ভয়ংকর এক বৈশাখি ঝড় বৃষ্টির রাতে শফিক সাহেব আর নাজনীন আরা বাবা-মা হন। আবহাওয়ার কারনে তাদের হাসপাতালে আসতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারপরও আল্লাহর অশেষ রহমতে ডাক্তার শেষ পর্যন্ত একটা ভাল খবর দিতে পেরেছিলেন।
–কনগ্রাচুলেশন। আপনার একটি মেয়ে হয়েছে। মা আর বাচ্চা দু’জনই সুস্হ আছে। আপনার মেয়েটা একটা ফাইটার। আমরা তো অনেকটা আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু আপনার ফাইটার মেয়ে ফাইট করে টিকে থেকেছে।
ডাক্তারের কথায় সেদিন শফিক সাহেব আর নাজনীন আরা ব্যাখার অতীত খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু আজ মেয়ের ফাইটার রুপ দেখে ওনাদের আর এত খুশি লাগে না। ভয় লাগে, দুশ্চিন্তা হয়। সারাক্ষণ অজানা আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে থাকেন তারা।
বৈশাখে মেয়ের জন্ম বলে নাম দেয়া হলো ‘বৈশাখি’। সেদিন যে নামটাকে মেয়ের জন্য সবচেয়ে সঠিক মনে হয়েছে, আজ সেটা ভুল মনে হয়। “মানুষের নাম তার স্বভাবের উপর প্রভাব ফেলে।” ওনারা এখন সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
মনে হয় নামের প্রভাবের কারনেই মেয়েটা একদিকে যেমন সব সামাজিক জরা-ব্যাধি দূর করার চেষ্টা করছে অন্যদিকে তেমনি এসব করতে যেয়ে যখন তখন বৈশাখি ঝড় তুলছে বাব-মার মনে কিংবা এদিক সেদিক।
বৈশাখির বাবা-মা সেদিন বহু প্রতীক্ষিত মেয়েকে দেখে যে পরিমান খুশি হয়েছিলেন আজকে তারচেয়ে শতগুণ বেশী চিন্তিত। ওনাদের মেয়ে বৈশাখি ছোটবেলা থেকেই খুব প্রতিবাদী। কোথাও কোন অন্যায় বা খারাপ কাজ দেখে চুপ করে থাকতে পারে না। সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য সাহসী পদক্ষেপ নিতেও দ্বিধা করে না। ওর ভীতু বাবা-মা বুঝে পায় না যে, ওনাদের মেয়ে হয়ে বৈশাখি এত সাহস কোথায় পায়! “নিশ্চয় নামটারই দোষ” ওর মা প্রায়ই বলেন।
সেই ছোটবেলা থেকেই কোথাও কোন অন্যায় কথা শুনলে বা দেখলে বৈশাখি সেখানে ঝাপিয়ে পড়বেই। স্কুলে কিংবা পাড়াতে খেলার সময় প্রায়ই ঝগড়া কিংবা মারামরিতে জড়িয়ে পড়ত বৈশাখি। ঝগড়া-মারামরি মেটাতে গিয়ে দেখা যেত মেয়েটা কারো কোন খারাপ কথা বা কাজের প্রতিবাদে জড়িয়ে ঝগড়া বা মারামারি করছে। মেয়েটা শুধু যে নিজের জন্যই প্রতিবাদ করে তা নয়। যে কোন মানুষের জন্য ওর একই প্রতিক্রিয়া। বড় হতে হতে ঝগড়া মারামারি কমেছে, হাত পায়ের ব্যবহার কমেছে কিন্তু মুখের সাহায্যে কাটা কাটা সত্যি কথা বলা, নিজের মনের কথাগুলো ঠাস ঠাস করে বলে দেয়া কিংবা কারো অন্যায় দাবিকে প্রশ্রয় না দেয়া অনেক বেড়েছে। কাউকে খুশি করার জন্য হলেও সে এসব করতে পারে না। থাকুক সেখানে খারাপ পরিনামের সম্ভাবনা কিংবা হোক সে মানুষ ওর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বা প্রয়োজনীয়।
মেয়েকে নিয়ে শফিক সাহেব আর নাজনীন আরার চিন্তার অন্ত নেই। বৈশাখির পড়ালেখা শেষের পথে। বাব-মা চান মেয়ের বিয়ে দিতে। পর পর তিনটা সম্বন্ধ বৈশাখির জন্যই ভেঙেছে
প্রথমবার
সমস্যা হলো পোশাক নিয়ে। বৈশাখি কিছুতেই শাড়ী পরবে না। সালোয়ার কামিজ পরেই পাত্রপক্ষের সামনে গেল। মেয়ে দেখতে এসে ছেলে পক্ষের এক মুরুব্বীও বিষয়টি ধরে বসলেন।
–মা তুমি শাড়ী পরনি কেন?
–শাড়ী পরতে কঠিন লাগে। তাছাড়া সব সময় যেভাবে থাকি সেভাবেই আপনাদের সামনে আসা ভাল। তাইনা?
–আমাদের বাড়ির রীতি হলো বিয়ের পর শাড়ী ছাড়া অন্য কোন পোশাক পরতে পারবে না। তোমার কোন অসুবিধা নেই তো?
–এ আবার কেমন রীতি! হ্যা আমার কিছু অসুবিধা আছে।
এরকম বেয়াড়া ধরনের উত্তর শুনে ছেলেপক্ষ আর বেশিদূর আগাল না।
দ্বিতীয়বার,
বৈশাখীর কাছে হবু শ্বশুরের কাছ থেকে প্রশ্ন এল রান্না নিয়ে। বৈশাখির উত্তরে বিয়ে ভেঙে গেল। ও বলেছিল,
–আমি রান্না করতে পারিনা। আমার রান্না করতে ভাল লাগে না। আপনার ছেলে কি রান্না করতে পারে?
ওর কথা শুনে সেই পরিবারটির আক্কেল গুড়ুম! তারা চলে গেল। বৈশাখির কান্ড দেখে ওর মা কাঁদতে বসল আর বাবাও উদাস। এদিকে বৈশাখি বুঝতেও পারছিল না ওর দোষ কোথায়! ওরা যতগুলো প্রশ্ন করেছে সবগুলোর উত্তর ও দিয়েছে। ও একটা প্রশ্ন করছে তাতে ওদের নেগেটিভ হয়ে যাওয়ার কারন বুঝতে পারল না মেয়েটা।
তৃতীয়বার,
বিয়ে ভাঙল চাকরি নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে। এইবার হবু শ্বাশুরি জিজ্ঞেস করল,
–মা তুমি পড়ালেখা শেষ করে কি চাকরি করবে?
–এখনও কিছু ঠিক করিনি।
–আমরা এ বিষয়টা একটু ক্লিয়ার হতে চাইছিলাম।
–পড়ালেখা শেষ করে সিদ্ধান্ত নিব। তবে, বিয়ের পরেও এটা আমার ব্যক্তিগত পছন্দ থাকবে। আমি চাকরি করতে চাইলে কেউ আমাকে বাঁধা দিতে পারবে না আবার করতে না চাইলে কেউ আমাকে জোর করে চাকরিতে পাঠাতে পারবে না। তাছাড়া সংসারের সব আর্থিক দায়িত্ব নিতে হবে আপনার ছেলেকে।
কিন্তু চতুর্থবার,
পাওয়া গেল অত্যন্ত আধুনিক ও বিশাল মনা পরিবার। যেমন বাবা-মা তেমনি তাদের ছেলে। বৈশাখিকে তারা এমন কোন প্রশ্নই করল না যা থেকে বৈশাখি কোন সোজাসাপ্টা বা কাটা কাটা জবাব দিতে পারে।
বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। পাত্র অল্প বয়সেই বেশ উচ্চ পদস্হ কর্মকর্তা। তার অফিসের সবচেয়ে বড়কর্তা। দেখতে বেশ সুপুরুষ। ব্যবহারে অতি অমায়িক। ভদ্র, নম্র ও আদব-কায়দা জানা। বাবা হবু জামাই এর অফিসে খোঁজ নিতে গেলেন। সেখান থেকেও ভাল রিপোর্ট। বৈশাখির সহজ-সরল, বোকা বাবা-মা একবারও চিন্তা করল না যে, ‘অফিসের বড় কর্তার বিষয়ে খারাপ রিপোর্ট না আসারও কথা।’
বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে বৈশাখির বাবা-মা খুশিতে পাগল প্রায়। এবার সব কিছু অন্যরকম ও ঠিকঠাক মত আগাচ্ছে। বিশেষ করে মা, প্রতিদিন আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, “মেয়ের বিয়েটা যেন ভালয় ভালয় হয়ে যায়”। উনি এই দোয়াটার সাথে যদি আরও কিছু দরকারী দোয়া করতেন তাহলে বেশি ভাল হোত। যেমন: “হবু জামাইটি বাইরে থেকে দেখতে যেরকম, সত্যিই যেন সেরকম হয় কিংবা হবু জামাই বা তার পরিবারের ভয়ংকর কোন লুকায়িত সত্য থাকলে তা যেন বিয়ের আগেই বের হয়ে আসে।” উনি এসব না করে প্রতিদিন শুধু বিয়ে হয়ে যাবার দোয়া করতে থাকলেন।
হবু স্বামী বৈশাখির বিষয়ে বেশ আগ্রহী। প্রায় প্রতিদিন একবার হলেও ফোনে কথা বলে। খোঁজ খবর নেয়। তার আচার, ব্যবহার, কথা বার্তা সবই খুব ভাল লাগার মত। বৈশাখির জীবনে এই প্রথম কেউ ওর ভিন্ন ধারার কথাবার্তা ও ব্যবহারকে এ্যাপ্রিশিয়েট করতে লাগল। মেয়েটাও ধীরে ধীরে হবু স্বামীটির পছন্দ করতে লাগল।
বিয়ের তারিখ অনুযায়ী আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাকি।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বৈশাখি একটা ফোন পাচ্ছে ওর ব্যক্তিগত ফোনে। অপরপ্রান্ত থেকে চাপা গলায় একটা মেয়ে কথা বলে। তার বক্তব্য অনুযায়ী,
“বৈশাখির হবু স্বামীটির চারিত্রিক সমস্যা আছে। সে তার অফিসের মহিলা কর্মচারীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্হাপন রাখে। ফোনের মেয়েটাও তাদেরই একজন। অফিস কর্মচারীদের সে এসব কাজে বাধ্য করে। শুধু তাই না, অফিসের বাইরেও তার একাধিক মহিলার সাথে শারীরিক সম্পর্ক আছে।”
বৈশাখি সেই মেয়েটার সাথে দেখা করতে চাইল, সামনে সামনি কথা বলতে চাইল, মেয়েটাকে সাহায্য করতে চাইল কিন্তু মেয়েটা সাহস করে উঠল না।
বৈশাখি একটা সত্য-অসত্যের সংশয়ের মধ্যে সময় কাটাতে কাটাতে হঠাৎই একদিন হবু স্বামীর কাছ থেকে প্রস্তাব পেল তাদের ফ্ল্যাটে যাবার।
–বৈশাখি আমাদের ফ্ল্যাটে একদিন আস। আমরা একসাথে প্রাইভেট সময় কাটাতে পারব।
–ওখানে আমাদের বাব-মায়েরা থাকবেন। প্রাইভেট টাইম আবার কোথা থেকে?
–না। তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ থাকবে না। বাবা-মা এখন গ্রামের বাড়িতে গেছেন।
–ওহ, আমি ভেবেছিলাম তুমি বলছ, আমি আমার বাব-মায়ের সাথে যাব। তোমার বাবা-মাও থাকবে।
–না। শুধু তুমি আর আমি।
–তোমাদের খালি ফ্ল্যাটে আমাকে যেতে বলছ?
–হ্যা।
–সম্ভব না। একেবারে বিয়ের পর।
এরপরও হবু স্বামীটি বারবার বলতে থাকে বৈশাখিকে। বৈশাখির রাজি না হওয়া তাকে রাগান্বিত করে। সে বলতে চায় যে, “বৈশাখি তাকে ভালবাসে না, তাকে খুশী করতে চায় না বা তার সাথে একান্তে সময় কাটাতে চায় না”
হবু স্বামীটি অসন্ষ্ট হয়ে বৈশাখির সাথে কথা বলা কমিয়ে দেয়। তার রাগ বা আবেগঘন কথায় বৈশাখির মন তেমন গলে না।
বরং সে তার চিন্তার মোড় ঘোরায়। ফোনের মেয়েটার সাথে কথা বলে আরও কিছু তথ্য বের করে। পহেলা বৈশাখের দিন, হবু স্বামীর ফ্ল্যাটে যায়। তবে, ভিতরে না বাইরে। সবাই যখন পহেলাহেলা বৈশাখের উৎসব আনন্দ নিয়ে ব্যস্ত, বৈশাখি ব্যস্ত একজন মুখোশধারীর মুখোশ উন্মোচনে।
খুব ভোরেই ফ্ল্যাটের বাইরে ব্যক্তিগত শখের ক্যামেরা হাতে পৌঁছে যায় বৈশাখী। ওর চোখ হবু স্বামীটির ফ্ল্যাটের দিকে। সকাল ১০টা অবধি ওখানে কাউকে ঢুকতে দেখা যায় না। কিন্তু বের হতে দেখা যায় এক মেয়েকে। মেয়েটি এদিক সেদিক দেখে চলে যায়। হবু স্বামীটি বের হয় ২০/৩০ মিনিট পর। পহেলা বৈশাখ উদযাপনের পোশাকে। চোখে কালো চশমা।
ভোরের আলো ফোটার আগে মেয়েটা অন্য কোন জায়গা থেকে আসেনি অর্থাৎ রাতে এখানেই ছিল। ফোনের মেয়েটাও এরকমই বলছিল। ওরা চলে যাওয়ার পরও
বৈশাখি সারাদিন সেখানেই থাকে। ওর আরও নিশ্চিত হওয়া দরকার।
বিকেল নাগাদ আকাশ কালো করে বাতাসের সাথে ঝড় উঠে। হয়ত ঝড় ওঠার কারনেই হবু স্বামীটি ফিরে এসেছে। এবার সাথে আরেক মেয়ে।
বৈশাখির মনের আকাশেও ঝড় উঠল। মনে প্রানে চাইছিল যেন ফোনের মেয়েটার কথা মিথ্যা হয়। হলোনা। ওর মনের অবস্হাও হলো আকাশেরই মত। কালো, কান্না কান্না। কিন্তু সেটা কান্না না হয়ে পরিনত হলো ঝডো বাতাসে। যে বাতাস দূর করে নিয়ে যেতে পারে পুরনো ভুল, জরা, ব্যধি আর গ্লানিকে। ও হবু স্বামীটির বসের সাথে যোগাযোগ করে রেখেছিল। বসটিকে ফোনের মেয়েটির রেকর্ড করা কথা এবং নিজের তোলা ছবিগুলো দিল। বস বোধহয় আরও কিছু ইনভেস্টিগেশন করার উদ্দেশ্যে ফ্ল্যাটেও গেলেন। তারপর হবু স্বামীটি চাকরী হারিয়েছিল আর বেঁচে গিয়েছিল অফিসের মেয়েগুলো।
সেদিন বৈশাখির চোখ খুব জ্বালা করলেও, নিজেকে সামলে নিয়েছিল। ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বাসায় ফিরেছিল কাকভেজা হয়ে। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত বৈশাখি যদিও পথের মাঝেই হবু স্বামীটির জন্য সব আবেগে ধুয়ে এসেছে তারপরও বাবার বুকে মাথা রেখে ওর মনটা হু হু করে উঠল। বাবা তার প্রিয় মেয়ের মনের অবস্হা বুঝে জড়িয়ে রাখলেন বুকের সাথে। হোক তার মেয়ে ফাইটার, তারপরও তো সে রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। অনুভূতি আর আবেগে ভরা।
বৈশাখির বিয়ে ভেঙে গেল। সমাজের চোখে এবারও ওর কারনেই বিয়ে ভেঙেছে। বেয়াড়া, মুখরা, বোকা, মেয়ে হিসেবে ওর নামটা আরেকটি পাকা হলো।
চতূর্থ বিয়ে ভাঙার পর বৈশাখির মা হাপুস নয়নে কাঁদলেন।
প্রতিবার বিয়ে ভাঙার পরই বৈশাখির মা নাজনীন আরা বেশ কান্নাকাটি করেন। বাবা-মেয়ে ওনার কান্না থামায়।
কিন্তু এবার বৈশাখি বা শফিক সাহেব নাজনিন আরাকে থামাতে গেল না। তাদের মনে হলো, সারাজীবন কান্নার চেয়ে একদিন কান্না বরং ভাল।
আজ বরং বাবার মনে গর্ব। ওনার মেয়ের জন্য আরও কতগুলো মেয়ে রক্ষা পেল অপমান আর অত্যাচার থেকে। আজকের ঝড়ের দিকে তাকিয়ে শফিক সাহেবের মনে হচ্ছে, “মেয়ের বৈশাখি নাম যেন সার্থক”
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply