1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:২০ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
# আহারে # খোরশেদ ।। সমাজে নতুন অপরাধী চক্র তৈরী হচ্ছে কিন্তু ভবিষ‍্যতে এদের রক্ষা করবে কে??।। – – – আশিক ফারুকী “অতঃপর” __ সালমা আক্তার বীরাঙ্গনা নই আমি মুক্তিযোদ্ধা – – – শাহনাজ পারভীন মিতা জলপাই রঙের স্বাধীনতা – – – আরিফুল হাসান প্লাস্টিকের উৎপাদন বন্ধ করতে হবে – উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ান হাসান – – – স্বাধীন আজম –   টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি, স্বপ্নমায়া – – – – মাহজাবীন আহমেদ বুড়ি মরে গেল – – – মোঃ আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমাম প্রযুক্তির দুনিয়ায় শিক্ষার্থীদের এখন উন্নত জীবন গড়ার দারুণ সময়:– ————–টিপু সুলতান লেখক ও সমাজ চিন্তক ডায়াবেটিস নিয়ে সচেতনতাই পারে ডায়াবেটিস রোগ নির্নয় ও রোগের চিকিৎসা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা – – – ডা: সাদিয়া আফরিন 

# নীলার_সংসার # লেখকঃ_নুসরাত_জাহান_সম্পা # পর্বঃ_১, পর্বঃ_২,পর্বঃ_৩,পর্বঃ_৪ এবং পর্বঃ_৫

  • আপডেট টাইম : শুক্রবার, ৫ মার্চ, ২০২১
  • ৪৪২ বার
পর্বঃ_১
বিবাহের তিন বছর ঘুরতে না ঘুরতেই স্বামীর দেওয়া ডির্ভোসের কাগজটা শ্বাশুড়ি মা নিজের হাতে বয়ে নিয়ে এসেছে আমার বাবার বাড়িতে৷ আজ ছয়মাস ধরে রোদের সাথে কোন যোগাযোগ নেই আমার৷ শ্বাশুড়ি মা ডির্ভোস পেপারটা আমার হাতে দিয়ে কেঁদে কেঁদে আঁচলটা মুছে চলে গেলেন। পেপারটা হাতে নিতেই শরীরের ভিতরটা নাড়াচাড়া দিয়ে উঠল। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল রোদ এমনটা করতে পেরেছে বলে।
নীলার মা উচ্চস্বরে চেঁচাতে লাগল। নীলা কোথায় গেলি কতক্ষণ ধরে তোকে ডাকছি তুই কি শুনতে পাচ্ছিস না। সারাদিন এভাবে মন মরা হয়ে বসে থাকলে কিভাবে চলবে বলতো? একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা কর দেখবি রোদ তার ভুল বুঝতে পারবে এবং তোর কাছে এসে ক্ষমা চাইবে আর তোকে সাথে করে নিয়ে যাবে। কথাগুলো বলে দরজার কাছে এসে নীলার হাতে কিছু একটা দেখে বেশ কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ায়। ভালো করে খেয়াল করল নীলার হাতে ডিভোর্স লেটার। এটা দেখে পুরো স্তব্দ হয়ে যায় নীলিমা বেগম। শাড়ির আঁচল দুহাত দিয়ে কচলাতে থাকল।
নীলাকে কি জিজ্ঞেস করবে সেটাই সে ভুলে গেছে হয়তোবা চোখের সামনে যা দেখল সেটা দেখেই তার সব বলতে চাওয়া চিন্তাগুলো এক নিমিষেই মাটি হয়ে গেল। নিজের মেয়ের মুখের দিকে কেনো জানি তাকাতে পারছে না। এতটা সাহস হয়তো তিনি এখনো জোগাড় করতে পারেনি যে এমন পরিস্থিতিতে তিনি মেয়েকে যে কথাগুলো বলবে বলে ডাকছিল।
আমার চোখ মায়ের দিকে পড়তেই বুঝতে পারলাম তিনিও বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন যার কারণে মুখের ভাষা থমকে গিয়েছে। চোখের কোণে পানি চলে এসেছে। মাকে কি বলে সান্ত্বনা দিব বুঝতে পারছি না। বুকের ভেতরে অনেকটা সাহস নিয়ে কাঁপা গলায় বললাম,
– মা জীবনের শ্রেষ্ঠ গিফট পেয়ে গেছি৷ বংশের ভিতরে কোন মেয়ের আজ অব্দি যে বদনাম হয়নি সেটা আমাকে দিয়ে শুরু হয়েছে। কাল সকালে সবাই এটাকে নিয়ে হাসি তামাশা করবে। ছিঃ ছিঃ বলে ধিক্কার দিবে আর উচ্চস্বরে বলবে,
নীলিমা তোর মেয়ে নীলা তো সংসার করতে পারল না বলেছিলাম না এত বড়লোক ঘরে মেয়েকে বিয়ে দিস না। শুনলি না তো আমাদের কথা। এখন ঠেলা সামলা আর ডিভোর্সি মেয়েকে নিয়ে এলাকায় ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরে বেড়া। কথায় আছে না অতি লোভে তাঁতি নষ্ট। সবার কপালে বড়লোক স্বামী মানায় না৷
নীলিমা বেগম নিজেকে সামলাতে না পেরে চোখের জল ছেড়ে দিল। দুচোখ ভর্তি পানিতে টলটল করছে৷ মেয়েকে এতটা কষ্ট পেতে দেখে কোন মা কি সুস্থ থাকতে পারে? এতদিন ভেবেছিল হয়তোবা সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রতিদিন জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে একটাই প্রার্থনা করত যাতে মেয়েটার সংসারটা না ভাঙে। কিন্তু আল্লাহ সেটাই করল যেটা সে কখনও চায়নি৷ অবিবাহিত মেয়েদেরই বিয়ে হতে চায় না আর তো বিবাহিত মেয়ে। এ কেমন কঠিন বিচার তোমার?
নীলিমা বেগম মুখ খুলতে যাবে তখনি বললাম মা প্লিজ তোমার জ্ঞান বাক্য আমাকে বলবে না ওগুলো শুনতে অভ্যস্ত না। তোমরা যা করেছ ভালোই করেছ আমার কষ্ট আমার কাছেই থাক বলে নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে নিলাম। রুমে ঢুকে পা যেনো চলছেই না। বিছানা অব্দি যাওয়ার মত শক্তি নেই। শরীরের রক্ত চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম তৈরি হয়েছে, নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে যাবে পালা হয়েছে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বিছানার এক কোণে গাপটি মেরে বসলাম৷ বালিশ ঠিকঠাক করে আধ শোয়া অবস্থায় বিছানার সাথে হেলান দিয়ে শুয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। চোখে প্রচন্ড ঘুম চলে এসেছে কিন্তু চোখ বন্ধু করলে রোদের মুখটা ভেসে উঠছে। কানের কাছে জোরাল গলায় কারও ফরিয়াদ আম্মু আমাকে মেরে ফেলো না আমি মরতে চাই না আমাকে বাঁচাও৷ তোমরা তো কোন অবৈধ সম্পর্ক করনি যাতে করে তোমাদের চিন্তা হবে৷ তাইলে কেনো এত ভয় পাচ্ছো আম্মু। আমাকে তুমি মেরে ফেলো না আমি না তোমার পেটের সন্তান। প্লিজ আম্মু আমাকে মেরে ফেলো না৷ চিৎকার দিয়ে কাঁদছে। বাচ্চাটার কাকুতি মিনতি শুনে আমি ভয়ে লাফিয়ে উঠলাম। সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। পুরো শরীর ঘামে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। শ্বাসপ্রশ্বাস জোড়ে জোড়ে বেরিয়ে আসছে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ঝাপসা চোখে টেবিলের উপরে তাকালাম জগ ভর্তি পানি আর সামনে রাখা গ্লাস কিন্তু বিছানা দিয়ে নেমে পানি খাওয়ার মত শক্তি পাচ্ছি না। টিকতে না পেরে মা বলে চিৎকার দিলাম। মেয়ের চিৎকার শুনে রান্নাঘরে থাকা নীলিমা বেগম ছুটে এলেন মেয়ের রুমের কাছে কিন্তু একি দরজা তো ভিতর থেকে আটকানো তাইলে কি করে ঢুকে মেয়ের কাছে যাবে। হাত দিয়ে দরজাটাকে ধাক্কা দিচ্ছে নীলিমা বেগম তবুও এই দরজার খিল খুলতে পারছে না। ধাক্কাতে ধাক্কাতে মনে হয় রুমের দরজার এখনি ভেঙে ফেলবে।
নীলা বুঝতে পারল মা শত চেষ্টা করেও আটকানো দরজা খুলতে পারবে না তাই নিজেকে যথাযথ ভাবে সামলে নিয়ে বিছানা দিয়ে নেমে আগে দরজাটা খুলে দিল। দরজাটা খুলে দিয়ে এক কোণে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। মায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবারও মাথাটা নিচু করল।
নীলিমা বেগম মেয়ের দিকে এগিয়ে গেল। নীলা কি হয়েছে তোর? এত করে ডাকছি অথচ তোর কোন সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। নীলা কথা বল মা কি হয়েছে তোর? তাছাড়া এভাবে ভেঙে পরলে চলবে কি করে বল মা? রোদের সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে হবে। বুঝলাম না স্বামী-স্ত্রীর ভিতরে তো টুকটাক ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকে কিন্তু কি এমন কারণ যে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেওয়া লাগবে। মায়ের কথা শুনে কোন জবাব দিলাম না। কি আর জবার দিব, কি বলব মাকে, যে তার স্বামী মনে করে সে বুড়ো হয়ে গেছে দেখতে অসুন্দর হয়ে গেছে তার সাথে একদম মানায় না। আগেই সুন্দর ছিল যখন সে স্কুল থেকে কলেজে উঠেছে আর তার কয়েক বছর পরে বিয়েটা হয়েছে। অথচ বাচ্চা নেই তবুও আমি দিনদিন ফুলে যাচ্ছি, মুখে ব্রণ উঠে ভরে গেছে এমন মেয়ে মানুষ রোদের পছন্দ না। রোদ সব সময়ই বলে ছেলেদের সব সময় নিজের চেয়ে কমপক্ষে ১০-১৫ বছরের ছোট মেয়ে বিয়ে করা উচিত যাতে করে ছেলেদের বয়স ষাট হলেও সে বউয়ের সাথে দিব্যি আরামসে সংসার করতে পারে৷ বিয়ের প্রথম দিন থেকেই বুড়ি বলত, তারপর মাঝেমাঝে আমাকে বুড়ি বলত, আবার বলত আমার একটা বিয়ে করা দরকার তোমার পেট বড় হয়ে গেছে অনেক চর্বি হয়ে গেছে। বাবু নিলে সমস্যা হবে। প্রচুর টাকা খরচ হবে তার উপরে তুমি আরও মোটু হয়ে যাবে। স্লিম মেয়েরাই সিজার করতে মোটু হয়ে যায় আর মোটু মেয়েদের সিজার করলে… থাক আর নাই বা বললাম।
আমি হেসে হেসে উড়িয়ে দিতাম ভাবতাম হয়তো রোদ মজা করছে। এতদিন যে রোদের সচারাচর বলে যাওয়া কথা যেগুলোকে আমি মজা ভাবতাম সেগুলো সব সত্যি বলে বুঝতে পারলাম। ফোনে কার সাথে যেনো প্রেমের আলাপে মত্ত হয়েছে। তার কাছে হেসেহেসে আমার বদনাম করছে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে কথার প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য বিষয়ে আলাপ করে। যাক তবুও সবটা মেনে নিয়েছি। মনকে এটা বলে সান্ত্বনা দিয়েছি আর তো মাত্র কয়েকটা দিন পরে শ্বশুর শ্বাশুড়ি চলে আসবে তখন ভালো ভাবে তাদের কাছে সবকিছুর বিচার দিব। কিন্তু আজকে ডিভোর্সের পেপারটা হাতে পেয়ে আমার সব ভাবনা এক নিমিষে শেষ হয়ে গেছে। কল্পনাও করতে পারিনি যে এত তাড়াতাড়ি এত বড় একটা গিফট পাব।
কি না করেছি রোদের সাথে সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার জন্য যা বলতো মেনে নিতাম তবুও ওর মন কখনও ভরাতে পারিনি। পেটের বাচ্চাটাকেও…….চিৎকার দিয়ে কাঁদলাম মনের কষ্টটাকে হালকা করার জন্য তবুও যেনো মনের শান্তি ফিরে আসছে না। কত করে বলেছি রোদ আমি মা হতে চাই কিন্তু ওর পাষাণ মনটা কিছুতেই গলাতে পারিনি। যতবারই চেষ্টা করেছি ততবারই ব্যর্থ হয়েছি। পেটের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ছেড়ে দিলাম। মাথাটা ঘুরছে ভনভন করে মনে হচ্ছে এখুনি ফ্লোরে পড়ে যাব। অন্ধকারে চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এসেছে।
চলবে……………
নীলাকে জড়িয়ে ধরল নীলিমা বেগম। মেয়ের কান্না সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। বিশ্বাস করতে পারছে না নিজেকে। আজ নিজেদের ছোট্ট একটা ভুলের কারণে মেয়েটা তিলেতিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিভাবে মেনে নিবে নিজের মেয়ের চোখের কান্নাগুলো যা এখন বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়ছে। মেয়েকে সান্ত্বনা দেবার মত কোন ভাষা নেই নীলিমা বেগমের। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে হাসি মুখে মেয়ের চোখের জল মুছে দিল৷ গলাটা খকখক করে কাশি দিয়ে মেয়ের কপালে চুমো এঁকে দিয়ে বলল,
– আমি তো ভেবেছি তুই সাহসী মেয়ে অথচ আজ এভাবে কাঁদছিস! তোর মতো সাহসী মেয়ের চোখে এসব কান্না মানায় না৷ আরে কাঁদবে তো ঐ বেয়াদব রোদ যে তোকে মূল্যায়ন করতে পারেনি। তুই তো একটা হিরার টুকরো কাঁচের সাথে কি তোর মানায়?
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নীলা আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস তোর ভালো করতে গিয়ে জীবনের এত বড় একটা ক্ষতি করে ফেললাম। আমাদের ভুলের জন্য তোর চিরজীবনের বদনাম হয়ে গেছে।
মায়ের কথাশুনে কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। সত্যি মানুষগুলো আর মানুষ রইল না জানোয়ারের রুপে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম তারপর ধীর গলায় বললাম,
– মা আমি তোমার মেয়ে তাইতো অল্পতে ভেঙে পরতে শিখিনি। রোদের সংসার করতে পারিনি তো কি হয়েছে মা বাবার খেদমত তো করতে পারব৷ জানো মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত তাই তোমাদের খেদমত করেই বেহেশতে যেতে চাই।
মা চলে যাওয়ার আগে বিছানার বালিশের উপরে শুইয়ে দিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে মাথায় ভালো করে হাত বুলিয়ে গেলেন আর বললেন,
মায়ের পায়ের নিচে যেহেতু জান্নাত খুঁজে পেতে চাস তাইলে এটাও মনে রাখিস আল্লাহ সবকিছু ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেয় না। তবে একটা কথা মনে রাখবি আল্লাহ সৃষ্টি যখন করেছেন তাইলে সব সমস্যার সমাধানও নিশ্চয়ই করেছেন। তুই এখন চুপচাপ একটা ঘুম দে দেখবি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
নীলিমা বেগম রুম থেকে বেরিয়ে গেল চোখ মুছতে মুছতে শাড়ির আঁচলটা ভিজিয়ে।
ঘুম ভাঙল রাত ৯.০৫ মিনিটে। চোখ মেলে তাকালাম মাথাটা হালকা হালকা করে ব্যথা করছে। আড়চোখে বাহিরের দিকে তাকালাম বাহিরে পূর্নিমার আলোয় ঝলমল করছে চারিদিকটা। যেনো বসন্তের আগমন ঘটতে চলেছে। দমকা বাতাসে বেশ ভালো লাগছে। আড়মোড়া দিতে দিতে শোয়া ছেড়ে উঠে পা বাড়ালাম জানালার কাছে যাওয়ার জন্য হঠাৎ মনে পড়ল নাকফুলটার কথা। রোদের দেওয়া নাকফুল যেটা বিয়ের কয়েকমাস পরে সখ করে নিজের পছন্দে কিনে নিয়ে এসেছিল। নাকফুলটা পড়িয়ে দিয়েছিল পরম যত্নে যেনো ভালোবাসার মমতাগুলো ফুটে উঠেছিল রোদের হাতে। বিয়ের এতমাস পরে ঐদিনই প্রথম উপহার দিয়েছিল আমাকে। কথাটা মনে পড়ার সাথে সাথে এক সেকেন্ড ও দেরি না করে সোজা দৌড়ে গেলাম ওয়ারড্রবের কাছে। ড্রয়ারের চাবি দেয়ালের উপরে ঝুলানো ছিল সেখানে হাত দিয়ে নামিয়ে তালা খুলে বক্স বের করলাম। বক্সের ভেতরে রোদের দেওয়া নাকফুলটা সাজানো ছিল। খুব সযত্নে খুলে রেখেছিলাম যেদিন রোদের বাসা থেকে চলে আসি সেদিনই। তখন কাঁদতে কাঁদতে নাকফুলটা তুলে রাখি তবে কখনও কল্পনা করতে পারিনি এত তাড়াতাড়ি আমাদের ডিভোর্স হবে।
রোদ আমাকে পছন্দ করত না ওর শুধু মেয়েদের স্লীম শরীরটা পছন্দ ছিল যেটা আমার বিয়ের পরে হারিয়ে গেছে। অনেকবার চেষ্টা করেও ফিরিয়ে আনতে পারিনি আগের চেহারা৷ নাকফুলটা হাতে নিয়ে কয়েকবার নাড়াচাড়া করার পরে মনে হচ্ছে কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। যেহেতু রোদের সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই সেহেতু নাকফুলটা রাখাও ঠিক হবে না। নাকফুলটা হাতে নিয়ে ড্রেসিন টেবিলের কাছে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিলাম৷ সমস্ত মুখে কালো স্পষ্ট পড়ে গেছে, গায়ের রঙ কালচে হয়ে গেছে, গলায় কয়েকটা ভাজ পড়েছে আর ভাঁজের ফাঁকে ফাঁকে কালো দাগ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।
রাতে না ঘুমিয়ে কাটাতে কাটাতে চোখের নিচটা এমন কালো হয়ে গেছে। বিবাহিত জীবনে সুখ শান্তি না থাকলে যেমনটা হয় ঠিক তেমনি আমারও হয়েছিল।
নাকফুলটা কালকেই যেভাবে হোক রোদের কাছে পৌঁছাতে হবে৷ হঠাৎ মোবাইলে মেজেসের টোন বাজল। নাকফুলটা বক্সের ভিতরে রেখে ফোনটা হাতে নিলাম৷ ইনবক্স চেক করে দেখলাম রোদের নাম্বার থেকে মেজেস এসেছে। ভালো লাগছিল না মেসেজটা খুলতে তবুও কি লিখে পাঠিয়েছে সেটা জানার জন্য কৌতুহল বশত হয়ে খুললাম।
মেসেজটা এমন ছিল……
নীলা তোমাকে আমি বলেছিলাম না যে, তুমি আমার যোগ্য না কারণ রোদের জন্য অন্য রকম মেয়ের দরকার যা তোমার ভিতরে নেই। বিয়ের কয়েক মাসের ভিতরে তোমার চেহারা নষ্ট হয়ে গেছে দেখলে মনে হয় বাসার কাজের মেয়ে। পেট একদম উঁচু হয়ে গেছে মনে হয় পেটের ভিতরে কয়েকটা বাচ্চা। তোমাকে সাথে নিয়ে হাঁটলে মানুষ পিছনে বসে হাসাহাসি করত আর বলত ঐ দেখ রোদ তার আন্টির সাথে বের হয়েছে। কতদিন আর এসব সহ্য করা যায়। আমিও মানুষ আমার ও রক্তে মাংসে গড়া শরীর৷ দীর্ঘ আড়াইটা বছর এসব সহ্য করেছি যখন দেখলাম আর পারছি না তখনি তোমার সাথে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল।
জানো আজ আমি বিয়ে করেছি আমার চেয়ে ১৫ বছরের ছোট মেয়েকে। মেয়ের বয়স মাত্র ১৬ বছর কেবল ইন্টারমিডিয়েট ভর্তি হয়েছে একদম বাচ্চা। তুমি ওর সামনে দাঁড়ালে মনে হবে তোমার মেয়ে হা হা হা খুব মজা পেয়েছি ব্যাপারটা নিয়ে। যখন লিখছি তখন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়েছি। এখন সব কথার এক কথা ডিভোর্স লেটার তো হাতে পেয়ে গেছ এতক্ষণে কোন ঝামেলা করার চেষ্টাও করবে না। রোদ যেমন ভালো তেমনি খারাপের চেয়েও খারাপ। আর তোমার কাবিনের টাকা আগামীকাল হাতে হাতে পেয়ে যাবে।
মেসেজটা পড়ার পরে পাশে থাকা চেয়ারটা টেনে বসে পড়লাম। মাথায় চক্কর কাটতে শুরু হল। যেনো মাথার উপর সম্পূর্ণ আকাশটা ভেঙে পড়েছে। মোবাইলটা রেখে বেলকুনিতে গেলাম৷ আকাশের পানে এক পলক তাকিয়ে পাশে থাক রকিং চেয়ারের উপরে শুয়ে পড়লাম। চেয়ারটা বাবার। ছোটবেলায় দেখতাম কোন চিন্তায় পড়লে বাবা চেয়ারের উপরে সোজা হয়ে টান টান হয়ে চোখ বন্ধ করে থাকত। খানিকটা সময় পাড় হলেই পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে পুরো প্যাকেটটা শেষ করে তারপর ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসত। ব্যাস এরপর আর কোন চিন্তা করত না। আমার ক্ষেত্রে উল্টোটা হবে কারণ পুরুষ মানুষ কষ্ট ভুলে থাকার জন্য সিগারেটের ধোঁয়া উড়ায় আর আমি সেগুলো পারব না। তাই সব কষ্ট ভুলে থাকার জন্য কি করা উচিত বুঝতে পারছি না। চোখ খুলে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকলাম অজু করে বেরিয়ে আসলাম। জয়নামাজ বিছিয়ে নফল নামাজ আদায় করে কুরআন শরীফ পড়লাম। আল্লাহর সাথে কাঁদলাম মনের শান্তির জন্য। বেশ ভালো লাগছে মনটা সুস্থ লাগছে মস্তিষ্ক।
পড়ন্ত বিকেল খোলা আকাশের নিচে ছাদের মাঝখানে মাদুর বিছিয়ে বসে বসে পিঠা বানাচ্ছি। রোদের পাঠানো টাকা মায়ের একাউন্টে জমা হয়েছে আজ সকালে যার মেসেজ কিছুক্ষণ আগে এসেছে। মেসেজটা দেখা মাত্রই রুম থেকে বেরিয়ে কোথাও এক সেকেন্ড না দাঁড়িয়ে সোজা চলে এসেছি ছাদে। শুক্রবার বাবা বাসায় আসবে। গ্রামের জমি জমা নিয়ে মামলার রায় ছিল আজ। জানি না ফলাফল কাদের পক্ষে গিয়েছে। বাবা খুব সাধারণ মানুষ কোন ঝামেলার ভিতরে যাওয়াটা পছন্দ করে না তাই তো সব সময় নিজেকে আড়ালে রাখে। মেয়ের ডিভোর্সের কথা ভেবে বিন্দুমাত্র মন খারাপ না করে বরং আমাকে বুঝালো এসব বিয়ে, সংসার সবকিছু আল্লাহ তালার গিফট তাই এগুলো জোড় করে কখনও আদায় করা যাবে না। একটু শান্ত হও মা সময়ের সাথে সাথে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সেদিন বাবার বোঝানো কথাগুলো শুনে ভীষণ ভালো লেগেছিল মনে সাহস পাচ্ছিলাম বেঁচে থাকার।
শুক্রবার সকাল সকাল উঠে বাবার পছন্দমতো সব খাবার রান্না করলাম যাতে করে বাবা খুশি হোন।
সকাল ১১ টায়,
বাবার নাম্বার থেকে কল আসল। কলটা রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে বাবা বলল,
– নীলা মা কেমন আছিস? মা রে সকালে আসার কথা ছিল কিন্তু সমস্যা জনিত কারণে সকালের বাসটা ক্যানসেল হয়েছে। বাস মালিকেরাই বিকালে আসার টিকিটের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
– তার মানে তুমি বিকালে আসবে? কয়টা বাজবে বাসায় পৌঁছাবে?
– জানি না মা গাড়ি চালানোর উপরে নির্ভর করছে।
– ঠিকাছে। সাবধানে আসবে। কারও দেওয়া কোন কিছু খাবে না।
আজমল সাহেব মেয়ের এমন বাচ্চাদের মতো কথাটা হাসি মুখে উড়িয়ে দিয়ে বলল,
– নীলা আমি কোন বাচ্চা নই মা দুমাস আগে বয়স আমার পঞ্চাশ পেরিয়েছে।
– হা জানি বাবা কিন্তু তাতে কি হয়েছে তুমি তো আমার বাবা তাই আমার কাছে বাচ্চাদের মতোই।
– ঠিকাছে আমার পাগলী মেয়েটা। আচ্ছা শোন অনেক কাজ আছে বাসায় এসে মন খুলে কথা বলব৷
– হুম।
বাবার সাথে কথা বলা শেষ করে মায়ের কাছে রান্নাঘরে ঢুকলাম। মা তরকারি কাটতেছে। মনটা অস্থির লাগছে তবুও মাকে বললাম,
– মা….
নীলিমা বেগম উপরের দিকে মুখ করে বলল,
– কি রে বাবার সাথে কথা বলা শেষ?
– হ্যাঁ মা। কিন্তু তুমি কি করে জানলে যে আমি বাবার সাথে কথা বলেছি?
মাথাটা নাড়িয়ে আবারও তরকারি কাটতে শুরু করল নীলিমা বেগম৷ বেগুনের পেটে যখন বটিটা ঢুকিয়ে কয়েক টুকরা করে বাটিতে রাখল তখনি মাথাটা চক্কর কাটতে লাগল। চোখের সামনে সমস্ত কিছু ধোঁয়াশা মনে হল। মা বলে চিৎকার দিয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়তেই তরকারি ফেলে দিয়ে ফ্লোরে পড়ার আগেই ধরে নিল।
হঠাৎ জ্ঞান ফিরতেই অবাক হয়ে যাই। নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সকাল ৮ টা৷ বিছানার পাশে চেয়ারে বসে বসে ঘুমাচ্ছেন বাবা৷ বাবাকে দেখে চমকে উঠলাম। তার মানে আমি গতকালকে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। কিছুই তো আমার মনে নেই।
চলবে………..
শোয়া ছেড়ে উঠার চেষ্টা করলাম। হাতে টান লাগতেই উফফ ব্যথা অনুভব করলাম। লক্ষ্য করলাম বেডের পাশে ইঞ্জেকশন রাখা। হাতের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করলাম কয়েকটা ফুটো হয়ে লাল হয়ে আছে তখনি বুঝতে পারলাম এটা ইঞ্জেকশন লাগানোর চিহৃ। রুমের চারিদিকে চোখ বুলালাম কিন্তু মাকে দেখলাম না। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে এখুনি পানি খেতে হবে।
বাবাকে কি ডাকাটা ঠিক হবে বুঝতে পারছি না। কিন্তু পানি খাওয়াটা খুব জরুরি না হলে শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যেতে ও পারি৷ অনেকটা অনিচ্ছা স্বত্বেও বাবাকে ডাকলাম, বাবা ও বাবা পানির পিপাসা পেয়েছে। বাবার কানে ডাক পৌঁছাতেই বাবা চোখ মেলে তাকিয়ে কি মা কিছু বলবি?
– পানি খাব।
আজমল সাহেব টেবিলের উপরে রাখা পানির বোতলটা হাতে নিয়ে মুখ খুলে আমার হাতে ধরিয়ে দিল। বোতলটা হাতে পেয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিলাম। নরম গলায় বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম,
– বাবা মা কোথায়?
– একটু আগে বাসায় গেছে। গোসল করে ১১ টার দিকে আসবে।
– ওহ্।
– নীলা তোর শরীর কেমন এখন?
– ভালোই লাগছে এখন তবে মাথায় একটু চক্কর কাটছে। জানি না কালকে কি হয়েছিল আমি কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই সেন্সলেস হয়ে পড়ি। তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তাই না! পারলে ক্ষমা করে দিও। মেয়ে হয়েছি বলে তোমাদেরকে আজ এত অপমান সহ্য করতে হচ্ছে যদি ছেলে হতাম তাইলে তো আর এসব সহ্য করতে হত না।
– নীলা একদম বাজে কথা বলবি না। তাড়াতাড়ি নাস্তা করে ওষুধ খেয়ে নিবি বিকালে তোকে বাসায় নিয়ে যাব।
– বাবা, ডাক্তার আমার বিষয়ে কি বলেছে? কি হয়েছে আমার কিছু বলেছে?
– না মা তেমন কিছু বলেনি। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করতে বলেছে শরীর খুব দূর্বল।
– ওহ্।
– মা তুই এখন বিশ্রাম নে আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসতেছি।
বাবা চলে গেলে বেডের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম৷
বিকালে বাসায় ফিরলাম। বাবা আমার পছন্দ মতো বাজার করতে বেড়িয়ে গেলেন। বাবাকে এত করে বললাম আমার জন্য এক্সট্রা কোন বাজার করা লাগবে না যা তোমরা রান্না করবে তাই খাব৷ কিন্তু বাবা শুনল না সে আমাকে ধমক দিয়ে সোজা বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
বাজার থেকে একগাদা জিনিসপত্র কিনে এনে আমার সামনে রাখল। তারপর হাসিমাখা মুখে বলল,
– মা বল রাতে কি রান্না করব? আজকে আমি নিজের হাতে তোকে রান্না করে খাওয়াব।
– না বাবা আমি থাকতে তুমি কেন রান্না করবা।
নীলিমা বেগম এসে বাহ্ বাহ্ বাপ মেয়ের কি মিল মায়ের কথা একটাবারও চিন্তা করে না তারা। শুধু নিজেরাই রান্না করবে বলে চিল্লাচ্ছে। বলি কি তোর মা কি মরে গেছে যে পুরুষ মানুষের রান্না করা লাগবে আবার অসুস্থ শরীর নিয়ে তোর।
আজমল সাহেব নীলিমা বেগমকে বলল,
– ঠিকাছে যাও তোমাকে আমি দশ টাকা দিব তার বিনিময়ে তুমি পোলাও, রোস্ট আর ঝাল গোশত রান্না করবে বলে অন্যদিকে ফিরে হাসল। আসলে তোমার রান্না অনেক ইয়াম্মি হয় সো এখনি পিপারেশন নাও।
রুমে গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছি। আর কয়েকদিন পরে রমজান শুরু হবে। এবার গরমের তীব্র আবহাওয়াতে রমজান শুরু হবে। আম, কাঁঠাল পাকার সাথে সাথে মানুষের শরীরও পাকা শুরু করবে। বাহিরে ভালোই বাতাস বইছে। বেশ ভালো লাগছে বাহিরের পরিবেশটা৷ জানালার পর্দা ঠিকমতো টেনে রুমে গিয়ে বিছানায় বসলাম। ক্লান্ত লাগছে। মা তো পোলাও রান্না করতেছে অথচ আমার তো খেতে ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ বিছানার বালিশের পাশে নকশিকাঁথা দেখলাম। এই তো গতবছর কাঁথাগুলো সেলাই করেছিলাম নিজের বাচ্চাকে কোলে তোলার জন্য৷ কিন্তু কি হল এগুলো? পেটের দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই চোখের কোণে পানি চলে এল। ধরে রাখতে পারলাম না তাই তো বৃষ্টির মতো টিপটিপ হয়ে গড়িয়ে পড়ল হাতের উপরে। চোখদুটো লাল হয়ে আছে। কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। শরীরটাও বড্ড খারাপ লাগছে। খুব দূর্বল লাগছে। মনে পড়ল কালকে ২৫ তারিখ রোদের জন্মদিন। দীর্ঘশ্বাস নেওয়ার সাথে সাথে বুকটা হাহাকার করে উঠছে। চোখ বন্ধ করলাম।
বধুবেশে লাল বেনারসি শাড়ি পড়ে লম্বা ঘোমটা টেনে দিয়ে বসে রইলাম নতুন বউয়ের বেশে। মাত্র আধাঘণ্টা আগেই কাজী সাহেব এসে বিয়েটা সম্পন্ন করে চলে গেছে। ঘর ভর্তি মেহমান। সবাই টিপাটিপি করে প্রায় সমবয়সী ছেলেমেয়েদের বিয়েটা বেশিদিন টিকে না অন্ততপক্ষে ৫ বছরের ব্যবধান থাকা উচিত। ছেলের পরিবার কি দেখে যে এমন মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে আল্লাহই ভালো জানেন। মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি হয়। ত্রিশ বছর হয়ে গেলে বাচ্চাকাচ্চা হতে চায় না। নীলার বয়স তো প্রায় ২৫ ছুঁই ছুঁই। ছেলের বয়স নাকি ২৭। মাত্র ২ বছরের ব্যবধান। মানুষ তো কানা ফুসফুস করবেই এটা স্বভাব বলা চলেন।
আসলে সত্যিটা হল নীলার আইডি কার্ডে ২ বছর বাড়ানো বর্তমান বয়স ২৩ বছর অথচ আইডি কার্ডের কারণে ২৫ বছর চলছে। বাবা যখন ফরম ফিলাপ করে তখন দু’বছর বাড়িয়ে দিয়েছিল যাতে করে ইন্টারপাশ করার পরপরই সেনাবাহিনীর চাকরি পাই। বাবার খুব সখ ছিল আমাকে সেনাবাহিনীর পদে চাকরি করানোর। নিজের স্বপ্নটা তো পূরণ করতে পারেনি তাই তো আমাকে বানিয়ে পূরণ করতে চেয়েছিল। যখন চাকরির জন্য নিবন্ধন করি সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিল মাঝপাথে এমপির একজন লোকের কারণে চাকরিটা হল না। সেদিন বাবা কেঁদে কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিল।
সবার কথাগুলো কানে ভেসে আসছিল কিন্তু উত্তর দেওয়ার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
অনেকক্ষণ ধরেই অপেক্ষা করছি বাসরঘরে এখনো কেউ আসেনি। অপেক্ষা….অপেক্ষা….অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ি। আচমকাই দরজা লক করার শব্দে ঘুম ভাঙল আমার। পুরো রুম অন্ধকারে ছেয়ে আছে সামনে তাকিয়ে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ভালো করে লক্ষ্য করার পরে খেয়াল করলাম কারও ছায়া দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে আসল পাঞ্জাবি পড়া মানুষটি। বুঝতে বাকি রইল না যে ইনি আমার স্বামী হবে যার সাথে কিছুক্ষণ আগে বিয়ে হয়েছে।
আমি খাটের উপরে ভালো করে আঁটসাঁট হয়ে বসলাম। মাথার ঘোমটাটা টেনে ঠিকমতো বসলাম। সামনে থাকা লোকটি মূর্তির ন্যায় আমার সামনে দাঁড়িয়ে রইল এক পা সামনে বা পিছনে করছে না। অনেকক্ষণ ধরে অবাক দৃষ্টিতে আঁড়চোখে বিষয়টা লক্ষ্য করলাম কিন্তু কি জিজ্ঞেস করব কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তবে একটা মজার বিষয় হল যাকে আমি বিয়ে করেছি তাকে আমি বিয়ের আগে দেখিনি। না সে আমাকে দেখেছে না আমি তাকে। সেকারণেই সে হয়তো টেনশনে আছে। বাবা মা বিয়েটা ঠিক করেছে। না দেখে বিয়েতে রাজি হচ্ছিলাম না তবুও বাবা মা জোড় করেই মতের বিরুদ্ধে আমার বিয়েটা দিল। কেনো দিল জানি না। এখন আর জানতেও ইচ্ছা করছে না শুধু এটাই জানতে ইচ্ছা করছে তিনি কেনো আমাকে বিয়ে করেছে? খুব জানতে ইচ্ছা করছে।
শুনেছি উনাদের অনেক টাকা আছে তাহলে আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েকে কেনো বিয়ে করল তাও আবার না দেখে। অনেকটা কৌতুহল বশত সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম,
– এই যে শুনুন, আপনি কি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি এদিকে আসবেন।
আমার কথায় সে অনেকটা বিরক্ত ফিল করল। জোড় গলায় বলল,
– আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকব না রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকব সেটা একান্তই আমার ব্যাপার তুমি বলার কে? আমার তো তোমাকে দেখে সন্দেহ হচ্ছে বিনা চিন্তায় একদম নিশ্চিন্তে বধুবেশে বসে থাকতে দেখে। আচ্ছা একটুও ভয় লাগছে না। বিয়ের আগে তো আমাকে দেখনি আমি কালো না গুন্ডা খুনি না মাস্তান এসব নিয়ে তোমার কি মাথা ব্যথা নেই? দুনিয়াতে এত মানুষ দেখছি তোমার মত বেহায়া মেয়ে কোথাও দেখিনি।
রোদের কথায় রাগে সমস্ত শরীর জ্বলতে লাগল। তড়িঘড়ি করে মাথার ঘোমটটা তুলে নিলাম। এমন সময় বিদুৎ চলে এসেছে। তার মানে এতক্ষণ বিদুৎ ছিল না।
রোদকে দেখে জোড়ে তু……….তুমি।
– এই তুমি।
দু’জনের মুখ হা হয়ে গেল। রোদ ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকায়। তোতলাতে তোতলাতে বলল,
– তুমি এখানে? কিভাবে সম্ভব? এটা হতে পারে না।
– আমারও তো একই প্রশ্ন তুমি এখানে?
দুজনেই সাপের ন্যায় ফুলতে লাগল। রোদ রুম থেকে বেরিয়ে গেল আর আমি বিছানার বালিশের উপরে শুয়ে পড়লাম। মনে মনে গালাগাল করতে লাগলাম। হারামী, কুত্তা তুই এখানে কিভাবে? দুনিয়ার লুচ্চা ছিলি এখন আমার কপালে এসে জুটলি। এ্যা….এ্যা… আমার সাথেই কেন এমনটা হল।
এদিকে রোদ হাঁটছে আর ভাবছে শালী তোকে আমার কোনদিনও পছন্দ ছিল না। বুড়ি জানি কোথাকার, উফফ এর সাথে হাঁটলে জীবনটা শেষ। সবাই হাসাহাসি করবে। না না এর একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
রোদ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে থাকা সিগারেট জ্বলছে। একে একে কয়েকটা সিগারেট টেনে ফিল্টারগুলো উপর থেকে নিচে ছুঁড়ল। রাত প্রায় দুটো বাজতে চলছে এত রাতে বেলকুনিতে দাঁড়ানো ঠিক হবে না। কেউ দেখলে খারাপ ভাববে বলবে আজকেই বিয়ে করে নতুন বউ ঘরে এনেছে আর আজকেই তাকে রুমের বাহিরে পাঠিয়ে দিয়েছে। যত্তসব অপদার্থ লোকজন।
মানুষের তো খেয়ে দেয়ে কোন কাজ নেই পরের জিনিস সবার কাছেই সুন্দর লাগে তাই তো সবার নিজের বউকে ভালো না লেগে পাশের বাড়ির ভাবীকে সুন্দর লাগে। কি রুচি একেকজনের ভাবলেও বমি আসে।
চলবে…………
রোদের চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। বাবা দেখেশুনে এমন একটা মেয়ের সাথে বিয়েটা করাবে যেটা তার কল্পনার বাহিরে ছিল। সেদিন যদি কোর্ট কাচারিতে না জড়াত তাইলে হয়তোবা এত বড় শাস্তিটা পেতে হত না। রুশাকে আমার ভালো লাগে ওকে বিয়ে করার কথা ছিল কিন্তু ও যে এত বড় বেইমানি করবে সেটা ভাবতে পারেনি। মানুষ তো ভালোবাসে কিন্তু বিয়ে করতে চায় না অথচ সে রুশাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল আর সে ধোঁকা দিল। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না তবুও প্রতারিত হতে হয়েছে রোদকে। যাক সবটা মেনে নিয়েছিল তবুও কেনো জানি রুশাকে ভুলতে পারল না আর এটাই তার একমাত্র ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
রোদ হাতে থাকা ঘড়ির দিকে বারবার দেখতে লাগল। রাত অনেক হয়েছে। ঘুম ও পেয়েছে কিন্তু রুমে তো ঐ….কথাটা শেষ করার আগেই জিহব্বাতে কামড় বসিয়ে দিল। সিগারেট অতিরিক্ত খাওয়াতে মুখটা কেমন তেঁতো হয়ে আছে পানির পিপাসা পেয়েছে খুব। তাই আর দেরি না করেই বেলকনি থেকে চলে ডাইনিং রুমে আসল পানি খেতে। ডাইনিখ রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে তখনি চোখ পড়ল ফ্রি খুলে মা যেনো কি বের করছে। ভয়ে আর সামনে এগোলাম না। এই রাতে মা যদি আমাকে এখানে দেখে ফেলে তাইলে কাজ সেরে যাবে। চেচামেচি করতে করতে সবাইকে ঘুম থেকে তুলে ফেলবে। পানি না খেয়েই রুমের দিকে রওনা দিল।
রুমের সামনে এসে পায়চারি করছে। ঢোকার মত সাহস খুজে পাচ্ছে না। অনেকটা রাগ নিয়ে রুমে ঢুকল রোদ। এক পা দু পা করে এগিয়ে গেল বিছানার কাছে। টেবিলের উপরে জগে পানি রাখা দেখে পিপাসার কথাটা মনে পড়ল। জগ থেকে পানিটা ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিল রোদ। মাথার উপরের কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে টপটপ করে। পিছনের দিকে ফিরতেই আচমকাই পায়ে হাত দিয়ে সালাম দেওয়ার অনুভূতিটা টের পেল রোদ। লাফিয়ে উঠে এক হাত দূরে সরে বলল,
– এই কি করছ এসব? পা ধরছ কেন?
লাজুক স্বরে জবাব দিলাম,
– টিভিতে তো দেখেছি বাসর রাতে স্বামী ঘরে আসলেই নতুন বউয়েরা তার পায়ে সালাম করে। সালামের পর্ব শেষ হওয়ার পরে স্বামী তাকে তুলে থুঁতনিতে হাত দিয়ে কপালে চুমো এঁকে দিয়। তারপর হাত ধরে বিছানার উপরে বসে। তারপর….তারপর…..!
ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকায় রোদ। তারপর টা তোমার কাছেই রাখো।
মুখটা ভেংচি কেটে বিছানায় গিয়ে শোয়ার প্রস্তুতি নিলাম। কাৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। শরীরটা মেজমেজ করছে। মায়ের সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছা করছে। তবে রাত বেশি হওয়ার কারণে সব চিন্তা ধুলোয় মিশিয়ে দিলাম। রুমের ভিতরে ডিম লাইট জ্বালিয়ে রেখেছে রোদ। এতক্ষণ কোন লাইট জ্বালানো ছিল না হঠাৎ করে সে লাইট জ্বালিয়ে রেখেছে। লাইটটা এমন জায়গায় রাখা যে সব আলো এসে আমার চোখে মুখের উপরে পড়ে। লাইটের আলো চোখে পড়লে আমি আবার ঘুমাতে পারি না। বিয়ের প্রথম রাতেই যদি উনাকে এত আদেশ করি তাহলে তো সে রিতীমত বিরক্ত হবে আমার উপরে।
প্রায় ভোর হয়ে এসেছে রোদ এখনো বসে আছে। মোবাইলের আলো চোখে পড়ছে বুঝতে পারলাম সে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত৷ অনেকটা বিরক্তির সুরে রোদকে বলতে বাধ্য হলাম কারণ উনার যে পালা তাতে সোজা কথায় ঘি উঠবে না। গলাটা খকখক করে কাশি দিয়ে বললাম,
– এখন কি সন্ধ্যা নাকি সকাল লাইট তো জ্বালিয়ে রেখেছ আবার মোবাইলটাও চালাচ্ছে। আমাকে বিয়ে করে এনেছেন নাকি বাসার জন্য পার্মানেন্ট ঝি কিনে এনেছেন। নতুন বউয়ের যে কত কিছুর প্রয়োজন হয় সেটা কি মাইক নিয়ে বলা লাগবে নাকি চোখ দিয়ে দেখবেন।
– নিশ্চুপ রোদ।
– কি হল কথা শুনতে পাচ্ছেন না?
– এই মেয়ে এত ঘ্যানঘ্যান করবে না তাইলে মাঝরাতে রুমের বাহিরে পাঠিয়ে দিব। ঘুমিয়ে পড় না হলে তোমার…..
– না হলে কি করবেন? হা শুনি তো একটু, আমাকে হুমকি দিচ্ছেন যে বাহিরে পাঠিয়ে দিব। এত তাড়াতাড়ি সেদিনের কথাটা ভুলে গেছেন মনে হয়৷ সেদিন তো পুকুরে ধাক্কা মেরেছিলাম আবার উল্টাপাল্টা কিছু বললে সোজা নদীতে নিয়ে চুবিয়ে আনব। এটা ভাববেন না আপনার ঘর দেখে আপনার সাথে সন্ধিহান করব। এখন রুমের লাইটটা ভালোয় ভালোয় বন্ধ করে পাশে এসে শুয়ে পড়েন।
রোদের মেজাজ পুরো তিনশো ষাট ডিগ্রিতে গরম হয়ে গেছিল। ইচ্ছা করছিল কাঁচা গিলে খেতে কিন্তু বউ বলে এ যাত্রায় বেঁচে গেছে।
রোদ মেজাজ গরম করে লাইট বন্ধ করে বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে সোফার উপরে শুয়ে পড়ল। অন্ধকারে কোন কিছু দেখাচ্ছে না। রোদ চুপচাপ শুয়ে পড়ল অন্যপাশ ফিরে।
আমিও অপর দিকে কাৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। বিয়ে তো হয়েই গেছে সারাজীবন এই লোকটাকে সহ্য করতে হবে যেটা খুবই দুঃখ জনক। মাথাটা প্রচণ্ড রকমের ব্যাথা করছে। হাত দিয়ে কপাল টিপলাম তবুও অসহ্য লাগছে। এমনিতেই প্রচন্ড রকমে গরম পড়েছে। এপাশ ওপাশ করে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালের সূর্য্যের আলো চোখে পড়তেই লাফিয়ে উঠলাম শোয়া ছেড়ে। ঘড়ির দিকে তাকালাম সকাল ১০ টা বেজে ১০ মিনিট৷ জিহব্বাতে কামড় বসিয়ে এই যা কাজ সেরেছে তাইলে নতুন বাসায় প্রথম দিনেই এত বেলা জরে উঠেছি বাড়ির লোকজন কি মনে করবে ভাবতেই বুকের ভিতরটা অস্থির হয়ে উঠল। বাড়ির লোকজন কি মনে করবে আল্লাহ ভালো জানেন। হাই তুলতে তুলতে বিছানা দিয়ে নামলাম। সাথে আনা ব্যাগ থেকে ব্রাশ বের করলাম। ওয়াশরুমে ঢুকে টুথপেষ্ট খুঁজে না পেয়ে বেরিয়ে বাহিরে আসলাম। রুমের চারিদিকে চোখ বুললাম কোথাও টুথপেষ্ট দেখতে না পেয়ে চিন্তা পরলাম। দাঁত কিভাবে মাজবো বুঝতে পারছি না।
সামনে হাত দিয়ে টুথপেষ্ট এগিয়ে দিল রোদ।
– দাঁত ব্রাশ করে নাও না হলে মুখ দিয়ে পঁচা গন্তব্যে আসবে।
কথা বলার জন্য হা করতেই রোদ ধমক দিয়ে বলল,
– একদম চুপ কোন কথা বলবে না। বলছি না মুখ দিয়ে পঁচা গন্ধ বের হবে।
রোদের হাতে থাকা টুথপেষ্টটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। দাঁত ব্রাশ করে বেরিয়ে এসে দেখে রোদ বিছানার উপরে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। আমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে গলায় ভার এনে বলল,
– ভালো করে দাঁত ব্রাশ করেছ?
রোদের কথায় পুরো স্তব্দ হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় খুঁজে পেলাম না।
চলবে…..
মাথা ব্যাথার কারণে গতকালকে গল্প দিতে পারিনি। আর আজকের পর্বটাও ছোট হয়ে গেছে।
রোদ গলাটা সেরে আবারও বলতে লাগল নাস্তা করতে মা নিচে ডাকছে।
– হুম।
– তাড়াতাড়ি কর মা আবার দুপুরের রান্না করতে রান্নাঘরে ঢুকবে। তাছাড়া বাড়ির বউয়েরা এত দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখো চেহারা দেখলে মনে হয় সারারাত পাহাড়া দিয়ে সকালবেলা শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছ। শান্তির ঘুমের মানে বোঝ? বোঝ না জানতাম। আমিই বলি তাইলে শোন শান্তির ঘুম মানে কাউকে খুন করে গোসল সেরে যে ঘুমটা দেয় ওটাই হচ্ছে শান্তির ঘুম। রাতে পাহাড়া দিয়ে আর সকালে নাক ডেকে ঘুমাবে।
রোদের মুখে নাক ডাকার কথাটা শুনে রিতীমত অবাক না হয়ে পারলাম না তার মানে সত্যি কি আমি নাক ডেকে ঘুমাই? হতেও পারে বলা তো যায় না কিন্তু…কিন্তু মা তো কখনও এমনটা বলেনি যে নীলা তুই নাক ডেকে ঘুমাও। মুখটা কুঁচকে গেল কি বলবে উত্তর খুঁজে পেল না। যেই বলা সেই কাজ।
– আচ্ছা মিস্টার রোদ, আপনাকে কে বলেছে যে আমি নাক ডেকে ঘুমাই। তাছাড়া মায়ের সাথে তো ছোটবেলা থেকেই ঘুমিয়েছি কখনো তো বলেনি যে আমি নাক ডাকি! আর তুমি..?
– হা হা হা তোমার মা বলেনি বলে কি আমি বলব না, যা সত্যি তাই বলেছি। তুমি নাক ডেকে ডেকে আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছ।
রোদের কথায় সত্যতা প্রমাণ মিলেছে তাই আর কথা বাড়ালাম না সোজা রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং রুমে গেলাম৷
রোদের মা টেবিল গুছাচ্ছে। অনেকটা ভয়ে ভয়ে মায়ের কাছে এগিয়ে গেলাম। কাঁপা গলায় বললাম,
– স্যরি মা আসলে বিশ্বাস করেন আমি ইচ্ছা করে এত বেলা করে ঘুমাইনি। নতুন জায়গা নতুন পরিবেশ তাই হয়তোবা একটু বে….বলে হা করতেই রোদের মা হেসে হেসে জবাব দিল ধুর পাগলী মেয়ে কোথাকার তোকে কি আমি কারণ জিজ্ঞেস করেছি? আমি তো জানি তুই ইচ্ছা করে ঘুমাসনি। আমিও তো কোনদিন বউ হয়ে এসেছি এ বাড়িতে তাই না। আজ না হয় চুল পেকে বুড়ি হয়ে গেছি তাই বলে কি এই পাঠ পড়িনি। জানিস তুই তো তবুও ১১ টার পরে নাস্তার টেবিলে এসেছিস আর আমি দুপুর তিনটে বেজে দশ মিনিটে লাঞ্চ করতে টেবিলে এসেছিলাম। জানিস বাড়ি সুদ্ধ মেহমান সবাই যে কত করে হাসাহাসি করেছে সেটা সামনাসামনি না থাকলে বুঝা যাবে না। লজ্জায় তো একদম গোল টমেটোর মত চেহারার অবস্থা বানিয়েছিলাম তবে তোর শ্বশুর অনেক সাপোর্ট দিয়েছিল না হলে তো কাঁদতে কাঁদতে দিনটাই মাটি হয়ে যেত। এই দেখ তোকে আমি খেতে দিব তা না করে দাঁড়িয়ে রেখে গল্প করছি৷
– মা আসলে কোন সমস্যা নেই ভালোই লাগছে কথাগুলো শুনতে।
রিদিতা বেগম নাস্তার প্লেটটা আমার সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল,
– নে জলদি নাস্তাটা সেরে ফেল। আমি আবার দুপুরের রান্না বসাব। সন্ধ্যার পরে আবার বাসায় মেহমান আসবে অনেক কাজ আছে। তুই তাড়াতাড়ি খেয়ে রুমে গিয়ে বিশ্রাম নে। শুক্রবার তোদের বাড়ির লোকজনকে দাওয়াত দিয়েছি সব মিলিয়ে কয়েকদিন ঝামেলায় থাকতে হবে।
– মা ছোট মুখে একটা কথা বলব যদি রাগ না করেন।
– হা বল তুই এসব কি বলছিস ছোট মুখ মানে কি? তুই বাড়ির বউ তাই তোর সবকিছু বলার অধিকার আছে। বলে ফেল কি বলবি?
– গতকালকেই তো আমার বাসার লোকজনকে দাওয়াত দিলেন তাইলে তাদেরকে আবারও দাওয়াত দিলেন যে?
– মেয়েকে তারা পরের বাড়ি দিল সেটা কি আর দেখবে না? আমি জানি মেয়েকে বিদায় দিলে মায়ের কলিজাটা খন্ড খন্ড হয়ে যায়। আর বাবা তার কথা না বললেও চলে কারণ পুরুষ মানুষ এতটাই শক্ত যে সব কষ্ট তারা সহ্য করতে পারে।
মায়ের অনুভূতিগুলো শোনার পরে নিজেকে খুব গর্বিত মনে হচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম,
– মা আমি কি আপনার সাথে রান্নাঘরে যাব?
– এখন না নীলা, যখন সময় হবে আমি নিজেই তোকে ডেকে নিব৷
– হুম।
নাস্তা খাওয়া শেষ করে রুমে ঢুকলাম। রোদ তখন ফোনে ব্যস্ত। আমি ভিতরে ঢুকতেই রোদ ফোনটা হাত থেকে নামিয়ে কেটে বিছানার উপরে রাখল।
– মায়ের সাথে গল্প করা কি শেষ?
– হুমম৷
আর কোন কথা না বাড়িয়ে মোবাইলটা নিয়ে বেরিয়ে গেল রোদ।
এভাবে কেটে গেল ছয় মাস।
রোদের সাথে আজ পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হয়ে ওঠেনি যদিও রোদের থেকে কোন রেসপন্স ছিল না। প্রায়ই রাতে মোবাইলে কথা বলত আবার ফেসবুকে চ্যাটিং করে রাত কাটিয়ে দিত তবুও বউয়ের দিকে ফিরে তাকাত না। খুব জানতে ইচ্ছা করত কি কারণে সে এমনটা করছে৷ কলেজে বসে খুব বিরক্ত করত তাই তো তাকে পাত্তা দিতাম না কিন্তু এখন তো বিয়ে হয়েছে তাহলে? রোদকে স্বামী হিসাবে খুব করে পেতে চাইতাম আল্লাহর কাছে নামাজ পড়ে বলতাম জেনো সে আমার প্রতি নমনীয় হয়ে স্ত্রীর মর্যাদা দেয়। ধৈর্য ধরে থেকেছি কবে সেই মূহুর্ত আসবে।
রাত তখন পৌঁনে একটা বাজে। বাসার ভিতরে আমি একা। সন্ধ্যা থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির ফোঁটা গুলোও বড়বড়৷ শ্বাশুড়ি মা আজকে আর বাসায় ফিরবে না বলে গেছেন৷ তার বোনের মেয়ের আজ ডেলিভারি হওয়ার কথা যার কারণে আজকে আসতে চাইলেও আসা সম্ভব না৷
ঘড়ির কাটা টিকটিক করে ঘুরছে কিন্তু রোদের আসায় নামগন্ধ নেই। বাহিরের বৃষ্টির মাত্র তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে। রাত প্রায় দেড়টে বাজে চোখের পাতাগুলো সবেমাত্র একের সাথে এক লেগেছে তখনি দরজায় কলিংবেল বাজল। ঘুমের মধ্যে লাফিয়ে উঠলাম। হঠাৎ কানে আসল দরজা লক খোলার শব্দ। তখন বুঝতে পারলাম রোদ এসেছে৷ চোখদুটো জ্বলছে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত ঘুম আমার চোখে নেমে এসেছে। অনেক কষ্টে চোখের পাতাগুলো মেলে রাখার বৃথা চেষ্টা করছি। কথায় আছে না ঘুম তো আর মানব সৃষ্টি নয় ইচ্ছা করলেই কেউ ঘুমাতে পারে না আর ইচ্ছা করলেই কেউ না ঘুমিয়ে থাকতে পারে না। শরীরটা তো একটা যন্ত্র মাত্র। একজন তার পরিচালক। এবার আর দিশাবিশা না পেয়ে বিছানা দিয়ে নেমে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। কল ছেড়ে দিয়ে চোখেমুখে পানি ছিটালাম। আয়নার দিকে ভালো করে খেয়াল করলাম চোখদুটো লাল হয়ে আছে। রুমের ভিতরে টুংটাং শব্দ হচ্ছে বুঝতে পারলাম সে রুমে চলে এসেছে। মাথায় দু মগ পানি দিয়ে টাওয়াল দিয়ে আলতো করে মুছলাম। ওয়াশরুমের দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দে দরজা খুললাম। সামনে তাকিয়ে পুরো স্তব্দ হয়ে যাই। রোদের হাতে সিগারেট জ্বলছে শার্টের প্রতিটা বোতাম খোলা, মাথার চুল এলোমেলো৷ শরীর বেয়ে পানি পড়ছে।
গলার ভিতরে ঢোক গিললাম। তারপর ধীরস্থির গলায় বললাম,
– আপনার এমন অবস্থা কেন? আপনি তো পুরো ভিজে গেছেন। সাথে তো গাড়ি ছিল তাহলে বৃষ্টিতে ভিজে গেলেন যে? মায়ের সাথে কথা হয়েছে৷
এই,,,,নীলা তোমায় না হট লাগছে খুব আসো না এদিকে একটু ভালোবাসা করি চোখ বুঝতে বুঝতে বলল রোদ।
চোখদুটো এখন টিউবলাইটের মত হয়ে গেছে।।বড়বড় চোখ করে রোদকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলাম। সে তো স্বাভাবিক নয় ছাইপাঁশ গিলে এসেছে। ভাবার ঠিক শেষ মূহুর্তে রোদ আমার হাতটা খাপ করে ধরে ফেলল। কি হল ডার্লিং এভাবে চুপটি করে আছ কেন আসো না কাছে একটু বাসো না ভালো।
এবার রোদকে পুরোপুরি অসহ্য লাগছে। গম্ভীর গলায় বললাম,
– তুমি ড্রিংকস করে এসেছ?
– একটু খাইছি৷ আজ শ্রেয়ার জন্মদিন ছিল তো তাই আমরা পার্টি করে ইনজয় করেছি। তোমাকে নেওয়ার কথা ছিল অথচ আমি নেইনি কেনো জানো? কারণ তোমাকে বুড়ির মত দেখায় পেটটা বিশাল বড় আমার পাশে হাঁটলে লজ্জা লাগে।
কিছু বলার জন্য মুখ খুলব তখনি রোদ তার ঠোঁট জোড়া দিয়ে আমার ঠোঁট চেপে ধরল। কথা বলার মত কোন সুযোগ দিল না। তারপর কোলে তুলে নিল। ধপাস করে বিছানার উপরে বসিয়ে হাত ধরল। নীলা তোমাকে আমার কিছু বলার ছিল।
রোদের এমন প্রশ্নে হতভম্ব না হয়ে পারলাম না।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বললাম,
– হ্যাঁ বল কি বলবে।
– আমাদের বিয়ের বয়স তো অনেক মাস হয়ে গেছে তাই না তাই বলছিলাম কি আমাদের সম্পর্কটাকে ভালোবাসায় বদলে নিলে হয় না। মানে তোমার যদি মতামত থাকে। পুরো কথাগুলো কাঁপা কাঁপা গলায় বলছে রোদ। মাথা টাল হয়ে আছে। এখন কি বলছে ঘুমিয়ে পড়লে আর মনে থাকবে না সেটা আমি ভালো করেই জানি তবুও স্বামী বলে যে একটা কথা আছে না সেটাই করলাম আমি। রোদের কথায় আমি রাজি হয়ে গেলাম। এরপর আর রোদ সময় নেয়নি ঝাঁপিয়ে পরে আমার উপরে। কিছুক্ষণ পরে বুঝতে পারলাম রোদ ভালোবেসে এগিয়ে আসেনি নিজের চাহিদা মেটাতে এগিয়ে এসেছে। ভয় লাগছিল খুব রোদ যখন সকালে উঠবে তখন সবকিছু ভুলে যাবে কথাটা ভাবতেই চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। সে পানি রোদ দেখতে পায় না। নিজের চাহিদা মিটানো হয়ে গেলে ক্লান্ত শরীরে অন্যপাশ হয়ে শুয়ে পড়ল রোদ। বিছানার পাশে পড়ে থাকা শাড়িটার দিকে তাকিয়ে আরও জোড়ে কাঁদতে লাগলাম।
চলবে………..

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..