যে লোকটার সাথে শ্রাবণীর বিয়ে ঠিক হয়েছে সে লোকটার বয়স চৌত্রিশ। নাম পাবেল আহমেদ। লোকটার সাথে শ্রাবণীর বয়সের ব্যবধান আঠারো। পাবেল আহমেদ লেখাপড়া শেষ করেছেন অনেক আছে। চাকরিবাকরি কিছুই করছেন না, বেকার। তবে পুরোপুরি বেকার বলা যাচ্ছে না। রাজনীতি করে নাকি। বড় বড় নেতাদের সাথে ঘোরাফেরা করেন। তবে পাবেল আহমেদের বাবার বিশাল ব্যবসা আছে। আর পাবেল আহমেদ বাবার একমাত্র সন্তান। ভবিষ্যতে এই বিশাল ব্যবসা কিংবা বাপের সমস্ত সম্পত্তির মালিক পাবেল আহমেদই। পাবেল আহমেদের মানেই হলো শ্রাবণীর, এই হিসেবেই বেকার ছেলের কাছে মেয়ের বিয়ে দিতে কোনো রকম আপত্তি করছেন না সেলিম হোসেন। সেলিম হোসেন শুনেছেন ছেলের একটু বাজে স্বভাব আছে। মদ, গাঁজা, সিগারেট খায় নাকি। সে নিয়েও তেমন কোনো আপত্তি নেই সেলিম হোসেনের। আজকালকার ছেলে একটু এমন হবেই। বিয়ের পর শ্রাবণী সব ছাড়িয়ে একদম সাংসারিক করে ফেলবে। আশেপাশের লোকজন বলছে ছেলের বয়সটা একটু বেশি। ছেলে আগে বিয়েসাদি করেনি তো? সেলিম হোসেন সেসব কথাও গুরুত্ব দিচ্ছেন না। চৌত্রিশ বছর বয়স। কত আর বেশি? ছেলের বাবাকে বয়স নিয়ে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন,
–‘ছেলে লেখাপড়া করেছে, রাজনীতি করছে এসবে বয়স কেটে গেছে। তাছাড়া আজকালকার ছেলেরা তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নিজের স্বাধীনতা নষ্ট করতে চায় না।’
____________
অনেকক্ষণ ধরে নিঃশব্দে কাঁদছে শ্রাবণী। ফর্সা গাল দুটো লালচে হয়ে গেছে। চোখ গুলোও ফুলে গেছে। মাথার দুই পাশের রগ গুলো দপদপ করছে। দুই দিন ধরে কিছু খাচ্ছে না। সেদিকে কারো খেয়াল নেই। শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আসছে ক্রমশ। এ বাসার কারো মুখের উপর কিছু বলার সাহস শ্রাবণীর নেই। সবার সব সিদ্ধান্ত মুখ বুজে মেনে নিয়েছে সারাজীবন। শ্রাবণীর চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। পৃথিবীটা বড্ড বিষাদময় লাগছে। এ বাসা ছেড়ে পালিয়ে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কোথায় যাবে? নিজেকে ভীষণ একা মনে হচ্ছে। একাকীত্ব, অসহায়ত্ব গ্রাস করে ফেলছে শ্রাবণী। নিজের যন্ত্রণার, একাকীত্বের গল্প গুলো বলার মত কেউ নেই। নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা, অভিমান, অভিযোগ কখনো মুখ ফুটে প্রকাশ করতে পারেনি। আজও পারছে না। সেলিম হোসেনের মুখের উপর বলতে পারছে না, বাবা এ বিয়েটা ভেঙে দেও। আমি কলেজে ভর্তি হবো। লেখাপড়া করবো। শ্রাবণীর এই কথা গুলো শোনার মত কেউ নেই। হাত ধরে একটু প্রবোধ দেওয়ার মতও কেউ নেই। শ্রাবণী হঠাৎ গলা ছেড়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠল। শ্রাবণীর চিৎকার শুনে পাশের রুম থেকে পারভীন বেগম ছুটে আসেন। কাল বিয়ে। বাসায় ঢের কাজ। সবকিছু গোছগাছ করা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন পারভীন বেগম। পারভীন বেগমকে দেখে শ্রাবণী কান্না থামানোর চেষ্টা করে। এরকম পাষণ্ড মানুষকে কান্না দেখিয়ে লাভ নেই। এরা কখনো শ্রাবণীর কান্নার গুরুত্ব দেয়নি। শ্রাবণী কান্না চাপিয়ে থমথমে মুখে বসে রইল। দৃষ্টি ফ্লোরের দিকে নিবদ্ধ। পারভীন বেগম শ্রাবণীর দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল,
–‘কি হয়েছে তোর? অযথা চিৎকার চেঁচামেচি করছিস কেন? মরছে কেউ? সকাল থেকে ফোঁস ফোঁস করে কাঁদতেছিস। দুনিয়াতে আর কোনো মেয়ের বিয়ে হয় না নাকি? তোকে ঘরে রেখে খুঁটি দিবো? এসব ন্যাকামি বাদ দিয়ে কাজ কর। একদম হাত-পা তুলে সকাল থেকে বসে আছিস। মা তো অন্য লোকের হাত ধরে ভাগাইছে। আপদ আমার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে গেছে।’
শ্রাবণী নীরব হয়ে রইল। কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। পারভীন বেগম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রুম থেকে চলে গেলেন। শ্রাবণীর চোখ থেকে নিভৃতে আবার জল গড়াচ্ছে। বুকের ভিতর উথালপাথাল কষ্ট ঢেউ খেলছে! সমস্ত দুঃখ নিজের মনেই চাপিয়ে রাখলো।
সারারাত শ্রাবণীর ঘুম হলো না। রাত পোহালেই বিয়ে- এই ভাবনাটা শ্রাবণীকে ঘুমাতে দিলো না। সকাল হতেই ভীষণ মাথা ব্যথা শুরু হলো। শ্রাবণী মাথার উপর বালিশ চেপে শুয়ে রইল। রুমের বাইরে শ্রাবণীর বড় ফুফুর গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বড় ফুফু এসে গেছে বোধ হয়। শ্রাবণী বিছানা ছেড়ে ওঠল না। ইচ্ছে করছে না। কিছুক্ষণ পরই শ্রাবণীর দরজায় কেউ কড়া নাড়লো। ক্লান্ত শরীর নিয়ে দরজা খুলতেই শ্রাবণী দেখল অজ্ঞাত এক যুকব দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। কাঁধে বড়সড় সাইজের একটা ব্যাগ। শ্রাবণী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল চমকে গিয়ে। চেনা চেনা লাগছে যুবককে। কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছে না। শ্রাবণী কিছু বলার আগেই যুবকটি বলে ওঠল,
–‘এত বড়ো হয়ে গেছিস শ্রাবণী! কত ছোট দেখেছিলাম তোকে। তখন বোধ হয় তুই ফাইভে পড়তিস। আমায় চিনতে পারছিস না?’
–‘যাইফ ভাই আপনি?’
–‘হ্যাঁ। তুই নাকি ছাত্রী হিসেবে খুব ভালো। কিন্তু তোর স্মৃতিশক্তি এতো খারাপ কেন?’
কথাটা বলতে বলতে শ্রাবণীকে পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকলো যাইফ। কাঁধের ব্যাগটা টেবিলের উপর রাখলো। তারপর শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল,
–‘চেহারা এমন দেখাচ্ছে কেন তোর? বিয়েতে রাজি না না-কি?’
শ্রাবণী সন্তপর্ণে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করে দরজার সামনে থেকে খাটের দিকে এগিয়ে গেল। যাইফের কথার উত্তর দিলো না। যাইফকে শ্রাবণী অনেক আগে দেখেছে। চেহারাও পরিষ্কার মনে নেই। তবে এইটুকু মনে আছে যে তখন যাইফের মুখে এমন চাপদাঁড়ি ছিলো না। যাইফের মা বছরান্তে একবার আসলেও যাইফ তেমন আসে না। পাঁচ বছর পর এসেছে এবার।
–‘রাতে বাসে ঘুম হয়নি। বাসে ঘুমাতে পারিনা আমি। ঘুমে চোখ জ্বলে যাচ্ছে। তোদের দুই রুমের মুরগির খোপের মত একটা বাসা। তোর বাবা এত কিপ্টামি করে কেন? বাসা বড় করে না কেন? মেয়ের জামাই এসে ঘুমাবে কোথায়? ওই রুম ভরতি মানুষ, হাউকাউ, চেঁচামেচি। আমি এখানে একটু ঘুমাবো। এই রুমে কাউকে আসতে দিস না।’
শ্রাবণী হ্যাঁ সূচক ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালো কেবল। যাইফ খাটে শুয়ে পড়েছে। শ্রাবণী খাট থেকে উঠে চেয়ারে বসল। এর ভিতর যাইফ বলল,
–‘তুই কিসে পড়িস? এসএসসি দিয়েছিস?’
–‘হ্যাঁ।’
–‘এত অল্প বয়সে তোর বিয়ে দিচ্ছে কেন? প্রেম ট্রেম করে ধরা খেয়েছিস নাকি?’
শ্রাবণী নিতান্তই স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলল,
–‘না।’
–‘তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে তুই দুই-তিন দিনের না খাওয়া। তুই কি বিয়েতে রাজি না?’
শ্রাবণী এবারও স্বাভাবিক গলায় বলল,
–‘না রাজি না। যে লোকের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে সে আমার থেকে আঠারো বছরের বড়।’
যাইফ এবার চমকে গেল। এতক্ষণ যে হাসিঠাট্টার ভঙ্গিতে কথা বলছিল সেই ভঙ্গিটাও বদলে গেল মুহুর্তে। উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
–‘দুপুরে বরযাত্রী এসে পড়বে। বিয়ে হয়ে যাবে। রাজি না তো সেটা সবাইকে বলছিস না কেন? এভাবে বসে আছিস কেন? আঠারো বছরের বড় একটা লোকের সাথে কেন বিয়ে দিচ্ছে তোকে? কি অদ্ভুত!’
শ্রাবণীর গলা ধরে আসলো। কান্না পাচ্ছে ভীষণ। বলল,
–‘আমার কথা শোনার কেউ নেই যাইফ ভাই।’
–‘তুই একটা কাজ কর। তুই পালিয়ে যা।’
শ্রাবণী আঁতকে ওঠে বলল,
–‘কি বলছেন? আমি কোথায় পালিয়ে যাবো?’
–‘তুই পালিয়ে যেতে চাইলে আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি। তোর থাকা-খাওয়া, এভরিথিং।’
–‘না, না আমায় দিয়ে এসব হবে না। বাবা আমায় খুন করে ফেলবে।’
–‘তো তুই ওই বুড়ো লোকের সংসার করবি? বিয়ে, সংসার এসবের বয়স হয়েছে তোর?’
শ্রাবণীর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। কোনো কথা বলছে না। যাইফ বলল,
–‘আচ্ছা তোর বয়স আঠারো হয়েছে?’
–‘না।’
এর ভিতর পারভীন বেগম আসলো হুট করে। যাইফের সাথে শ্রাবণীর কথা আর এগোয়নি। গোসল দিয়ে দ্রুত রেডি হতে বললো শ্রাবণীকে। অগত্যা শ্রাবণী কাপড়চোপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। বরযাত্রী আসার সময় হয়ে গেছে। বউ সাজানো হলো শ্রাবণীকে। অসম্ভব মিষ্টি লাগছে শ্রাবণীকে দেখতে। এই সংসারের সবার অপ্রিয় শ্রাবণী চলে যাবে। নিত্য আর ঝগড়া হবে না শ্রাবণীকে নিয়ে। নিজের চিরপরিচিত রুমটা, রুমের সামনে বারান্দাটা, বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা শিমুল গাছটা সবকিছুর জন্য মায়া হচ্ছে শ্রাবণীর। মনের ভিতর অন্য আরেক ভয়ও উঁকি দিচ্ছে শ্রাবণীর। স্বামী নামক মানুষটা কেমন হবে? শ্রাবণী কি হতে পারবে আদৌ কারো প্রিয়?
__________________
(চলবে)
Leave a Reply