এটি আমার জীবনের একটি ঘটনা।এই গল্পটি বলার আগে, একটু ভূমিকা দরকার।
আমি ঊনিশ বছর বয়সে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পরি।রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস্।সাদা বাংলায় যাকে বলে ‘বাত’।রোগটি ধরা পরলেও ঠিক সময়ে আর সঠিক চিকিৎসা না হলে, এটি দূরারোগ্য ব্যাধিতে পরিনত হয়।শুধু তাই নয়,মানুষ সম্পূর্ণভাবে পঙ্গু হয়ে যায়। যেটা নাকি আমার হয়েছে।
আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন মোবাইল ফোনের এত রমরমা ছিল না।মোবাইল এসে গেছে তখন, কিন্তু সেটা ব্যবহার করা খুব ব্যায়বহুল ছিল। কারণ যে ফোন করতো তার যেমন charges কাটতো, যাকে ফোন করা হতো তারও charges কাটত।কাজেই তখন সাধারণ মধ্যবিত্তের আওতার বাইরে ছিল মোবাইল। তখন কিছু কিছু বাড়িতে ল্যাণ্ড ফোন ছিল। আমি অসুস্থ হই সেটা ১৯৯১।প্রথম দিকে হাঁটাচলা করতে পারলেও আস্তে আস্তে আমার হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময় মানসিকভাবে খুবই নিঃসঙ্গ হয়ে পরি। যদিও প্রচুর বই পড়তাম,সিনেমা দেখতাম। তবু নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হতো। একটা ঊনিশ বছরের মেয়ে, যে নাকি কলেজে যেতো, কলেজ ক্যান্টিনের আড্ডা এই সব ছেড়ে হঠাৎ যদি ঘর বন্দী হয়ে যায় তার কি অবস্থা সেটা বলে বোঝানো যাবে না।যার হয় সেই জানে।এাই অবস্থায় কাগজে বিজ্ঞাপন দেখলাম, পত্রমিতা চায়। আমি নির্দিষ্ট ঠিকানায় চিঠি দিলাম। উত্তরও এলো।এই শুরু হলো আমার পত্রমিতালী।এখনও মনে আছে আমার প্রথম পত্রমিতার নাম ছিল, ‘রবিন’।দূর্গাপুরে থাকত।
এরপরে কাগজে একটি বিজ্ঞাপন দেখলাম ‘পত্রমিতালী’ক্লাবের’।বছরে সামান্য কিছু টাকা নেয় সদস্য হবার জন্যে, তার বিনিময়ে তারা ত্রৈমাসিক একটি পত্রিকা বের করে, যাতে সমস্ত সদস্যদের নাম-ঠিকানা থাকে, তার সঙ্গে যে সব সদস্য গল্প-কবিতা লিখতে পারে,তাদের লেখা প্রকাশ করা হতো। আর বার্ষিক সংখ্যায় সদস্যদের ছবিও দেওয়া হতো। সেখান থেকে অনেক বন্ধু পেয়েছিলাম। একটা সময় ছিলো যখন এক এক দিনে কুড়ি -পঁচিশটা করে চিঠি পোস্ট করতাম।
এখানে যার কথা লিখতে বসেছি, তার সঙ্গে আমার আলাপ 1994 তে।অল্প অল্প মনে আছে, তখনও পুরোপুরি শীত পরে নি,হালকা হালকা ঠাণ্ডা পরেছে।সেরকমই এক দুপুরে সাধারণ একটি পোস্টাল খামে একটি চিঠি পেলাম। পরিপাটি সুন্দর হাতের লেখার গুণে সেই সাধারণ পোস্টাল খামটি হয়ে উঠেছিল অসাধারণ। ওইরকম সুন্দর হাতের লেখা আমার মা ছাড়া আর কারুর দেখেছি বলে আমার অন্তত মনে পরছে না।যিনি চিঠি দিয়েছেন, তাঁর নাম কাজী মুজিবুল ইসলাম।বাড়ি বাঁকুড়ার ইনদাস নামক একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। যদিও গ্রামটি যথেষ্ট বর্ধিষ্ঞু।বাড়ির বড় ছেলে, বাড়িতে সবাই বেশ সমীহ করে চলে।গ্র্যাচুয়েশান করে চাকরির চেষ্টা করছে। WHo অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে কোয়াক ডাক্তারের ট্রেনিং নিয়ে, গ্রামে প্রাথমিক চিকিৎসা করে। সামান্য লেখালেখিও করে
বলে রাখা ভালো, আমি যে সময়ের কথা বলছি সেই সময় আমি কিন্তু লিখতাম না।ডায়েরি লিখতাম। কিন্তু কবিতা-গল্প এসব লিখতাম না বা লেখার কথা ভাবতেও পারতাম না।খুব সুন্দর চিঠি লিখতো আমার এই পত্রমিতা।কবিতা লিখত খুব ভাল।দিনের পর চিঠির আদানপ্রদান চলল।সখ্যতা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হলো।আমার এই বন্ধুটি আমায় রাশি রাশি কবিতা লিখে পাঠাতেো।আর নিজের মনের কথা উজাড় করে বলতো।আমি প্রথম প্রথম মন খুলে কথা বলতাম না।কিন্তু মুজিবের অন্তরঙ্গ ব্যবহারে,আমিও আস্তে আস্তে মন খুলে লিখতে শুরু করলাম। মুজিবই আমায় কবিতা লেখার জন্যে জোর করতে লাগলো। আমি অস্বস্তিবোধ করতাম, লজ্জা পেতাম। তারপর হঠাৎই একদিন চার লাইন লিখে পাঠালাম চিঠিতে।মুজিব খুব খুশি হয়ে লিখলো,এই তো তুমি পেরেছো।চেষ্টা করো নিশ্চয় পারবে। সেই আমার কবিতা লেখা শুরু। এরপরে কখন যে দুজনে দুজনের মনে জায়গা করে নিয়েছিলাম নিজেরাই বুঝতে পারি নি।চিঠি পেতে দেরী হলে দুজনেই অস্থির হয়ে পরতাম।রাগ হতো, অভিমান হতো। এখন যেমন ফেসবুকে বা হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পেতে দেরী হলে মব খারাপ হয় সেইরকমই।বন্ধুত্ব কখন যে প্রেমে পরিণত হয়েছে দুজনেই বুঝতে পরি নি।এইভাবেই বেশ চলছিল, হঠাৎ চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেল। অপেক্ষা করতে করতে মনের মধ্যে রাগ-অভিমান জন্মালো।আমাদের মাঝে মাঝে ফোনে কথা হতো। মুজিবের গ্রামের একটা বুথ থেকে ফোন করতো। সেখানেও কয়েকদিন ফোন করেছিলাম।সেখান থেকেও কিছু বলতে পারে নি।বেশ কিছুদিন বাদে একটা চিঠি পেলাম। চিঠিটা মুজিবের এক বন্ধুর লেখা। মুজিব নাকি খুব অসুস্থ তাই চিঠি দিতে পারছে না।চিন্তা আরও বেড়ে গেল। কথাটা ঠিক বিশ্বাস হলো না।তখন এফএম রেনবোতে শুক্রবার রাত বারোটা থেকে একটা অনুষ্ঠান হতো। ‘অনেক কথা বলার ছিল ‘।শেষ পর্যন্ত সেই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমার মনের কথা জানালাম মুজিবকে।এর বেশ কিছুদিন পরেই মুজিবের ফোন পেলাম।তখনই আসল ঘটনা জানতে পারলাম। বিহারে বেড়াতে গিয়ে সামান্য একটা কথা কাটাকাটি থেকে পুলিশি ঝামেলাতে জড়িয়ে পরে। তারপরে যা হয়।থানা পুলিশ, কোর্ট।এই ঘটনায় এতোটাই লজ্জা পেয়েছিল যে আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করে নি।২০০৪ পর্যন্ত আমাদের সম্পর্ক ছিল। ২০০৪ এর ১০ ই জানুয়ারী আমার বাবা ইহলোক তাগ করেন।ওর বাবাও এর কয়েক মাস বাদে মারা যান।তারপরে আস্তে আস্তে সম্পর্ক ঙ্খীন হতে হতে শেষ হয়ে যায়। এরপরে আমি ফেসবুকে আসার পরে আমি অনেকবার ওকে মেসেজ পাঠাই।কিন্তু কোনও উত্তর পাই নি।হঠাৎই নিজেই ২০১৭ নাগাদ ফেসবুকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। আবার ২০১৯ নাগাদ নিজেই সমস্ত যোগযোগ ছিন্ন করে দেয়।
মিথ্যা বলব না,মুজিব আমাদের সম্পর্কটাকে চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি রাজি হই নি।কারণ যেহেতু মুজিব মুসলিম ছিল, তাই আমাদের বাড়ি থেকে সম্পর্কটা মেনে নিতো না।যদিও আমি জেদ ধরলে মা-বাবা রাজি হতো। কিন্তু আমার একটা প্রতিজ্ঞা ছিল যে মুসলিমকে বিয়ে করবো না।এর পেছনে একটা গল্প আছে।
আসলে আমার মা-বাবার বিয়েটা ঠিক স্বাভাবিক ছিল না।বাবা মাকে পছন্দ করেছিল। আমার দাদু অর্থাৎ মায়ের বাবা, আর আমার ঠাকুমার এই বিয়েতে মত ছিল না।আমার দাদুর মত না থাকার কারণ, আমার বাবা তখন খুব সামান্য মাইনের চাকরি করতো। মাত্র ১২৫ কি ১৫০ এইরকম কিছু একটা মাইনে ছিল বাবার। আর দাদু পেনসন পেত ৩০০ টাকা।আর আমার ঠাকুমার আপত্তির কারণ ছিল, আমার মামার বাড়ি ছিল কায়স্ত,আর আমরা হলাম ব্রাহ্মণ।পরে অবশ্য ঠাকুমা এই বিয়েতে রাজি হয়।আমি জন্মানোর পরে আমার ঠাকুমা মাকে অভিশাপ দিয়েছিল, ‘তোমার মেয়ে মুসলিমে বিয়ে করবে ‘।এই ঘটনা মা’র কাছ থেকে শোনার পরে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম,যাই ঘটে যাক্ আমি মুসিলিমে বিয়ে করবো না।
মুজিব এখন ঘোর সংসারী। বিয়ে করেছে। একটা ছেলে আছে।
এখন দেখি ইনবক্সের প্রেম নিয়ে অনেক কিছু গল্প লেখা হয়।কিন্তু পত্রমিতালী নিয়ে কোনও গল্প দেখি না।
তবে এটা গল্প নয়।আমার জীবনের একটা জলজ্যান্ত সত্যি।
Leave a Reply