অত্যন্ত সুন্দর করে সাজানো ঘরটা। জানালায় নতুন পর্দা। দেয়ালে চুনকাম করিয়ে তার উপর নকসা করা হয়েছে। মেঝেতে গোলাপ-গাদার পাঁপড়ি দিয়ে একটি বড় ফুল আঁকা। তার ভেতরে একটি মঙ্গলদীপ জ্বলছে ডালডার তেলে। ঘরে নীল একটা বাতি আলো দিচ্ছে পূর্বদিকে দেয়ালে। পশ্চিমের দেয়ালে আরেকটি লালবাতি জ্বলছে। লাল ও নীল আলো একে অপরের ভেতর ডুকে যাচ্ছে এক দারুন রঙধনুর মতো। জানালার পর্দাগুলো সবুজ, কিন্তু নীল নিয়নের আলোয় তাকে কালো দেখাচ্ছে। কালো জমিনের ভেতর লতানো মানিপ্লান্টের চেকগুলো যেনো আরো বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। ঘরের ঠিক মাঝামাঝি বিছানা। চারপাশের মশারির স্ট্যান্ডগুলোকে এতোবেশি ফুলের সমারোহে সাজানো হয়েছে যে, কাঠের কোনো অংশই খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। শাদা একধরণের বুনো ফুলের ঝুলের মাঝে মাঝে কাঠগোলাপ মিষ্টি গন্ধে ভরিয়ে তুলছে ঘরটি। বিছানাজুড়ে রক্তগোলাপের পাঁপড়ি চাদরের সিংহভাগই ঢেকে রেখেছে। বালিশদুটো দেখে বুঝা যাচ্ছে বেডকভার সেটটি সিল্কের। গাঢ় মেজেন্টার বালিশওয়ারদুটো রুচিশীলতার পরিচয় বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেয়। এই সমারোহ, এই আলোককোমল ঘর, পুষ্পশোভিত বিছানা, সবকিছুকে তুচ্ছ করে দিয়ে বিছানার মাঝখানে বসে আছে এক নববধু। যার ঘোমটা এখনো খোলেনি, যার রূপ এখনো আমরা দেখতে পাইনি।
রাত একটা বাজে। পরিবারের ধুমধাম মিটিয়ে সুবহান কুদ্দুস ঘরে প্রবেশ করে। দীর্ঘ প্রবাসজীবনের কঠোর পরিশ্রম দেশকে যেমন রেমিটেন্স দিয়েছে তেমনি নিজের অবস্থাও ফিরেছে চাঙ্গাভাবে। তিনতলার ঘরে প্রবেশের মুখে সুবহান কুদ্দুস মুচকি হাসে। নিজের জীবনের পেছনের দিকে একবার চোখ ফিরিয়ে চায়। কী ছিলো সে? আর এখন সে নিজেকে কোন পজিশনে নিয়ে এসেছে! দেখে, তার দরজার কাঠে মসৃণ সেগুনের পাল্লা কেমন ধীর হয়ে সরে যাচ্ছে। ঘরে প্রবেশ করতেই কাঠ গোলাপের মিষ্টি গন্ধ সোবহানের নাক-মুখ দিয়ে প্রবেশ করে মনের ঘরে একটি মোহনীয় আলোড়ণ সৃষ্টি করে। তানিয়া সাজিয়েছে এ ঘর। তানিয়ার খুব সখ ছিলো এ ঘরে সোবহানের সাথে নববধু হিসেবে শোবে। কিন্তু তানিয়ার গায়ের রঙ চাপা। নাকটা কেমন বোঁচা। পছন্দ করলো না সোবহান। কথা প্রসঙ্গে খালু বলেছিলো সোবহানের বাপের সাথে। ভায়রার কথা ফেলতে পারে না, তাই বলেছিলো, সুবহানকে একটাবার জিজ্ঞেস করে নেই। পারিবারিকভাবে খালাতো ভাইবোনের মধ্যে বেশ মিল ছিলো। সোবহান কাঁধে-কাঁখে করে বড় করেছে তানিয়াকে। সেদিনের সেই পুচকে তানিয়া আজ বিয়ের উপযুক্ত! তাজ্জব লাগে সোবহানের। সে বাবা মাকে না করে দেয়। মন খারাপ হলেও তানিয়ার পরিবার এমনকি তানিয়াও বুঝতে দেয়নি কাউকে। হাসিমুখেই সোবহানের বিয়েতে এসেছে এবং তানিয়া নিজ দায়িত্বে সোবহানের ছোটবোন মুনিয়াসহ আরও কয়েকজন বান্দবী সাজিয়েছে বাসরঘরটি।
তখন আমের গন্ধে, কাঠালের গন্ধে প্রকৃতির মাঝে এক মনমাতানো উষ্ণতা। মানুষজন হাটে গেলে খালি হাতে ফিরে আসে এমনটি দেখা যায় না। ফলের বাজারে মধুমাসের অজ¯্রফল রসালোলোভন আভা ছড়াতে থাকে। হাটুরেদের কাঁধে দেখা যায় দশাশই কোনো কাঠাল কিংবা হাতে পলিথিনভর্তি করে নিয়ে আসে হলুদ হলুদ আম। যাদের আমকাঠালের গাছ আছে তারাও হয়তো টসটসে লিচুর একশো সংখ্যার থোকা হাতে ধরে ফিরে বাজার থেকে। সোবহান ঘরে প্রবেশ করে কাঠগোলাপের সুবাসের সাথে, গোলাপের গন্ধের সাথে পাকা ফলের ঘ্রাণও টের পায় নাকের মধ্যে। দেখে, শিয়রের পাশে বেড-টেবিলজুড়ে বড় একটি ডিসের মধ্যে একডিশ ফল, একটি জগে পানি, স্বচ্ছ দুটি গ্লাস, দুটি দুধভর্তি মাগ ও এক পেয়ালা মিষ্টি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সোবহানের চোখ জুড়িয়ে যায়। বিদেশে সে কতো পরিশ্রম করেছে। দেহের রক্ত পানি করে মা বাবাকে টাকা পাঠিয়েছে। সে টাকার অনর্থ করেনি তার পরিবার। দুটো বোনকে বিয়ে দিয়েছে, জমি কিনেছে তিন কানি। পাঁচতলা ফাউন্ডেশনে তিনতলা পর্যন্ত কমপ্লিট করেছে এই মনোলোভা ভবনটি। সোবহান দেশে এসে নিজেদের ভবন দেখে বিশ্বাস করতে চায়নি। সামান্য শনের ঘর থেকে সে বিদেশ গিয়েছিলো। বাপদাদারকালীন ষাট শতাংশের একমাত্র জমিটি লিখে দিতে হয়েছিলো আদমব্যাপারি মিজান সরকারের নামে। ক’ টাকাই বা জমির, পোলায় সৌদিআরব গেলে জমি কিনতে বেশিদিন সময় লাগবে না, ভেবেছিলো সোবহানের বাবা। তার ভাবনাটাকে বিফলে যেতে দেয়নি সুবহান। একটানা দশবছর বিদেশ করে এসে এখন মোটামুটি গ্রামে প্রায় মান্যগন্য একজন হয়ে উঠেছে সে। তাই তার বিয়ের জন্য বেশি খোঁজাখোঁজি করতে হয় না। পাত্রের চাহিদা হলো উজ্জ্বল সুন্দর ও শিক্ষিত হতে হবে। একটাকা যৌতুক সে নেবে না। উল্টো মেয়েকে স্বর্নালংকারে সাজিয়ে আনবে।
সানজিদার বাবা বিত্তশালী নয়। মাছ-ব্যবসা করে স্বচ্ছল চলাফেরা। কিন্তু মেয়ে সানজিদা একাই যেনো সাতরাজার বৈভব। তার মতো রূপসী দশগাঁয়ে খুঁজে পাওয়া ভার। সানজিদার বাবা মেয়েকে শখ করে ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়েছে। তৃতীয়বর্ষের সানজিদা লকডাউন ও করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে সাতমাস ধরে বাড়িতেই থাকছে। বাড়িতে আসার পর থেকেই নানা জায়গা থেকে বিয়ের পয়গাম আসতে থাকে প্রচুর। সানজিদার এক কথা, পড়ালেখা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তবেই সে চাকরি নেবে। এ পর্যন্ত কোনো পাত্রপক্ষকে দেখাতে পর্যন্ত পারেনি তার অভিভাবক। শেষে সুবহান কুদ্দুসের প্রস্তাব আসলে কঠোর হয় সানজিদার বাবা। বলে, সারাজীবন রাজরানী হয়ে থাকতে পারবি। সানজিদা রাজি হয় না। শেষমেষ শুধু দেখানো পর্যন্ত রাজি করাতে পারে মেয়েকে। কিন্তু দেখতে এসেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। সুবহান এমন অপ্সরীকে পেতে বিলম্ব করতে চায় না। সানজিদার বাবাও অমন ভালো পাত্র হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা রাখতে চান না। এক বসাতেই সব কথা পাকা হয়ে গেলে সুবহানের লোকেরা বাড়ি থেকে আটভড়ি সোনার গহনা, লাল বেনারসি এনে সানজিদাকে পড়িয়ে নতুন বৌ সাজিয়ে নিয়ে যায়।
একটা দুঃস্বপ্নের ভেতর সানজিদার বিয়ে হয়ে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় সে এতোটাই বিহ্বল হয়ে পড়ে যে স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সে বুঝতেই পারেনি তার সাথে কী ঘটছে। স্বামীর বাড়িতে ব্যান্ডপার্টির তুমুল আওয়াজের সাথে তার শ্বাশুরী যখন তাকে ধান-দুর্বা ছিটিয়ে ঘরে তুলে তখন তার হুঁশ ফেরে এবং সে প্রথমবারের মতো চিৎকার করে কেঁদে উঠে। তার চোখের জল নদীর প্রবাহ হয়ে ফর্সা দুই গাল বেয়ে অবিরত বয়ে যায়। বিয়ে বাড়ির আনন্দের ভেতর এসব কারোরই অস্বাভাবিক ঠেকে না। নতুন বৌ বাপের বাড়ি ছেড়ে এসেছে, সে তো কান্না করবেই। কিন্তু অস্বাভাবিক লেগেছিলো তখন যখন সে বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি যাওয়ার পথে টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। অনেকে ভেবেছিলো, সুবহানের সাথে বিয়ে হওয়াও সানজিদাও মনে মনে যথেষ্ঠ খুশি হয়েছে, তাই সে কান্নাকাটি করেনি। আবার কেউ কেউ বলে, আজকালের শিক্ষিত মেয়েরা কান্নাকাটি করে না। আবার অনেকে বলে, জগৎ থেকে লাজ-শরম সব উঠে গেলো দেখছি। যা হোক, স্বামীর বাড়ির আড়ম্বরে সানজিদার হুঁশ আসে এবং সে অশ্রুর নদীতে ভাসতে ভাসতে মামুনের কথা করে। সে আরও বেশি অসহায় হয় যখন সে বুঝতে পারে তার মুঠোফোনটিও সাথে করে আনেনি।
মামুন আর সানজিদা একই ইয়ারে পড়ে। মামুন পড়ে বাংলায়। একটু কবি কবি ভাব। ডিপার্টমেন্টের সবাই অবশ্য তাকে কবিই ডাকে। সে কবিতা লেখে। বাংলা বিভাগ থেকে একটি দেয়াল পত্রিকা প্রকাশের সাথে কাজ করে। মাঝে মধ্যে উদাস হয়ে যায়। এই উদাস হওয়াই সানজিদাকে টেনেছে সবচেয়ে বেশি। একদিন পাহাড়ের চুড়োয় মামুন উদাস হয়ে আকাশ দেখছে। সানজিদা তার বান্ধবীদের নিয়ে হল থেকে ফিরছিলো। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাটি পাহাড়বেষ্টিত। ছোটখাটো চুড়াতেই ছেলে মেয়েরা বসে আড্ডা দেয়। বিভিন্ন চূড়ায়, পাহাড়ের ঢালে বেশকিছু ছেলেমেয়ে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। সানজিদা দেখে, সবচেয়ে উঁচু চূড়াটিতে একটি ছেলে তন্ময় হয়ে আকাশ দেখছে। সে থামে। তার বান্ধবীরা তাড়া দেয়, কিন্তু সানজিদা ব্যাপারটি দেখতে চায়। সে দেখে, বেশ অনেক্ষণ ধরে ছেলেটি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কতক্ষণ সানজিদা জানে না। তার বান্ধবীরা চলে যায়, সে দাঁড়িয়ে থাকে। থাকতে থাকতে একসময় অজানা অচেনা এক চৌম্বক যেনো তাকে টেনে তুলে সে পাহাড়ের চূড়োয়। সেই থেকে সানজিদা আর মামুন স্বপ্ন দেখতে থাকে তাদের বিয়ের পর তারা পাহাড়ের কোলে একটি বাড়ি করবে।
আলোকোজ্জল বাসরঘরটিতে প্রবেশ করতে করতে সুবহানের মনের মধ্যে উদয় হয় কতো কি কথা। সেও কোনো এক মেয়েকে ভালোবাসতো। কিন্তু গরীবের ভালোবাসতে নেই। তাই সবকিছু ছেড়েছুড়ে পাড়ি জমিয়েছে ভিনদেশে। আজ দশবছর পরে যখন সে আসছে তখন সে দেখতে পাচ্ছে কতো ভালোবাসাই এখন তার জন্য পাগলপ্রায়। সুবহান মাথা থেকে সেসব চিন্তা সরিয়ে দেয়। সে যাকে ভালোবাসতো সানজিদার নখের সমান যোগ্যতাও তার ছিলো না। সুবহান মনে মনে শুকুর আদায় করে। দরজার ছিটকিনিটা প্রায় নিঃশব্দে আটকে দেয় সে। মেঝে দীপাবলী আলোতে গোলাপপাঁপড়ির নকসা লোবন উষ্ণতা ছড়িয়ে দেয় সুবহানের ভেতর। ফুলের ঝুল পাশ করে সে শয্যায় গিয়ে বসে। ঘোমটা আবৃত সানজিদার দিকে তাকায়। কী বলবে ইতস্ত করতে থাকে। কোনো কথাই তার মুখ দিয়ে গুঁছিয়ে বের হয় না। সে মাথা থেকে সামাল খুলে একপাশে রাখে। গলার কাঁচাফুলের মালাটা খুলে সামালের পাশে রাখে। বেডটেবিল থেকে একগ্লাস জল পান করে। কিন্তু কোনো কথার শুরুটা তার মাথায় আসছে না। এমনি করে প্রায় আধঘন্টা কেটে গেলে সুবহান অধৈর্য হয়ে পড়ে। সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। হাত, বাড়িয়ে সানজিদার ঘোমটা সরাতে যায়। এক ঝটকায় নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয় সানজিদা। তারপর কর্কশ কণ্ঠে বলে, থামুন। আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে আমার অমতে। আমি এ বিয়েতে সম্মত নই। এবং আমি কোনোদিন আপনার হতে পারবো না। সুবহান এমন মধুমাসের মথুরায় এমন বাক্য শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।
Leave a Reply