1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৬ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
# আহারে # খোরশেদ ।। সমাজে নতুন অপরাধী চক্র তৈরী হচ্ছে কিন্তু ভবিষ‍্যতে এদের রক্ষা করবে কে??।। – – – আশিক ফারুকী “অতঃপর” __ সালমা আক্তার বীরাঙ্গনা নই আমি মুক্তিযোদ্ধা – – – শাহনাজ পারভীন মিতা জলপাই রঙের স্বাধীনতা – – – আরিফুল হাসান প্লাস্টিকের উৎপাদন বন্ধ করতে হবে – উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ান হাসান – – – স্বাধীন আজম –   টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি, স্বপ্নমায়া – – – – মাহজাবীন আহমেদ বুড়ি মরে গেল – – – মোঃ আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমাম প্রযুক্তির দুনিয়ায় শিক্ষার্থীদের এখন উন্নত জীবন গড়ার দারুণ সময়:– ————–টিপু সুলতান লেখক ও সমাজ চিন্তক ডায়াবেটিস নিয়ে সচেতনতাই পারে ডায়াবেটিস রোগ নির্নয় ও রোগের চিকিৎসা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা – – – ডা: সাদিয়া আফরিন 

# দ্বৈরথ ১ এবং দ্বৈরথ ২ — শামীমা নাসরিন

  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১০ জুলাই, ২০২১
  • ৩২১ বার
( দেশভাগ,মুক্তিযুদ্ধ, এবং স্বৈরাচার আন্দোলনের ওপর লেখা উপন্যাস।)
সবে সিলেট থেকে এসেছি। বাসায় এসে স্থিতু হতে না হতে বন্ধু মুহিব এসে হাজির।
– দোস্ত চিটাগাং যাচ্ছি… সাথে চল…..
এখনো অফিসে হাজিরা দেওয়াটাই হয়ে ওঠেনি আমার। দুদিন হলো এসেছি। সকালে বিছানায় তখনো। একটু পরে অফিসে যেতে হবে। মুহিব এসেই কোন কথা না বলে সরাসরি এই কথা বলতে ,
চাদরটা দিয়ে মুখ ঢেকে বলি,
– এত সকাল সকাল বাসায় এসেছিস কেন? বাসায় বউ নাই ? বাপের বাড়ি গেছে ?
– বউ যায়নি তবে আমি যাবো, আর সঙ্গে তুই ও
এক লাফ দিয়ে বিছানায় ওঠে বসি । জিজ্ঞেস করি….
– কোথায়?
– বললাম তো চট্টগ্রাম, আমাদের গ্রামে
একটা নিঃশ্বাস ফেলে পাশের টেবিলে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে ঝুলিয়ে দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে ধূঁয়া ছেড়ে বললাম,
– তুই যা। আমার দ্বারা হবেনা। মাত্র সিলেট থেকে পরশু ফিরলাম,
– প্লিজ চল, বাবা কাঁধে ঝামেলা একটা তুলে দিয়েছে। না গেলে মহা কেলেংকারি হয়ে যাবে।
– যেতে হয় যাবি আমাকে বাদ দে
– প্লিজ দোস্ত চল। আমি বলছি তোর ভাল লাগবে। তুই তো লিখিস, হয়তো ওখান থেকে তোর গল্পের একটা প্লট ও পেয়ে যেতে পারিস।
– তাতো বুঝলাম। কিন্তু চাকরির কি হবে? আমার তো তোর মত বাপের তালুকদারি নাই।
– প্লিজ ম্যানেজ কর। মাত্র তো দুইটা দিন।
যতই না বলি মুহিবের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়া সম্ভব হলো না। অফিস থেকে দুইদিনের ছুটি নিয়ে যেতে হয় সুদূর চট্টগ্রাম।
ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় ঘুরে বেড়ানো নেশা আমার। কখনো কক্সবাজার কখনো রাঙ্গামাটি আবার কখনো বা কাপ্তাই, মাধবকুন্ড, মহেনজোদাঁড়ো। দেশের এমন কোন প্রান্ত এমন কোন জায়গা বাকি নেই যেখানে দু চারবার আমার দর্শন ঘটেনি। শুধু যে বেড়ানোর নেশা অথবা দেশ দেখার নেশায় আমার এ ঘুরে বেড়ানো তা কিন্তু নয়। বরং এক এক জায়গায় এক এক ধরনের মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া তাদের জীবন যাপন পদ্ধতি সম্পর্কে জানার অনেক বেশী কৌতুহল আমাকে এ জীবন যাপনে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। আমার এ আগ্রহে জীবনে অনেকবার অনেক বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে অনেক লোকের সাহচর্য্য লাভ করেছি । ঢাকায় বাসাবোর কাছে একটা ছোট বাসা নিয়ে থাকি আমি, অকৃতদার। বয়স চল্লিশের কোঠায়। পেশা একটা দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক। সঙ্গে সখের ফটোগ্রাফি, লেখালেখি করে ও বেড়াই। জীবনের অভিজ্ঞতা গুলি লিখে সকলের সাথে ভাগাভাগি করে নেই। নিজের রচিত কয়েকখানি গল্পের বই ইতিমধ্যে ভারত বাংলাদেশ পাঠককূলের হৃদয় জয় করেছে। দু দুবার বাংলাএকাডেমি পুরষ্কার ও পেয়েছি। বিভিন্ন টেলিভিশন মিডিয়া আমার লেখা গল্প নিয়ে নাটক, সিনেমা তৈরি করে। পিছুটান নেই কোন তাই মুক্তবিহঙ্গের মত ঘুরে বেড়াতে ও বাঁধা নেই।
বাল্যবন্ধু মুহিবের ডাকে সেবারে ওর সাথে ওর নানাবাড়ি চট্টগ্রাম গেলাম। চট্টগ্রাম এর কালুরঘাট সেতুর পূর্ব পাশে মুহিবের নানাবাড়ি। এলাকায় চেয়ারম্যান বাড়ি নামে পরিচিত। মুহিবের নানা ইসমাইল খাঁ এলাকায় একটানা অনেকবছর ধরে চেয়ারম্যান ছিলেন। পুত্র সন্তান ছিলনা তাঁর। আয়শা এবং আসমা নামে দুই মেয়ে। অনেক ভূ সম্পত্তির মালিক। বড় মেয়ে মুহিবের মাকে বাইরে বিয়ে দিলে ও ছোট মেয়েটিকে একটি সম্ভ্রান্ত গরীব ঘরের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে বাড়িতেই রাখেন তিনি। কিছুদিন আগে ইসমাইল খাঁ গত হন। তার ও বছরখানেক আগে তাঁর স্ত্রী রোকেয়া বেগম ও। তাঁর অর্জিত বিপুল ভূ সম্পত্তির মালিক এখন তাঁর দুই মেয়ে। এই ভূ সম্পত্তির কারনে এখন মুহিবকে মাঝে মাঝে চট্টগ্রাম আসতে হয়।
অনেক রাতে বাড়ি পৌঁছে সেদিন ভালো করে কিছু দেখার সৌভাগ্য আর হলোনা।পরদিন কাক ডাকা ভোরে কেউ ঘুম থেকে জাগার আগে ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই আমি।
বাড়ির বাইরে মেঠো পথটা ধরে কিছুদূর যেতেই প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে মন প্রাণ ভরে যায় আমার। ভোরের সোনালী রঙা সূর্য্যের আলোয় চারিদিকে আলোকিত সকালটা ঝিঁকমিক করছে সেই সাথে স্নিগ্ধ বাতাস, যেন গা জুড়িয়ে গেল। চারিদিকের সবুজ প্রান্তর এবং এলোমেলো গাছের সারি কিযে অপূর্ব দৃশ্য! মনে হয় মুহিবের কথাই ঠিক। এবারের আসাটা ও একেবারে বিফলে যাবে না। দু পাশে ধানক্ষেত বেয়ে আলের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম আমি। দিগন্ত জুড়ে সবুজ ফসলের উপর ঝিরঝিরে হাওয়া, তারি মাঝে দু চারটি বক সারি বেঁধে মিতালী পাকিয়ে ধানক্ষেতের ফাঁকে এসে কিছুক্ষনের জন্য হারিয়ে গিয়ে আবার আকাশপানে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। অদ্ভূত সুন্দর দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দী করতে দেরি হয় না। আল পথ পেরিয়ে কিছুদূর যেতেই আবারো মেঠোপথের সন্ধান পাই । সেই পথে হাঁটতে গিয়ে একটা গাছে ক্ষনেকের তরে চোখ আবারো আটকে যায়। দুটি পাখি একটা গাছের ফাটলে মুখ লুকিয়ে পারস্পরিক ভালবাসার লেন দেনে ব্যস্ত। এমনই সে ব্যস্ততা পৃথিবীর অন্য কোনদিকে খেয়াল নেই তাদের। ক্যামেরা টা তাক করতেই ওড়ে গেল পাখি দুটি। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। মনে হল অনধিকার চর্চ্চা করে ফেললাম। ততক্ষনে আশে পাশে দু চারজন লোক বেরিয়ে গেছে।সূর্য্যটা ও মাথার উপর উঠে রোদটা চড়চড় করছে। নাহ্ এবার ফিরতে হবে।
বাসায় ফিরতেই মুহিবের পরিবার একেবারে হৈ চৈ ফেলে দিল। নতুন জায়গা, তাতে নতুন পরিবেশ, আমার এভাবে একা একা বের হওয়া ঠিক হয়নি। সকলকে এড়িয়ে কামরায় এসে দেখি মুহিব তখনো ঘুম। এতটা পথ হেঁটে এসে ক্ষিদায় পেট চড়চড় করছে। মুহিবকে ডাকি,
– এই মুহিব ওঠ…। এই এই মুহিব ওঠবিনা?
-উমম্। বলে মুহিব আরো নড়ে চড়ে বালিশটা বুকে নিয়ে শুল।বালিশটা বুক থেকে কেড়ে নিয়ে দূরে ছুড়ে দিয়ে আবার ও ধাক্কালাম মুহিবকে-
– মুহিব ওঠ খেতে তেতে দিবিনা নাকি? ক্ষিদায় যে পেটে চড়া পড়ে গেল…
একলাফে বিছানা থেকে ওঠে মুহিব দুচোখ কপালে তুলে বলল
– রাতে যে এত্তগুলি গিললি! এত তাড়াতাড়ি হজম হয়ে গেল?
-গেলই তো! সকাল থেকে কতদূর হেঁটে এসেছি জানিস? তোর মত পড়ে পড়ে ঘুমাতে তো আসিনি…।
ঘুমের কথা শুনে মুহিব আবার বালিশখানি বুকে জড়িয়ে ওল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে যায়।
-ও কি আবার শুয়ে পরলি যে, মুহিব ওঠ।
-দোস্ত তুই একটু কষ্ট করে ভিতরে যা। গিয়ে আমার বোন পূরবী আছে তাকে গিয়ে বল। আর হ্যাঁ আমারে আর জ্বালাস না। আমি এখন ঘুমাব। পূরবীরে বলিস রান্না হলে দুটোর সময় আমাকে ডেকে দিতে।
মুহিব সত্যি সত্যি আবার ঘুমিয়ে যায়।
বিকেল বেলাটা মুহিব কে নিয়ে বের হই। হাটের দিকে এগিয়ে যাই আমরা। পথে মুহিবের অনেক পরিচিত জনের সাথে দেখা হয়। হঠাৎ ওল্টো দিক থেকে একজনকে দেখি দ্রুত পায়ে হেঁটে আসতে। কাছাকাছি আসতে লক্ষ্য করে দেখলাম তেইশ চব্বিশ বছরের এক যুবক। শুকনা পাতলা শরীর, মাঝারী উচ্চতা এবং শ্যামলা। মুখে গোঁফ চোখে চশমা। চোখ দুটি বেশ উজ্জ্বল, কিছুটা ধূর্ত।
– মুহিব ভাই ভালো আছেন? আপনাকে দেখতে পেয়ে ছুটে আসলাম।
– আরে রুম্মন যে কেমন আছ তুমি?
– ভাল না মুহিব ভাই। আপনার পরামর্শ দরকার ।
– গুরুতর কিছু মনে হচ্ছে!
– তা একটু গুরুতর আছে। মুহিব ভাই সময় হবে আপনার?
– কবে আসতে চাও তুমি?
– কাল? কাল আসি মুহিব ভাই?
– কাল? কিন্তু কাল যে আমি ব্যস্ত থাকব একটু। তুমি বরং পরশুদিন বিকেলে আস। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।
– আচ্ছা! তাইলে ওই কথাই রইল মুহিব ভাই, পরশু বিকেলে?
– হ্যাঁ। এবার আস তুমি।
– মুহিব ছেলেটা কে রে?
– ও আছে একজন, এ এলাকার।
– তা কি করে?
হেসে ফেলে মুহিব।
– কি করে? সমাজের জঞ্জাল সাফ করে।এবং তা করতে গিয়ে বাড়তি কতগুলি ঝামেলা বাড়ায়।
– প্রশ্রয় দিস কেন?
– দিতে হয় বন্ধু। ছেলেটা একেবারে ঢোঁড়া সাপ নয়।মৌলবাদী সংগঠনের একজন নেতা ও যে সে।
– বলিস কি? সব জেনে ও তুই তার সাথে…
– কি হল বন্ধু এখনি বাক্যি হরে গেছে? এসেছিস যখন দেখে যা। লেখার কিছু পেয়ে ও যেতে পারিস।
বুঝলাম মুহিব ঢাকায় থাকলেও গ্রামের সাথে ওর একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। এমন কী গ্রামে ওর বেশ প্রতিপত্তি ও আছে।
হাট থেকে ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে যায়। গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে ফিরে আসতে গিয়ে নির্জন রাতের সৌন্দর্য্যটা যেন নতুন করে ধরা দেয় আমায়। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় চারিদিক ঝকমক করছে। সে ঝকমকে চাঁদের আলোয় পথ চলতে গিয়ে মনটা অজানা ভালো লাগায় ভরে যায়। মুহিব হঠাৎ তার ভরাট গলায় গান ধরে। রবিঠাকুরের গান। “যেতে যেতে পথে পূর্ণিমা রাতে চাঁদ উঠেছিল গগনে। সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে” উপযুক্ত পরিবেশে উপযুক্ত গান। নাহ্ মুহিবটা গায় ভাল। চুপচাপ শুনি। চারপাশের পরিবেশখানি গানের আমেজে ভারী হয়ে ওঠে।
বাড়ি ফিরে দেখি সকলে চাঁদের আলোয় উঠোনে বসে আছে। আমরা ও বসে যাই। গল্প আর আড্ডার ফাঁকে মুহিব আবার ও একটার পর একটা গান ধরে। সঙ্গে গলা মেলায় মুহিবের ছোট খালার মেয়ে পূরবী। পূরবীর কন্ঠ ও অসাধারণ । পূরবীর সাথে মুহিবের ও গানের গলাখানা যেন সোনায় সোহাগা। কথায় কথায় জানলাম পূরবী স্থানীয় গানের স্কুলে গান শিখে। অবাক হই শুনে, গ্রামীন পরিবেশে থেকে ও মেয়েকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে কোন দ্বিধা নেই পূরবীর পরিবারে। বেশ সংস্কৃতি এবং উদারমনা পরিবার তার বুঝাই যায়। তবে এটা ও ঠিক মুহিবের নানাবাড়ি অনেকটা হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায়। যে কারণে পূরবীর মত এমন অনেক মুসলিম পরিবারে আজকাল সংস্কৃতি অনেক বিস্তার লাভ করছে। অনেক রাত পর্যন্ত গান হয় সেদিন।
পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে জেগে আগের দিনের মতই আমি একাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। দরজার কাছে খালার সাথে দেখা হয়ে যায়।বারান্দায় বসে নামাজ সেরে দোয়া দরুদ সারছিলেন তিনি। আমাকে দেখে বললেন,
– বেরুচ্ছ বাবা?
– জ্বী খালা একটু ঘুরে আসি।
– একা যাচ্ছ?
– জ্বী… মুহিব ঘুমাচ্ছে… ডাকলে ও ওঠবে না।
একটু হাসলেন তিনি…. । একমুহূর্ত সব ভুলে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। এত পবিত্র লাগছিল মুখখানি! তিনি বললেন,
– মুহিবটা বরাবরই এমন। বড্ড ঘুম কাতুরে। যাও তবে বেশিদূরে যেও না। নতুন জায়গা তায় আবার আজকাল দিনকাল ও তেমন ভালো না।
– জ্বী খালা…. বলে বেরিয়ে যাই।
এবারে আগের দিনের রাস্তা না ধরে অন্যদিক ধরে এগুলাম আমি। যেতে যেতে কখন যে নদী পারের রাস্তায় গিয়ে উঠে পড়লাম টের ই পেলাম না। নদীর দেখা পেতেই মনটা খুশীতে একেবারে লাফিয়ে ওঠে।চট্টগ্রামের সেই বিখ্যাত কর্নফুলি নদী। নদী পারে বসে কিছুক্ষন নদীর ঢেউ গুনি। ঢেউয়ের তালে তালে নৌকার আসা যাওয়া দেখতে দেখতে ভাবছিলাম এই নদীকে ঘিরে কত গান কত লেখা গুনীজনদের! “সাধের কর্নফুলিরে সাক্ষী রাখিলাম তোরে” অথবা” লুসাই পাহাড় উত্থুন নামিয়ারে”। চট্টগ্রামের সেই বিখ্যাত আঞ্চলিক গানের শিল্পী শেফালী ঘোষের গাওয়া সেই গান।
হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই থমকে যাই আবারো। নদীপার ঘেঁষে কিছুদূর ভিতরের দিকে এমনতরো একটা দৃশ্যের জন্য যাইহোক আমি প্রস্তুত ছিলাম না মোটে। বিশাল এলাকা জুড়ে গাছ আর গাছ। ফলের গাছ, ফুলের গাছ এমন কি ঔষধী গাছ সহ কি নেই? গাছগুলির মাঝখানে সরু রাস্তা দুপাশের গাছগুলিকে সারিবদ্ধ ভাবে আলাদা করে দিয়েছে। সেই সরু রাস্তা দিয়ে সম্মোহনীর মত এগুতে থাকি। একপাশে ফলের গাছ অপর পাশে ঔষধী গাছ, তারপরে দুদিকে ফুলের গাছ। মনের মধ্যে অদ্ভূত মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কত রকমের ফুল ফুটে রয়েছে বাগানে। গোলাপ, বেলী, জবা, ঝুমকো লতা, রঙ্গন । কি নেই বাগানে? কোথাও কৃষ্ণ চূড়া, কোথাও রাধাচূড়া আবার কোথাও বা গন্ধরাজ, কামিনী অথবা হাস্নাহেনা। সেই সাথে মৌসুমী ফুলের গন্ধে চারিদিক মাতোয়ারা। সামনে আর একটু এগোতেই রীতিমত হোঁচট খাই আমি।
বাগানের মাঝখানে এক অপরূপ সুন্দরী মহিলা সাঁজিতে ফুল তুলছেন। সম্ভবত পূজোর। মহিলার পরনে গেরুয়া রঙের শাড়ী। কপালে চন্দনে ফোঁটা । মাথায় ভেজা চুল পিঠময় ছড়ানো। পিছন ফিরে গাছ থেকে ফুল তুলছিলেন। পিছন ফিরে আমার দিকে তাকাতেই আমার চোখে চোখ পরে যায়। সকালের স্নিগ্ধ আলোয় চারিদিকে একরাশ ফুলের মাঝে মহিলাকে দেখে মনে হচ্ছিল এ যেন পরী, ভুল করে আকাশ থেকে ছিটকে এ বাগানে এসে পড়েছে। বাঙ্ময় বড় বড় পটলচেরা চোখদুটিতে যেন না বলা অনেক কথা জড় হয়ে আছে। খাড়া নাকে বড় হীরের নাকচাবিটি হঠাৎ হঠাৎ সূর্য্যের কিরণ পরে ঝিঁকমিক করে ওঠতে থাকে। ফর্সা, লম্বা একহারা গড়ন। বয়স সাতাশ ও হতে পারে কিংবা সাঁইত্রিশ। চোখে চোখ পড়তে একটু এগিয়ে এসে চোখ তুলে চাইলেন।নিজে থেকে বললাম যেন অনেকটা কৈফিয়তের সুরে,
– ইয়ে মানে হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়েছি। বুঝতে পারিনি এটা কারো এলাকা হতে পারে। এত সুন্দর! অপূর্ব!!
মহিলা হাসলেন। সুন্দর দুপাটি দাঁতের সারি চোখে পরে।মুক্তার মত দাঁত। হাসলে দুগালে দুটো টোল ও পরে। যেন বিধাতার নিজ হাতের অপূর্ব সৃষ্টি। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি।
-আসুন।
বলে হাঁটতে থাকেন তিনি। মন্ত্রমুগ্ধের মত তাঁর পিছন পিছন হাঁটতে থাকি আমি ও। একশ গজের মত হাঁটার পর ভিতরের দিকে একটা মন্দির চোখে পরে। মহিলা কি এই মন্দিরের কেউ? নাকি মন্দিরে এমনিতে পূজো দিতে এসেছেন। যদি তাই হয় মন্দিরের বাগান থেকে ফুল নিবেন কেন? প্রশ্নের উত্তর একটু পরেই পেয়ে যাই। তখনই মন্দিরের ভিতর থেকে গুরুজী বের হয়ে আসেন। প্রনামের উদ্দেশ্য দুহাত তুলি আমি। প্রত্যুত্তরে তিনি ও দু হাত তুলে স্বাগত জানালেন আমাকে। অতঃপর মহিলার দিকে তাকালেন।
– কিরে মা এত দেরি করলি যে ফুল তুলতে গিয়ে। পূজোর যে দেরী হয়ে গেল।
-হ্যাঁ বাবা যাই। বাবা এই ভদ্রলোক বাগানে ঘুরছিলেন, নিয়ে আসলাম। তোমরা কথা বল, আমি পুরোহিত মশাইকে পূজোর যোগাড়টা দিয়ে আসি।
তিনি ভিতরের দিকে চলে গেলেন। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকি আমি। দুচোখে মুগ্ধতা, দৃষ্টি এড়ায় না গুরুজীর। হঠাৎ তাঁর গলার আওয়াজে সম্বিত ফিরে পাই।
– তা বাবুজী কি এই এলাকার কেউ? কখনো দেকেচি বলে তো মনে হয়না!
– জ্বী না গুরুজী আমি এখানে বেড়াতে এসেছি।
– বেড়াতে এয়েচেন? কোথা থেকে?
-ঢাকা
– আত্নীয়র বাড়ি বুঝি? কোন বাড়ির অতিথি আপনি?
– জ্বি না। আমার আত্নীয় নয় আমি আমার বন্ধুর সাথে এসেছি। পাশের গ্রামের খাঁ বাড়ীর নাতী আমার বন্ধু।অনেকে চেয়ারম্যান বাড়িও বলে।
– কোন খাঁ বাড়ি? ইসমাইল খাঁ?
– জ্বি হ্যাঁ।
– হুমম্। ভেতরে আসুন,বসুন। তা বাবুজী থাকা হবে কয়েকটা দিন?
– কয়েকদিন বলতে দুদিন তো আজকে নিয়ে হয়ে গেল।হয়ত আর দু চারটে দিন থাকব। তারপর বলি,
-আপনাদের এই এলাকাটা ভারী সুন্দর গুরুজী।
গুরুজী হাসলেন একটু। মুখে কিছু বললেন না। একটু পর বললেন
– এলাকাটা ঘুরে দেখলেন বাবুজী?
– না তেমন কিছু না। বাগানে ঢুকতেই উনার সাথে দেখা হয়ে গেল…
– আর একটু ঘুরে দেকতে চান ? কাউকে সঙ্গে দেব?
– হ্যাঁ তাইলে খুব ভালো হয়। ছবি তোলা যাবেতো?
– সে আপনি যত ইচ্ছা হয় তুলুন। ফিরে যাওয়ার সময় কিন্তু দেখা না করে যাবেন না। বলে অদূরে মহাদেব বলে কার উদ্দেশ্য হাঁক পাড়লেন। মুহূর্তে মহাদেব নামের লোকটি হাজির হয়ে যায়।
– বাবুজী আপনি এর সাথে ঘুরে বেড়ান। এর নাম মহাদেব। এ মন্দিরের সেবক। বাগান খানা সে ই দেখাশোনা করে।
অতঃপর মহাদেবের উদ্দেশ্যে বললেন,
– মহাদেব ইনি শহুরে বাবু। ঢাকা থেকে এয়েচেন। তুমি একটু বাগানখানি ইনারে ঘুইরে ফিরে দেখাও দিখিনি।আর হ্যাঁ দেখা শেষ করে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। মনে রেখো অতিথি নারায়ন।
– জ্বি, আজ্ঞে গুরুজী। মহাদেব আমার দিকে ফিরে বলে,
– চলুন বাবু…..
গাঁট্টাগোট্টা চেহারার বেশ শক্তপোক্ত কিছুটা খাটো গায়ের রং মিশ কালো দেখতে মহাদেবের পিছন পিছন চললাম আমি। ভিতরের দিকে ঢুকে আরো অবাক হয়ে যাই বাগানের বিশালত্ব দেখে। বাগানের বিশাল একটা অংশ জুড়ে রয়েছে সব্জী বাগান। তাতে সব মৌসুমী সব্জী ফলে আছে। ভিতরের দিকে বড় বড় কয়েকটা গাছ। গাছ গুলিতে দেখলাম মৌমাছি বাসা বেঁধেছে। একঝাঁক মৌমাছি সেখানে গুনগুন করছে।
– মহাদেব বাবু এখানে কি মৌমাছির চাষ করা হয়?
– না বাবু এখানে এমনিতেই মৌমাছিরা এসে বাসা বাঁধে।গুরুজী বলেন এরাও অতিথি। আর অতিথি নারায়ন, তাই এদের ও যত্ন নিতে হয়। বাবুজী জানেন এই মৌমাছির মধু আমরা নিই। আমাদের সারাবছর হয়ে গুরুজী আরো বাইরে বিলোন। আরো ভিতরে যেতে দেখলাম সারি সারি গোয়ালঘর। একজন গয়লাকে দেখলাম বালতি ভর্তি গরুর দুধ নিয়ে যাচ্ছে। মহাদেবের দিকে তাকাতে বললো,
– বাবুজী এ মন্দিরের সেবক রসিক চাঁন। গয়লার কাজ করে। প্রতিদিন এক থেকে দেড় মন দুধ পাওয়া যায়। মন্দিরে পর্যাপ্ত রেখে বাকীটা বাইরে রোজ দেয়।
সামনে আরো এগিয়ে যেতে দেখলাম তাঁতঘরে কয়েকজন মহিলা মিলে তাঁতে কাপড় বুনছে। তারো সামনে এগুতে দেখলাম এক মহিলা একটা ঘরে সেলাই মেশিন নিয়ে অনবরত সেলাই করে যাচ্ছে। মন্দিরের বিশাল আয়োজন আমাকে মুগ্ধ করে দেয়।
চলবে……………
দ্বৈরথ ২
বাগানটা ঘুরে মনে ভারী তৃপ্তি বোধ করি। ঘুরে ফিরে অনেক ছবি ও তুলি। আজ আপাতত এতেই হবে।তবে মনে মনে বুঝলাম আবার আসতে হবে। আজ অনেক বেলা হয়ে গেছে। ওদিকে মুহিব রা কি করছে আল্লাহ জানে। খালা আজ আবার বিশেষভাবে সতর্ক করে দিলেন যাতে বেশিদূর না যাই। অথচ হাঁটতে হাঁটতে এলাকা ছাড়িয়ে অনেক দূরেই চলে আসলাম। দ্রুত পা চালাই আমি। মুহিবকে নিয়ে ভাবি না। মুহিবের আজ অনেক কাজ। সকালের দিকে জমির লোকজন আসবে তাদের সাথে মুহিবকে বসতে হবে। তবু খালা হয়তো চিন্তা করতে পারেন। মন্দিরে ফিরে আসতেই দেখি খাবার নিয়ে গুরুজী অপেক্ষা করছেন। আমি আপত্তি জানাতেই তিনি হা হা করে উঠেন।
– পাপ দিবেন না বাবুজী। অতিথি নারায়ন। নারায়নকে অভুক্ত রেখে বিদায় দিই কি করে বলুন? পাপের বোঝা নিয়ে যে নরকে ও ঠাঁই হবেনা আমার।
অতঃপর মহাদেবের দিকে তাকিয়ে বলেন,
– ওরে মহাদেব বাবুজীকে হাতমুখ ধোয়ার জল দে। নিন হাত মুখ ধূয়ে বসে পড়ুন বাবুজী। বুঝলাম আপত্তি করে কোন লাভ নেই। হাত মুখ ধূয়ে চুপচাপ খেতে বসে যাই।খাবার দেখে আঁতকে উঠি রীতিমত।
– এত খাবার? অসম্ভব আমি খেতে পারবনা। সরিয়ে নিতে বলুন গুরুজী।
গুরুজী আমার কথায় কান না দিয়ে বলেন,
– শুরু করুন বাবুজী যতটুকু পারেন খাবেন। দেখছেন তো সব আমার বাগানের ফল এবং সব্জী। পরটা খানা যে ঘি দিয়ে ভাজা তা ও মন্দিরের গো- মাতার খাঁটি দুধ দিয়ে তৈরী। ওরে মহামায়া এ বেলা আমার গ্লাসে দুধটুকু ও দিয়ে যা মা।
বুঝলাম আপত্তি জানিয়ে কোন লাভ নেই। সব্জী দিয়ে পরটা খানি ছিঁড়ে মুখে পুরলাম। খাওয়া মুখে দিয়ে বুঝতে পারলাম সত্যি সত্যি অনেক ক্ষুদা পেয়ে গিয়েছিল। গুরুজী তেমন কিছু খেলেন ই না। একটা কলা আর দুই তিন টুকরা সফেদা, এবং সেই সাথে দু চামুচ মধু। সম্ভবত বাগানের। একটু পরে সকালের সেই মহিলা এসে দু গ্লাস দুধ এনে রাখলেন আমাদের সামনে। শুনলাম গুরুজী একাহারী মানুষ। দুপুর বেলা অন্ন গ্রহন করেন শুধু। বাকী দু বেলা ফল এবং দুধ ই তাঁর আহার। দুধটুকু মুখে দিয়ে বলতে লাগলেন,
– বুঝলেন বাবুজী আমাদের এই মন্দিরে সবই ঈশ্বরের দান। কিছু আমাদের কিনতে হয়না । চাল,ডাল শাক সব্জী, ফলমূল, দুধ, দই এমন কি নারকেল তেল, সরষের তেল ও নিজেদের তৈরী। সরষের তেল তৈরীর জন্য একখানা ছোটখাট ঘানি ও রেখেচি আমরা। কাপড় বুননের তাঁত এবং সেলাই মেশিন ও রয়েছে আমাদের।
– অস্বীকার করার উপায় নেই। সকাল বেলা তার কিছু নমুনা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, হেসে বললাম আমি
– খাওয়া দাওয়া সেরে বিশ্রাম নিন। ও বেলা না হয় বাকীটা ঘুরে দেখবেন। বললেন তিনি। শুনে আঁতকে উঠলাম আমি। এবার উঠতে হবে। মুহিব রা হয়ত এতক্ষনে খোঁজ করা শুরু করে দিয়েছে। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখি অনেকগুলি মিসড্ কল। গুরুজীকে জানালাম সে কথা। গুরুজী আপত্তি করলেন না। আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নেয়ার উদ্দেশ্যে হাত ধোয়ার উদ্যোগ নিতেই দেখি গল্প করতে করতে কখন যে পূরো প্লেট খালি করে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি। ভারী লজ্জ্বা পেলাম, লক্ষ্য করে গুরুজী বললেন
– লজ্জ্বা পাওয়ার কিছু নাই বাবুজী। এ যে ঈশ্বর প্রদত্ত সেবা আপনি পেয়েছেন। সকলের ই তাই হয়। প্রথমে আঁতকে উঠে ঠিকই পরে ঈশ্বর যখন সেবা দেন তখন কোনদিক দিয়ে যে সব খাবার শেষ হয়ে যায় সে কেউ বুঝতে পারেনা।
গুরুজীকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিতে গেলে গুরুজী অনুরোধ করে বললেন,
– বাবুজী সন্ধ্যার দিকে আর একবার আসতে পারেন? আসলে ভালো লাগতো আপনার।
ভিতরটা উম্মুখ হয়ে উঠে, জানতে চাইলাম,
– কেন সন্ধ্যায় কি হবে?
– না তেমন কিছু না। সন্ধ্যার দিকে একটু গান কীর্তন হয়। এই গুরুকীর্তন ই সব। মনে হলো আপনার ভালো লাগতে পারে।
মনে মনে ভাবলাম আমার তো আবার আসতেই হতো।সেটা আজ সন্ধ্যায় হলে ক্ষতি কি? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই মন্দির ঘিরে কোন না কোন লেখার রসদ আমি পেয়ে যাব। বিশেষ করে সেই মহিলা আমার মাথায় বার বার ঘুরে ফিরে আসছে। মনে হচ্ছে কোন একটা রহস্য এই মহিলাকে ঘিরে আছে। এ বয়সের এত সুন্দরী একটা মহিলা মন্দিরের সেবায়েত, কেন যেন মন মানতে চাইছেনা। মহিলাকে তেমন অশিক্ষিত বলে ও মনে হয়না। কি সেই রহস্য জানতেই হবে। এ রহস্যময়তার জের এড়ানোর শক্তি নেই আমার। গুরুজীর এ আমন্ত্রন যেন আমাকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য একধাপ এগিয়ে দিল। তাড়াতাড়ি সম্মতি জানিয়ে সামনে পা বাড়ালাম আমি। খাঁ বাড়ি পৌঁছুতেই মুহিবের বকাঝকা শুরু হয়ে যায়। চুপ করে থাকি। ওদের কাছে আমি নতুন, জায়গাটাও। আমার জন্য ভাবাটা স্বাভাবিক। সকালবেলাটা বেচারাদের বড্ড উদ্বেগে কেটেছে। নাস্তা নিয়ে আসে পূরবী। শুধু চা টুকু নিয়ে বাকিটা ফিরিয়ে দিলাম। অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে মুহিব।
দুপর বেলা খেয়ে দেয়ে শুতেই ক্লান্ত দুচোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসে।এক ঘুমে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হবে হবে। জেগে উঠে চোখ মেলতে একলাফে জামা কাপড় পড়ে মুহিবের খোঁজ করতে দেখি বারান্দায় সে রুম্মন এর সাথে ব্যাস্ত। বুঝলাম তাকে পাওয়া যাবেনা।দূর থেকে ইশারায় সেল ফোন টা দেখিয়ে ছুটে বের হয়ে যাই আমি। দ্রুত পা চালাই। পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। কাছাকাছি পৌঁছুতেই সুরের আওয়াজ শুনতে পাই। বুঝলাম শুরু হয়ে গেছে গুরুনাম। ভিতরে প্রবেশ করে দেখি সকালের সেই বারান্দায় শতরঞ্জি বিছিয়ে তাতে সেতার বাজিয়ে গান করছেন সকাল বেলার সেই মহামায়া নামের সাধিকা টি। এবেলা ও তার পরনে সকাল বেলার মত গেরুয়া রং এর শাড়ী এক পেশে করে পড়া।মাথার চুল উপরে চুড়ো করে খোঁপা করা।হাতে দুগাছি সোনার চুড়ি, কানে ছোট্ট দুটি দুল এবং গলায় সরু লম্বা একখানি বিছে হার।বেশ পরিপাটি বেশভূষা। আশে পাশে সঙ্গে দু চারজন মহিলা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দোহার মিলাচ্ছেন।তাদের পরনে ও একই পোষাক।একজনের হাতে হারমোনিয়াম এবং অপরজনের হাতে ঠুংরী। তার পাশে খঞ্জনী হাতে অপর এক মহিলা একটু দুলে দুলে চোখ বন্ধ করে তাতে তাল দিয়ে যাচ্ছে। তবলা বাদক এক পুরুষ লোককে দেখলাম অদূরে গুরুজীর পাশে। গুরুজী চোখ বুজে কীর্তন শুনছেন। মাঝে মাঝে মাথাখানি মৃদু মৃদু দোলাচ্ছেন। উঠোনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে শতরঞ্জি বিছানো। তাতে অনেক স্ত্রী পুরুষ ভক্ত বসে কীর্তন শুনছেন। তাদের সামনে কয়েকজন নারী পুরুষ হাতে মাটির পাত্রে আগুনের ভার নিয়ে ধূনচি নৃত্যয় রত। সম্ভবত আজ তাদের বিশেষ কোন পূজো।তারই আরতি হচ্ছে। কাউকে কিছু না বলে একদম পিছনের সারিতে বসে পরলাম আমি। সূরের অপরূপ মূর্ছনায় চারিদিক শুনশান নীরবতা। সে নীরবতা যেন আমাকে ও ছুঁয়ে যাচ্ছিলো। গান শুনতে শুনতে কখন দুচোখ বুজে এসেছে বুঝতে পারিনি। চমকে উঠি পিঠে কারো স্পর্শ পেয়ে। দেখি মহাদেব।
– বাবুজী আসুন। গুরুজী আপনাকে ভিতরে ডাকছেন।
একটু অবাক হয়ে গুরুজীর পানে তাকিয়ে দেখি তখনো তাঁর তেমন ই দুচোখ বন্ধ।মনে হচ্ছে ধ্যানে মগ্ন তিনি। তথাপি চুপিসারে এসে পিছনে এসে বসাটা নজর এড়াল না তাঁর! মহাদেবের পিছন পিছন এসে গুরুজীর পাশে বসি। সেকেন্ডের জন্য চোখ খুলে গুরুজী আমায় অভিবাদন জানিয়ে তাঁর পাশে বসতে ইশারায় অনুরোধ জানালেন। আমি ও বিনা দ্বিধায় বসে যাই তাঁর পাশে। আসর তখন আরো জমজমাট হয়ে উঠেছে। জমে উঠেছে ধূনুচি নৃত্য ও। গুরুজীর পাশে বসে আবারো আমি সুরের জগতে হারিয়ে যাই। একটানা কখন তিন তিনটি ঘন্টা কেটে গেল টের পেলাম না। গুরুজীর ডাকে চোখ মেলে তাকাই। আসর শেষ। সেই ধূনুচি নাচ ও থেমে গেছে। কিন্তু ধোঁয়ার রেশ তখনো বাতাসে ভেসে আছে। সাধিকারা সকলে উঠে ভিতরে প্রবেশ করেছে। মন্দিরের অন্যান্য সেবকরা তাদের বাদ্য যন্ত্রগুলি উঠিয়ে নেয়ায় ব্যাস্ত। ভক্ত মহিলা পুরুষগুলি সারিবদ্ধভাবে ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরী।মহাদেবকে দেখলাম আরো দুজন সেবক সহ ভক্তদেরকে কলাপাতায় প্রসাদ বিতরন করতে। একটু পর আর একজন সাধিকা আমাদের সামনে কাঁসার প্লেটে করে দু প্লেট প্রসাদ সাথে কিছু ফলমূল এবং বড় গ্লাসে দুধ সেই সাথে পানি দিয়ে গেল। গুরুজীর সাথে সেই প্রসাদ মুখে দিলাম। তেমন কিছু নয় সামান্য কিছু সব্জী মিশিয়ে গলানো খিচুরী। মুখে দিয়ে দেখি অপূর্ব স্বাদ সে প্রসাদের।খাঁটি ঘিয়ের সুগন্ধ মেশানো তাতে। মুসলমান ঘরে জন্ম আমার।এমনতরো অনুষ্ঠানে উপস্থিত এবং প্রসাদ গ্রহন দুটোই আমার জীবনে প্রথম। কিন্তু ঘটনার প্রবাহ এবং আকস্মিকতা আমার মনের মধ্যে কোনরকমের দ্বিধা কাজ করতে দিলেনা। আমি যেন গুরুজীর মোহে সন্নিবিষ্ট হয়ে গেলাম। অম্লানবদনে প্রাসাদ গ্রহন করি। একাহারী গুরুজী নামমাত্র প্রসাদ নিয়ে যথারীতি ফল এবং দুধ দিয়ে তাঁর রাতের আহার সারলেন।ঘড়ি দেখলাম রাত দশটা। তাড়াতাড়ি সেল ফোনে হাত দিয়ে দেখি এর মধ্যে মুহিবের অনেকগুলি ফোন এসে গেছে।গুরুজীর কাছে বিদায় চাইলাম।পরেরদিন দুপুরবেলার আবার আসার প্রতিশ্রুতি নিয়ে বিদায় দিলেন গুরুজী। সঙ্গে দিলেন মহাদেবকে এবং অতুল নামের আর এক সেবককে। রাত হয়ে গেছে অনেক তাই আপত্তি করলাম না। মেইন রাস্তায় উঠতেই আবার মুহিবের ফোন। তাকে আস্বস্ত করে সামনে পা বাড়াই। গল্প করতে করতেই বাকি রাস্তা পার হয়ে যাই আমরা। বাড়ির কাছাকাছি আসতে তারা বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমি বাড়ির ভিতর পা রাখলাম।
মুহিবকে এড়িয়ে হাতমুখ ধূতে সরাসরি বাথরুমে ঢুকে যাই। বের হতেই দেখি মুহিব দাঁড়িয়ে আছে বাথরুমের দোরগোড়ায়। মনে মনে জোর একটা নিঃশ্বাস নিয়ে প্রমাদ গুনতে থাকি
– কিরে খাওয়া দাওয়া করবি তো?
– হ্যাঁ তো! তাড়াতাড়ি চল পেটে ছুঁচোরা লাফালাফি করছে।
উপায় নাই এ মিথ্যার আশ্রয়টুকু নিতেই হলো। নইলে মুহিবের সন্দেহ হতে পারত। মন্দিরের প্রসাদ অবশ্য হেঁটে আসতে আসতে অনেকটুকুই নেমে গেছে। মুহিবের পিছন পিছন খাওয়ার কামরায় এসে ঢুকলাম। খাবার মুখে দিয়ে মুহিব জিজ্ঞাসা করল,
– সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরিস বলত? নাওয়া নাই , খাওয়া নাই….
– তোদের এলাকাটা ভারী সুন্দর! তুই কখনো পূরো এলাকাটি ঘুরে দেখেছিস?
– না , দেখিনি! অত সময় কোথায়? দেখছিস তো এসে অব্দি শুধু লোকজনের সাথে মিটিং করতেই ব্যাস্ত থাকতে হয়।
– হুমম্! একবার ঘুরে দেখিস জবাব পেয়ে যাবি। বলে টেবিল ছেড়ে উঠে গেলাম।
– ওকি উঠে পড়লি যে? এর মধ্যে খাওয়া শেষ হয়ে গেল? এই যে বললি পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে ?
– বলেছিই তো! বন্ধু তুমি তো আমার নাড়ি নক্ষত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছ তাই লক্ষ্য করনি আমি অলরেডি অনেক খেয়ে ফেলেছি। এবার বলতো রুম্মন কি নিয়ে কথা বলতে এসেছিল?
– ওই আর কি নেই কাজ তো খই ভাজ। কিছু করার নেই , বসে বসে উটকো ঝামেলা করা…
– এবার কি বলতে চায় সে?
– নদীর কাছে নাকি একটা মন্দির আছে..
চমকে উঠে বললাম ,
– হ্যাঁ তো?
– ও টা তুলে দিতে চায়।
হঠাৎ শিঁর দাঁড়া বেয়ে একটা শীতল প্রবাহ বয়ে গেল আমার। নড়ে চড়ে দাঁড়ালাম।
– কেন? ওটা আবার তার কি ক্ষতি করল?
এখনো করেনি , তবে ভবিষ্যতে করতে পারে!
– কি রকম?
– রুম্মনের মতে একটা মুসলিম পাড়ার কাছাকাছি এরকম একটা মন্দির রয়েছে এবং তাতে সকলসময় গান বাজনা হয় , এতে পাড়ার যুবসমাজ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তদুপরি মন্দিরে খুব সুন্দরী একজন সাধিকা রয়েছেন যার রূপের আগুনে যুব সমাজ পতঙ্গের মত ঝাঁপ দিয়ে পুড়ে মরল বলে।
মনে মনে রুম্মনের শেষের ধারনা টা অস্বীকার করতে পারলাম না। গত দুদিন ধরে নিজের অবস্থাখানাই তো বড় প্রমান। দিনে রাতে ঐ সাধিকা টি আমার নিজের চোখেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। তা থেকে বেরুতে পারছি না। তবু একটু শেষরক্ষা করতে চাইলাম।
– মন্দির টা কি নতুন এ এলাকায়?
– না… শুনেছি এর পত্তন অনেক বছর আগে। ছোটবেলায় নানাজানের হাত ধরে অনেকদিন আমি নিজেও বেড়াতে গেছি। মন্দিরের গুরুজী নানাজানের খুব পছন্দের মানুষ ছিলেন। কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে বলে গেল মুহিব।
– তখন এই সাধিকাটি ছিলেন না?
– না তখন ছিলেন না। তিনিএসেছেন আরো পরে এখন থেকে প্রায় চৌদ্দ পনের বছর আগে।
– চৌদ্দ পনের বছর? তাওতো অনেক লম্বা সময়। এতদিন যুব সমাজ টিকে থাকল কিভাবে তাইলে?
– দ্যাটস্ দ্যা পয়েন্ট…. একটু হেসে বলে মুহিব। তারপর আমার পিঠ টা চাপড়ে বলল,
– চল্ এবার শুতে যাই। পরে ভাবা যাবে না হয় এসব নিয়ে।
ভেবেছিলাম খেয়ে দেয়ে বিছানায় শুয়ে মুহিবকে মন্দিরের কথা বলবো। মন সায় দিলো না। রুম্মনরা মন্দিরটাকে ঘিরে কিছু একটা ষড়যন্ত্র করছে। কি করতে যাচ্ছে যদি ও বুঝতে পারছি না। এমন কি এতে মুহিব নিজেকে এর মধ্যে কতটুকু সম্পৃক্ত করতে যাচ্ছে তাও না। যেহেতু কিছু বুঝতে পারছি না আপাতত চেপে যাওয়াটাই সমিচীন মনে হলো। তবু মুহিবকে একটু সতর্ক করে দিতে ইচ্ছে হলো। বিছানায় শুয়ে তাকে ডাকলাম,
– মুহিব
– বল
– তুই কি রুম্মনের ঐ ব্যাপারটায় সায় দিচ্ছিস?
– আরে না কি যে ভাবিস!
– তুই নিজেকে এসবে জড়াস না। দেখ একটা অসম্প্রদায়িক দেশে যার যার ধর্ম সে সে পালন করছে। এতে তো অন্যের মাথা ঘামানো উচিত না।
– হু…. বলে মুহিব কিছু বললো না। উল্টা দিক ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। বিষয়টা আমাকে বেশ নাড়া দেয়। ভাবতে ভাবতে আমি ও ঘুমিয়ে যাই।
পরদিন ভোরে আর বের হলাম না। একটু বেলা করেই ঘুম থেকে জাগি। উঠে একেবারে গোসল সেরে নাস্তা করতে বসে মুহিবকে জানালাম দুপুর বেলা দাওয়াতের কথা। সরাসরি মন্দিরের কথা না বলে একটু ঘুরিয়েই বললাম। একটু অবাক হয়ে তাকাল মুহিব
– এখানে তোকে আবার কে দাওয়াত করল?
– ঐ আছে একজন। হাঁটতে গিয়ে আলাপ। আমাদের বয়সী। তুই তাইলে খালাকে বলিস , আমি এ বেলা খাব না।
– আশফাক!
মুহিবের গলার গাম্ভীর্য্যতায় চমকে ফিরে তাকালাম তার দিকে..
– কিছু বলবি মুহিব?
– যা তোর উপর আমার ভরসা আছে। তারপর ও সাবধানে থাকিস। হাজার হোক নতুন জায়গা।
ওকে আস্বস্ত্ব করলাম ,
– ভাবিস না। বলে বের হয়ে পড়ি। মুহিবকে আস্বস্ত করলে ও কেন বুঝলাম না নিজের ভিতরের একটা অস্বস্তি আমার মনটাকে কেমন জানি কুরে কুরে খাচ্ছে। রাতের বেলা মুহিবের কাছ থেকে রুম্মনের সাথে মুহিবের হওয়া কথাগুলি ভাবতে ভাবতে গুরুজীর বাড়ি পৌঁছে গেলাম।
চলবে……………

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..