তখন উপস্থিত লোকজনের মনে আবারও ইরানি শায়েরের কথা উদয় হয় এবং এ পর্যায়ে তারা একটি কথা ঠিক ঠিক মনে করতে পারে।সাপুড়ে তাদেরকে মনে করতে সহায়তা করে।সে বলে, সেই নাগরানীর নাম ছিলো ইরাবতী।তো সেই ইরাবতী নাগরানী শায়েরকে তার জাদুর কারাগারে বন্ধি করে রাখে।তার অভেদ্য যাদু, তবুও তার মনের সন্দেহ কাটেনা।সে মনে করে, ইরানি শায়ের হয়তো তাকে ফাঁকি দিয়ে এই কারাগার ছেড়ে পালাবে।তাই সে তার প্রহরী সাপেদের দূর দূরান্ত থেকে জঙ্গলে আনতে থাকে।এক দুই তিন চার করে পুরো এলাকার ভয়ানক সব প্রহরী সাপকে সে জঙ্গলে নিয়ে আসে।কালসাপ, বিষনাগ, শিষনাগ; গোখরা, কোবরাশঙ্খিনী, আরও যত যত সাপ আছে ভয়ানক বিষধর; সবগুলোকে এনে কারাগারের চারপাশে পাহাড়ায় নিযুক্ত করে।শায়ের বুঝতে পারে, এই সাপেদের রাজ্য থেকে তার আর কোনো মুক্তি নেই।কিন্তু সুমাইয়া বিনতে তালহার শোক এতো তাড়াতাড়ি ভুলতে পারেনা শায়ের।তাই সে নির্জীব হয়ে পড়ে থাকে সোনা, রূপা ও হিরক নির্মীত নাগরানীর যাদুর কারাগারে।কোনো কিছু খায়না, কোনো কথা বলেনা কারো সাথে।দিন দিন শায়েরের দেহ শীর্ণ থেকে শীর্ণ হতে থাকে।
এদিকে কারাগারের বাইরে নাগরানী ইরাবতীর ও একই অবস্থা।সে শায়েরের প্রেমে এতোটাই দিওয়ানা হয় যে দিন রাত সে কারাগারের সামনে বসে কেঁদে কেঁদে শায়ের কে প্রেম নিবেদন করতে থাকে।ফলে তার আহার নিদ্রায়ও ব্যাঘাত ঘটে এবং তার রাজ্য পরিচালনাও মন্থর হয়ে পড়ে।নাগরাজ্যের সুবিশাল এলাকা জুড়ে কতো শতো ঝামেলা দিনরাত নাগরানীকে সামলাতে হতো! রাজ্য রক্ষা, প্রজাসাপেদের দুঃখ সুখ দেখা, রাজ্যের কোথায় খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে, কোথায় তার প্রজা সাপেরা নিজেদের মধ্যে মারামারি খুনোখুনি করেছে, এসবই নাগরানীকে দেখতে হতো।রাজ্যের সকল সাপেরাই ছিলো নাগরানীর উপর সন্তুষ্ট ও তার অনুগত।নাগরানীও মাতৃ হৃদয়ে ¯তার প্রজাদের বুকে ধরে রাখতো।কিন্তু সবকিছু দিন দিন অরক্ষিত হয়ে যাচ্ছে।নাগরানী কোনোক্রমেই রাজ্যপাটে মন বসাতে পারছেনা।
তখন নাগরানী ইরাবতীর রাজ্যে একদিন পাশের রাজ্যের নাগকুমার নীলকমল আক্রমণ করে।নীলকমল খুব সহজেই নাগরানীর রাজ্যে প্রবেশ করে কারন ইরাবতীর রাজ্য সীমায় যেসব প্রহরীরা ছিলো সেসব প্রহরীদের ইরাবতী এনে শায়েরের কারাগারের চারপাশে মোতায়েন করেছে।লক্ষ লক্ষ অজগর সাপ দিনরাত পাহারা দেয় ইরানি শায়েরকে।অবস্থা এমন যে তারা বিপুল সংখ্যক সাপ একটি সীমাবদ্ধ কারাগারের চারপাশে জটলা হয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকেনা।তারা একজনের দেহ দশজনে পেঁচিয়ে, দশজনের সাথে আরও এগারোজন পেঁচিয়ে পাহাড়ের মতো প্রাচীর তৈরি করে।দূর থেকে দেখলে মনে হবে যে এ এক জীবন্ত চক্রাকার পাহাড় কারাগারকে ঘিরে আছে।ফলে এই গাদাগাদি করে থাকতে থাকতে ইরাবতীর পাহাড়াদার যোদ্ধা বিষধর সাপেরাও কেমন নির্জীব হয়ে পড়ে, তাদের গায়ে ঘা দেখা দেয়, তারা একই সাথে অলসও হয়ে পড়ে।তো সীমান্তে পাহারা না পেয়ে নাগকুমার নীলকমল খুব অনায়াসেই নাগরানীর রাজ্যে প্রবেশ করে এবং নির্বিচারে সাধারণ সাপেদের হত্যা করতে করতে ইরাবতীর রাজধানীর দিকে অগ্রসর হয়।
এসব খবর নাগরানীর কাছে আসে।সে জানতে পারে অত্যাচারী নীলকমল তার রাজ্যে আক্রমণ করেছে এবং বিনা বিচারে তার প্রজাসাপদের ধরে ধরে হত্যা করছে।কিন্তু সে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনা।তার সারাক্ষণ মনে হয় যদি সে ইরানি শায়েরকে না পায় তাহলে তার এ রাজ্যপাট দিয়ে আর কি হবে।সে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করে যে তার যেনো রাজ্যপাট সব চলে যায়, বিনিময়ে সে যেনো ইরানি শায়েরকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পায়।কিন্তু ইরানি শায়েরের মন তখনও টলেনা।বন্দি হবার পর থেকে উনচল্লিশ দিন সে কোনো খাবারই গ্রহন করেনি।বাইরে থেকে ইরাবতীও এই উনচল্লিশ দিন পর্যন্ত আহার নিদ্রা ছাড়া থাকে।শেষে জীবন বাঁচাতে ইরানি শায়ের টুকটাক খাদ্য মুখে দিতে শুরু করলে ইরাবতী ও ফলটা দুধটা মুখে তুলতে থাকে।ইরানি শায়ের নাগরানীর এতো প্রেমেও তার সওদাগর কন্যা সুমাইয়া বিনতে তালহাকে ভুলতে পারেনা।মনের আবছায়ায় উঁকি দেয় সেই অনিন্দ সুন্দর চাঁদমুখ।শায়ের খাবার দাবার খেলেও তার মন সবসময়ই মরা মরা থাকে।কারো সাথে কোনো কথা বলেনা।নাগরানী কারাগারের বাইরে অবিরাম শায়েরকে উদ্দেশ্য করে প্রেম নিবেদন করে যায়।রাজ্যের কোনো ব্যাপারেই আর কেউ তাকে পায়না।এমনকি কারো সাথে কোনো কথাও বলেনা আর।এখন এই সুবিশাল ভাটি রাজ্যে দুজন দুজনের নিজেদের দুখে কাতর হতে হতে বাকস্বর হারাতে বসে।তার উপর আবার পাশের রাজ্যের অত্যাচারি নাগকুমার তার রাজ্যে আক্রমণ করেছে।রাজ্যে প্রবেশ করে তার প্রজাদের নির্বিচারে হত্যা করছে।কিন্তু রানী কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয় না।তখন রাজ্যের সকল সাপেরা এসে নাগরানীকে ধরে এবং জানায় যে, এ সঙ্কট কালে রানী তার নিজের প্রেমের জন্য বসে থাকতে পারে না।সাপেরা একে একে তাদের অগ্নিঝরা বক্তব্য পেশ করে এবং অনুনয় করে জানায় যে তাদের রানী যেনো তাদের রাজ্যকে রক্ষা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে।কিন্তু রানী ইরাবতী তৎক্ষণাৎ কোনো সিদ্ধান্ত তার প্রজাদেরকে দিতে পারেনা।তাই রাজ্যে দুটো সমস্যা দেখা দেয়, এক হচ্ছে নীলকমল কর্তৃক রাজ্যে আক্রমন, আর দুই হচ্ছে প্রজাদের অসন্তুষ।
তখন আর রানী ইরাবতী চুপ করে থাকতে পারেনা।তার অন্তরের প্রেম তখন বিষে পরিপূর্ণ হয়।সে কারাগারের দরোজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে এবং শায়েরকে বিছানা থেকে টেনে তুলে।শায়েরের আলখাল্লার কলার চেপে ধরে সে শায়েরকে বলতে থাকে, “আমি তোমার জন্য আজ আমার রাজ্যপাট হারাতে বসেছি।প্রতিবেশি রাজকুমার আমার অরক্ষিত সিমান্ত দিয়ে সহজেই প্রবেশ করেছে আর আমার নিরীহ প্রজাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করতে করতে রাজধানীর দিকে এগিয়ে আসছে।আমার প্রজারা সব ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে দিগবিদিক পালিয়ে যাচ্ছে।আর এমতাবস্থায় আমার কোনো পদক্ষেপ না থাকায় রাজ্য জুড়ে আমার উপর প্রজার অসন্তুষ দেখা দিয়েছে।অবস্থা দৃষ্টে এমন মনে হচ্ছে যে, আর দুয়েক দিনের মধ্যেই আমি আমার রাজ্যপাট, সাথে প্রাণটাও হারিয়ে ফেলবো।প্রাণ হারাবো, তাতে আমার আপত্তি নেই।রাজ্য হারাবো, তাতে আমার আপত্তি নেই।কিন্তু অসভ্য নীলকমল আমাকে প্রাণে মারবেনা।সে আমাকে তুলে নিয়ে যাবে।আমাকে পাওয়ার জন্যই তার এ রাজ্য আক্রমণ।এর আগেও সে কয়েক বার আক্রমণ করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু আমার বীর সৈনিক সাপেরা তার দলবলকে জলপান করার ও সুযোগ দেয়নি।কিন্তু আজ আমি তোমাকে পাহাড়া দিতে রাজ্যের সকল সৈনিক সাপ কারাগারের চারপাশে নিয়োজিত করেছি।অল্প জায়গায় দীর্ঘ দিন থাকতে থাকতে তাদের দেহে আর যুদ্ধ করার সৌর্য ও অবশিষ্ট নাই, তথাপি আমি যুদ্ধ করতাম; কিন্তু তোমাকে যদি না পাই তাহলে আমার যুদ্ধ করে রাজ্যকে নিরাপত্তা দিলেই বা আর কি লাভ হবে? তাই তোমার জন্য আমি রাজ্য ছাড়তে প্রস্তুত।কিন্তু নাগকুমার নীলকমল যদি আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যায় তাহলে তো আমি চিরদিনের মতো তোমাকে হারাবো।কসম, হে ভীনদেশি শায়ের, তোমাকে হারানোর যন্ত্রণা আমাকে শত শত মৃত্যুর শোক ভুলিয়ে দেবে।জীবন্ত জাহান্নামে আমি পতিত হবো চিরদিনের জন্য।দোহাই শায়ের, আমাকে তুমি আর খালি হাতে ফিরিয়ে দিও না।করুণা করেও একবার আমার ভালোবাসা গ্রহণ করো।”
চলবে…….
Leave a Reply