শোয়া ছেড়ে উঠার চেষ্টা করলাম। হাতে টান লাগতেই উফফ ব্যথা অনুভব করলাম। লক্ষ্য করলাম বেডের পাশে ইঞ্জেকশন রাখা। হাতের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করলাম কয়েকটা ফুটো হয়ে লাল হয়ে আছে তখনি বুঝতে পারলাম এটা ইঞ্জেকশন লাগানোর চিহৃ। রুমের চারিদিকে চোখ বুলালাম কিন্তু মাকে দেখলাম না। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে এখুনি পানি খেতে হবে।
বাবাকে কি ডাকাটা ঠিক হবে বুঝতে পারছি না। কিন্তু পানি খাওয়াটা খুব জরুরি না হলে শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যেতে ও পারি৷ অনেকটা অনিচ্ছা স্বত্বেও বাবাকে ডাকলাম, বাবা ও বাবা পানির পিপাসা পেয়েছে। বাবার কানে ডাক পৌঁছাতেই বাবা চোখ মেলে তাকিয়ে কি মা কিছু বলবি?
– পানি খাব।
আজমল সাহেব টেবিলের উপরে রাখা পানির বোতলটা হাতে নিয়ে মুখ খুলে আমার হাতে ধরিয়ে দিল। বোতলটা হাতে পেয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিলাম। নরম গলায় বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম,
– বাবা মা কোথায়?
– একটু আগে বাসায় গেছে। গোসল করে ১১ টার দিকে আসবে।
– ওহ্।
– নীলা তোর শরীর কেমন এখন?
– ভালোই লাগছে এখন তবে মাথায় একটু চক্কর কাটছে। জানি না কালকে কি হয়েছিল আমি কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই সেন্সলেস হয়ে পড়ি। তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তাই না! পারলে ক্ষমা করে দিও। মেয়ে হয়েছি বলে তোমাদেরকে আজ এত অপমান সহ্য করতে হচ্ছে যদি ছেলে হতাম তাইলে তো আর এসব সহ্য করতে হত না।
– নীলা একদম বাজে কথা বলবি না। তাড়াতাড়ি নাস্তা করে ওষুধ খেয়ে নিবি বিকালে তোকে বাসায় নিয়ে যাব।
– বাবা, ডাক্তার আমার বিষয়ে কি বলেছে? কি হয়েছে আমার কিছু বলেছে?
– না মা তেমন কিছু বলেনি। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করতে বলেছে শরীর খুব দূর্বল।
– ওহ্।
– মা তুই এখন বিশ্রাম নে আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসতেছি।
বাবা চলে গেলে বেডের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম৷
বিকালে বাসায় ফিরলাম। বাবা আমার পছন্দ মতো বাজার করতে বেড়িয়ে গেলেন। বাবাকে এত করে বললাম আমার জন্য এক্সট্রা কোন বাজার করা লাগবে না যা তোমরা রান্না করবে তাই খাব৷ কিন্তু বাবা শুনল না সে আমাকে ধমক দিয়ে সোজা বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
বাজার থেকে একগাদা জিনিসপত্র কিনে এনে আমার সামনে রাখল। তারপর হাসিমাখা মুখে বলল,
– মা বল রাতে কি রান্না করব? আজকে আমি নিজের হাতে তোকে রান্না করে খাওয়াব।
– না বাবা আমি থাকতে তুমি কেন রান্না করবা।
নীলিমা বেগম এসে বাহ্ বাহ্ বাপ মেয়ের কি মিল মায়ের কথা একটাবারও চিন্তা করে না তারা। শুধু নিজেরাই রান্না করবে বলে চিল্লাচ্ছে। বলি কি তোর মা কি মরে গেছে যে পুরুষ মানুষের রান্না করা লাগবে আবার অসুস্থ শরীর নিয়ে তোর।
আজমল সাহেব নীলিমা বেগমকে বলল,
– ঠিকাছে যাও তোমাকে আমি দশ টাকা দিব তার বিনিময়ে তুমি পোলাও, রোস্ট আর ঝাল গোশত রান্না করবে বলে অন্যদিকে ফিরে হাসল। আসলে তোমার রান্না অনেক ইয়াম্মি হয় সো এখনি পিপারেশন নাও।
রুমে গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছি। আর কয়েকদিন পরে রমজান শুরু হবে। এবার গরমের তীব্র আবহাওয়াতে রমজান শুরু হবে। আম, কাঁঠাল পাকার সাথে সাথে মানুষের শরীরও পাকা শুরু করবে। বাহিরে ভালোই বাতাস বইছে। বেশ ভালো লাগছে বাহিরের পরিবেশটা৷ জানালার পর্দা ঠিকমতো টেনে রুমে গিয়ে বিছানায় বসলাম। ক্লান্ত লাগছে। মা তো পোলাও রান্না করতেছে অথচ আমার তো খেতে ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ বিছানার বালিশের পাশে নকশিকাঁথা দেখলাম। এই তো গতবছর কাঁথাগুলো সেলাই করেছিলাম নিজের বাচ্চাকে কোলে তোলার জন্য৷ কিন্তু কি হল এগুলো? পেটের দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই চোখের কোণে পানি চলে এল। ধরে রাখতে পারলাম না তাই তো বৃষ্টির মতো টিপটিপ হয়ে গড়িয়ে পড়ল হাতের উপরে। চোখদুটো লাল হয়ে আছে। কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। শরীরটাও বড্ড খারাপ লাগছে। খুব দূর্বল লাগছে। মনে পড়ল কালকে ২৫ তারিখ রোদের জন্মদিন। দীর্ঘশ্বাস নেওয়ার সাথে সাথে বুকটা হাহাকার করে উঠছে। চোখ বন্ধ করলাম।
বধুবেশে লাল বেনারসি শাড়ি পড়ে লম্বা ঘোমটা টেনে দিয়ে বসে রইলাম নতুন বউয়ের বেশে। মাত্র আধাঘণ্টা আগেই কাজী সাহেব এসে বিয়েটা সম্পন্ন করে চলে গেছে। ঘর ভর্তি মেহমান। সবাই টিপাটিপি করে প্রায় সমবয়সী ছেলেমেয়েদের বিয়েটা বেশিদিন টিকে না অন্ততপক্ষে ৫ বছরের ব্যবধান থাকা উচিত। ছেলের পরিবার কি দেখে যে এমন মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে আল্লাহই ভালো জানেন। মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি হয়। ত্রিশ বছর হয়ে গেলে বাচ্চাকাচ্চা হতে চায় না। নীলার বয়স তো প্রায় ২৫ ছুঁই ছুঁই। ছেলের বয়স নাকি ২৭। মাত্র ২ বছরের ব্যবধান। মানুষ তো কানা ফুসফুস করবেই এটা স্বভাব বলা চলেন।
আসলে সত্যিটা হল নীলার আইডি কার্ডে ২ বছর বাড়ানো বর্তমান বয়স ২৩ বছর অথচ আইডি কার্ডের কারণে ২৫ বছর চলছে। বাবা যখন ফরম ফিলাপ করে তখন দু’বছর বাড়িয়ে দিয়েছিল যাতে করে ইন্টারপাশ করার পরপরই সেনাবাহিনীর চাকরি পাই। বাবার খুব সখ ছিল আমাকে সেনাবাহিনীর পদে চাকরি করানোর। নিজের স্বপ্নটা তো পূরণ করতে পারেনি তাই তো আমাকে বানিয়ে পূরণ করতে চেয়েছিল। যখন চাকরির জন্য নিবন্ধন করি সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিল মাঝপাথে এমপির একজন লোকের কারণে চাকরিটা হল না। সেদিন বাবা কেঁদে কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিল।
সবার কথাগুলো কানে ভেসে আসছিল কিন্তু উত্তর দেওয়ার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
অনেকক্ষণ ধরেই অপেক্ষা করছি বাসরঘরে এখনো কেউ আসেনি। অপেক্ষা….অপেক্ষা….অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ি। আচমকাই দরজা লক করার শব্দে ঘুম ভাঙল আমার। পুরো রুম অন্ধকারে ছেয়ে আছে সামনে তাকিয়ে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ভালো করে লক্ষ্য করার পরে খেয়াল করলাম কারও ছায়া দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে আসল পাঞ্জাবি পড়া মানুষটি। বুঝতে বাকি রইল না যে ইনি আমার স্বামী হবে যার সাথে কিছুক্ষণ আগে বিয়ে হয়েছে।
আমি খাটের উপরে ভালো করে আঁটসাঁট হয়ে বসলাম। মাথার ঘোমটাটা টেনে ঠিকমতো বসলাম। সামনে থাকা লোকটি মূর্তির ন্যায় আমার সামনে দাঁড়িয়ে রইল এক পা সামনে বা পিছনে করছে না। অনেকক্ষণ ধরে অবাক দৃষ্টিতে আঁড়চোখে বিষয়টা লক্ষ্য করলাম কিন্তু কি জিজ্ঞেস করব কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তবে একটা মজার বিষয় হল যাকে আমি বিয়ে করেছি তাকে আমি বিয়ের আগে দেখিনি। না সে আমাকে দেখেছে না আমি তাকে। সেকারণেই সে হয়তো টেনশনে আছে। বাবা মা বিয়েটা ঠিক করেছে। না দেখে বিয়েতে রাজি হচ্ছিলাম না তবুও বাবা মা জোড় করেই মতের বিরুদ্ধে আমার বিয়েটা দিল। কেনো দিল জানি না। এখন আর জানতেও ইচ্ছা করছে না শুধু এটাই জানতে ইচ্ছা করছে তিনি কেনো আমাকে বিয়ে করেছে? খুব জানতে ইচ্ছা করছে।
শুনেছি উনাদের অনেক টাকা আছে তাহলে আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েকে কেনো বিয়ে করল তাও আবার না দেখে। অনেকটা কৌতুহল বশত সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম,
– এই যে শুনুন, আপনি কি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি এদিকে আসবেন।
আমার কথায় সে অনেকটা বিরক্ত ফিল করল। জোড় গলায় বলল,
– আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকব না রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকব সেটা একান্তই আমার ব্যাপার তুমি বলার কে? আমার তো তোমাকে দেখে সন্দেহ হচ্ছে বিনা চিন্তায় একদম নিশ্চিন্তে বধুবেশে বসে থাকতে দেখে। আচ্ছা একটুও ভয় লাগছে না। বিয়ের আগে তো আমাকে দেখনি আমি কালো না গুন্ডা খুনি না মাস্তান এসব নিয়ে তোমার কি মাথা ব্যথা নেই? দুনিয়াতে এত মানুষ দেখছি তোমার মত বেহায়া মেয়ে কোথাও দেখিনি।
রোদের কথায় রাগে সমস্ত শরীর জ্বলতে লাগল। তড়িঘড়ি করে মাথার ঘোমটটা তুলে নিলাম। এমন সময় বিদুৎ চলে এসেছে। তার মানে এতক্ষণ বিদুৎ ছিল না।
রোদকে দেখে জোড়ে তু……….তুমি।
– এই তুমি।
দু’জনের মুখ হা হয়ে গেল। রোদ ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকায়। তোতলাতে তোতলাতে বলল,
– তুমি এখানে? কিভাবে সম্ভব? এটা হতে পারে না।
– আমারও তো একই প্রশ্ন তুমি এখানে?
দুজনেই সাপের ন্যায় ফুলতে লাগল। রোদ রুম থেকে বেরিয়ে গেল আর আমি বিছানার বালিশের উপরে শুয়ে পড়লাম। মনে মনে গালাগাল করতে লাগলাম। হারামী, কুত্তা তুই এখানে কিভাবে? দুনিয়ার লুচ্চা ছিলি এখন আমার কপালে এসে জুটলি। এ্যা….এ্যা… আমার সাথেই কেন এমনটা হল।
এদিকে রোদ হাঁটছে আর ভাবছে শালী তোকে আমার কোনদিনও পছন্দ ছিল না। বুড়ি জানি কোথাকার, উফফ এর সাথে হাঁটলে জীবনটা শেষ। সবাই হাসাহাসি করবে। না না এর একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
রোদ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে থাকা সিগারেট জ্বলছে। একে একে কয়েকটা সিগারেট টেনে ফিল্টারগুলো উপর থেকে নিচে ছুঁড়ল। রাত প্রায় দুটো বাজতে চলছে এত রাতে বেলকুনিতে দাঁড়ানো ঠিক হবে না। কেউ দেখলে খারাপ ভাববে বলবে আজকেই বিয়ে করে নতুন বউ ঘরে এনেছে আর আজকেই তাকে রুমের বাহিরে পাঠিয়ে দিয়েছে। যত্তসব অপদার্থ লোকজন।
মানুষের তো খেয়ে দেয়ে কোন কাজ নেই পরের জিনিস সবার কাছেই সুন্দর লাগে তাই তো সবার নিজের বউকে ভালো না লেগে পাশের বাড়ির ভাবীকে সুন্দর লাগে। কি রুচি একেকজনের ভাবলেও বমি আসে।
Leave a Reply