ডিসেম্বরের থার্টি-ফাস্টে নাইটে ঝকমকে আলোক উজ্জ্বল ক্লাবঘরটার ঠিক পিছনেই জৌলুসহীন প্রায় ঘুটঘুটে অন্ধকার বস্তির হিজিবিজি ভাবে তোলা ঝুপড়ী ঘরে এক ছোট্ট ছেলে তার মা ছেঁড়া কাঁথা মুড়ে ঘুমানোর আয়োজন করছে।মা লাইটটা নিভিয়ে পাশ ফিরে থাকা তার ছোট্ট ছেলেকে কাছে ডাকে– “বাজান,তুমি খেতার নিচে আসো। আইজ অনেক শীত পড়সে।”ছেলেটা তার দিকে ছুঁড়ে ফেলা কাঁথা থেকে নিজেকে বের করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করতে করতে বলে —“আইজ আমার আর শীত করে না আম্মা।এই আমারে ধইরা দেখ। এই শীতেও আমার শরীর কত গরম? ”
মা বিস্মিত হয়ে ছেলের মাথায় হাত দিয়ে দেখে অতংকিত হয়ে ছেলেকে অষ্টপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বলে— “হ! তাইতো বাজান! তোমার শরীর তো অনেক গরম।” ছেলেটা ফিসফিস করে তার মাকে বলে—-“হ আম্মা! একটা স্যার কইছে ছোট মাইনষ্যের নাকি শীত নাই,সব শীত বড়দের!আইজ সন্ধ্যায় ইস্টিশনের হেই মাথায় কম্বল দিসে। আমি লাইনে ফাস্টে আছিলাম। স্যার আমারে কইলো–” তুই ছুডু মানুষ। তর আবার কম্বলের দরকার কি?স্যার কইছে ছোট মাইনষ্যের শীত নাই। কম্বল লাগবো না। কম্বল শুধু বড়গোর লাগে। এই কথা শুইনা সবাই হা হা কইরা হাসতাছিল।”
জুলেখা বেগমের বুকটা কান্নায় জমে যায়। একটানে ছেলেকে বুকে টেনে নেয়। একমাত্র ছেড়া কাঁথায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায় মা-ছেলে।হঠাৎ বিস্ফরিত পটকার শব্দে ছোট্ট ছেলেটি তার মাকে জড়িয়ে ধরে ভীত বিহবল কন্ঠে মাকে প্রশ্ন করে— ” শব্দ কিসের আম্মা?” পটকার শব্দে ভীত ছেলেটির গায়ে কাঁথা মুড়ে দিতে দিতে তার মা জবাব দেয়– “বাজান পটকা ফুটার শব্দ “।
ছেলে ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে আসা আলোর ঝলকানি দেখে আবারও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে প্রশ্ন করে –” আকাশে এত্ত ঝিকিমিকি ক্যান আম্মা? এগুলান কি?”মা ছেলের কপালে জলপট্টি দিতে দিতে বলে — “এইগুলান আতশবাজি বাজান।” ভীত কন্ঠে ছেলেটা ছোট্ট হাতে মাকে দুইহাতে জড়িয়ে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে বলে— “আতশবাজির শব্দে আমার ডর করে আম্মা! বুঁকডা কাপে।”
তার মা তাকে অভয় আবার খানিকটা ভৎসনার সুরে বলে— “ধুর পাগলা! আতশবাজির শব্দে ডরায় মাইনষ্যে? আতশবাজি ফুটায়ে মাইনষ্যে আনন্দ করে বাজান।”ছেলে আরও নিবিড় ভাবে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে — “তবু আমার ডর করে আম্মা। চাইয়্যা থাকবার পারি না। চোখে ধান্দা লাগে।”
মা হেসে তাকে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে আরও লেপ্টে নিয়ে বলে— “আয় বুকে আয় বাজান। আম্মা সাথে থাকতে কিসের ডর বাজান?”
ছেলেটি বন্ধ চোখেই মাকে প্রশ্ন করে —“এত রাইতে মানইষ্যে আতশবাজি ফুটায় ক্যান আম্মা?” মা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দেয়— “আনন্দে বাজান।” অবুঝ ছেলে আবারও পালটা প্রশ্ন করে—” কিসের আনন্দ আম্মা?”
মা তার নিজের দ্বীর্ঘশ্বাস খানিকটা লুকিয়ে উত্তর দেয়–“কালকা নতুন বছর আইবো সেই খুশিতে মাইনষ্যে মজা করতাসে বাজান।” ছেলের আবারও মাকে প্রশ্ন করে — “নতুন বছরের খুশি কী আমাগো ঈদের খুশির মতনই আম্মা?”
মা তার দ্বীর্ঘশ্বাস আবারও আপ্রাণ লুকিয়ে উত্তর দেয়— “হ! বাজান, ঈদের মতনই খুশি।”ছেলে বলে—” তাইলে এহন সবাই কি সেমাই পায়েস খাইতাছে আম্মা?তারপর উত্তর না পেয়ে আপন মনেই মাকে বলে–” আমি জানি হ্যারা কি খাইবো।আমি সন্ধ্যায় দেখছি। আমাগো বস্তির সামনে যে ক্লাবঘরটা আছে না? সেইহানে দেখছি। ক্লাবঘরটার সামনে বড় বড় ডেচকিতে রান্না করতাছিল। কি যে বাস বাইর হইতাছিল বিরানির আম্মা!আগুনে মুরগী পুড়াইয়া কি যেন রানতাছে।
আমার বন্ধু খোকন কইলো এইটার নাম নাকি বারবিকু ( বারবিকিউ)। আমি আশেপাশে কত্ত ঘুরলাম। কিন্তু কেউ আমারে কিচ্ছু দিলো না। তারপর আমি আর খোকন চোখ বন্ধ কইরা আর বড় বড় দম নিয়া বিরানির আর বারবিকুর গন্ধ খাইছি। আমার তাই আইজ রাইতে আর ভুখ নাই।”
মায়ের গাল দুই হাত দিয়ে ধরে ছোট্ট ছেলেটা মাকে আদর করতে করতে অনুমতি নেয়ার ছলে বলে—“আম্মা আমারো আনন্দ করতে ইচ্চা করে। ক্লাব ঘরের সামনে যাই?মা তার ছেলেকে খানিকটা কড়া গলায় বলে— “ছোট মাইনষের জন্য এসব আনন্দ না বাজান। তুমি বড় হইলে আনন্দ কইরো।এক সময় কাঁথাটা ওদের শরীর থেকে পড়ে গেলেও মা আর ছোট্ট ছেলেটার শীত করে না। আতশবাজি আর বারবিকিউ এর আগুনের হল্কায় ওরা ওম নিতে থাকে!
Leave a Reply