(১৯৮৫ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি গুলি করে হত্যা করা হয় এই বীরকে)
মধুর ক্যান্টিনে যাই
অরুণের চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে
বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়।
তোমার সেই সদা হাসিমাখা ফুল্ল ঠোঁট
উজ্জ্বল চোখের দ্যুতি
সারাক্ষণ চোখে চোখে ভাসে
বুঝি এখনই সংগ্রাম পরিষদের মিছিল শুরু করার তাগিদ দেবে তুমি
ওই তো, ওই তো সবার আগে তুমি মিছিলে
কি সুঠাম তোমার এগিয়ে যাবার ভঙ্গিমা
প্রতিটি পা ফেলছো কি দৃঢ় প্রত্যয়ে
কি উচ্চকিত তোমার কন্ঠের শ্লোগান
যেন আকাশ ফেটে পড়বে নিনাদে
হাত উঠছে হাত নামছে
মাথা ঝুঁকছে ঘাড় দুলছে চুল উড়ছে বাতাসে
ওই তো, ওই তো আমাদের ঐক্যরে পতাকা হাতে এগিয়ে যাচ্ছ তুমি।
মধুর ক্যান্টিনে যাই
নিত্য নতুন প্রোগ্রাম, মিছিল সভা বটতলা
অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে র্দুজয় শপথ
সামরিক জান্তার ছোবল থেকে
শিক্ষাজীবন, শিক্ষাঙ্গনের স্বায়ত্বশাসন রক্ষার অঙ্গীকারে
ডাক দেই দেশবাসীকে
তোমারি মতো নিরাপত্তাহীনতায়
প্রতিটি ছাত্রের দুর্বিষহ জিম্মী জীবন এখনো এ ক্যাম্পাসে
হলে গেটে গেটে পড়ে থাকে ভয়ংকর বিস্ফোরোন্মুখ তাজা বোমা
প্রতিদিন চর দখলরে মতো হল দখলের হিংস্র মহড়া
গুলি ও বোমা ফাটার শব্দ
এখনো আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অংশ
এ অস্ত্রের উৎস কোথায়?
মধুর ক্যান্টিনে যাই
প্রতিদিনই আমাদের জীবন হাতের মুঠোয়
প্রতিদিন হামলা রুখতে হয়
বসু, আজ সেই প্রতিরোধের সারিতে তুমি নেই
আজ বড়ই অভাব অনুভব করছি তোমার।
শিক্ষাভবন অভিমুখে সামরিক শাসন ভাঙ্গার প্রথম মিছিলে তুমি ছিলে
রক্তাক্ত ১৪ই ফেব্রুয়ারির কাফেলায় তুমি ছিলে
৪ঠা আগস্ট সশস্ত্র দুবৃর্ত্তদের কবল থেকে
আমাদের পবিত্র মাটি রক্ষা করার সম্মুখ সমরে তুমি ছিলে
এমন কোনো র্ধমঘট, হরতাল, ঘেরাও, মিছিল আন্দোলন নেই যে তুমি ছিলে না
সেই নৃশংস ঘাতক রাতেও
তুমি অস্ত্রধারীদরে দুর্গের দিকে অবিচল যাত্রা অব্যাহত রেখেছিলে
ঘাতক বুলেট ভেদ করে গেছে তোমাকে
কিন্তু তুমি পিছু হটোনি
তুমি বীর, তুমি সাহসী যোদ্ধা, তুমি সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান
যুগে যুগে সংগ্রামীদের অফুরান প্রেরণা।
মধুর ক্যান্টিনে যাই
অরুণের চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে
বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়।
কাউন্টারের সামনে কতদিন
তোমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খেয়েছি
কতদিন তুমি আমাকে চায়ের পয়সা দিতে দাওনি
কতদিন চায়ের সঙ্গে একটি সিঙ্গারা বা কেকের আবদার করেছ
কতদনি তোমার সঙ্গে খোশগল্প হাসিঠাট্টায় মেতে উঠেছি
বসু, আজ সব কথা মনে পড়ে যায়।
রিপার বিয়েতে তুমি বলেছিলে
অ্যাকশনে আপনার আর আগে থাকার দরকার নেই,
আমরা তো আছি
বসু, তুমি রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে সে কথা প্রমাণ করে গেলে
বসু, তুমি আমার শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার একটি রক্তকরবী বৃক্ষ।
মধুর ক্যান্টিনে যাই
বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়।
তোমার মৃত্যুর সেই নৃশংস ঘাতক রাত্রিতে
আমি ছিলাম ঢাকার বাইরে
তোমার গুলিবদ্ধি রক্তাক্ত লাশ আমি দেখিনি
তোমার মৃত্যুর খবর শুনে
বারবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল মন
তবু সেই রাত্রেই আড়াই-শত মাইল দূর থেকে
সঙ্গে সঙ্গে রওয়ানা দিয়েছিলাম
তোমার হত্যার প্রতিশোধ নিতে
তোমার খুনিদের রক্তে হাত রাঙ্গাতে।
বসু, আমরা বহুবার তোমার হত্যার প্রতিশোধ নেবার শপথ গ্রহণ করেছি
অপরাজয়ে বাংলার পাদদেশে, শহীদ মিনার, বটতলায়, বায়তুল মোকারমে,
সারাদেশ তোমার হত্যার বদলা চায়
কিন্তু এখনো তোমার খুনিরা প্রকাশ্যে সর্গবে ঘুরে বেড়ায়
এখনো তোমার ঘাতকেরা ক্ষমতার কালো কেদারায় বসে
রাইফেল তাক করে আছে আমাদের প্রতি।
বসু, আমাদের শিক্ষানীতি এখনো বদলায়নি
সামরিক খাতে ব্যয় শিক্ষাখাতের চেয়ে আরও বেড়েছে
নতুন নতুন ক্যান্টনমেন্ট তৈরির পরিকল্পনা হলেও
সংস্কারের অভাবে জগন্নাথ হলের জীর্ণ ছাদ ধ্বসে
তোমার অনেক বন্ধু মারা গেছে
এখনো হলে হলে মেধা-ভিত্তিক সিট বণ্টন চালু হয়নি।
বসু, তুমি এসবের পরিবর্তন চেয়ে জীবন দিয়েছ
কিন্তু আমরা এখনও তোমার একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে পারিনি
বসু, আমরা তোমার কাঙ্খিত লড়াই চূড়ান্ত করতে পারিনি
আমরা তোমার হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারিনি
আমরা এখনো অজস্র বসু হতে পারিনি বলেই …
মধুর ক্যান্টিনে যাই
বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়
খুব মনে পড়ে
মনে পড়ে….
Leave a Reply