বাবা মারা গেছে আজ ক’দিন হল। পুরো বাড়ি জুড়ে এখনও শোকের ছায়া। জীবন থেমে থাকেনি। মা রান্না ঘরে রুটি বানাতে বানাতে শাড়ির আচল দিয়ে চোখ মুছছে। আমি দূরে বসে ভাজির জন্য সব্জি কাটছি।
” মা, আপনি রেস্ট নিন, আমি সব্জি কেটে রুটি গুলো বেলে নিব।”
“না, তুমি তোমার হাতের কাজ শেষ করে ঘরে যাও, ওরা কি করছে গিয়ে দেখ”
ছোট আরও দুটো ভাইবোন আছে। ওরা বাবার শোকটা তেমন বুঝতে পারছে না। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। আর বাবাই বড় বোনের বিয়ে দিয়ে গেছেন।
পুরো সংসার কিভাবে চলবে, মা এ নিয়ে ভীষণ চিন্তায় আছে। বাবার অফিস থেকে সামান্য কিছু পাওয়া যাবে কিন্তু কবে তার ঠিক নেই। বাবা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করত।
আমি দশম শ্রেণিতে উঠেছি মাত্র। খুব যে একটা বুঝতে পারি , তা নয়। কষ্টটা বুঝতে পারছি কিন্তু কি করব, জানি না।
খুব সকালে পাশের বাসার এক আন্টি এসে হাজির।
“মুক্তির মা, কি করবে, ঠিক করেছো?”
চোখ মুছতে মুছতে মা উত্তর দিল।
“এত ভেঙে পড় না, আল্লাহ ভরসা, তোমার মেজ মেয়ে তো লেখাপড়ায় বেশ ভালো, আমার মেয়েটাকে পড়াতে পারবে? আমি তো আগেও বলেছি একথা। যদি পারে, আমাকে জানিও”
প্রতিবেশি বলে নয়, উনি আমাদের সব সময় খোঁজ খবর নেয়। অনেক ভালো। বাবা কখনও চাইতেন না, পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছু করি। বাবা অনেক কষ্ট করতেন। আর মা, সারাদিন কাজ শেষে রাতে বসে সেলাই করতেন। ক্লান্তি মাকে কখনও স্পর্শ করেনি কিন্তু বাবা চলে যাবার পর থেকে মা মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছেন। যদিও বুঝতে দেন না কিছুই, কিন্তু আমি অন্তত সব বুঝতে পারি।
আমি সাথে সাথেই বললাম, ” আন্টি আমি কাল থেকেই পড়াব, কোন অসুবিধে নেই। “
“না, না, ক’দিন যাক, যখন ভালো লাগবে, শুরু কর। তাড়াহুড়োর কিছু নেই, আর তুমি যেহেতু এখন বড়, মাকে দেখে রেখো। আজ আসি আপা, কোন চিন্তা করবেন না। যে কোন প্রয়োজনে ডাকবেন।”
“মা এত চিন্তা করছো কেন, একটা ব্যবস্হা হবে।”
মা আবারও চোখ মুছলেন। এই ক’টা দিনে মা যেন অনেক বুড়ো হয়ে গেছেন, আর সেই সাথে বেশ অসুস্থও মনে হচ্ছে।
মা কাজ শেষ করে ঘরে গিয়ে বসলেন।
” নিলা আমাকে কি একটু পানি খাওয়াবি মা”
আমি দৌড়ে পানি নিয়ে গেলাম। মা খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। বুঝতে বাকি রইল না, মার ভালো লাগছে না। আমি ফেনটা ছেড়ে দেই। মার কিনারে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া মাত্র মা চোখ বন্ধ করলেন।
ছোট ভাই বোনকে রুটি আর ভাজি খেতে দেই। মার জন্য রেখে নিজে একটু খেয়ে নেই। মাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। দুপুরের খাবারের ব্যবস্হা করতে চলে যাই। মা একটু রেস্ট নেক।
মাসের শেষ। মার হাতে তেমন কিছু আছে বলে মনে হয় না। সামনের দিন গুলো কিভাবে যাবে, আসলেই চিন্তার বিষয়। না, আজই কাজ শেষ করে রুনাকে পড়ানো শুরু করে দিবে।
দুপুরের খাবার তৈরি করে মাকে ডেকে তুলি।
“মা, তুমি এখন একটু খেয়ে নাও”
“দিয়েছি, তুমি চিন্তা কর না”
খেয়ে মাকে বললাম, ” মা, আজ থেকেই রুনাকে পড়ানো শুরু করতে চাই”
মা কিছু বললেন না, আর কিবা বলার আছে।
“এখনই যাবি?”
“হা”
“আচ্ছা শেষ করে দেরি করিস না”
” না, মা”
আমাদের বাসার খুব কাছেই। পাঁচ মিনিটের পথ।
বেড়িয়ে পড়লাম।
” কি, মা, আজ থেকেই শুরু করবে??”
বলেই আন্টি মাথায় হাত রাখল। চোখে পানি এসে পড়ল।
” মন শক্ত কর, তোমার এখন অনেক দায়িত্ব, ভেঙে পড়লে চলবে কিভাবে “
চোখ মুছে নিলাম।
আন্টি ভিতরে নিয়ে গেলেন। রুনাকে তৈরি হতে বললেন।
রুনা ক্লাস ফাইভে পড়ে। ছাত্রী ভালোই। একটু কথা বলে বেশি, এই সমস্যা।
” আপু, আজ এত পড়ব না৷ গল্প করব।”
” কোন অসুবিধে নেই, তবে আগে একটু পড়ে নিব”
রুনা বই খুলে বসল। এক এক করে সব বিষয় একটু একটু করে পড়ালাম।
যথারীতি একটু গল্প করতেই হল। শেষে বিদায়ের সময় আন্টি এসে আমার হাতে পাঁচশত টাকার একটি নোট গুজে দিলেন।
আমি খুব ইতস্তত , “আন্টি আমি তো আজই কেবল শুরু করলাম মাএ”
বললেন, ” এটা এমনিই, মাকে নিয়ে দিও”
টাকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। একটু খারাপ লাগছিল।
মাকে গিয়ে টাকাটা দিলাম। ” আমি চাইনি, আন্টি এমনিতেই দিল, তোমাকে দিতে বলল”
মা টাকাটা নিল, কিন্তু আবারও চোখ মুছলেন।
রাতের খাবারের আয়োজন শুরু করলাম। তেমন কিছু না। ভাত আলু ভর্তা আর ডাল। আগামী মাসে কিভাবে চলব, তা নিয়ে আমিও চিন্তিত। তারপরও মাকে বার বারই বলছি, ” চিন্তা কর না মা, আল্লাহ ভরসা।” কিন্তু চিন্তা এসে যায়। আরও ক’টা টিউশনি পেলে সব কিছু একটু সহজ হবে। আত্নীয় স্বজনও তেমন কেও নেই যে সাহায্য করবে। যাদের আছে, তারা ইতিমধ্যেই সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
এভাবে চলছিল কিছু দিন। বাবার অফিস থেকে সামান্য কিছু পাওয়া গেছে। মা ওটা ব্যাংকে রেখে দিয়েছেন। মাসিক কিছু টাকা অন্তত আসবে।
রুনাকে পড়াতে পড়াতে আন্টি ওনার ছোট ছেলেকেও পড়াতে বললেন। মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ বললাম। আন্টি অনেক ভালো মনের মানুষ। যা দিবে, তা দিয়ে বাজার খরচটা চলে যাবে। আসলেই ওনার মত মানুষ আজকাল চিন্তা করা যায় না। মা আর আমি সব সময় ওনার জন্য দোয়া করি।
এদিকে আমার এস এস সি পরীক্ষা খুব কাছে এসে গেছে। সারাদিন স্কুল শেষ করে প্রাইভেট পড়িয়ে রাতে পড়তে বসি। অনেক সময় মাও আমার সাথে বসে রাত জেগে সেলাই করে। আমি মানা করি কিন্তু মা কিছুতেই শুনতে নারাজ। মোটামুটি আল্লাহ চালিয়ে নিচ্ছিল।
কিন্তু পরীক্ষার কারণে পড়ার সময় অনেক দেয়া দরকার। কি করব, চিন্তা করছিলাম। রুনাকে পড়াতে আসার সময় এখন বই নিয়ে আসছি। বেশ কিছুটা সময় এখানে থাকি, সাথে নিজেরও কিছু পড়া তৈরি করে নেই।
মা বললেন, “পরীক্ষার আর এক মাস আছে, তুমি টিউশনি গুলো আপাতত বাদ দাও। পরীক্ষার পর আবার কর”
” না, মা, আমার কোন অসুবিধে হচ্ছে না, হলে আমি নিজেই বাদ দিব, তাছাড়া পরীক্ষার এক মাস তো ঠিকভাবে পড়াতে পারব না”
পরীক্ষা খুব কাছে এসে গেল। মনে মনে বেশ খানিকটা ভয় কাজ করছে। বাবার কথা খুব মনে পড়ে। বাবা থাকলে আজ সব কিছু অন্য রকম হত। বড় বোন মাসে মাসে কিছু দেয়। এ মাসে পরীক্ষার জন্য আমাকে কিছু টাকা দিয়ে গেছে। বড় বোনর কিছু দিন আগে একটা স্কুলে চাকুরী হয়েছে। এখন ও মাসে কিছু টাকা মার হাতে দিয়ে যায়।
আমাকে বলে গেল, ” নিলা, দেখ, বাবার অনেক ইচ্ছে ছিল তোকে নিয়ে, বাবার সেই ইচ্ছে পূরণ করিস। প্রাইভেট আপাতত বাদ দে, তোর উপর অনেক ধকল যাচ্ছে”
“আপু, আমার সমস্যা হচ্ছে না, হলে ছেড়ে দিব, তুমি চিন্তা কর না”
পাশের আন্টি নিজেই বললেন, ” মা, তোমার পরীক্ষা খুব কাছেই, এখন পড়ানোর দরকার নেই। “
” না, আন্টি, অসুবিধে হলে আমি বলব, আপনি চিন্তা করবেন না।”
পরীক্ষার এক দিন আগে আন্টি এসে দু’মাসের টাকা মার হাতে দিয়ে গেলেন। মা এক মাসেরটা রেখে আরেক মাসেরটা ফেরত দেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু আন্টি কিছুতেই তা নিবে না।
” আমি ওটা নিলার জন্য দিলাম। ওর মত মেয়ে যেন আল্লাহ সব ঘরে ঘরে দেন, এত ভালো মেয়ে এখন দেখি না। ওকে দেখলেই চোখটা জুড়িয়ে যায়, ও অনেক বড় হবে, দেখে নিও মুক্তির (বড় আপুর নাম) মা”
” আপা, দোয়া করো, মেয়েটা অনেক কষ্ট করছে, ওর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে। “
” তুমি চিন্তা কর না, আল্লাহ অবশ্যই তোমার সহায় হবে”
” আপা, তুমি যা করেছো, সেই ঋণ আমি কোনদিনও শোধ করতে পারব না৷ আপন মানুষও তা করে না”
“না, তেমন কিছু না, তুমি তো আমার প্রতিবেশী, অনেক কিছু করার ছিল আমার, আমি কিছুই করতে পারি নাই, যেটা করেছি, তা খুব সামান্য।”
“আপা, এভাবে বল না, আজকাল খুব কাছের মানুষও তা করে না, বিপদ দেখলে মুখ সরিয়ে নেয়, আল্লাহ তোমার ভালো করুক”
পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। সব গুলোই ভালো হয়েছে, যতগুলো এ পযর্ন্ত হয়েছে। আর আছে ২ টা। অংক আর জীববিজ্ঞান।
অংক পরীক্ষার আগের রাতে শুরু হল বমি। সারারাত এভাবে চলল। মা ডাক্তার ডেকে আনল। ডাক্তার বমির মেডিসিন দিল। বমি কমলেও রাতে তেমন রিভিশন দেয়া হল না। খুব দূবর্ল লাগছিল। শেষ রাতে শুয়ে শুয়ে যতখানি দেখতে পেরেছি। মা সারারাত বসে ছিল পাশে। দোয়া পড়েছে শুধু।
সকাল বেলা উঠে পরীক্ষার হলে গেছি। মাও আমার সাথে গেছেন। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ সব কমোন এসেছে। কিন্তু মাথা কেমন জানি করছিল। যা পেরেছি দিয়ে এসেছি। নব্বইয়ের কাছাকাছি পাব কিন্তু একশোতে একশো পাব না। অংক আমার খুব প্রিয়, আশা করে ছিলাম পুরো নাম্বার পাব কিন্তু এখন সে আশা করে লাভ নেই। আলহামদুলিল্লাহ যে, পরীক্ষাটা অন্তত দিতে পেরেছি। না পারলে একটা বছর নষ্ট হয়ে যেত।
যথারীতি সবগুলো পরীক্ষা শেষ হল। আবার প্রাইভেট শুরু করলাম। রুনাও বেশ ভালো রেজাল্ট করছে। আন্টি খুব খুশি। আমি ইন্টারের অংক শুরু করে দিলাম, কেননা, ইন্টারে সময় খুব কম, কিন্তু পড়া অনেক বেশি। ইন্টারের জন্য কিছু বিষয়ে আমাকেও প্রাইভেট পড়তে হবে। একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম। মাকে এত কিছু বললে চিন্তায় পড়ে যাবে।
সময় মত রেজাল্টের দিন এল। সারারাত ঘুমাতে পারিনি। খুব সকালে স্কুলে যাই। এত সকাল যে, কেও আসেনি। আস্তে আস্তে সবাই এল। সবার বাবা মা সাথে এসেছেন কিন্তু রাতে মার শরীরটা ভালো ছিল না বলে মাকে নিয়ে আসিনি, যদিও মা আসতে চেয়েছিলেন। যাইহোক, টেনশনে হাত পা কাঁপছে। সবার বাবারা একটু সামনে গিয়েই রেজাল্ট নিয়ে এসেছে, আমি এখনও আমারটা পাইনি। আমার খুব প্রিয় আপা দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “নিলা, তুমি অনেক ভালো রেজাল্ট করেছো, সব বিষয়ে নব্বইয়ের উপরে, শুধু অংকে ছাড়া কিন্তু সব মিলিয়ে তুমি স্কুলের সেরা দশের মাঝে আছো।”
আপাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম। আপা আমার পুরো বিষয়টা জানেন। তিনশত টাকা দিয়ে বললেন,” মার জন্য মিষ্টি কিনে বাড়ি যাও”
সাথে সাথে বেশ কিছু স্যার আপারাও আমার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পরে স্কুলের সবাই আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছেন। আমি এসব স্যার আপাদের কথা সারাজীবন মনে রাখব। টাকাটা দিয়ে মিষ্টি কিনে বাসায় এলাম। এদিকে আন্টিও বাসায় এসে অপেক্ষা করছে। রেজাল্ট বলামাত্র মা খুশিতে কেঁদে দিলেন। আন্টিও অনেক আদর করলেন। আন্টি বাইরে এসে নিজ হাতে মিষ্টি কিনে আনলেন। আপাও এলেন। সবাই খুব খুশি। আজ বাবা থাকলে অনেক খুশি হতেন।খুব মনে পড়ছিল বাবার কথা। বাবা সব সময় মা বলে ডাকতেন। মা ছাড়া কথাই বলতেন না। আজ সব কিছুই চলছে শুধু বাবা নেই। কেন এমন হয়? আনন্দের চাইতে কষ্টটাই বেশি। বাবা এভাবে এত তাড়াতাড়ি হারিয়ে গেল কেন?? মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল “বাবা বাবা”
মা আপু আন্টি সবাই আমার কাছে এল। আমাকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা বুঝি সবাই হারিয়ে ফেলে ছিল।
আপু আর সেদিন বাসায় গেল না। ভাইয়াকে ফোনে জানিয়ে দিল, কাল স্কুল করে বাড়ি যাবে। রাতে আপু রান্না করল। আমাকে কিছু করতে দিল না। মাকে খানিকটা অসুস্থ মনে হল। মা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
আপু, ” মা তোমার খারাপ লাগছে?”
মা কিছু বললেন না। আপু মায়ের মাথায় তেল দিয়ে কিছুক্ষন আচরে দিলেন। মা চোখ বন্ধ করলেন।
খুব কাছে একটি কলেজে ভর্তি হলাম, যেন হেঁটে যেতে পারি। কলেজে সময় খুব কম। তাই পড়াশোনা পুরোদমে শুরু করে দিলাম। আপু বললেন, ” প্রাইভেট পড়, আমি টাকা দিব, ভালো ফলাফল করতেই হবে”
প্রাইভেট শুরু করলাম। আর রুনাদেরও তো পড়াচ্ছি। ভালোভাবেই প্রথম বর্ষ শেষ করলাম। দ্বিতীয় বর্ষে সময় তেমন নেই। শুধু পরীক্ষা। মার শরীরটা ইদানিং তেমন ভালো যাচ্ছে না। আপু আমি দু’জনেই বলছি সেলাই বন্ধ করতে কিন্তু মা শুনতে নারাজ। তবে আগের চাইতে অনেক কমিয়ে দিয়েছে। পারে না আগের মতো আর।
আস্তে আস্তে পরীক্ষা খুব কাছে এসে গেল। বাসার কাজ, কলেজ প্রাইভেট সব মিলিয়ে কিভাবে যে সময় চলে যাচ্ছে টের পাচ্ছি না।অনেক রাত জেগে পড়তে হচ্ছে।
পরীক্ষার মাসটা রুনাদের আর পড়াব না। আগের মতো আন্টি পুরো টাকাটাই দিয়ে গেছে। আসলে খুব ভালো মানুষ উনি। সচারাচর ওনার মত মানুষ পাওয়া কঠিন।
এক এক করে সব গুলো পরীক্ষা শেষ হল। সবগুলোই ভালো হয়েছে। এখন অপেক্ষার পালা।
আবারও রুনাদের পড়ানো শুরু করলাম। বসে থাকলে তো সংসার চলবে না। দেখতে দেখতে সময় পাড় হয়ে গেল। আবারও সেই টেনশনের দিন। কলেজে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। যথারীতি এবারও আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো ফলাফল। বাসায় এসে মাকে, আপুকে জানালাম। সবাই খুব খুশি।
মেডিকেলের কোচিং আগেই শুরু করেছিলাম। পড়ার চাপ অনেক বেড়ে গেছে। যখনই সময় পাচ্ছি, পড়ছি। যে করেই হোক বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। আমার সামনে আর কোন পথ নেই। বাবা সব সময় বলতেন, ” মা, মানুষের সেবা করার মাঝে অনেক আনন্দ, যখন সুযোগ পাবে, তখনই করবে। জীবনে কখনও পিছিয়ে পড়বে না, দেখবে এমনিতেই তোমার সব কাজ সহজ হয়ে যাবে”
বাবার এসব কথা গুলো সব সময় মনে পড়ে। তখন পড়ার আগ্রহ বেড়ে যায়।
সময় মত মেডিকেলের পরীক্ষাও হয়ে গেল। বেশ ভালো হয়েছে। আবারও অপেক্ষার পালা।
গতরাতে বাবাকে স্বপ্নে দেখেছি। অনেক খুশি বাবা, আমাকে অনেক আদর করছেন। ঘুম থেকে উঠেই মনে হচ্ছে বাবা আমার সাথেই আছেন। আজ মেডিকেলের রেজাল্ট দিবে। একটু অস্থিরতা কাজ করেছে। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পারব কি?
আকাশে মেঘ ডাকছে, বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। দরজার কাছে আসতেই ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি শুরু হল। আমাদের ঘরে টিনের চাল, আর টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ খুব ভালো লাগে। অনেক দিন বৃষ্টি ওভারে দেখা হয় না। আজ কেন জানি অন্য রকম লাগছে। ছোট ভাই বোন দুটোও জানালার পাশে বসে বৃষ্টি দেখছে, সেই সাথে কাগজের নৌকা বানাচ্ছে। অনেক বৃষ্টি, ভালোই লাগছে।
পাশের পাড়ার এক আপুকে রোল নম্বর দিয়ে রেখেছি। ফলাফল প্রকাশের সাথে সাথেই জানাবে, বলেছে। উনিও মেডিকেলে পড়ছে।
বৃষ্টির মাঝে ভিজতে ভিজতে আপুও চলে এসেছে খবর জানতে। মা ঘরে বসে দোয়া পড়ছে। আস্তে আস্তে বৃষ্টিটা কিছুটা কমেছে। জানি না, আল্লাহ কি রেখেছেন। যদিও পরীক্ষা ভালো হয়েছে।
বৃষ্টি থেমে গিয়ে অনেক রোদ উঠেছে। এই বৃষ্টি আবার এই রোদ।
দরজায় কড়ার শব্দ, দৌড়ে গেলাম। সেই আপু চিৎকার করে বলল, ” নিলা, তুই ঢাকা মেডিকেল এ চান্স পেয়েছিস”
আমি কি করব, বুঝতে পারছিলাম না, ঢাকা মেডিকেল এ, সাথে সাথে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালাম। মা নামাজে বসে গেল। আজ আপুর সাথে ভাইয়াও এসেছে। ভাইয়া বলল, ” দেখিয়ে দিলি তো নিলা, খুব ভালো লাগছে রে, যাই মিষ্টি নিয়ে আসি”
আপু আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন। “যাক, আল্লাহ রহমত করেছেন, বাবার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে”
চোখে পানি এসে গেল। অনেক কষ্টের পর সুখ কিন্তু বাবা নেই, কোন দিন আসবেও না।
“আপু, বাবা কি দেখছে আমি যে মেডিকেলে চান্স পেয়েছি, বাবার সেই স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে আজ, কিন্তু কেন বাবা এত তাড়াতাড়ি চলে গেল আপু,আমাদের কেন এত কষ্ট, আমার সব বন্ধুদের তো বাবা আছে”
আপু আমাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো।
উঠোনে এসে দাড়ালাম। কি সুন্দর রংধনু উঠেছে। আকাশের দিকে তাকালাম। “বাবা তুমি কি দেখছো? আজ তোমার স্বপ্ন পূরণের পথে আমি। আমি অবশ্যই তোমার সেই স্বপ্ন পূরণ করব, ভালো ডাক্তারই হব না, অনেক ভালো মানুষও হব, তুমি যেটা সব সময় চাইতে। তুমি শুধু দোয়া কর। আমি যেন সারাজীবন মানুষের সেবা করতে পারি। বাবা ক’দিন পড়েই যাব মেডিকেলে ভর্তি হতে কিন্তু তুমি আমার সাথে যাবে না, জানি সবাই সবার বাবাকে নিয়ে যাবে, শুধু আমি যাব বাবা ছাড়া, খুব কষ্ট বাবা, খুব কষ্ট।”
জানি একদিন অনেকটাই থেমে যাবে বৃষ্টির কান্না কিন্তু মনের নিভৃতে কোন এক কোণে বাবা নামে ছোট্ট শব্দটার সেই ক্ষত কোন দিনও শুকাবে না, একা নিজেই বয়ে বেড়াবো সেই ক্ষত চিহ্নের ঘা। তারপরও, বাবা আজ তোমার সেই ইচ্ছে পূরণ হতে চলেছে।
রংধনুর সবকটা রং গাঁয়ে মেখে আমি এখন উড়ে যাচ্ছি সেই নীল আকাশের পাণে, কি যে ভালো লাগছে আমার, সব সময় পাশে থেকো বাবা। আমি তোমার স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছি আজ।।
(নিলা নামে মেয়েটি বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল এ পড়ছে, আর এসব সংগ্রামী , কঠোর পরিশ্রমী, অধ্যবসায়ী নিলাদের জন্য রইল অনেক অনেক শুভকামনা আর ভালোবাসা, এভাবেই যেন তারা বাবার স্বপ্ন পূরণ ও মানবতার সেবায় নিজেকে তৈরী করতে পারে, এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের)
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply