-শার্ট, কখনো সেমি ক্যাজুয়াল আউটফিটে দেখেছি তাকে। বত্রিশ বছর বয়সী একজন পুরোদস্তুর সুপুরুষকে লাগছিল তারুণ্যে উদ্দীপনায় টগবগে চব্বিশ, পঁচিশের যুবক। অন্যদিকে, অনিন্দ্য সুন্দরী একুশ বছরের শমী যেন ষোড়শী বধূ।
এসব দেখে বেশ ভালোই হীনমন্যতায় আক্রান্ত হচ্ছি। শ্যামলকে অজস্র বার দেখতে পেলেও শ্যামল আমাকে হলুদের অনুষ্ঠানের পর একবারও দেখতে পায়নি। এ আড়াল ইচ্ছাকৃত অকারণ অভিমানে।
টানা পাঁচ দিনের বিয়ের উৎসব শেষে আমি ফিরেছি আমার ঘরে। মামার বাসায় থাকি। বাবা মা গ্রামে থাকেন। আমার বয়স হয়ে যাচ্ছিলো। এম এ পাশ মেয়ের পাত্র পাওয়া গ্রামে চাট্টিখানি ব্যাপার না। জবটবের ব্যস্ততা নিয়ে সময় গড়িয়ে কখন জানি বয়স ঊনত্রিশে পা দিয়েছি। ছোট ভাইয়ের বিয়ে। ওর বয়স ছাব্বিশ।
বড় বোনের বিয়ে হয়নি অপবাদে আজেবাজে কথা শুনতে হয়েছে ছোট ভাই বিপ্লবকে। বিয়ে ভাঙা ভাঙা একটা বাজে পরিস্থিতি ঠেকাতে ঢাকায় মামার বাড়ী চলে এসেছি। এখানেই একেবারে থেকে যাবো ভাবছি। যদিও শহর আমাকে টানে না। পড়াশোনার জন্য দীর্ঘ একটা সময় মামার বাসায় থাকতে হয়েছে।
মা, বাবাকে কন্যা দায়গ্রস্ত দেখতে আর ভাল লাগছে না। মামী স্নেহ করেন খুব। মামাতো ভাইবোন সবাই বিয়ে করে আলাদা থাকেন। মামা মামীর একক সংসারে আমি যেন আশির্বাদ স্বরূপ হলাম ওনাদের মাঝে।
বুকের ভেতর কালো মানিক নামক এক চাপা কষ্ট নিয়ে দিনগুলো আমার কেটে যাচ্ছে হেসে খেলে।
মিলার বিয়ের প্রায় পাঁচমাস পর, হঠাত একদিন না বলেই মিলা আমার মামার বাসায় এল আমার বিয়ের পয়গাম নিয়ে। আমি আগ্রহ দেখাইনি।
ছেলের বায়োডাটা আর মিলার মুখে ছেলের গুণগান শুনে পাত্রকে মামা মামীর পছন্দ হলো খুব।
গ্রাম থেকে মা, বাবা আর সঙ্গে নতুন বউ নিয়ে বিপ্লব এসেছে আমাকে বিয়েতে রাজি করাতে। ভেতরটা আমার পুড়ে ছাই। বিয়ে করবই না জেদ ধরেছি। এতে করে দুই বান্ধবীর মাঝে দারুণ ঝগড়া হল৷ মিলার সাথে বন্ধুত্ব ব্রেকআপ হয় হয় অবস্থা। আমার সঙ্গে না পেরে আমার মায়ের আঁচল ধরল মিলা।
শেষমেশ মায়ের চোখের পানি আমায় “কবুল” বলিয়েই ছাড়লো।
এমুহূর্তে নিজের বাসর ঘরের ফুলশোভিত আসনে সম্পূর্ণ অদেখা, অচেনা, অপরিচিত বরের অপেক্ষায় বসে বসে ঝিমুচ্ছি।
রাত তখন দেড়টা।
মিলা এল ওর বর নিয়ে হৈ হৈ রৈ রৈ করে।
আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে মিলাদের সাথে রুমে ঢুকলো ট্রেনে দেখা শ্যামলের সেই ভাগ্নী। সঙ্গে স্বয়ং শ্যামল।
সে শেরওয়ানী পরিহিত। মাথায় আফগানী পাগড়ী।
বরের সাজে শ্যামল এসেছিল আমার বিয়েতে?
কখন?
আশ্চর্য, একবারও চোখে পড়ল না! আর এই লোক এমন বর সেজে আছে কেন? একেবারে নওশা লুক। এতদিনে তো ওর শমীর সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা। নিশ্চয়ই শমীও এসেছে বউ সেজে। কথাটা স্মরণ হতেই
মনটা ভেঙে চুরচুর হয়ে গেল। আমার বিয়ের বাসরে আপনাদের আসার কী খুব দরকার ছিল শ্যামল? কেন এলেন? সবকিছু শেষ করে দিলেন, এখন কীভাবে কাটবে এ রাত, বলুন? আপনি কখনো জানবেন না আপনার উপস্থিতিতে কেমন করে ফুরিয়ে গেছি আমি।
মাথার ঘোমটা আরেকটু টেনে লম্বা করে দিলাম, আমি চাই না শ্যামল আমার নীরব, নিভৃত অশ্রু দেখুক।
কান্নারত আমাকে একপ্রকার ভড়কে দিয়ে মিলা একটানে ঘোমটা সরিয়েই আমার গালে আদুরে কামড় বসিয়ে দিল। তা দেখে শ্যামল সশব্দে হায় হায় করে উঠলে আমি স্তব্ধ। মিলা এসবে পাত্তাই দিল না।
সে চেঁচিয়ে বলল,
— জীবনেও তোকে মামী ডাকতে পারবো না জানবাচ্চু, তুই আমার পদ্মরাগ হয়েই থাকবি। শ্যামল মামা সরি, আমার বান্ধবীটা আমারই থাকুক।
— থাকুক, থাকুক। তোমার জন্যই তো পদ্মকে পেয়েছি। নইলে এ মেয়ে যে কোথায় ঘাপটি মেরে ছিল কে জানে।
ওদের আলাপ শুনে আমার হৃদয় মণিকোঠায় লক্ষ তারার ফুল বৃষ্টি হয়ে ঝরছে। ঘোমটার আড়ালে নিঃশব্দে কাঁদছি।
সবাই মিলে কতক্ষণ খুনসুটি করে ওরা শ্যামলকে রুমে রেখে বেরিয়ে গেল। ডোর লক করে শ্যামল আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। কিছু হয়তো বলবে।
আমার একটুও তর সইলো না।
শ্যামলের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্রোতস্বিনী নদীর মত কান্নায় ভেঙে পড়েছি। মাথা থেকে ঘোমটা ফেলে দিয়ে শ্যামল আদরে আদরে আমার অশ্রু শুষে নিতে লাগল।
আদুরে গলায় বলল,
— অভিমানী হিংসুটে পদ্ম আমার। এমন করে কেউ লুকোয়? কত্ত খুঁজেছি জানো। পাগল করে ছেড়েছো বোকা মেয়ে। সুদে-আসলে সব ফিরিয়ে দাও। এখুনি দাও।
শ্যামল ওর পদ্মবধূর গ্রীবায় চুমু খেতে খেতে আবেশে জড়ানো মধুর কন্ঠে সুধায়,
— কেন দেবে না, কী করেছি আমি? দাও।
— শমীকে পাশে নিয়ে ঘুরছিলেন। ওকে বিয়ে করলেন না কেন? কত্ত সুন্দর শমী। বয়স কম।
— কে শমী?
কাউকে পাশে নিয়ে ঘুরিনি। ওয়েট, এতকিছু দেখেছ, আমার চোখ দুটো যে অধীর হয়ে কাউকে খুঁজছিল তা দেখনি? মারব ভীষণ বুঝচ্ছ। কেন পালালে পদ্ম!
তুমি আমার চোখেমুখে, হৃদয় জুড়ে পদ্মরাগ মেখে দিয়েছিলে ট্রেনের ঐ কামরাতেই। শমী টমি দেখার সময় কই বল তো? দাও এবার সব সুদ সমেত ফেরত দাও।
— না, আমি কিচ্ছু করিনি। সব তোমার দোষ। তুমি দেবে। তুমি দাও।
— শুধুই কী দেবো? নেবে না? পদ্মরাগ নেবে আমায়?
এইটুকুতেই আমি শেষ। কী বলব এখন ইশশ!আঙুলের ডগায় চিবুক তুলে
শ্যামল আমায় বাধ্য করে, চোখে চোখ রাখতে। কালো মানিকের
হাস্যোজ্জ্বল শুভ্র দাঁতে আমার কপাল ছুঁয়ে আঁকি, মনে স্বপ্ন ছিল যত। বিড়বিড় করে আবৃত্তি করি,
তুমি আমার কালো মানিক
হীরক হয়ে জ্বলো
তুমি প্রথম শ্রাবণ
পদ্ম বুকে
বৃষ্টি হয়ে ঝরো
খেয়া পাড়ের
নৌকোয় কাটে
তোমার অপেক্ষায়
বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা
তুমি দেবে আমায়
তোমাকে?
তুমি হাসলে
জ্যোৎস্না বারি হয়ে নামে
শরীরের কলকব্জায়।
কণ্ঠায় সোনার মণিহার
তোমার স্পর্শে এসে গলে
ভীষণ লজ্জায়।
তুমি আমার কালো মানিক
হীরক হয়ে জ্বলো
কী নেবো বলো?
একটু আগে কাগজের ফুল ছিলাম। গন্ধহীন।
তুমি তাকে গোলাপ বানালে। সুগন্ধ অমলিন।
আবৃত্তি শেষ হতেই শ্যামল তার শক্ত দু’বাহুর বন্ধনে, আমাকে নিজের সাথে মিশিয়ে বাঁধল।
বলল,
— তুমি আমায় এত দামী ভাবো পদ্মরাগ!
— তারচেয়েও বেশি তুমি শ্যামল। তোমার ভাগ কাউকে দেব না। একটুও না।
আমার গোপন কষ্টে উপচে পড়া হু হু কান্নার মানে শ্যামল না বুঝলেও তার প্রশ্নহীন, ভালোবাসায় নিবিড়ভাবে আগলে নিতে, একমুহূর্তও দেরি করল না।
একবারই শুধু খুব দৃঢ়তায় বলল,
এরপরের সময়টুকুতে আমি আর কান্নার সুযোগই পাইনি। আর কোনোদিন পাব বলে মনে হয় না। এলোমেলো ওলট-পালট আদরে, কথার সুরের মূর্ছনায়, স্বপ্নময় মুহুর্মুহু বর্ণিল স্পর্শে…শ্যামল আমায় রাঙিয়ে যেতে লাগল।
অন্ধকার ঘর আমার
বাগান বিলাসের রঙে সেজে উঠছে।
কালো মানিকের ওষ্ঠ হতে জ্যোৎস্না চুইয়ে চুইয়ে ঝরছে আমার সারা গায়। ওর হাসির আলোকে পূর্ণিমার চাঁদ আজ, লজ্জায় ওঠেনি আকাশে।
Leave a Reply