1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৬ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
# মাহমুদা সুলতানা একা # কালো_মানিক বেসিনে গরম পানি ঢালার পূর্বে সতর্ক হোন!! ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড ———————————– অভিনন্দন – শুভ জন্মদিন অবন্তী দেব সিঁথি ————————— — মেসবা খান ঢাকায় অবস্থানরত জামিয়া গহরপুর সিলেট’র ফুযালা ও প্রাক্তনদের আয়োজনে ❝মাহফিলে নূর❞ অনুষ্ঠিত —— হজ্জ ২০২৫ ও ওমরাহ বুকিং চলছে – – মক্কা হুজুর হজ্জ কাফেলা সাউথ বাংলা ট্যুরিজম ————————— প্যারাডাইজ ইন্টারন্যাশনাল হাই স্কুল রম্য কবিতা – অবশেষে হেডমাস্টার – – কলমে – – – – – চৈতালী দাসমজুমদার আলহামদুলিল্লাহ বহু প্রতিক্ষিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্যোগ, মানব সেবার লক্ষ্য ……. প্রস্তাবিত “জেড ওয়েল মেডিকেল কলেজ ও হসপিটাল লি:”

#ভালবাসা_রং_পাল্টায়_না – পর্ব-১, পর্ব-২, পর্ব-৩, পর্ব-৪, পর্ব-৫, (অন্তিম পর্ব) – – – তানিয়া আবেদিন

  • আপডেট টাইম : শনিবার, ২ জুলাই, ২০২২
  • ২৮৫ বার
পর্ব-১
সময়টা নব্বই দশকের মাঝামাঝি। একদল স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়ে মফস্বলের এক সরকারী কোয়ার্টারের মাঠে খেলা করছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই তাদের মাঝে অতি তুচ্ছ একটা বিষয়ে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। ঝগড়ার বিষয়টা একটু পরে বলছি। ঝগড়ার শুরু রুবানা আর তানজীদের মাঝে। রুবানা আর তানজীদ এক ক্লাসে পড়ে। তারা আবার বেস্ট ফ্রেন্ড যাকে বলে তার চেয়ে বরং একটু বেশী। রুবানার দু’বছরের বড় রুমকি। রুমকি এখানে সবার বড়।
এই ছেলেমেয়েগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই মফস্বল শহরে তাদের বাবার চাকুরীসূত্রে এসে বসবাস করছে। এবং কোয়ার্টার সংলগ্ন স্কুলে পড়ার কারনে তাদের মাঝে সম্পর্কের গভীরতা বাকি আর সবার চেয়ে একটু বেশী। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে সবাই একই জায়গায় থাকার কারনে সবাই সবার সুখ দুঃখের সমান অংশীদার।
এই কিশোর কিশোরী গ্রুপের মধ্যে রুমকি সবার বড়। আর বাকি সবাই রুমকিকে আপু ডাকলেও তানজীদ কেন জানি ওকে আপু বলে না। সবার সাথে প্রচুর কথা বললেও রুমকির সাথে নেহায়েত প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনা এবং যা বলে সেটাও ভাববাচ্যে।
আজ মূলত দু’জনের ঝগড়ার বিষয় হলো তানজীদ কেন রুমকিকে আপু ডাকে না। প্রথমটায় দুই একটা কথা কাটাকাটি হলেও পরবর্তীতে সেই ঝগড়া হাতাহাতিতে রূপান্তরিত হয়। তখন খেলা বন্ধ করে সবাই ওদের দু’জনের ঝগড়া থামাতে ব্যস্ত হয়ে পরে।
পরবর্তী দুইদিন যদিও তাদের কথাবার্তা এবং মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল কিন্তু দুইদিন পর তারা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়।
………………
সময় তার নিজ গতিতে বয়ে চলে। কারো জন্য থেমে থাকা সময়ের ধর্ম নয়। সময়ের সাথে সাথে এই মানুশগুলোর মাঝে সম্পর্ক আরো গাঢ় হতে থাকে, সেই সাথে ছেলেমেয়েগুলো বড় হতে থাকে। রুমকি এবার ক্লাস নাইনে, রুবানা আর তানজীদ ক্লাস সেভেনে। বেশ কয়দিন ধরে তানজীদের আচরণ রুমকির কাছে কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকতে লাগল।
এখন আর আগের মতো খেলা হয়না ওদের। ছেলেরা মাঠে খেলা করলেও মেয়েরা সবাই দলবেঁধে কখনো ছাদে আবার কখনও নীচে হাঁটাহাঁটি করে গল্পগুজব করে। সে সময়টায় তানজীদ কেন জানি খেলা বাদ দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে ওদের দিকেই তাকিয়ে থাকে। প্রথমটায় ব্যাপারটা আমলে না নিলেও পরে কেন জানি ব্যাপারটা রুমকির চোখে লাগতে লাগল।
একদিন স্কুল থেকে আসার পর রুবানা বেশ উৎসাহ নিয়ে বলল
-আজ কি হয়েছে জানিস আপু?
-তুই না বললে আমি কি করে জানব?
-তানজীদ কি করেছে জানিস!
তানজীদ নামটা শোনার পর রুমকির কেন যেন আর কিছু শোনার আগ্রহ হলোনা। সে উঠে চলে যেতে উদ্যত হলে রুবানা হাত ধরে টেনে বসিয়ে বলে
-আরে শোন না। তানজীদ সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে ও তোকে বিয়ে করবে।
এই বলে হাসিতে ফেটে পরল রুবানা। একথায় রুমকির রাগে গা রিরি করতে লাগল। রুবানাকে ধমক দিয়ে বলে
-খুব আনন্দ হচ্ছে না তোর! বেশরম! যেমন তোর বন্ধু তেমন তুই।
রুবানা আরও কিছু বলতে নিলে রুমকি রুম থেকে বের হয়ে যায়।
এই ঘটনার পর থেকে রুমকি যে জায়গাগুলোতে তানজীদের থাকার সম্ভাবনা আছে সেগুলো এড়িয়ে চলতে শুরু করল।
………………
রুমকি একদিন স্কুল থেকে এসে দেখে তানজীদ ওর পড়ার টেবিলে কি যেন করছে। ওকে কিছু বলতে যাবে এমন সময় দেখতে পেল তার গুণধর বোন পাশেই আছে। তাই কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে গেল। সন্ধ্যায় পড়তে বসলে বইয়ের ভেতরে একটা চিরকুট পেল। তাতে লেখা
‘আপনাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। কেন, কবে থেকে আমি বলতে পারব না। তবে যখনি আপনাকে দেখি আমি সব ভুলে যাই। কেবল আপনাকে দেখতেই ইচ্ছে করে। সারাদিন ধরেও যদি আপানাকে দেখি আমার সাধ মিটবে না।
তুলি আপুর হলুদে আপনাকে প্রথম শাড়ি পরা দেখেছি আমি কেবল আপনাকেই দেখেছি। বাসায় এসে মনে পরেছিল আমি আপনাকে দেখতে দেখতে রাতের খাবার খেতে ভুলে গিয়েছি। কিন্তু জানেন আমার একটুও খারাপ লাগেনি। আপনাকে দেখার জন্য আমি এমন অনেক বেলা না খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারব।
আপনি যখন বাম দিকে সিথি কেটে চোখে কাজল দেন কেমন অদ্ভুত সুন্দর লাগে আপনাকে আমি বলে বুঝাতে পারব না। লাল রঙয়ে আপনাকে ভীষণ সুন্দর লাগে, গোলাপীতে লাগে ভীষণ আদুরে, হলুদ আপনার মাঝে অদ্ভুত দ্যুতি ছড়ায়, আর কালো? কালোতে আপনাকে দেখলে আমার হৃদকম্প বেড়ে যায়।
আপনি কি বুঝতে পারেন আমি সারাক্ষন আপনাকেই দেখি। আমার কেন যেন মনে হয় বুঝতে পারেন। আপনাকে সরাসরি কথাগুলো বলতে পারছি না কোনভাবেই। তাই এই চিঠির আশ্রয় নিলাম।
কাল ঠিক বিকেল চারটায় আপনার জন্য ছাতিম গাছটার নীচে অপেক্ষায় থাকব। আসবেন তো? আমি কিন্তু অপেক্ষায় থাকব’।
……………
চিঠিটা দেয়ার পর থেকেই তানজীদের মাঝে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছে। কে যানে রুমকি ব্যাপারটা কি ভাবে নিবে? রুমকি কি আসবে? এসে কি করবে বা কি বলবে? আচ্ছা বকাঝকা দিলেও সমস্যা নেই। রুমকির সবকিছু তার পছন্দ। বকা দিলেও হজম করে নিবে। কিন্তু যদি না আসে? তানজীদ তখন কি করবে?
প্রচণ্ড অস্থিরতায় সারারাত ঘুমাতে পারল না, পরদিন ক্লাসে মন বসল না। মন কেবল অপেক্ষায় আছে চারটা বাজার। ইচ্ছে করছে এখনি যেয়ে ছাতিম গাছের নীচে বসে থাকে। চারটা পর্যন্ত আর তর সইল না তার। তিনটা থেকে যেয়েই বসে ছিল।
চারটা পেরিয়ে গেছে সেই কখন! কিন্তু রুমকির দেখা নেই। তানজীদের মনে দু’ধরনের চিন্তা কাজ করছে। এক রুমকি আসবে না, দুই রুমকির হয়তো দেরী হচ্ছে। প্রথমটা কেন যেন মন থেকে মানতে পারছে না তানজীদ। তার মনে দ্বিতীয় চিন্তাটাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই অপেক্ষা করতে লাগল। অপেক্ষার পালা শেষ হলো যখন পাশের মসজিদ থেকে আযানের শব্দ ভেসে এলো।
রুমকি আসেনি। এটাই সত্যি। কিন্তু সেই সত্যিটা কেন যেন এই বারো তেরো বছরের কিশোর মেনে নিতে পারছে না। তার মন বলছে একবার রুমকির সামনা সামনি গিয়ে দাঁড়ানো প্রয়োজন। আর কিছু না ভেবেই সে চলে গেল রুমকিদের বাসায়।
বেল দিতেই রুবানা এসে দরজা খুলে দিল। তানজীদের চেহারা দেখে ভীষণ রকমের ভয় পেয়ে গেল রুবানা। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই তানজীদ তাকে বলল
-রুমকি কোথায়? ওকে ডাক।
-কি হয়েছে তোর? আপুকে দিয়ে কি করবি?
-যা বলেছি তা কর।
-দেখ আব্বু আম্মু বাসায় নেই। প্লীজ কোন কিছু করিস না।
এই কথা শোনার সাথে সাথে তানজীদ আর কিছু না বলে ভেতরের দিকে চলে যায় আর রুবানা ছুটে তার পিছু পিছু। রুমে ঢুকেই দেখে রুমকি হেডফোনে গান শুনছে আর গল্পের বই পড়ছে। এটা দেখে প্রচণ্ড রাগ হলো তানজীদের। সে এদিকে অস্থির হয়ে আছে আর অপরদিকে আরেকজন রিলাক্স করছে। এক ঝটকায় রুমকির হাত ধরে টেনে তুলে ফেলল।
ঘটনার আকস্মিকতায় রুমকি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। হেডফোন থাকায় তানজীদ কখন এসেছে টের পায়নি। তানজীদকে দেখে হেডফোন সরিয়ে কিছু বলতে যাবে এমন সময় তানজীদের প্রশ্নবাণে পরল রুমকি।
-কি ব্যাপার আপনি এলেন না কেন? আমি সেই তিনটা থেকে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। আপনার কাছে কি আমার ফিলিংসের কোন মূল্য নেই?
রুমকি বেশ অবাক হলো এই ছেলের আচরণে। রাগও হচ্ছে ভীষণ। তারপরও নিজেকে সামলে বলল
-তোমাকে কি আমি প্রমিজ করেছি আমি যাব?
-না।
-তাহলে এভাবে জেরা কেন করছ তুমি?
-আপনি আসেননি কেন? আমি অপেক্ষায় ছিলাম।
-ফের এক কথা!
এবার তানজীদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল
-আমি আপনাকে ভালবাসি। ভীষণ ভালবাসি।
কথা শেষ হতে পারেনি তার আগেই রুমকি এক চড় বসিয়ে দিল তানজীদের গালে। একেতো ফর্সা তার উপর চড় খেয়ে ছেলের গাল যেন একেবারে লাল টকটকে হয়ে গেছে। তানজীদ ও এমনটা প্রত্যাশা করেনি। কেবল ফ্যালফ্যাল করে রুমকির দিকে তাকিয়ে রইল। আর রুবানা নীরব দর্শকের মতো একবার বোনের দিকে আর একবার বন্ধুর দিকে তাকাচ্ছে।
চলবে………
পর্ব (২)
রুবানার সাথে তানজীদের বন্ধুত্ব আজ বেশ কয়েক বছর। তাদের দুজনের বাবা প্রায় কাছাকাছি সময়ে এই জায়গায় ট্রান্সফার হয়ে আসেন। তানজীদ ভীষণ প্রান চঞ্চল একটা ছেলে। যে কাউকে সহজে আপন করে নেয়। রুবানার সাথে সেই এক সাথে খেলা করার সময় থেকেই বন্ধুত্ব। যদিও মারামারিই তারা বেশী করত কিন্তু একে অপরকে ছাড়া আবার থাকতেও পারত না।
সেই তানজীদ আর তার বড় বোনের মাঝে এমন কিছু একটা দেখে রুবানা যেন বোকা বনে গেল। আগে থেকে যে কোন কিছু জানত না রুবানা এমনটাও কিন্তু নয়। কিন্তু সে ভেবেছিল অল্প বয়সের ফ্যান্টাসি বলে যেমনটা হয় তেমন। তানজীদ যে এমন একটা কান্ড করে বসবে ঘুনাক্ষরেও টের করতে পারেনি রুবানা। পরক্ষনেই নিজেকে ধীক্কার দিল। নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের মনে কি চলছে সে বুঝতে পারল না। বুঝতে পারলে এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না কাউকে।
………………
অনেকটা সময় হলো রুবানা আর তানজীদ মুখোমুখী বসে আছে। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ অনেক চুপচাপ তানজীদ। নীরবতা ভেঙ্গে রুবানা বলল
-কি হলো এসব? তুই এমন কেন করলি?
-আমি রুমকিকে ভালবাসি।
-কবে থেকে?
-জানি না। সেই একসাথে ঘরঘর খেলার সময় থেকেই আমার ওকে ভাল লাগে।
ঘরঘর খেলার সময় গৃহকর্তা আর গৃহকর্ত্রীর ভূমিকা সবসময় তানজীদ আর রুমকি করত। তানজীদ ছেলেদের মধ্যে লম্বায় প্রায় রুমকির কাছাকাছি হওয়ার কারনে সে এই সুযোগ পেত।
রুবানা আর কিছু বলল না। কারন সে বুঝতে পেরেছে কিছু বলে কোন লাভ নেই।
…………
বেশ কিছুদিন কেটে গেল। রুমকি এখন আর তানজীদকে খুব একটা দেখে না। কিন্তু তাই বলে তানজীদ রুমকিকে দেখা ছাড়েনি। লুকিয়ে লুকিয়ে প্রতিদিন সে রুমকিকে দেখে। দিনগুলো চলে যাচ্ছিল ভালো মন্দ মিলিয়ে ঠিক সেসময় একদিন তানজীদের বাবার পোস্টিং হয়ে গেল অন্য শহরে।
পোস্টিং অর্ডার আসার পর থেকেই তানজীদের অবস্থা পাগলপ্রায়। বেশ কয়বার রুমকির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আর কোন উপায় না পেয়ে চিঠির আশ্রয় নিল সে। রুমকি এমনিতে কয়দিন ধরে তানজীদের আচরণে বিরক্ত ছিল। চিঠি পেয়ে সরাসরি হেডমাস্টারের কাছে জমা দিয়ে আসল।
এরপর তানজীদকে ডেকে ভীষণ বকা দিলেন হেডমাস্টার মশায়, সাথে এ বলে সতর্ক করে দিলেন পরবর্তীতে এমন ঘটনা ঘটলে ওর বাসায় বাবা মাকে জানানো হবে। এই ব্যাপারটি এখানে শেষ হয়ে গেলে হতো। কিন্তু কি করে যেন তানজীদের বাবার কানে গেল কথাটা। পুরো ব্যাপার শুনে উনি ভীষণ রেগে গেলেন। যাচ্ছে নয় তা বললেন ছেলেকে।
এরপর বেশ কিছুদিন আর তানজীদ স্কুলে যায়নি। দেখতে দেখতে তাদের চলে যাবার সময় কাছে চলে এলো। এবার টিসি নেয়ার জন্য তো স্কুলে যেতে হবে। কিন্তু কেন যেন তানজীদের যেতে ইচ্ছে করছিল না। ভীষণ খারাপ লাগছিল। এই স্কুল, খেলার মাঠ, কোয়ার্টার এসবে কতো স্মৃতি রয়েছে। সবচেয়ে মন খারাপ হয় রুমকির কথা ভেবে। এক সাথে কত খেলা করেছে। প্রতিটা গাছ, ব্লকগুলোর রাস্তা যেন বারেবারে সেই স্মৃতিগুলো মনে করিয়ে দেয়। শেষ কয়দিন তেমন একটা ঘর থেকেও বের হয়নি। বন্ধুরা সবাই এসে দেখা করে গেছে।
স্কুলে এমন একটা সময় গেল যখন ক্লাস চলবে, সুতরাং রুমকির সাথে দেখা হবার সম্ভাবনা নেই। হাজার হলেও মানুষের মন। যতই লাগাম টানুক এক সময় আর ধরে রাখা যায় না চির ধরেই। যাবার আগের দিন কোনভাবেই আর মনকে মানাতে পারল না। রুবানার সাথে দেখা করার বাহানায় গেল ওদের বাসায়। অনেক বার বলার পরেও রুমকি সামনে এলো না।
………………
এদিকে রুমকি ভীষণ বিরক্ত। সেদিন চড় দেয়ার পর কয়দিন চুপচাপ দেখে ভেবেছিল তানজীদের মাথা থেকে ভূত নেমেছে। কিন্তু তানজীদ যে ওকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে তা ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি রুমকি। বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ আবার বারেবারে কি যেন বলতে চাইত। রুমকি অবশ্য পাত্তা দিত না।
সমবয়সী বা সিনিয়র হলে এক কথা ছিল। জুনিয়র একটা ছেলে তাকে প্রেমের কথা বলছে তাও আবার তার ছোট বোনের বেস্ট ফ্রেন্ড! কেমন আজব লাগছিল ব্যাপারগুলো। তাই তানজীদকে যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত এড়িয়ে চলতে শুরু করে রুমকি।
এরমধ্যে আবার শুরু হলো চিঠির উপদ্রব। প্রতিটা চিঠিতেই ভালবাসার কথা লেখা। একদিন এক চিঠি গিয়ে পরল তার এক বান্ধবীর হাতে। তাকে আবার সিআইডি বললেও কম বলা হয়। জেরার চোটে রুমকি সব বলে দিল। বান্ধবীর পরামর্শেই চিঠি সরাসরি হেডমাস্টারের কাছে দিয়ে পুরো বিষয়টা জানিয়ে এলো রুমকি।
এই ঘটনার পর আর তানজীদের দেখা নেই। জলজ্যান্ত একটা মানুষ কি করে এভাবে হাওয়া হয়ে যায় রুমকির ভীষণ অবাক লাগে। পরে একদিন রুবানার কাছে জানতে পারে তানজীদের বাবার ট্রান্সফার অর্ডার এসেছে। এই খবর শুনে যেন বেশ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল রুমকি।
হঠাৎ একদিন বিকেলে তানজীদ এসে হাজির। লুকিং গ্লাসে তানজীদকে দেখে রুমকি ইচ্ছে করে দরজা না খুলে রুবানাকে পাঠায়। বেশ কিছুক্ষন পর রুবানা এসে যখন জানাল তানজীদ রুমকির সাথে কথা বলতে চায় রুমকি রাজি হয়নি। বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও রুমকি যায়নি তানজীদের সামনে।
সময়টা আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি। হুঠহাট করেই যেকোন সময় বৃষ্টি হয়। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই আকাশে মেঘ করে আছে। যেকোন সময় ভারী বর্ষন শুরু হবে। আকাশে বিজলী চমকাচ্ছে। তানজীদ বিদায় নিয়ে চলে যাবার উপক্রম হলে রুবানা এবং তার মা দুইজনই বারবার বলে একটু অপেক্ষা করে বৃষ্টি হয়ে গেলে তারপর যেন যায়।
তানজীদও নাছোড়বান্দা সে যাবেই। আসলে তার আর এক মুহূর্তও বসতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। নীচে জারুল গাছটার বরাবর রুমকির রুম। তানজীদ জানে রুমকি রুমে আছে। সে জারুল গাছটার নীচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে যদি একবার রুমকিকে দেখতে পায়।
আজ যেন সবকিছুই একটু বেশী বেশী। অন্যান্য দিন হাজার বিজলী চমকালেও বৃষ্টি কদাচিৎ হয় বা হলেও অল্প স্বল্প হয়। আজ হঠাৎ করে প্রচন্ড ঝড় শুরু হয়ে গেল। বাতাসের দমকে রুমকি তার রুমের জানালা লাগাতে গেলে দেখে একটা ছেলে জারুল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টি ঠিক তার জানালা বরাবর।
রুমকি ভীষণ অবাক হয়। এই ঝড়ের মধ্যে কোন পাগল এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমটায় ছেলেটিকে চিনতে না পারলেও পরে বুঝে এ আর অন্য কেউ নয় তানজীদ। কিন্তু কি হাল হয়েছে এই ছেলের! শুকিয়ে কেমন হয়ে গেছে! ঘনঘন বিজলী চমকাচ্ছে সেদিকে তা যেন কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে আছে রুমকির দিকে।
কি ছিল সে চাহনীতে রুমকি জানে না, কিন্তু সেই চাহনি উপেক্ষা করে জানালা বন্ধ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আকাশে মেঘের গর্জন সাথে দমকা হাওয়া আর ঝড় আর ধরনীতে দুইজন কিশোর কিশোরী সব ভুলে চেয়ে রয়েছে একে অপরের পানে।
চলবে………
পর্ব (৩)
দুর্দান্ত প্রতাপে ঝড় বয়ে যাওয়ার সাথে চারপাশটা প্রায় লন্ডভন্ড হবার দশা। তারচেয়ে ভয়ঙ্কর অবস্থা বিরাজমান এই দুই কিশোর কিশোরীর মনে। কিশোরের মনে অজস্র প্রশ্ন ঘুরপাক করছে আর কিশোরী? কিশোরীর মন কেমন করা সব অনুভূতি হচ্ছে।
কি যে ছিল সেই কিশোরের চাহনীতে, কিশোরীকে সম্মোহনী শক্তিতে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। ঝড় থেমে এলে তানজীদ চলে যায় কিন্তু রুমকি কি যেন এক ঘোরের মধ্যে রয়ে গেল। এই ঘোর কি আজীবন আচ্ছন্ন করে রাখবে রুমকিকে? রুমকি বুঝতে পারে না। কিন্তু নিজের মাঝে ভয়ঙ্কর রকমের একটা পরিবর্তন টের পায়।
যে মানুষটাকে সে একসময় সহ্য করতে করতে পারত না আজ উঠতে বসতে সারাদিন তার কথা মনে পরে। মনে পরে বললে আসলে ভুল হবে রুমকি মাথা থেকে সেদিনের সেই ঘটনা সরাতে পারছে না কোনভাবে। সেই সাথে নতুন উপদ্রব হিসেবে হানা দেয় পূর্বের স্মৃতিগুলো।
কিন্তু এসময়ে এমন কেন হলো। তানজীদরা তো চলে যাচ্ছে। স্কুলে আসা যাওয়ার পথে, ব্যস্ত মাঠে কিংবা বিকেলে হাঁটার সময় খুব সন্তপর্নে রুমকির চোখ জোড়া কেবল তানজীদকেই খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু জগতের কিছু অদ্ভুত নিয়ম আছে। যখন প্রচন্ড ভালোবাসা নিয়ে তানজীদ আশেপাশে ঘুরত রুমকির মনটা বিষিয়ে থাকত। আর আজ? এতো করে যাকে এক নজর দেখার জন্য মনের ভেতরটা আকুপাকু করছে তার দেখা মিলছে। সে যেন বাতাসে হারিয়ে গিয়েছে।
কয়েকদিন পর তানজীদের বাবা মা এলেন বাসায় দেখা করার জন্য। আর তিনদিন পর চলে যাচ্ছেন উনারা। এদিকে তানজিদের না কোন খবর আছে না দেখা। রুমকির ভীষণ খারাপ লাগতে থাকে।
……………………
সেদিনের পর তানজীদ ঠিক করে আর কোনভাবেই সে রুমকির মুখোমুখি হবে না। আড়াল থেকেই রুমকিকে দেখতে থাকে স্কুলে আসা যাওয়ার সময় কিংবা বিকেলে হাঁটাহাঁটি করার সময়। এমনকি কোয়ার্টারের সবাই মিলে যখন তাদের ফেয়ারওয়েল পার্টির আয়োজন করেছিল তখনও ইচ্ছে করে রুমকির সামনে আসেনি। দূর হতেই রুমকিকে দেখছিল।
নতুন জায়গা নতুন মানুষজনের মাঝে একটা কিশোরের পূর্বের স্মৃতি ধীরে ধীরে ভুলে যাবার কথা। কিন্তু তানজীদ কোনভাবেই যেন সেসব স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। সে যে চেষ্টা করেনি এমনটা কিন্তু নয়। কিন্তু পারেনি।
আর ঐদিকে রুমকির অবস্থা আরও করুন। কথায় আছে না মানুষ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝেনা এক্ষেত্রে ঠিক তাই। তানজীদরা চলে যাবার পর রুমকি যে খুব ভালো ছিল এমনটা নয়। সারাক্ষণ তাকে তাড়া করে বৃষ্টির জলে ভেজা এক কিশোরের করুন অথচ খুব তীব্র এক চাহনি। আকুতি ভরা সেই চাহনি যেন ঘুমের মাঝেও তাড়া করে বেড়ায় রুমকিকে।
…………………………
ব্যস্ত নগরীর, ব্যস্ত সড়কের, কোনো এক ব্যস্ত রেস্তোরাঁয় একঝাঁক উচ্ছল তরুন তরুনীর মিলন মেলা বসেছে। একপক্ষ এসেছে তাদের বন্ধুর জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে আর অপরপক্ষ তাদের বন্ধুর পরীক্ষায় ভালো ফলাফল উদযাপন উপলক্ষে।
আট বছর অনেক লম্বা একটা সময়। এই সময়ের ব্যবধানে কিশোর হয়ে যায় তরুণ আর কিশোরী আজকের দিনের সেই তরুণী। কিন্তু তরুণটি? সে কোথায়? সে এখনো এসে পৌঁছায়নি আজকের সেই রেস্তোয়ার। কারন তার বন্ধুর জন্মদিন আর কেক আনার দায়িত্ব পরেছে তার কাঁধে। লম্বা ট্রাফিক ঠেলে কেক নিয়ে পৌঁছাতে তার দেরী হয়ে গেছে। বন্ধুরা ততক্ষনে এসে পৌঁছে গেছে। বারবার কল করে যাচ্ছে তাকে। এমনিতেই দেরী হওয়ার কারনে অস্থির তানজীদ তার উপর একের পর এক কল করেই যাচ্ছে বন্ধুরা। এমন অবস্থায় ঘটল এক অঘটন।
রুমকির অনার্স ফাইনালের রেজাল্ট দিয়েছে। সর্বোচ্চ সিজিপিএ তার। যার ফলে বন্ধুদের সবার আবদার রাখতেই তাদের আজকের এই আয়োজন। ওদের আড্ডা প্রায় শেষ বের হয়ে যাওয়ার আগ মুহুর্তে রুমকি ওয়াশ রুমের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। একটু আনমনা থাকায় লক্ষ্য করেনি হঠাৎ কি যেন এসে ওর গায়ের উপর পরল। কিছুক্ষণের জন্য যেন কোন সেন্স কাজ করছিল না রুমকির।
খবর যখন হলো তখন গায়ে নরম কিছু লেগে থাকার অনুভূতি হচ্ছিল। ভালো করে তাকাতেই দেখে ইয়া বড় একটা কেকের পুরোটাই তার গায়ে। সাথে সাথে তার রাগ হলো ভীষণ। পুরো নিউমার্কেট ঘুরে এই বটল গ্রীন কালারের জামদানীটা কিনেছিল। টেইলারের দোকানে কারো ফলস লাগাতে দেয়া সবুজ জামদানীতে চোখ আটকে গিয়েছিল তার। মা বলেছিলেন সামনে ছোটন মামার হলুদে এমন একটা জামদানী কিনে দিবেন।
কিন্তু ছোটন মামার হলুদে সবাই একই রকম শাড়ি পরায় রুমকির আর শাড়িটা পরা হয়নি। তাই আজ খুব শখ করে শাড়িটা পরেছিল। মা অবশ্য বারবার নিষেধ করছিলেন শাড়ি পরতে। এখন ভীষণ আফসোস হচ্ছে। রুমকির মা সবসময় জামদানি শাড়িকে মহারানীর শাড়ি বলেন। কারন এই শাড়ির সবসময় স্পেশাল কেয়ার লাগে। অথচ এই জামদানী শাড়িই রুমকির ভীষণ পছন্দ।
এতো শখের শাড়ী! তার উপর এই রঙয়ের জামদানী তেমন পাওয়াও যায় না। সব মিলিয়ে রুমকির ভীষণ মন খারাপ হলো। এই ভাবনা থেকে সম্বিত ফিরে পেল সামনের ব্যক্তির “সরি” বলায়। কিন্তু এখানেও বাঁধল বিপত্তি। মানুষটার দিকে তাকাতেই যেন বড়সড় একটা ধাক্কা খেল। এই চোখ জোড়া তো সেই চোখ, যা তাকে এতগুলো বছর তাড়া করে আসছে।
……………
তানজীদের অবস্থা পাগলপ্রায়। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কার সাথে যেন ধাক্কা লেগে পুরো কেকটা গিয়ে পরল সামনের মানুষটার গায়ে। সরি বলে তাকাতেই একেবারে জমে গেল। সেই মানুষটা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, এতগুলো বছর যার অপেক্ষায় ছিল।
সেই মুহূর্তে আর কি বলবে বা বলা উচিৎ তার মাথায় আসছে না। রুমকির চোখে চোখ পরতেই বুঝতে পারল রুমকি তাকে চিনতে পেরেছে। কি করবে বুঝতে পারছিলা না এমন সময় রুমকিই বলল “তানজীদ”। একটুখানি সংশয় যেন ছিল রুমকির কন্ঠে। তানজীদ ভীষন অবাক হয় রুমকি ওকে কি করে চিনতে পেরেছে এই ভেবে। ওর নাকি চেহারায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। তারুন্যে এসে কৈশোরের কোনো কিছু নেই চেহারায়। একেবারে ভেঙ্গেচুরে নাকি অন্য এক তানজীদ হয়ে গিয়েছে, এমনটা তার আত্মীয়স্বজন সবাই বলে। তাহলে এতো বছর পর রুমকি তাকে চিনল কি করে?
চলবে……
পর্ব (৪)
রুমকি কখনো ঐ চোখ জোড়া ভুলতে পারেনি। কি এক ভীষন আকুতি ছিল সেই চোখ জোড়ায় যা তাকে এতোটা বছর তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ভবিষ্যতে কখনও ভুলতে পারবে বলেও মনে হয় না। ওর চিনতে ভুল হবার কথা নয়। তাই নাম ধরেই সম্বোধন করল।
তানজীদ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। সে যেন এমনটা আশা করেনি। ভীষণ অবাক হয়েছে রুমকিকে দেখে। একটু সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল
– রুমকি! কেমন আছ? আমাকে চিনলে কি করে?
তানজীদের এমন সাবলীলতা রুমকিকে ভীষণ অবাক করল। ভাববাচ্যে কথা বলা ছেলেটি আজ এতো বছর পর দেখা হওয়া মাত্র সরাসরি তুমি বলে সম্বোধন করছে। বিস্ময় না ঢেকেই জবাব দিল
-ভালো আছি। না চেনার কোনো কারন তো দেখছি না।
তানজীদও ভীষণ অবাক হয় রুমকির এমন সাবলীলতা দেখে। এ রুমকি আর আগের রুমকির মাঝে যোজন যোজন ফারাক। তার দিকে কখনো ভালো করে তাকিয়ে না দেখা মেয়েটি আজ কি সুন্দর করে কথা বলছে! এটা কি সময়ের জন্য নাকি অন্য কিছু?
দুজন দুজনের আচরনে এতটাই অবাক হয়েছে যে আর কোন কথা কেউ বলতে পারেনি। এতো বছর পর এভাবে দুজনের দেখা হয় যাবে দুজনের কেউ বুঝতে পারেনি। সেই ছোটবেলায় কখন কে কাকে দেখেছে কিংবা ভালবেসেছে এতদিন এসব কিছুই মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ন বিপরীত। ভুলেও গিয়েও যেন ভুলে থাকা যায় না। পলকেই সব স্মৃতি যেন জেগে উঠেছে।
তানজীদের মনে হচ্ছিল এইতো সেদিন। মাত্র সেদিন রুমকি ওকে চড় দিয়েছে। আর রুমকির মনে হচ্ছিল কালই যেন তানজীদ ওর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। এ কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি। আর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যপার হলো পূর্বের তিক্ততাটুকু দুজনের কারোই মনে উঁকি দিল না।
অদ্ভুত দোলাচলে কে কি করছে বা কোথায় থাকছে কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারল না। ফলাফল সরূপ আবার হারিয়ে ফেলা। রুমকি বাসায় ফিরে ইতস্তত ভাবে রুবানাকে তানজীদের কথা জিজ্ঞেস করতে রুবানা মুখ উল্টিয়ে বলে
– আমার সাথে তো যোগাযোগ নেই। তবে শুনেছি মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি হয়েছে।
রুমকি চলে যেতে নিলেই রুবানা জিজ্ঞেস করে
-কিরে ব্যাপার কি? আজ এতো বছর পর হঠাৎ তানজীদের কথা জিজ্ঞেস করছিস?
-ওর সাথে আজ রেস্টুরেন্টে দেখা হয়েছে। আমার শাড়ির যে অবস্থা দেখছিস তা তোমার গুণধর তানজীদের কাজ।
-ওহ ওহ এতোদিন পর দেখা তাও একেবারে সিনেমাটিক স্টাইলে। ওরা আছে কোথায়?
-আমায় জিজ্ঞেস করছিস কেন? তোর বন্ধু, তুই ভালো জানবি সেটা।
-ইশ! কোথাও কি যেন পুড়ে যাচ্ছে। এখান পর্যন্ত গন্ধ পাচ্ছি।
-কই আমি তো পাচ্ছি না।
রুবানা ফিক করে হেসে দিতেই রুমকি বুঝল রুবানা তাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলেছে। কপট রাগ দেখিয়ে রুমকি চলে যেতেই রুবানা অট্টহাসিতে ঘর মাতিয়ে তুলল।
……………
এদিকে তানজীদ বুঝে উঠতে পারছে না এমন একটা বোকামী সে কি করে করল। এতগুলো বছর রুমকির ব্যাপারটা ছাই চাপা আগুনের মতো চাপা পরে থাকলেও আজ যেন আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো হয়ে গেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় রুমকির ব্যাপারে কোন কিছু আর জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠেনি।
বাসায় এসে মনে হতেই একে একে পুরোনো সকল বন্ধু বান্ধবদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু করল। সেই ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় ওর বাবা ট্রান্সফার হয়ে যান। বন্ধু বান্ধব কারো সাথে তেমন যোগাযোগ নেই। এইদিকে ছুটিও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
দুইদিন পাগলের মতো ছুটোছুটি করে দু’একজন বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে রুবানার সম্পর্কে যতটুকু তথ্য যোগাড় করতে পেরেছে তা এক প্রকার কোনকিছু না পাওয়ার মতোই। তারপরেও সেসবের উপর নির্ভর করে আর কিছুটা আন্দাজের উপর শেষমেশ রুবানাকে খুঁজে বের করতে সফল হয়।
রুবানার তানজিদকে দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না এতোগুলো বছর পর তানজীদ কেন আজ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাই কথা না বাড়িয়ে তানজীদকে সরাসরি বাসায় নিয়ে আসে। উদ্দ্যেশ্য ওদের দুজনের মাঝে কিছুটা হলেও সখ্যতা গড়ে তোলা।
রুবানা বারবার রুমকিকে ওদের সাথে গল্প করার জন্য আসতে বললেও রুমকি এড়িয়ে গেল। কেবল সৌজন্য সাক্ষাতটুকু করে চলে গেল। তানজীদের কাছে রুমকির এমন আচরন নতুন কিছু নয়। একথা ওকথার পর নিজেই বলল
-তোর বোনটা সেই খারুসই রয়ে গেল। পাল্টায়নি স্বভাবে একটু। তবে আগের চেয়ে অনেক বেশী সুন্দর হয়েছে দেখতে।
রুবানা ভ্রুকুটি করতেই তানজীদ আবার বলে
-দেখ আমার কিন্তু সামনের সপ্তাহে শীপে জয়েন করতে হবে। হাতে সময় নেই। এবার গেলে কখন আসব তাও জানি না। তোর বোনের সাথে কথা বলার ব্যবস্থা করে দে, না হলে কিন্তু এক পাও নড়ছি না আমি। কত কষ্ট করে এই দুইদিন মাথার ঘাম পায়ে ঝরিয়ে তোকে খুঁজে পেয়েছি। এখন আমার এই উপকারটুকু কর।
-মা বাসায় আছে। আর রুমকিকেতো চিনিস। তোরে ধরে আবার দুইটা চড় লাগালেও অবাক হব না।
-যা খুশী করুক। তোর বোনেরে এবার ছাড়াছাড়ি নাই। দরকার হলে তুলে নিয়ে যাব।
-এবার কিন্তু বেশী বেশী হচ্ছে। ওর তো অন্য পছন্দ থাকতে পারে।
-না নেই।
-এতো শিউর হচ্ছিস কি করে?
-ওর চোখ দেখে। ওর চোখে কোনদিন এমনটা দেখিনি। কিন্তু সেদিন কি যেন একটা উচ্ছ্বাস দেখেছি এবং সেটা আমার জন্য ছিল। না হলে এমন পাগলের মতো খুঁজে বের করি?
-হুম, একটু বেশী বুঝে ফেলেছিস। পরে এমন ছ্যাকা খাবি তখন বুঝবি।
-ছ্যাকা খাওয়ার কিছু নেই। এখন পেচাল না পেরে প্রেমে সাহায্য কর।
-জো হুকুম জাহাপনা।
রুমকির রুমে যেতেই দেখতে পেল, রুমকি কি যেন একটা বই পড়ছে। গলা খাঁকারি দিতেই রুমকি ফিরে চাইল। তানজীদকে দেখে অবাক হলো না। যেন সে এই মুহূর্তে তানজীদকেই প্রত্যাশা করছিল।
চলবে……
পর্ব (৫)
ভীষন রকমের নির্লিপ্তভাবে চেয়ে রইল রুমকি। কিন্তু এই নির্লিপ্ততা তানজিদের মাঝে কোন পরিবর্তন আনতে পারল না। সে আজ যে উদ্দ্যেশ্যে এসেছে সফল হয়ে যাবে। পেছন ফিরে দেখল রুবানা দাঁড়িয়ে আছে। রুবানাকে চলে যেতে বলেই রুমকির উদ্দ্যেশ্যে বলল
-আমি জানতাম তুমি এমন নির্লিপ্ত থাকবে। ভাব এমন করছ যেন আমার আসা না আসায় তোমার কিছু যায় আসে না।
রুমকি অবাক হয়ে যায় তানজীদ আসলে কি করতে বা বলতে চাইছে। ছোটবেলা থেকে রুমকির রুমে এভাবে চলে আসা তানজীদের জন্য কোনো ব্যাপার নয়। আর নানান সময় সে রুমকির সাথে কথা বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি একবার রুমকির হাতে চড়ও খেয়েছে। কিন্তু আজকের এই তানজীদ আর সেদিনের সেই তানজীদের মাঝে যেন বিস্তর ফারাক। আর এই তানজীদকে মানা করার সাধ্য যেন আজ রুমকির নেই। তাই চুপচাপ শুনে যেতে লাগল কথাগুলো।
তানজীদ বলে যেতে লাগল
-একটা ছেলে যখন থেকে ভালোবাসা নামে যে একটা জিনিস আছে সেটা বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই একটা মেয়েকে ভালোবাসে। ঘরঘর খেলার সময় বউ হিসেবে যে মেয়েটি তার সাথে খেলা করত বাস্তব জীবনে নিজের পাশে সে মেয়েটিকে চাইতে লাগল। মেয়েটি তার বয়সে বড় কি ছোট কিছুই মাথায় এলো না। এটা কি ভীষণ দোষের কিছু?
এই বলে কিছুক্ষণ রুমকির দিকে চেয়ে রইল। কিন্তু রুমকি যেন আজ পণ করেছে সে কিছু বলবে না। অবশ্য তানজীদ রুমকি কিছু বলবে সে আশাও করছে না। নিজের মতো করে আবার বলে যেতে লাগল
-মেয়েটি ব্যাপারটা জানার পর ভীষণ রকমের ভৎর্সনা করল। বাসায়ও কি করে যেন জানতে পেরে গিয়ে বাবা তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিল। প্রচণ্ড রকমের অভিমানে ছেলেটি সিদ্ধান্ত নেয় মেয়েটির সামনে আর যাবে না। কিন্তু চলে যাবার দিন যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল ছেলেটি নিজের মাঝে আর স্থির থাকতে পারে না। মেয়েটির সাথে দেখা করার জন্য চলে যায়। কিন্তু মেয়েটি এবারও তাকে ফিরিয়ে দেয়। প্রচন্ড অভিমানে ছেলেটি আর মেয়েটির সাথে দেখা করেনি। একতরফা ভালোবাসাকে দাফন করে দেয় মনের মাঝে। হঠাৎ অনেক বছর পর কাকতালীয়ভাবে মেয়েটির সাথে আবার দেখা হয় ছেলেটির। এবার ছেলেটি মেয়েটির চোখে এক অদ্ভুত অনুরাগ দেখতে পেল। ছেলেটির আর বুঝতে বাকি নেই মুখে কিছু না বললেও মেয়েটিও তাকে ভালোবাসে। এটা জানার পর ছেলেটি সিদ্ধান্ত নেয় সে আর পিছু হটবে না। তার ভালোবাসা সে যেমন করেই হোক আদায় করে নিবে।
এইটুকু বলে রুমকির দিকে তাকিয়ে থাকে। রুমকি ঠিক আগের মতোই নির্বিকার। তানজীদ ভীষণ অবাক হয় একটা মানুষ এমন নির্লিপ্ত থাকে কি করে। আর এদিকে রুমকি ভীষণ অবাক হয় এই ভেবে এই ছেলে কি করে তার মনের অবস্থা বুঝে ফেলল? এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুটা সময়। তানজীদ বুঝতে পারছিল রুমকি আজ আর কিছু বলবে না তাকে, তাই বিদায় নিয়ে চলে গেল।
দুইদিন পর রুবানা হঠাৎ রুমকিকে ডেকে তার মোবাইলে কথা বলতে দিল। অপর দিকে অবশ্যই তানজীদ ছিল। এবার রুমকি বাধ্য কথা বলতে। যদিও বেশীরভাগ কথা তানজীদ বলছিল। তানজীদ ভীষণ করে দেখা করতে চাইছে। তিনদিন পর চলে যাবে। যাবার আগে একবার রুমকির সাথে দেখা করতে চায়। রুমকি অবশ্য হা না কিছুই বলেনি।
এদিকে রুবানা রুমকির উপর ভীষণ ক্ষ্যাপা। সে মনে আশেপাশেই কোথাও ওত পেতে ছিল। কথা শেষ হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে চোটপাট শুরু করল
-এসব কি? ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস কেন? এবার খুল্লাম খুল্লা কর। অনেক দিন তো হলো আর কত? আর আমার ফোনে এভাবে কল দিয়ে ফোন এঙ্গেজ করে রাখা যাবে না। নিজের ফোন নাম্বারটা দে।
-তুই কি আড়ি পেতে কথা শুনছিলি?
-শোন আড়ি পাতার দরকার আছে? আমার মোবাইলের ভয়েচ রেকর্ড অপশন অন করে দিলেই তো হয়ে যায়, তাই না?
রুমকি বোকার মতো বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। এ দেখে রুবানা বলে
-এমন করে তাকাতে হবে না আমি তানজীদকে তোর নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি।
এরপর শুরু হয় তানজীদের পাগলামি। এই পাগলামির কাছে হার মেনে অবশেষে রুমকি দেখা করার জন্য রাজি হয়।
………….
আর আটদশ জন দেখা করার জন্য বেছে নেয় কোন রেস্তোরেন্ট, পার্ক কিংবা শপিং মল। কিন্তু এই ছেলেটি কেমন অদ্ভুত। সে দেখা করার জন্য বেছে নিয়েছে একটা নার্সারী। রুমকি ভীষণ অবাক হয়। তানজীদ একটু ক্ষ্যাপাটে আছে এটা জানে কিন্তু তাই বলে এতোটা!
যাই হোক রুবানাকে ঝাড়ি দিতে দিতেই সে দেখা করতে যাচ্ছে। রুবানা কিছু বলে না কেবল মুচকি হাসে। সে জানে রুমকির এই ঝাড়ির পেছেনেও আহ্লাদ লুকিয়ে আছে। তানজীদ আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল রুমকির জন্য। রুমকিকে দেখেই দৌড়ে এলো।
রুমকির কেমন যেন একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। কেন এলো বুঝতে পারছে না। আবার তানজীদের জোরাজোরিতে না এসেও পারছিল না। সব জেনে এসেছে তার মানে এটা দাঁড়ায় সে তানজীদের আহবানে সাড়া দিচ্ছে।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করল তানজীদ। এই ছেলের অদ্ভুত এক ক্ষমতা, কিছু বলতে হয় না। সবকিছু কি করে যেন বুঝে যায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতেই যেন নিজের গল্প করছে। বাবার বদলী, নতুন জায়গা, নতুন মানুষ, মজার ঘটনা ইত্যাদি ইত্যাদি। হঠাৎ করে বলে বসল
-তোমার তো অনার্স শেষ। মাস্টার্স শেষ হতে আর বছর দেড়েক এরপর পরিকল্পনা কি?
-কি আর! জবের জন্য ট্রাই করব।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলে উঠল
-আর বিয়ে?
-ভাবিনি এখনো।
আবারো বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা। হঠাৎ কণ্ঠস্বর কেমন যেন ভারী শোনাল তানজীদের
-আমাকে দুবছর সময় দিবে? দুবছর পর আমি ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে জয়েন করতে পারব। তখন বাসায় প্রস্তাব পাঠাব। প্লিজ।
রুমকি কি বলবে? নিজের মাঝেই কেমন যেন ভাঙ্গা গড়া টের পাচ্ছিল। অনেক কষ্টে বলল
-জানিনা।
-এ কেমন কথা তুমি জান না? আচ্ছা ঠিক আছে। দুবছর লাগবে না, আমি পরশু চলে যাচ্ছি শীপে। একবছরে ছুটিছাটা কেমন পাই জানি না। তবে যদি আসতে পারি তখন অথবা একবছর পর এলে তখন তোমার বাসায় প্রস্তাব পাঠাব। তুমি এক বছরই ধরে নাও। এই একটা বছর আমার জন্য অপেক্ষা কর প্লিজ।
রমকি কোথায় যেন হারিয়ে গেল। কি এক ঘোরের মধ্যে আছে নিজেও বলতে পারবে না। কেবল মুখ থেকে গোঙানির মতো ‘হু’ বের হলো। তানজীদ যেন এই এক ‘হু’র মাঝেই সব উত্তর পেয়ে গেল। তার এখন বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দ।
সবাই তাদের বিশেষ দিনটাকে স্মরনীয় করে রাখার জন্য নানান কর্মকান্ড করে থাকে। তানজীদও এর ব্যাতিক্রম নয়। কিন্তু তার কার্যকলাপ অন্যদের চাইতে একটু আলাদা। নার্সারী থেকে একটা কদম ফুল আর একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ কিনে নার্সারীর প্রবেশদ্বারের দুইপাশে লাগিয়ে দিল।
রুমকি ভীষণ অবাক হলো তানজীদের এমন কাজে। রুমকির বিস্ময় বুঝতে পেরেই বলল
-বর্ষার দিনে কদম গাছটা যখন ফুলে ফুলে ভরে যাবে তখন তোমার সাথে এসে এই কদম গাছের নীচে এসে বসে থাকব।
-কৃষ্ণচুড়া কেন লাগিয়েছ তাহলে?
-তোমার লাল রঙ প্রিয় তাই।
-আমিতো কখনো তোমাকে বলিনি আমার লাল রং পছন্দ।
-সবকিছু বলতে হবে কেন? যে মেয়েটা অনেকগুলো রঙের মাঝে বেছে বেছে কেবল লাল রংয়ের জিনিসটাই নেয়, তাতে যতই খুঁত থাকুক না কেন তাহলে তার পছন্দের রঙ লাল না হয়ে কি হবে?
রুমকি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তানজীদের দিকে। এই ছেলেটা তাকে এতো ভালোবাসে! ভীষণ আফসোস হচ্ছে তার কেন এতোগুলো দিন পর তাদের দেখা হলো। তানজীদ আবার বলল
-কৃষ্ণচূড়া গাছটি লাগানোর আরেকটা কারন আছে। তুমি ভালো করে ভেবে দেখ নার্সারিটা ঠিক আমার বাসার কাছাকাছি। তুমি যখন বিয়ের পর বাসা থেকে বের হবে এই নার্সারিটার সামনে দিয়েই যেতে হবে। সিজনে রাস্তার উপর বিছিয়ে থাকা ফুলগুলো মাড়িয়ে যখন এই পথ দিয়ে যাবে তখন ভাববে আমি ভালোবেসে লাল গালিচা বিছিয়ে রেখেছি তোমার জন্য।
চলবে……
(অন্তিম পর্ব)
সেই আকুতি ভরা চোখ জোড়া রুমকিকে এতগুলো বছর তাড়া করে বেড়ালেও ভালোবাসা নামক জিনিসটার সাথে পরিচয় হয়নি তার। আজ বুঝতে পারছে এই মানুষটাকে সে প্রচণ্ড রকমের ভালোবাসে। এবং সেই ভালোবাসা আজ থেকে নয় ছোটবেলা থেকেই।
ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই রুমকিকে যেন বোবায় ধরল। কোন কথা না বলে কেবল তানজীদের কথাগুলো মন দিয়ে শুনল আর সেই সাথে অপলক দৃষ্টিতে তানজীদকে দেখতে লাগল। রোদে একেবারে লাল হয়ে আছে। ছেলে হিসেবে অনেক ফর্সা তানজীদ। কিন্তু এই ছেলেকে বাজে লাগে না বরং ভীষণ রকমের সুদর্শন লাগে কেবল এই ফর্সা রঙের জন্য।
কি যেন জাদু আছে এই ছেলের মাঝে। মুহূর্তেই যে কারো সাথে মিশে যেতে পারে, পলকেই যেন আপন করে নেয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে এই ছেলের মাঝে। অনেক ঘুরল, আড্ডা দিল। এরপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে রুমকিকে বাসায় নামিয়ে দিতে এলে রুমকি বেশ করে বলল বাসায় আসার জন্য। কিন্তু তানজীদ এলো না, কাজ আছে বলে চলে গেল।
রুমকি যখন বারেবারে বাসায় যাবার জন্য অনুরোধ করছিল তানজীদের আর কেন যেন ভীষণ সংকোচ বোধ হচ্ছিল অথচ কালও সে একটা ডাকের অপেক্ষায় ছিল। মানুষ মনে হয় পলকেই অনেক খানি পরিণত হয়ে যায়!
এরপর দুজনের যোগাযোগ হয়ে গেল মুঠোফোনের হাতে বন্ধী। বেশীরভাগ সময় তানজীদ নেটওয়ার্কের বাইরে থাকত। আট বছর চোখের পলকে কেটে গেলেও এখন এই এক বছর সময় যেন কাটতেই চায় না। সব মিলিয়ে দুজনের কারো সময় ভালো যাচ্ছিল না। এর মাঝে তানজীদ জানাল পরের মাসেই তাদের শীপ বাংলাদেশ আসছে। তখন সে কিছুদিন ছুটি পাবে।
দুজন মিলে কত প্ল্যান। রুমকির বাবা ইদানিং কেন যেন ওর বিয়ে নিয়ে উঠে পরে লেগেছেন। তানজীদ এই ব্যাপারটা নিয়ে ভীষণ অস্থিরতায় আছে। প্রথমত তার এখনো ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে জয়েন করার অনেক বাকি। কি বলে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে রুমকির বাসায়? অবশ্য ওর বাবা মা শুরুতে আপত্তি জানালেও ওর পছন্দের কথা জেনে না করবেন না। কিন্তু রুমকির বাসায় কি করে কি হবে? রুমকি ওর বাবা মা কে কিছু জানানোর সাহস পাচ্ছে না এই ব্যাপারে। বয়সে ছোট ছেলে শুনে ওর বাবা মা শুরুতেই বেঁকে বসবেন।
তানজীদের সাথে কথা হয়েছে প্রায় সপ্তাহ খানেক। ও বারবার বলছিল সামনে কিছুদিন নেটওয়ার্কের বাইরে থাকবে। প্রায় এমন হয়। কিন্তু কখনো রুমকির এমন লাগে না। দুইতিনদিন ধরে কেমন যেন অস্থির লাগছে রুমকির। ঘুমুতে পারছে না ঠিক মতো, খাওয়ার রুচি নেই, রাতে কেবল তানজীদকে স্বপ্ন দেখে। সারাদিন মোবাইল নিয়ে বসে থাকে, পাছে তানজীদ কল বা মেসেজ দেয়।
এমনি এক সময় হঠাৎ তানজীদের কল পেল। খুশীতে আত্মহারা মন ময়ূরের মতো পেখম মেলে নাচতে শুরু করল। রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে তানজীদের উৎকণ্ঠিত কন্ঠ শুনতে পেল।
রুমকি কিছু বলতে যাবে কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে বলতে লাগল
-শোন ভালো করে। আমরা ঝড়ের কবলে পড়েছি। একটু আগে নেটওয়ার্ক পেয়েছি। পেয়েই প্রথমে আব্বু আম্মুকে কল দিয়েছি এখন তোমাকে। বেঁচে থাকলে দেখা হবে। আর না থাকলে ভুলে যেও। সব কিছু ভুলে নতুন জীবন শুরু করো।
এই কথাটুকুই কেবল শুনতে পেল রুমকি। এরপর তানজীদ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় লাইন কেটে গেল। রুমকি যেন নির্বাক হয়ে গেল। এ কি শুনল সে? কেবল সবে স্বপ্ন বোনা শুরু করেছে, এরমাঝে এসব কি বলল তানজীদ। ভুলে যাবে মানে? সব কিছু কি এতো সহজ?
সারারাত মোবাইল হাতে নিয়ে ঠাই বসে ছিল আর একটু পরপর তানজীদের নাম্বারে কল করছিল। কিন্তু লাইন পাচ্ছে না।
তানজীদের কোন খবর পাওয়া যায়নি। ডুবন্ত শীপ উদ্ধার করা হয়েছে। অনেকের মৃতদেহ মিলেছে, সৌভাগ্যবান দুই একজনকে অবশ্য মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। আর তানজীদের মতো অনেকেই নিখোঁজ রয়েছে।
পুরো পরিবারে যেন শোকের ছায়া নেমে এসেছে। রুমকির অস্বাভাবিকতা দেখে যখন ওর বাবা মা কিছু বুঝতে পারছিল না তখন রুবানা সব জানায়। এতে করে একটা উপকার হয় রুমকির বাবা ওর বিয়ের বিষয়টা আপাতত বন্ধ রাখেন। রুমকিকে স্বাভাবিক হতে সময় দেন।
কিন্তু রুমকি কেন যেন স্বাভাবিক হতে পারে না। মাঝ রাতে প্রায় তার ঘুম ভেঙ্গে যেন তানজীদের কণ্ঠ শুনতে পায়। সেই নার্সারির সামনে দিয়ে যাবার সময় গাছগুলো দেখে। ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে গাছগুলো। এটাই তো হওয়া উচিৎ। সময়ে্র সাথে সাথে সবকিছু পরিবর্তন হবে। গাছগুলোতে একসময় ফুল আসবে। কি করবে রুমকি তখন?
বাবা মায়ের অনেক অনুরোধ, বকাঝকা সব কিছু উপেক্ষা করে যাচ্ছে। সে কিছুতেই তানজীদকে তার মন থেকে সরাতে পারছে না। বলতে গেলে সেই একদিনের দেখা, আর কয়মাস ফোনে টুকটাক কথা। এতেই এতো মায়া জন্মায় কি করে? আসলেই কি মায়া? না ভালোবাসা?
আত্মীয়স্বজন সবাই অনেক করে বুঝিয়েছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। রুমকির সেই এক কথা তানজীদের লাশ তো পাওয়া যায়নি। এমনও হতে পারে সে বেঁচে আছে। কোন একদিন ফিরে আসবে। তখন? তখন রুমকি কি জবাব দিবে ওকে?
সবাই অনেক করে বুঝাল, পুকুরে ডুবে গেলেও একটা সময় পর আর আশা করা যায় না, আর তানজীদ ছিল মাঝ সমুদ্রে তাও আবার ঝড়ের মাঝে। কিন্তু রুমকি কোন কিছু মানতে নারাজ। সে কোন যুক্তির ধার ধারে না। ওর বাবাও হাল ছেড়ে দিয়েছেন। মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কেন যেন যেতে ইচ্ছে হয়নি উনার আর। ছোট মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করতে লাগলেন।
আর রুমকি? সে ঝুম বৃষ্টিতে সেই কদম গাছের নীচে বসে অপেক্ষায় থাকে হয়তো তানজীদ আসবে এই ঝড় মাথায় করে। এসেই তার সাথে ভীষণ রাগ দেখাবে এমন ঝড়ের মাঝে বসে থাকার জন্য। অপেক্ষায় থাকে রুমকি অন্তত রাগ দেখানোর জন্য হলেও মানুষটা আসুক। একবার হলেও আসুক।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..