পা গুটিয়ে বসে আছি বিছানার কিনারায় মশারীর গা ঘেঁষে। মধ্যেরাতের বেরসিক মশারা কানের কাছে বিরতিহীন সুর তুলছে। এখন গভীর রাত। ঘড়ির কাঁটা একটার ঘর অতিক্রম করেছে অনেক আগেই। শোয়া দরকার, সাথে নিরবিচ্ছিন্ন ঘুম। কিন্তু পারছি না।
বুকের বাম পাজর, ডান পাজর জুড়ে কেমন খাঁ খাঁ শূণ্যতা। আমি অন্ধকার ঘরে দৃষ্টি প্রসারিত করলাম। চারদিকে কেমন অসীম শূণ্যতা। এই শূণ্যতা অবশ্য ছাব্বিশ বছর ধরে বুকের ভেতর লালিত শূণ্যতার চেয়ে অনেক কম।
খুব ইচ্ছে করছে পাশের ঘরে নাক ডেকে ঘুমন্ত পিয়ারা বেগমকে ডেকে তুলতে। কিন্তু না, চাই না অসময়ে তাকে বিরক্ত করতে। সে অধিকার আমার নেইও। ছাব্বিশ বছর ধরে আমার একমাত্র সন্তানকে বুকে জড়িয়ে যে হতভাগী রমণী আমার পরিচয় বহন করে, আমার পথ চেয়ে বসে ছিল।
অামার অাগমনে তার মাঝে কোনো ভাবান্তর হয়নি দেখে ভেবেছিলাম অভিমান। আর অভিমান হওয়ারই কথা। ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনের ছাব্বিশ বছরই আমি দেশের বাইরে ছিলাম।
সবাই আবার ভাববেন না, টানা ছাব্বিশ বছরই আমি দেশে আসতে পারিনি।
দুই বছর পর পর আসতাম তিনমাসের জন্য। ঐ তিন মাস ছিল দুজনের জীবনের রঙিন সময়। শেষ দশ বছর আর আসতে পারিনি। সে অনেক কাহিনী। জেল খেটেছি দশ বছর। পাসপোর্ট ছিল না, ভিসা ছিল না। বিদেশের মাটিতে অবৈধ উপায়ে থাকার শাস্তি সরূপ আমাকে জেল খাটতে হয়েছে। তাই আসার ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও আসতে পারিনি।
যখন দুবছর পর পর বাড়ি আসতাম তখন, আত্মীয়-স্বজনের জন্য শপিং করে, এবাড়ি ও বাড়ি দাওয়াত খেয়ে একসময় আবার যাওয়ার সময় হয়ে যেতো।
আমি ছিলাম দুবাই। দরিদ্র বাবা মায়ের সন্তান হওয়ায় বাংলাদেশে অর্থ- সম্পদ বিশেষ কিছু ছিল না, ঐ ভিটে মাটিটুকু ছাড়া।
এদিকে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করায়, দরিদ্রতার মহাসমুদ্রে পড়ে বাধ্য হয়ে পাড়ি দিলাম দুবাই। রেখে গেলাম প্রাণপ্রিয় স্ত্রী, তিনবছরের পুত্র সন্তান, ছোট বোন আর বৃদ্ধ বাবা-মাকে। প্রথম পাঁচ বছর কেটে গেলো শুধু ঋণ শোধ করতে করতে।
তারপর ছোট বোনের বিয়ে, ছোট্ট একটা ঘর, একটু ধানিজমি, একটু বিলাসিতা, ছেলেটার লেখাপড়া, আরও কত কি! সবার সব চাহিদা মেটাতে মেটাতে দুজনের জীবন থেকে কেটে গেলো গুরুত্বপূর্ণ ছাব্বিশটা বছর।
যেদিন প্রবাসের জীবনের ইতি টেনে বাড়ি চলে এলাম। সেদিন আমার ভিটেতে পাকা দালান, চরে ছেলের মায়ের নামে কেনা কিছু ধানিজমি। স্ত্রীর গা ভর্তি সোনার গয়না, ছেলেটা স্নাতকোত্তর পাশ, সাথে একটা ভালো বেতনের চাকরি।
অথচ আমার নিজের কোনো একাউন্ট নেই, আমার কাছে নগদ কোনো টাকা নেই।
শরীর সৌন্দর্য নেই, যৌবন নেই, পকেটে টাকা নেই। চা, পান খেতেও হাত পাততে হয় ছেলের কাছে। দীর্ঘসময় বিদেশ থাকায় সামাজিকতাও যেন ভুলে গিয়েছি।
আছে শুধু স্ত্রী -সন্তানের জন্য বুক ভরা ভালোবাসা, আর শরীরের গিটে গিটে ব্যথা।
দুই বছরে তিন মাসের জন্য আসলে পকেটে টাকা থাকত, ব্যাংকে ব্যালেন্স থাকত, চলে যাওয়ার তাড়া থাকত। তখন হয়তো পিয়ারা বেগমের মনে আমার জন্য ভালোবাসা থাকত, তাই রাত জেগে শরীর ম্যাসাজ করে দিত।
বিদেশের বাড়িতে কঠোর পরিশ্রমের দাগ লেগে আছে আমার দুইশ ছয়খানা হাড়ের প্রতিটি জয়েন্টে জয়েন্টে। রাতে ঘুমুতে পারি না। পায়ের মাংশপেশী হাতের মাংশপেশীতে তীব্র যন্ত্রণা হয়। পিয়ারা পাশে থাকলে গায়ে হাত রাখে, পা রাখে কেমন যেন সুখের মতো ব্যথায় আমার সব জয়েন্টের ব্যথা চলে যায়।
কিন্তু কেন যেন আমার উপস্থিতি পিয়ারার পছন্দ নয়। সারারাত মৃদু যুদ্ধ চলে পাঁচ ফিট বাই আট ফিট খাটের নরম বিছানায়।
আমার ফ্যানের বাতাস সহ্য হয় না। পিয়ারা ফ্যান বন্ধ করলে ঘুমাতে পারে না। আস্তে করে বালিশ হাতে নিয়ে পাশের রুমে উঠে চলে যায়।
আমি বুকে জড়িয়ে ঘুমাতে পছন্দ করি। ছাব্বিশ বছর এককোল বালিশ নিরব সঙ্গী ছিল। এখন পিয়ারার গায়ে হাত দিলেও না-কি তার অস্বস্তি হয়। আস্তে করে হাত সরিয়ে দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে যায়।
আমার কেন যেন সাহস হয় না, তাকে বলতে পারি না
” পিয়ারা তুই আমার আগের পিরু হয়ে যায়। যার কাছে আমি ছিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে দামী সম্পদ। আমার কথা ছিল যার কাছে বাণী। আমি দিনদুপুরে রাত বললে যে রাতই মেনে নিত।”
একটা সময় কত বায়না করত পিয়ারা
” তুমি চলে আসো। ছেলেকে নিয়ে দু’জনে দু’টো ডাল ভাত খেয়ে জীবন পার করে দেব।”
তখন আমি আসব আসব করেও আসতে পারিনি। পরবর্তীতে আমি আসতে চাইলেও পিয়ারা আসতে দেয়নি। তাকে বড্ড টাকার নেশায় পেয়ে বসেছিল
” ঘরটা শেষ কর, জমিটা কেন, গয়নাটা বানাও। টাকা ছাড়া এখন আর এই সমাজে চলা যায় না। ছেলেটার পড়াটা শেষ হোক।”
ঘরটাও শেষ হলো, জমিটাও কেনা হলো, ছেলের পড়াও শেষ হলো। শুধু হারিয়ে গেলো আমার জীবন থেকে অানন্দময় সময়গুলোর ছাব্বিশটা বছর।
আজকাল নিজের ঘরেই নিজেকে কেমন পরবাসী মনে হয়। ছেলেটা কেমন যেন অচেনা মানুষের মতো আচরণ করে। কোনো কথা বলে না, কোনো আবদার করে না, কোনো বায়না করে না। মা’ই তার ভালো বন্ধু। কাছে ডাকলেও আসতে চায় না। কেমন যেন লজ্জা পায়।
আমি বুঝতে পারি ছেলের এতে কোনো অপরাধ নেই। যে বয়সে বাচ্চারা বাবার হাত ধরে হাঁটতে শিখে, সাঁতার কাটতে শিখে, স্কুলের বারান্দা চিনে, সে বয়সে আমি ছিলাম তার কাছে দূর অাকাশের তারার মতো। আমি কোন মুখে ছেলের কাছে আবদার করি, পাশে বাসার, কাছে থাকার।
ইচ্ছে ছিল ছেলেকে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করানোর। জানতে পারলাম তার না-কি নিজের পছন্দ আছে। শুধু আমার অনুমতি পেলেই বিয়ে করে আনবে।
আমি আর অনুমতি কী দেব, ছেলে যখন পছন্দই করতে পেরেছে, বিয়েও করে আনতে পারবে।
ছেলে আমার থেকে দূরে থাকবেই বা না কেন? উচ্চ শিক্ষিত পরিবারের মেয়ের বাবা অাপত্তি করছে প্রবাসী বাবার ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেবে না।
সেই থেকে ছেলে ভীষণ বিরক্ত নিজের উপর, নিজের জন্মের উপর, অশিক্ষিত প্রবাসী পিতার উপর। গতকাল শুনলাম নিচু কণ্ঠে মাকে বলছে
” বাবাকে কেন বিদেশ যেতে হলো? দেশে কি চাকরির অভাব পড়েছে? এখন কারো কাছে বাবার পরিচয় দেয়া যায় না।”
পিয়ারা বেগম একটু প্রতিবাদ করল না, ছেলের কথায়। উল্টো মাথায় হাত দিয়ে ছেলেকে সান্ত্বনা দিলো। ছেলে হয়তো সবটুকু জানে না, বা জানলেও উপলব্ধি করতে পারেনি। পিয়ারাও কি জানে না? আমার কেন বিদেশ যাওয়া, সেখানে থাকা। এই ঘর, বাড়ি, বিলাসিতা কোথা থেকে এসেছে? কোথায় ছিল এই টাকার উৎস? তার মানে কি পিরুর প্রবাসী বরকে এড়িয়ে যাওয়ার এটাই প্রধান কারন। সেও আমার পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করে?
আমি কষ্ট পাইনি, বাস্তবতা হয়তো এমনি নির্মম। আমি আলমারি থেকে পাসপোর্টটা নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। এই দেশ আমার জন্য নয়, এই পরিবার আমার নয়। আমি খুব প্রয়োজনীয় কিছু নয়। আমাকে কারো প্রয়োজন নেই, শুধু টাকা হলেই চলবে।
আমি চলে যাব অনেক দূরে, যেখানে আমার পরিচয় নিয়ে কোথাও কোনো সংঘাত হবে না, কারো কোনো দ্বন্দ্ব হবে না।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply