1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০৭ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
# আহারে # খোরশেদ ।। সমাজে নতুন অপরাধী চক্র তৈরী হচ্ছে কিন্তু ভবিষ‍্যতে এদের রক্ষা করবে কে??।। – – – আশিক ফারুকী “অতঃপর” __ সালমা আক্তার বীরাঙ্গনা নই আমি মুক্তিযোদ্ধা – – – শাহনাজ পারভীন মিতা জলপাই রঙের স্বাধীনতা – – – আরিফুল হাসান প্লাস্টিকের উৎপাদন বন্ধ করতে হবে – উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ান হাসান – – – স্বাধীন আজম –   টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি, স্বপ্নমায়া – – – – মাহজাবীন আহমেদ বুড়ি মরে গেল – – – মোঃ আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমাম প্রযুক্তির দুনিয়ায় শিক্ষার্থীদের এখন উন্নত জীবন গড়ার দারুণ সময়:– ————–টিপু সুলতান লেখক ও সমাজ চিন্তক ডায়াবেটিস নিয়ে সচেতনতাই পারে ডায়াবেটিস রোগ নির্নয় ও রোগের চিকিৎসা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা – – – ডা: সাদিয়া আফরিন 

#তোমায়_ভালোবেসে #পর্ব-০১#পর্ব-০২#পর্ব-০৩#পর্ব-০৪#পর্ব-০৫#পর্ব-০৬#পর্ব-০৭#পর্ব-০৮ ### ফারহানা ইয়াসমিন ডেইজি

  • আপডেট টাইম : শুক্রবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
  • ৮৯৬ বার
বাড়ির নাম ‘কাঠগোলাপ’। বড় গেটের দু’পাশে দু’টো কাঠগোলাপ গাছ। গাছ দু’টো এতোই বড় হয়েছে যে, সদর দরজা থেকে মুল বাড়িতে প্রবেশের পথ অবধি কাঠগোলাপ ফুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে সুন্দর একটা ফুলের গালিচা মতন তৈরি করেছে। সাদা আর হলুদের কম্বিনেশনে পুরো পাকা পথটা এক অপার্থিব সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। রায়া পাক্কা পাঁচ মিনিট মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলো। ও ভ্রু কুঁচকে ভাবছিলো, এটা কি কাঠগোলাপ ফুলের সিজন? আর ফুলগুলো এতো সুন্দরই বা কেন? আগে তো কখনো এতো ভালো লাগেনি? নাকি কখনো সেভাবে খেয়াল করেনি? ওর ভাবনার ভ্রুম কাটলো মোবাইলের রিংটোন। তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করতেই দেখলো ওর বন্ধু রিজভীর ফোন।
“হ্যালো, পৌঁছে গেছিস?”
“হ্যা,কেবল পৌছালাম।”
“আচ্ছা শোন, আজ মনেহয় কেবল কথা বলতে ডেকেছে তোকে। ঠিক কি কাজ আমি জানি না। উল্টো পাল্টা কিছু হলে প্লিজ একটু সামলে নিস।”
“সে না হয় নিলাম কিন্তু লোকটা কে রে ভাই? এ যে দেখছি এলাহি কারবার! বাড়ি নয় এ যেন রাজপ্রাসাদ?”
“হবে কোনো কেউকেটা। দেখ ভাই সাবধানে থাকিস। গতবারের মতো বোকামি করিস না। এবার বিপদ দেখলে কেটে পরিস আগেই। পরে না হলে আমার নিজেকে গিল্টি মনে হবে।”
“হুম, ঠিক আছে। এতো ভাবিস না, আমি সব সামলে নেবো। আমার কাছে সব জিনিস আছে। “
“বেশ। দরকার হলে আমায় ফোন করিস। “
“ওকে।”
রায়া ফোন কেটে ব্যাগে রাখে। মনে মনে একচোট হেসে নিলো। রিজভীটা এতো ভীতু কেন কে জানে? ব্যাগের চেন খুলে আরো একবার আত্মা রক্ষার অস্ত্রগুলো দেখে নিলো। পেপার স্প্রে, ছুরি, বড় সেপটিপিন, বালি। সবই আছে ঠিকঠাক মতো। চিন্তার কোনো কারন নেই। এই পঁচা দূর্গন্ধযুক্ত সমাজে নিজেকে বাঁচিয়ে চলার জন্য কতো কিছুই না করতে হয়? নিজেকে আশ্বস্ত করে রায়া ফুলের গালিচা ধরে হেঁটে গেলো। চারপাশটা ভালোমতো দেখে নিলো একবার। বাড়ির প্রতিটা কোনই সুন্দর। রায়া মনে মনে ভাবলো, যে বাড়ির বাইরেটা এতো সুন্দর তার ভেতরটা না জানি কেমন হবে?
যে রুমটাতে রায়া বসে আছে সেটার চারটা দেয়ালেই গ্লাস লাগানো। যেদিকে তাকাচ্ছে নিজেকেই দেখছে রায়া। বড্ড অসস্তি লাগছে নিজের কাছে। নিজের চেহারা দেখতে কখনোই ভালো লাগে না রায়ার। এমন নয় যে রায়া দেখতে খারাপ। বরং সে আর দশটা মেয়ের থেকে সুন্দর। অনেকের ভীড়ে তাকে আলাদা করে ফেলা যায় সহজে। মোটামুটি ফর্সা গায়ের রং, টানা টানা গভীর কালো দু’চোখ, টিকোলো নাক আর একটু পুরু ঠোঁট তাকে আলাদা সৌন্দর্য দিয়েছে। সেই সাথে মাথাভর্তি দীঘল কালো চুল আর নজর কাড়া উচ্চতা। তবুও আয়নার সামনে দাঁড়ায় না রায়া। নিজেই নিজের ভেতরটা দেখে ফেলার ভয় ওকে তাড়া করে। অন্য কেউ শুনলে হয়তো হাসবে। ভাববে, এটা রায়ার ঢং। ঠোঁট উল্টে বলবে, সুন্দরী মেয়েদের এরকম ঢং একটু থাকেই। রায়া আরো একবার সামনের দেয়ালে তাকালো। নিজেকে দেখলো একপলক। আজ একটা শাড়ি পরেছে রায়া। একটা খাদি শাড়ি, অফ হোয়াইট এর উপর গাঢ় খয়েরী রঙের ব্লকপ্রিন্ট, চোখে কাজল আর চুলগুলো একটা লম্বা বেনি করে ফেলে রেখেছে পিঠের ওপর। ঠোঁটজোড়া ফ্যাকাসে হয়ে আছে। আজ কেন যেন লিপস্টিক লাগাতে ইচ্ছে করেনি। ব্যাগ থেকে ভ্যাজলিন বের করে ঠোঁটে লাগিয়ে নিলো। আয়নায় নিজেকে আরো একবার দেখে নিয়ে রায়া উঠে দাঁড়ালো। এভাবে বসে বসে নিজের চেহারা দেখতে তার মোটেও ভালো লাগছে না। সে মনটাকে ঘুরানোর জন্য রুমে সাজানো দামি দামি শোপিস গুলো দেখতে লাগলো। হঠাৎ ই কানে এলো দু’জনের উচ্চ কন্ঠ। রায়া নিজের অজান্তেই দাঁড়িয়ে পড়লো। কানদুটো না চাইতেই সজাগ হয়ে গেলো।কথাগুলো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
“কেন এসেছেন আপনি? আপনাকে না এ বাড়িতে আসতে নিষেধ করেছি?”
“নিজের জন্য এসেছি নাকি? তোমাদের দেখতেই তো এলাম। তোমার দাদী এতো অসুস্থ অথচ আমাকে একটা বার জানালে না?”
“কেন? জানালে কি করতেন? এসে সেবা করতেন? দেখুন, এসব ঢং আমাকে দেখাবেন না। আপনাকে ভালো মতন চেনা আছে আমার। নিজের স্বার্থ ছাড়া যে আপনি একপাও নড়েন না তা কি আমি জানি না?”
“তোমার এটাই সমস্যা! আমার ভালোবাসাটা দেখতে পাও না তুমি?”
“কত টাকা লাগবে?”
হিসহিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো পুরুষ কন্ঠ।
“আশ্চর্য! আমি কি টাকার জন্য এসেছি নাকি?”
পুরুষ কন্ঠ এবার হাসলো উচ্চস্বরে। হঠাৎই শোনা গেলো –
“আসলে তোমার বাবার হঠাৎ করে করে শরীর খারাপ হয়ে গেলো। একটু ডাক্তার দেখাতে হবে।”
“জানি তো, টাকার জন্যই এসেছেন অথচ কি নাটকটাই না করলেন। আর শোনেন, কতো মিথ্যে বলবেন? এই সেদিনই না একলক্ষ দিলাম? লজ্জা করে না এভাবে আমার কষ্টের টাকাগুলো অপচয় করতে?”
“পেলেপুষে এতো বড় করলাম আর এখন আমাকে এই কথা শুনচ্ছ?”
নারী কন্ঠের গর্জন।
“চুপ!একদম চুপ! আপনি পেলেছেন আমায়? এতো মিথ্যাচার! এইজন্যই আপনাকে সহ্য হয় না আমার। সাবের! সাবের!”
পুরুষ কন্ঠের গর্জন শুনে কেঁপে উঠলো রায়া। দু পা পিছিয়ে গেলো ভয়ে কিন্তু সেই সাথে প্রচন্ড কৌতুহলে ওর পা দু’টো আপনাতেই চলতে শুরু করলো। পায়ে পায়ে ছোট করিডোর পার হয়ে সে এসে দাঁড়ালো খোলা হলরুমে। সেখানেই দেখলো একজন পুরুষ আর মহিলাকে। দু’জনই রায়ার দিকে পেছন ফিরে আছে তাই রায়া চেহারা দেখতে পেলো না। এভাবে কারো কথা শোনা কিংবা দেখাটা খারাপ জানে তবুও রায়া নিজেকে নিরস্ত্র করতে পারলো না কিছুতেই। কিছুক্ষণ পরেই একটা ছেলেকে নিচ থেকে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উপরে আসতে দেখলো। রায়া দেখেই চিনলো, এই ছেলেটাই তাকে রুমে নিয়ে বসিয়েছিলো। ছেলেটা একবার রায়াকে দেখে থেমে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিলো।
“সাবের!”
“জ্বী স্যার!”
“কতোবার তোমাকে বলেছি আমার বাড়িতে যেন যখন তখন যে কেউ না আসে। এতোগুলা মানুষ কি এমনি এমনি রেখেছি বাড়িতে? তোমরা কি কিছুই দেখবে না? সবদিকে আমারই খেয়াল রাখতে হবে?”
সাবের চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। জানে এখন স্যারকে কোনো জবাব দেয়া মানে অকারণে ঝাড়ি খাওয়া।
“এখনই এনার মুখের ওপর পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে এনাকে বিদায় করো। আর যদি কোনোদিন ওনাকে এ বাড়িতে দেখি তবে তোমাদের কারো চাকরি থাকবে না বলে দিলাম?”
কথাটা বলে লোকটা ঘুরে দাঁড়াতেই রায়াকে দেখলো। মুহুর্তেই লোকটার মুখের রং পাল্টে গেলো। সে একবার সাবের আর একবার রায়ার দিকে তাকাচ্ছে।
“আপনি!”
রায়ার যেন এতোক্ষণে হুশ আসে। এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে অপরিচিত দুজন মানুষের কথোপকথন শুনছিলো এটা ভাবতেই নিজের কাছে ভীষণ লজ্জা লাগলো। তাই জবাবে সে কি বলবে ভেবে পেলো না। তার উপর সামনে দাঁড়ালো লোকটা না না ছেলেটাকে দেখে ওর হার্ট অ্যাটাক হওয়ার জোগার। দুবার চোখ রগড়ে নিলো। চোখের অসুখ হলো কিনা সেটাই ভাবছে। আবার তাকালো। সে কি ঠিকমত সব দেখতে পারছে? যা দেখছে তা কি সত্যি?নায়ক ইহান! কিভাবে সম্ভব! সে আজ এ কালের জনপ্রিয় নায়ক ইহানের বাসায়! নিজেকে চিমটি কাটলো একবার, ব্যাথা পেয়ে উফফ করে উঠেই বুঝলো যে সে স্বপ্ন দেখছে না। ঘটনা সত্যি, তার সামনে আসলেই ইহান দাঁড়িয়ে। পেছনের মহিলাও এবার ঘুরে সামনে এলো। একনজরে রায়ার আপাদমস্তক জরিপ করলো-
“আজকাল তবে বাসায়ও মেয়ে আসছে? বাহ, বেশ ভালোই উন্নতি হয়েছে তোমার?”
মহিলার কন্ঠে বিদ্রুপ। কথাটা শোনা মাত্রই ইহানের চোয়াল শক্ত হলো-
“দ্যাটস নান অফ ইয়োর বিজনেস। আর আপনি এখনো দাঁড়িয়ে আছেন আমার বাড়িতে?”
মহিলা যেন শুনতেই পায়নি ইহানের কথা-
“তোমার দাদীজান জানে? তোমার যে এতো উন্নতি হয়েছে? “
“আপনি যাবেন নাকি দারোয়ান ডাকতে হবে?”
“যাচ্ছি তবে আবার আসবো। আমার যখন খুশি তখন। তুমি আমাকে বাধা দিতে পারবে না কিছুতেই।”
বলেই মহিলা গটগট করে হেঁটে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। ততক্ষণে রায়ার চোখমুখ অপমানে লাল হয়ে গেছে, কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করছে। মহিলা কি মিন করলো ওকে সেটা না বোঝার মতো বোকা তো রায়া নয়! এসব কথা কখনো গায়ে লাগে না রায়ার। তবুও আজ কথাগুলো কেন যেন ভীষণ গায়ে লাগলো। নিজেকে কেমন নোংরা মনেহচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে এখনি ছুটে বেড়িয়ে যেতে। চোখ দুটো আপনাতেই পানিতে টইটম্বুর হলো।
“মিস..”
ইহানের ডাকে মাথা তুললো রায়া। তাকিয়ে দেখলো ইহান তাকিয়ে আছে তারই দিকে। চোখ দুটো কি যেন বলতে চাইলো। সরি বলতে চাইছে নাকি?
“আমি রায়া।”
“মিস রায়া, আই এম এক্সট্রিমলি সরি। বাট দোষ কিন্তু আপনারও আছে। আপনারও কিন্তু সরি বলা উচিত আমাকে!”
ইহান ভ্রু নাচায়। রায়া প্রশ্নবোধক চাহনি দিতেই ইহান বলে-
“আপনি বিনা অনুমতিতে চুপি চুপি দুটো মানুষের ব্যক্তিগত কথোপকথন শুনেছেন। এটা কি ঠিক হয়েছে?”
রায়া এবার লজ্জা পেয়ে গেলো। আসলেই তো! সে নিজের উপস্থিতি লুকিয়ে এদের কথা শুনেছে। আজ তার কি যে হয়েছে? যে কাজগুলো কখনোই করো না সেগুলোই করে ফেলেছে।
“সরি!”
“ইটস ওকে। প্লিজ নেক্সট টাইম ব্যপারটা খেয়াল রাখবেন। আপনি যেয়ে গেস্ট রুমে বসুন আমি আসছি। সাবের, আমাদের জন্য দুকাপ কফি পাঠাও।”
সাবের মাথা নাড়তেই ইহান হলরুম ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো। রায়া তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। এতোক্ষণ কি হলো সবই তার মাথার উপর দিয়ে গেলো। নায়ক ইহান! এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না! যদিও নায়ক নায়িকা নিয়ে রায়া কোনো ফ্যান্টাসিতে ভোগে না। কাজের প্রয়োজনে অনেক বিখ্যাতদের কাছাকাছি দেখার সুযোগ হয়েছে তার। তবুও এর আগে কাউকে এতো কাছ থেকে দেখেনি। রায়ার কেমন যেন লাগে। ইহান কেন ডেকেছে ওকে? আর ওকে কিভাবে চেনে ইহান? সে তো বিখ্যাত কেউ না? পড়ালেখার পাশাপাশি নিজের আর পরিবারের ভরনপোষণ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের কাজ করে সে। কখনো ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, কখনো ছবির মডেল যখন যে কাজ পায় করে ফেলে। অথচ এই বছর পাঁচেক আগেও কি সুন্দর স্বপ্নময় একটা জীবন ছিলো তারও। আজ এই মুহুর্তে সেই জীবনটাকে কেবলই স্বপ্ন মনে হয়।
সাবের নিজেই এলো কফি নিয়ে। সেই সাথে প্রচুর খাবার। খাবার দেখেই রায়ার খিদে লেগে গেলো। আজ সেই সকালে দুটো রুটি খেয়ে ক্লাসে এসেছিলো। মাঝে দুপুর বেলা দুটো শিঙাড়া খেয়ে এখানে এসেছে। রায়ার কেন যেন অভিমান হলো। এসব খাবার তার গলা দিয়ে নামবে না। সে বরং কফি খেয়ে খিদেটা মেরে ফেলবে।
“সে কি! আপনি কিছু খাচ্ছেন না যে?”
ইহান ঘরে ঢুকে একটু দুরত্বে বসলো। রায়া কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারে না।
“আপনি আবার রাগ করলেন নাকি? আমি কিন্তু সরি বলেছি। প্লিজ শুরু করুন, আমিও খাবো। খিদে পেয়েছে ভীষন। “
বলেই ইহান এক পিস পিজ্জা তুলে নিলো। রায়া আড়চোখে ইহানকে দেখলো একবার। পর্দার চেয়ে বাস্তবে বেশি সুন্দর ইহান। উজ্জ্বল শ্যামবর্নের মুখে সবুজ চোখের ইহানকে দেখলে যে কেউ প্রেমে পড়বে। মাথাভর্তি একঝাঁক সিল্কি চুল দেখলেই হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। মনের এরকম বেখেয়ালি ভাবনায় রায়া নিজেই নিজের কাছে লজ্জা পেলো। ছি! কিসব ভাবছে সে! মনের ভাবনাগুলো একপাশে সরিয়ে দিয়ে একটু গম্ভীর হলো রায়া-
“স্যার, আমার কাজটা যদি বলতেন?”
রায়ার সম্বোধনে ইহান একটু অবাক হলেও সামলে নিলো নিজেকে-
“আপনি তো ছবির মডেল হন, তাই না? “
“জ্বী। পেইন্টিং এর মডেল। এটা আমার রিসেন্ট কাজ। আগে করতাম না ইদানীং করছি।”
“জানি। আপনি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর সাথে জড়িত। এটাও অকেশনাল কাজ। পড়াশোনা আর টিউশনির ফাঁকে ফাঁকে করেন।”
রায়া মনে মনে অবাক হলো। এই লোক তার সম্পর্কে এতোকিছু কিভাবে জানে?
“জ্বী। কিন্তু আপনি কিভাবে জানেন?”
ইহান রায়ার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলো।
“আমি আপনাকে এই দুটোর কোনোটাই বলবো না। একটা অফার আছে আপনার জন্য।”
“কিসের অফার?”
রায়ার কথা শুনে মুচকি হাসলো ইহান। কফির মগটা তুলে নিয়ে দু’টো চুমুক দিলো নিঃশব্দে।
“টাকার প্রয়োজনে আপনি যেসব কাজ করছেন আমার অফার সেসবের চাইতে বেটার। এগুলোর কোনো কিছুই আপনার করতে হবে না। তাই আমি ধরে নিচ্ছি কাজটা আপনি করবেন।” রায়ার ভ্রু কুঁচকে গেলো। লোকটা ওকে অপমান করার চেষ্টা করছে না তো? ওর আগেই বোঝা উচিত ছিলো এই লোকটা প্লেবয়। প্রায়ই বিভিন্ন মেয়েদের সাথে তার লিংক আপ শোনা যায়। সিনেমার নায়িকা থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যবসায়ীর সুন্দরী কন্যা কেউ বাদ যায় না। এই তো কিছুদিন আগেও এক মন্ত্রীর মেয়ের সাথে এর সম্পর্কের গুন্জন শোনা যাচ্ছিলো। রায়া মেজাজ খারাপ করে হাতের কফির মগটা স্বশব্দে ট্রেতে নামিয়ে রেখে বললো-
“কি কাজ সেটা বলুন। আগে শুনি কাজটা করার মতো কিনা?”
ইহান আগের ভঙ্গিতে চুপচাপ কফিতে চুমুক দিলো। রায়া তাকিয়ে দেখছে ইহানকে কিন্তু ইহানের দৃষ্টি দেয়ালে টাঙানো পেইন্টিং এর দিকে। রায়ার অধৈর্য্য লাগে। তখনই ইহান মুখ খোলে-
“আমার দাদি, খুব অসুস্থ। আপনি কয়েকটা দিন আমার দাদির সাথে থাকবেন।”
“মানে?”
রায়া ভ্রু কুঁচকে গেলো। ইহান একটু কেশে গলা পরিস্কার করলো-
“আসলে আমি সিনেমার শুটিংএ কয়েকদিনের জন্য দেশের বাইরে যাবো। তো এবার দাদী আমাকে কিছুতেই যেতে দিতে রাজী নয়। দাদী আমার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। বিয়ে না করলে আমায় নাকি আর অভিনয়ই করতে দেবেন না। কিন্তু বোঝেন তো, এটা আমার প্রফেশন। অভিনয় না করলে খাবো কি? দাদীকে আপাতত আমার প্রেম আছে এটা বলে শান্ত করেছি। আর দাদীও আমাকে শর্ত দিয়েছেন, যদি প্রেমিকার সাথে দেখা করিয়ে দেই, আমার অনুপস্থিতির কয়েকদিন সে দাদীর সাথে থাকে তাহলে আমায় ছাড়বেন।”
“তো আমি কি করতে পারি?”
সন্দিগ্নু চোখে রায়া তাকিয়ে থাকলো। ইহান রায়ার এই দৃষ্টির সামনে একটু দমে গেলো। সময় নিয়ে কফিতে চুমুক দিলো। কথা সাজিয়ে নিয়ে তারপর মুখ খুললো-
“আপনি যদি কয়েকদিনের জন্য আমার প্রেমিকার রোলটা প্লে করতেন তাহলে আমার খুব উপকার হতো। কথা দিচ্ছি, আমি ফিরে এলেই আপনি মুক্ত। এজন্য আপনাকে কোনো হ্যানস্ত করা হবে না পরবর্তীতে। আপনার অন্যান্য কাজের মতোই এটা একটা কাজ ধরে নিন।”
প্রস্তাবটা শুনেই রায়ার হঠাৎ করে রাগ উঠে গেলো। লোকটা ভাবে কি তাকে? সে কি অভিনেত্রী নাকি যে দাদির সাথে অভিনয় করবে? চেনে না জানে না আজই প্রথম দেখা এরকম প্রস্তাব দেয় কি করে? আজব লোক তো!
“দেখুন আপনি কি ভেবে আমাকে এই কাজের প্রস্তাব দিলেন আমি বুঝে পাচ্ছি না। না আমি অভিনেত্রী না আমার কাউকে ধোকা দেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। আমি একজন স্টুডেন্ট, পড়ালেখার পাশাপাশি আমি টুকটাক কাজ করি। আমার…”
ইহান রায়াকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো-
“আমাকে ভুল বুঝবেন না। দাদির শরীরটা যতনা খারাপ তার চেয়ে বেশি মন। ডাক্তার ওনার মন ভালো রাখতে বলেছেন। একবার এ্যাটাক হয়েছে এইজন্য সাবধানতা। আর অন্য কাউকে ডাকলে দাদী হয়তো বুঝে যাবেন। আপনার চেহারাটায় একটা মায়াকাড়া আর আপন আপন ভাব আছে তাই বলছিলাম আর কি। আর তাছাড়া কয়েকটা জায়গায় আপনাকে কাজ করতে দেখেছি সে হিসেবে আপনাকে আমি যতটুকু চিনেছি মনে হয়েছে আপনি কাজটা করবেন। চিন্তা করবেন না, এর জন্য অনেক ভালো এ্যমাউন্ট আপনি পাবেন। আপনার অন্য যে কোন কাজের চাইতে বেশি পাবেন।”
ইহানের মুখে টাকার কথা শুনেই রায়ার নিজের ওপর ঘেন্না এলো। রাগে অন্ধ হয়ে হঠাৎ সে নিজের ব্যাগটা নিয়ে বেড়িয়ে এলো। ভালো লাগছে না তার, দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিজেকে টাকার কাছে খেলো মনেহয়। মনেহয়, তার কোনো সম্মান নেই। তাইতো সবাই তাকে তার সময়কে টাকার ওজনে মাপতে চায়। আজ কেউ প্রেমিকা সাজার অফার দিচ্ছে তো কাল যদি কেউ তার সাথে বিছানায় যাওয়ার অফার দেয় তাতেও অবাক হবে না ও। জগতটাই এমন, এখানে একজনকে দুর্বল পেলে বাকীরা উঠেপড়ে তার সুযোগ নিতে চায়। তাইতো সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাকে। অসহ্য লাগে তার চারপাশ। নিজের জন্মদাতার প্রতি একরাশ ঘৃণা উথলে ওঠে বুকে। তার জন্যই তো রায়ার আজকের এই জীবন। অনেকটা পথ রায়া অন্ধের মতো হেঁটে যায়। ঘেমে জুবুথুবু হয়ে হাঁপিয়ে ওঠে রায়া। পা দু’টো ব্যাথায় টনটন করছে। ক্লান্ত হয়ে রাস্তার পাশে বসে পরে। কতো দুর হেঁটেছে নিজেও জানে না। মেইন রোড ধরে সা সা করে গাড়ি ছুটছে। প্রচন্ড পিপাসায় কাতর রায়া ব্যাগ থেকে বোতল বের করে একঢোক পানি খায়। রাত নেমেছে অনেক আগেই। কিভাবে বাসায় যাবে এখান থেকে? সেই মোহাম্মদপুর যেতে হবে ভাবতেই ক্লান্তি ভর করে শরীরে। অনেক চেষ্টার পর একটা সিএনজিতে উঠে পরে রায়া। অনেকগুলো টাকা বেড়িয়ে যাবে তবুও উঠলো। আজ মনটা অশান্ত হয়ে আছে। টাকা গেলে যাক, এতো ভাববে না। জীবনে কতো বাজে বাজে প্রস্তাব পেয়েছে রায়া কিন্তু কখনো এতোটা রাগ হয়নি। জুয়েল যখন ছেড়ে গেলো তখনও নিজেকে সামলে নিতে পেরেছিলো। তবে
আজ কেন এমন লাগছে তার?
ইহান বারান্দায় দাঁড়িয়ে রায়ার চলে যাওয়া দেখে। সে বুঝতে পারছে না মেয়েটা এতো রেগে গেলো কেন? সে তো কোন খারাপ প্রস্তাব দেয়নি? তবে? ইহান মন খারাপ করে নিজের রুমে ঢুকলো। একটা পেইন্টিং এর সামনে এসে দাঁড়ালো।
“শোন মেয়ে! খুব তো ঢং দেখালে। আমি কি জানি না তোমরা কি চাও? তোমার মতো সবাই প্রথম প্রথম ঢং করে তারপর টাকা পেলে সব ভুলে যায়। দেখা আছে আমার সবাইকে? কতো সতীসাবিত্রী তোমরা? প্রতিদিন দেখছি তোমাদের চরিত্রের রদবদল। জানি তো ঠিকই ফিরে আসবে। এবার এলে কিন্তু তোমার নাক রগরে দেবো? ইহানের সাথে ভাব নেওয়া? অনেক পস্তাতে হবে তোমাকে!”
চলবে—–
সকালের আরামের ঘুমের পাট জীবন থেকে চুকে গেছে বহু আগেই। বাহির থেকে জীবনটা যতটা চকচকে মনেহয় মানুষের কাছে সেটা আসলে ততটা চকচকে নয়। অন্তত নিজের কাছে তো নয়ই। কর্মব্যস্ত দিনে ইহানের সকাল শুরু হয় ভোর পাঁচটা থেকে। সকালে উঠে নিয়ম মাফিক একঘন্টা জীম করা তারপর সময় হলে দাদিমার সাথে বসে নাস্তা করে শুটিং, ডাবিং এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়া। ফিরতে ফিরতে গভীর রাত। মাঝের এই সময়টা সবচেয়ে বোরিং কাটে ইহানের। শুটিং এর মাঝে একই দৃশ্য পাঁচ কি সাতবার রিটেক, কখনো নায়িকার স্পটে আসতে দেরি, কখনো পরিচালক এর সমস্যা আবার কখনো টেকনিক্যাল সমস্যা। এসব কিছু মিলিয়ে দিনটা কখনোই ভালো যায় না ইহানের। আজ মনটা কেমন যেন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে ইহানের। দাদিমার শরীরটা বেশ খারাপ। ইচ্ছে করছে না আজ শুটিং এ যেতে। অথচ মানা করার কোনো উপায় নেই। সামনের সপ্তাহে দেশের বাইরে যাবে তার আগেই এই ছবির শুটিং শেষ করতে না পারলে সিডিউল জটিলতায় ভুগতে হবে ওকে। এসব কিছু ভেবেই ইহান কাপড় পরে রেডি হয়ে উদাস বসে ছিলো সোফায়। সাবের এসে দাঁড়ালো সামনে-
“স্যার, দাদি আম্মা ডাকে আপনেকে।”
ইহান ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা ভাবলো তারপর উঠে দাঁড়ালো-
“চলো।”
দাদির ঘরে ঢুকলেই ইহানের মন ভালো হয়ে যায়। কারনটা ঠিক বোঝে না ইহান। দাদিমার ঘরে সব পুরনো ফার্নিচারের আসর। ইহান ছোটর থেকেই যা দেখে আসছে। নতুন এই বাড়িতে ওঠার সময় ইহান দাদিমার জন্য নতুন ফার্নিচার দিয়ে ঘর সাজিয়েছিলো কিন্তু দাদিমা সেসবে থাকতে রাজি হয়নি কিছুতেই। তার এক কথা, পুরনো আমলের খাট পালঙ্কে না শুলে তার ঘুম আসবে না। ওটা নাকি দাদার শেষ স্মৃতি। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে ইহান পুরোনো আসবাবগুলো নতুন করে রংটং করে দাদিমার ঘরে সেট করে দিয়েছে। এখন ইহানও ফিল করে, এতো বিলাসি আসবাবের মাঝেও ইহান যখন এই ঘরে আসে তখন আলাদা একটা শান্তি পায়। এই ঘরের সবকিছু খুব আপন আপন লাগে। মাঝে মাঝে ভাবে দাদির জন্যই হয়তো ভালো লাগে। পৃথিবীতে এই একটা মানুষকেই ওর আপন আর নিজের বলে মনেহয়। বাকি সবাইকে মনেহয় স্বার্থলোভি। ইহান ঘরে ঢুকতেই দাদি জামেলা বেগম হাতের ইশারায় তা কাছে বসার জন্য বললেন। ইহান হেসে দাদির কাছে বসলো-
“তোমার শরীর কেমন দাদিমা? “
“ভালো আছি ভাই।”
“তবে টেবিলে না যেয়ে রুমে ডাকলে যে?”
“অতো জোর এখনো আসে নাই রে ভাই তাই তোমারে এইখানেই ডাকলাম। একটা জরুরি কথা বলতে চাই। “
জামেলা স্নেহময় হাতে ইহানের মুখটা ছুয়ে দিলো।
“বলো না দাদিমা। তোমার আবার অনুমতি লাগে নাকি?”
জামেলা হাসলেন একটু। আদুরে দৃষ্টিতে নাতিকে দেখলেন কিছুক্ষণ-
“তোমার আজকে এক জায়গায় যাওয়া লাগবে। জানি, তুমি সব জায়গায় যাও না। তবুও আজকে দাদির সম্মানের খাতিরে যাওয়া লাগবে। যাবা তো ভাই? “
“কোথায় যেতে হবে দাদিমা? না হয় তোমার আমার নামে একটা গিফট পাঠিয়ে দেই?”
“সেইটা হইলে তো আর তোমারে বলতাম না ভাই। ওই যে তোমার নুরু চাচা আছে না, চিনো তো?
এককালে বিপদে আমারে মেলা সাহায্য করছে, তোমার পড়ালেখার সময় না কইতে মেলা করছে আমাগো জন্য। সে নিজে আমাকে ফোন করছিলো। তার বড় পোলার বিয়া লাগছে, আইজকা বৌভাত। খুব কইরা যাইতে কইছিলো। নিজে একদিন আইসা বিয়ার কার্ডও দিয়া গেছে। এখন আমি তো অসুস্থ হইয়া পইড়া আছি, বিয়াতে যাইতে পারি নাই। এখন বৌভাতে না গেলে কেমুন অয়, আমার তরফ থিকা তুমি যাও না হয়?”
“আচ্ছা, যাবো। কি দিতে হবে বলে দাও।”
“সে তুমি দিয়ো তোমার ইচ্ছামতো কিছু একটা। এই যে কার্ড, এইখানে ঠিকানা লেখা আছে।”
“ঠিক আছে দাদিমা। আমি এখন যাই তাহলে?
“না, খাড়াও। তুমি মনেহয় কিছু ভুইলা যাইতেছো।”
ইহান মনে মনে প্রমোদ গুনলো। এই রে সেরেছে। দাদী এখন এ কথা না পারলে হয়।
“কোন কথা দাদীমা?”
“তোমার বিয়ার কথা। তুমার চেয়ে ছোট ছোট মানুষ সব বিয়া কইরা ফেলতেছে আর তুমি এখনো রঙ্গ করতেছো। তুমার না কার লগে জানি আমার দেখা করাই দেওনের কথা?”
“আমি যাই আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে দাদীমা।”
ইহান দাদীকে ফাঁকি দিতে চায়।
“না খাড়াও। আমার কথার জবাব দিয়া তারপর যেইখানে মনচায় যাও।”
ইহানের হাত ধরে দাদী তার পাশে বসিয়ে দেন। ইহান আমতা আমতা করে।
“কি হইলো কও?”
“দাদীমা, আমি তো তার সাথে তোমার দেখা করাইতে চাই কিন্তু সে তো রাজি হয় না। সে বলে, নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে সে নাকি বিয়ে করবে না। আমি এতো নামীদামী নায়ক আর সে এখনো চুনোপুঁটি। তাই তোমার সামনে আসতে চাইছে না।”
“তো সে কি এখন নায়িকা হইতে চায়? আজব মেয়ে মানুষ তো? আর তুমিও কি নায়িকা বিয়া করবা নাকি? তাইলে তো এইটা সংসার না সিনেমা হইবো। শোনো ভাই, এতোকথা আমি শুনতে চাই না। দুই-একদিন এর মধ্যে তার সাথে দেখা না করাই দিলে কিন্তু এইবার তোমারে ছাড়তাম না। তোমার চিন্তায় চিন্তায় শরীর আমার বেশি খারাপ হয়ে গেছে তুমি কি তা বোঝো না?”
“দাদীমা, আমাকে আর একটু সময় দাও দেখি তাকে বোঝাতে পারি কিনা? তুমি আর এইসব নিয়ে ভেবো না। আমি আসি দাদীমা।”
ইহান দাদির কপালে চুমু দিয়ে বেড়িয়ে এলো। সাবের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো। ইহান বের হয়ে সাবেরের হাতে কার্ডটা দিলো-
“আজকে রাতে দাওয়াত। তুমি একসেট গহনা কিনো, আমি নিজে এই দাওয়াতে যাবো। আর রাতে মনে করিয়ে দিয়ো আমাকে।”
সাবের মাথা নাড়ে। যদিও সে অবাক হয়েছে অনেক। ইহান পারতপক্ষে কোনো দাওয়াত বা পার্টিতে যায় না। আজ নিজে থেকে যেতে চাচ্ছে তারমানে এটা খুব স্পেশাল দাওয়াত। দু’জন চুপচাপ বসে রইলো কিছুক্ষণ। ইহানের কপালে চিন্তার রেখা। সাবের ভাবছে জিজ্ঞেস করবে কিনা ওর মনে দ্বিধা, স্যার আবার বকাটকা দিবে নাতো? শেষমেষ দ্বিধা ঝেড়ে ফেললো-
“স্যার, কি নিয়ে ভাবছেন বলা যাবে?”
“আর বোলো না, দাদী এবার ভীষণ জেদ করছে। এদিকে ওই মেয়েটাকে তো প্রস্তাব দিলাম কাল কিন্তু সে তো প্রস্তাবে রাজি নয় উল্টো এমন ভাব করে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলো যেন তাকে আমি বাজে প্রস্তাব দিয়েছি। কি করি বলোতো?”
সাবের কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললো-
“আপনি ভাববেন না স্যার আমি দেখছি কি করা যায়। “
ইহান সাবেরের দিকে তাকিয়ে থেকে নিশ্চিত হলে ঘাড় নাড়লো। সাবের যখন বলছে তখন কোনো একটা ব্যাবস্থা হবে নিশ্চয়ই।
“আরে, নায়ক সাহেব যে! এখন বুঝি সময় হলো আসার? আমি তো ভাবলাম আজ শুটিং ক্যানসেল?”
কথাটা শুনে ইহান দাঁড়িয়ে গেলো। হালের জনপ্রিয় নায়িকা আরতি। শিক্ষিত আর ড্যাম কেয়ার মেয়ে হিসেবে এরইমধ্যে বেশ নাম কামিয়ে ফেলেছে। ইহানের সাথে এই ছবিতেই প্রথম কাজ। মেয়েটা প্রায় দিনই দেরি করে আসে শুটিংএ। ইহান খুব বিরক্ত, মনে মনে ভেবেই রেখেছে এর সাথে আর কোনো কাজ করবে না। সেই মেয়ে কিনা আজ তাকেই কথা শোনাচ্ছে? ইহান একটা শুকনো হাসি দিলো-
“সরি, আজ একটু লেট। আসলে আজ যে আউটডোর শুটিং এটা আমার মাথা থেকে স্কিপ করে গেছিলো। তুমি দু’মিনিট বসো, আমি চট করে মেকাপ করে আসি।”
আরতি উঠে এলো, ইহানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো-
“আজ যে একটা রোমান্টিক সিন আছে সেটাও কি ভুলে গেলেন নাকি? একটু আলোচনা করে নিলো হতো না?”
ইহান মনে মনে চমকে গেলো। সত্যি সত্যি আজ কোনো সিন আছে নাকি? সে একনজর দেখলো আরতিকে। একেবারে আঁটোসাটো একটা পোশাক পরে আছে, শরীরের অর্ধেক দৃশ্যমান। চড়া মেকাপে মুখ ঢেকে আছে। ইহান চোখ সরিয়ে নিলো। কেমন যেন লাগছে তার, অরুচি লাগছে। এই মেয়ের সাথে আজ কোনোভাবেই কোনো সিন করা সম্ভব হবে বলে মনেহয় না। নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে ইহান বললো-
“আচ্ছা, আগে দেখি কি সিন। পরে প্রয়োজন হলে আলোচনা করবো।”
নিজের মেকাপ রুমে এসে দু’বার বড় বড় নিঃশ্বাস নিলো ইহান। কিছুক্ষণ পরই পরিচালক নাজিম রকি এসে ঢুকলো-
“হেই রিজওয়ান, এই যে আজকের স্কিপ্ট। একটু দেখে নাও।”
“রকি ভাই, কি শুনলাম? আজ নাকি কিসিং সিন আছে? আমি আপনাকে কিন্তু বার বার বলেছিলাম, ওসব থাকলে ছবি করবো না। আরতির সাথে তো আরো না।”
“রিল্যাক্স রিজওয়ান। কি করবো বলো, পাবলিক ডিমান্ড। একটা দু’টো কিসিং সিন না থাকলে তো ছবি জমবে না। আর তাছাড়া আরতির সাথে তোমার প্রথম মুভি, ওর একটা মার্কেট ভ্যালু আছে, ওটা কাজে লাগাতে হবে তো নাকি?”
বলেই চোখ টিপলো রকি। ইহানের মেজাজ চরম খারাপ লাগছে।
“আজ কোনো রোমান্টিক সিন পসিবল না রকি ভাই। আমার আজ মুড ভালো না। প্লিজ অন্যদিন রাখুন এই শুটিং।”
কিছুক্ষণ হো হো করে হাসলো রকি। যেন ইহান কোনো মজার জোকস বলেছে।
“তুমি যে কি বলো না রিজওয়ান না হেসে পারি না। কতোদিন ধরে অভিনয় করো বলোতো? এসব তো তোমার কাছে ডালভাত, চোখ বন্ধ করে করে ফেলতে পারবে। আজ আরতির মুড ভালো, প্লিজ ভাই না করো না। তোমার ক্যারিয়ারের জন্য ভালো হবে।”
“এখন আর এসব ভালো লাগে না রকি ভাই।”
“তবে যে আর্ট ফিল্ম করতে চাইলো? নাচতে নেমে কি আর ঘোমটা দিলে চলবে? টেক ইট ইজি ম্যান। দু’মিনিট এর সিন, দেখতে দেখতে হয়ে যাবে।”
রকি ইহানের পিঠ চাপড়ে বেড়িয়ে গেলো। হাতে ধরে থাকা স্ক্রিপ্টের কপিতে চোখ বুলাতে বুলাতে ইহানের মেজাজ সপ্তমে উঠলো। এতো খোলামেলা দৃশ্য আগে কখনো করেনি ইহান। হঠাৎ করেই ভীষণ লজ্জা লাগলো ইহানের। কোনোদিন যদি দাদিমা জানতে পারে কি বলবে ওকে? ছি! দাদাভাই, টাকা ইনকামের জন্য এইসব করেছিস? কি জবাব দেবে ইহান ওর দাদিমাকে?
*******
“মা, আজ আমার ফিরতে রাত হবে। আজ ডিউটি পরেছে আমার। “
রায়া মাকে বলে হুড়োহুড়ি করে বেড়িয়ে পরতে চায়। তার মা রাজিয়া বিল্লাল তখন রান্নাঘরে বসে আছে ঠায়। কিছু একটা ভাবছিলেন, মেয়ের কথা তার কানে গেলো না।
“এই তাসনি,শোন তো,একটু দাড়া।”
পেছনে বড় বোন জোয়ার গলা পেয়ে রায়া দাঁড়ালো। পেট উচু করে পেঙ্গুইনের মতো হেঁটে এলো জোয়া। আটমাসের বাচ্চা পেটে জোয়ার। প্রথম বাচ্চা, তাই তার বাবার বাড়িতে আগমন।
“কি বলবে আপা?”
“আমার না খুব বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করছে। আজ আসার সময় নিয়ে আসবি?”
রায়া একবার মায়ের দিকে তাকালো। রাজিয়া জুলজুলে চোখে তাকিয়ে আছে জোয়ার দিকে। রায়া মায়ের থেকে চোখ ফিরিয়ে বোনের দিকে তাকালো, ভেতর থেকে উঠে আসা নিঃশ্বাস চেপে নিয়ে বললো-
“আচ্ছা, নিয়ে আসবো। মা আমি আসছি।”
রায়া বেড়িয়ে যাওয়া মাত্র রাজিয়া জোয়ার কাছে এলো-
“তোর বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করছে?”
“হুম মা, খুব।”
রাজিয়া জোয়ার গালে কষে চড় লাগিয়ে দিলেন-
“তো বাপকে বলতে পারিস না? খুব তো ঢ্যাংঢ্যাং করতে করতে তার কাছে চলে গিয়েছিলি। এখন আবার আমার কাছে ফিরেছিস কেন? বাপ রাখেনি বুঝি তার আদরের মেয়েকে? শয়তান মেয়ে একটা!
আর তোর জামাইটাই বা কেমন? সে কি বেঁচে আছে না মরেছে আর নাকি তার পয়সার অভাব? তাকে বলতে পারিস না নিজের শখ আল্লাদের কথা? বোনটা খেটে খেটে মরছে তোর তার কাছেই নিজের খিদের কথা বলতে হবে?”
মায়ের চড় খেয়ে জোয়া কাঁদতে শুরু করলো-
“কেন ওকে কেন বলবো? আমি কি পালিয়ে বিয়ে করেছি? তোমরাই তো বিয়ে দিয়েছো। তবে কেন তোমার কাছে আসতে পারবো না? প্রথম বাচ্চা হবে আমার, আমি মায়ের কাছে আসবো না? আমার সব জাদের বাচ্চা হওয়ার সময় ওরা বাপের বাড়ি ছিলো। এখন আমি যদি না আসি তবে ওদের কাছে আমার মান থাকবে?”
মেয়ের কথা শুনে রাজিয়ার মনে হলো আরো কয়েকটা চড় মারে মেয়েকে। এতো স্বার্থপর মেয়ে পেটে ধরেছিলেন এটা ভাবতেই নিজের ওপর ঘেন্না ধরলো। মেয়ে হয়েছে ষোলআনা বাপের মতো। তার আর রুচি হলো না জোয়ার সাথে কথা চালানোর। সে উঠে চলে গেলো রান্নাঘরে।
“এই দোলন, ম্যাডাম কি খোঁজ করেছিলো আমার?”
রায়া খুব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো দোলনকে। দোলন আর রায়া একই সাথে পড়ে, আর একই সাথে একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানে পার্টটাইম কাজ করে। আজ একটা ইভেন্টে রায়া আর দোলনের ডিউটি পরেছে।
“হ্যা, দুবার খোঁজ করেছে। এখনই রওনা দিতে বলেছে সবাইকে। আজকের পার্টি অনেক বড়, পেমেন্টও পাবে ভালো আজ। তাই ম্যাডামের মেজাজ খারাপ। আজ কোনো উল্টো পাল্টা কিছু যেন না হয়, বারবার বলে দিয়েছে।”
“ওহহহ। আচ্ছা আমি তাহলে চট করে কাপড় পালটে নেই দাঁড়া।”
প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত ড্রেসকোড শার্ট আর প্যান্ট পড়ে বেরিয়ে এলো রায়া। যদিও এই পোশাকে ও কমফোর্ট ফিল করে না তবুও চাকরি বলে কথা। সবই মেনে নিতে হয়। রায়া আর দোলন প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।
*******
আরতির সাথে চুমুর দৃশ্য মোটেও সুখকর ছিলো না ইহানের কাছে। মেয়েটা চরম মাত্রার বেয়াদব। এমনিতেই এসব দৃশ্যতে ইহান ভীষণ আনকমফোর্টেবল ফিল করে তারউপর আরতি ঘুরে ফিরে ইচ্ছে করে বারবার ভুল শট দিচ্ছিলো। প্রতিবার পরিচালকের কাট শুনেই আরতির মুখে একটা বাঁকা হাসি খেলে যেতে দেখেছে ইহান। পরপর তিনবার এমন হওয়ার পর ইহান যথেষ্টই রেগে গেছিলো। চতুর্থবার ইহান প্রস্তুত হয়েই ছিলো। পরিচালকের ওয়ান টু থ্রি শোনার সাথে সাথে আরতিকে জাপটে ধরে গভীর চুমু দিয়েছিলো ইহান। আরতিও সেই চুমুতে গভীরভাবে সারা দিলো। দু’জনে এতোটাই বিভোর হয়ে ছিলো যে রকি ভাইয়ের কাট কথাটি কারো কানেই যায়নি। বেশ অনেকক্ষণ বাদে ইহানের হুশ ফিরলে ফট করে আরতিকে ছেড়ে দেয়। আরতি তখন মিটমিটিয়ে হাসছে, হাসছে রকি ভাইও-
“দারুন কাজ হয়েছে রিজওয়ান। তোমাদের ক্যামিস্ট্রি তো দারুন জমে গেছে। ছবি হিট হয়ে যাবে রিজু। এজন্য অবশ্য পুরো ক্রেডিট আরতি পাবে। ও তোমাকে ইচ্ছে করে রাগিয়ে দিয়েছে যাতে করে শুটটা পারফেক্ট হয়।”
ইহান সলজ্জ হেসে আরতিকে দেখলো। মেয়েটা তখনো হেসেই যাচ্ছে।
“আমি নতুন হতে পারি নায়ক সাহেব কিন্তু এসব কাজে আপনার থেকে পটু। কি বলেন?”
ইহান কোনো কথা বলতে পারলো না। ইস, মেয়েরা বুঝি এতো বোল্ড হয়! ইহানের তো মেয়েদের লজ্জাবতী দেখতেই ভালো লাগে।
“আপনার এই লজ্জা লজ্জা মুখটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে নায়ক সাহেব আর চুমুটাও…”
গাড়ির ব্রেক ইহানকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনলো। কানের কাছে তখনো আরতির কথাগুলো বেজে যাচ্ছে। সাবেরের কন্ঠ পাওয়া গেলো-
“স্যার, চলে এসেছি। “
ইহান গাড়ি থেকে নামলো। সেনাকুঞ্জে অনুষ্ঠান দেখে ভ্রু কুঁচকালো ইহানের। নুরু চাচার কি অনেক টাকা হয়েছে নাকি? এতোটা হাই প্রোফাইল বিয়ে তো সে আশা করেনি। দাদিমাও কিছু বলেনি ওকে। সে অবাক হয়ে সাবেরের দিকে তাকালো-
“সাবের, এতো দেখছি বড়লোকি বিয়ে। “
“জ্বী স্যার। উনি তো বেশ ভালো টাকার মালিক। হসপিটাল এক্সেসরিজের বিজনেস ওনার।”
“তাই নাকি? চলো দেখি, গিফট কি ছোট হয়ে গেলো নাকি? আমি তো বুঝতে পারিনি।”
“সমস্যা নেই স্যার, ভালো গিফট আছে, আপনি ভাববেন না। “
ইহান কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে সাবেরের দিকে তাকালো। এই ছেলেটা সবসময় ওকে বাচিয়ে দেয়। ইহান গেটের দিকে এগিয়ে গেলো। এদিকে দু’চার জন ঘুরে ফিরে তাকাচ্ছে ইহানের দিকে। নায়ক রিজওয়ান খান ওরফে ইহানকে দেখছে। নুরুল হক সাহেব ইহানকে দেখে এগিয়ে এলো –
“রিজু, আমিতো বিশ্বাস করতে পারছি না তুমি এসেছো! খুব খুশি হয়েছি বাবা। জামেলা খালার শরীর কেমন এখন?”
“আগের মতোই। আপনাকে ভুলেই গেছিলাম চাচা। আগে তো প্রায়ই বাসায় যেতেন।”
“আমি তো যাই প্রায়ই তোমার দাদিকে দেখতে। তুমি থাকো না তাই তোমার সাথে দেখা হয় না।”
কথা বলতে বলতেই ভেতরে যায় ইহান। বর কনের সাথে দেখা করে গিফট দিয়ে চলে আসবে ভেবেছিলো। কিন্তু নুরুল হক তাকে ছাড়লেন না কিছুতেই। নিজে ধরে নিয়ে গেলেন খাবার টেবিলে। না খেয়ে কিছুতেই যেতে দেবেন না। অগত্যা বাধ্য হয়ে ইহান বসলো। অনিচ্ছা সত্বেও প্লেটে খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে তখনই আওয়াজ, ইহান তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো। রায়া গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখ ভরা পানি। বেশ মোটাসোটা এক মহিলা চেচামেচি করছে-
“হাউ ডেয়ার ইউ, দেখে চলতে পারো না। আমার এতো দামি শাড়িটা নষ্ট করে দিলে। কে দেবে এই ক্ষতিপূরন? তুমি দেবে? কি সব লোকজন দিয়ে কাজ করায়। অসহ্য!”
মহিলার শাড়ি ততক্ষণে মাংসের ঝোলে মাখামাখি। রায়া ক্ষীন শব্দে সরি বলার চেষ্টা করলো কিন্তু গলা দিয়ে স্বর ফুটলো না। ইহানের সামনে এভাবে নিজেকে অপদস্ত হওয়াটা ওকে বেশি পোড়াচ্ছে। ইহান যখন ঢুকলো তখনই রায়ার নজরে পড়েছিলো। তাইতো এতোক্ষণ ইহানের চোখ বাচিয়ে চলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ধরা পড়েই গেলো শেষমেষ। ইহানকে দেখতে দেখতে কখন যে হোঁচট খেয়ে মহিলার উপর পড়েছে বুঝতেই পারেনি। মহিলা তখনো গজগজ করেই যাচ্ছে। রায়া চোখ ভরা জল নিয়ে আরো একবার ইহানকে দেখার চেষ্টা করলো। ইহান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওরই দিকে। কিছুক্ষন পর ইহান মুখ নামিয়ে নিলো। যেভাবে প্লেটের খাবার নাড়াচাড়া করছিলো সেরকমই করতে লাগলো। যেন সে কিছুই দেখেনি, যেন সে রায়াকে চেনে না। হঠাৎ রায়ার চোখ পড়ে মহিলার পাশের চেয়ারে বসে থাকা লোকটার দিকে। ইহানকে দেখার চক্করে এই লোককে নজরে পড়েনি। লোকটা দুএকবার রায়াকে চড় মারা মহিলাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছিলো কিন্তু তাতে মহিলা আরো যেন বেশি ফুসলে উঠলেন। লোকটা আর কিছু বলার সাহস পেলো না। কেবল একবার চোরা চোখে রায়াকে দেখে নিয়ে খাবার খাওয়ায় মন দিলো। দোলন এসে কোনোরকমে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে রায়াকে টেনে নিয়ে গেলো আড়ালে। রায়ার হঠাৎ কি হলো কে জানে। দোলনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। সে কোনোমতেই ভুলতে পারছে না ওই মহিলার পাশে বসা লোকটাকে। লোকটা যে তার বাবা! ওই মহিলার স্বামী!
চলবে—–
তীব্র অপমানের লজ্জায় মনেহয় রায়ায় সে রাতে ভীষণ জ্বর হলো। সারারাত ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে আর জ্বরের তাড়নায় রায়া বারবার কেঁপে কেঁপে উঠলো। রাজিয়া সারারাত মেয়ের পাশেই জেগে বসে রইলেন। বুঝতে পারছিলেন মেয়ে কোনো একটা বিষয়ে ভীষণ কষ্টে আছে। জ্বরে তপ্ত মেয়ের কপালে জলপট্টি দিতে দিতে রাজিয়া দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। মেয়েটা তার বড্ড চাপা। অল্প বয়সে সংসারের বিশাল বোঝাটা একা হাতে সামলাচ্ছে। জানে এই সংসারের ঘানি টানতে যেতে মেয়ের নিজের অনিচ্ছায় অনেক কাজ করতে হচ্ছে। তিনি সবই বোঝেন কিন্তু না বোঝার ভান করেন। মা হয়েও এদের জন্য কিছু করতে পারছেন না এই লজ্জা তাকে তাড়া করে ফেরে।
এই বয়সে স্বামীর দ্বারা প্রতারিত হয়ে অপমানের লজ্জায় মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে করলেও মেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নেন। একেকটা রাত তার কিভাবে কাটে সে নিজেও জানে না। সারাজীবন ঘরকন্নার কাজ ছাড়া আর কিছু করেননি। অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিলো। সেই থেকে স্বামী সংসারেই সব মনোযোগ দিয়েছেন। মনেই হয়নি কখনো যে পড়ালেখা করবেন বা অন্য কিছু করবেন।
সংসারী বউ ছিলেন, স্বামীর মনমতো চলতে পারতেন না হয়তো। তাইতো এই বয়সে এসে এরকম অঘটন ঘটালো লোকটা। ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিলো রাজিয়ার তখনই রায়া চোখ মেললো। ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেছে। গতকাল দুপুরে খেয়েছিলো শেষ, তাই জ্বর ছেড়ে যেতেই খিদেটা চাগার দিয়ে উঠলো। পাশে তাকাতেই দেখলো মা ঘুমিয়ে আছে। মাকে দেখে মায়া হলো ভীষণ, মানুষটা হয়তো ঘুমায়নি সারারাত। তাই সে মাকে না জাগিয়েই সন্তর্পনে বিছানা ছাড়লো। শরীরটা বেশ দুর্বল, মাথাটা টলছে রীতিমতো। রায়া বহুকষ্টে বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে এলো। ডাইনিংয়ে এসে ফ্রিজ খুলে দেখলো খাওয়ার মতো কিছু পাওয়া যায় কিনা। খাওয়ার মতো কিছু নেই, পুরো ফ্রিজ ফাঁকা পড়ে আছে। রায়া হতাশ হয়ে শ্বাস ছাড়ে। একসময় এই ফ্রিজ ভর্তি খাবার থাকতো আর এখন ফ্রিজ এতোটাই ফাঁকা যে দুবেলা পেট পুরে খাওয়া হয় না তাদের। একেই বুঝি নিয়তি বলে?
“কিরে, জ্বর ছাড়লো?”
রায়া ঘাড় ঘুরিয়ে মাকে দেখলো।
“তুমি উঠে গেছো?”
“হুম। তোকে না পেয়ে উঠে এলাম। কি খুঁজছিস?”
“কিছু না। খিদে লেগেছে মা, খাবার কিছু আছে?”
“নাহ। বাসায় তোএকটু চাল আর ডাল ছাড়া রান্নার মতো আর কিছু নেই। তুইতো আজ বাজার করতে চেয়েছিলি।”
“হুম।”
“খিচুড়ি রেধে দেই তোকে?”
রায়ার চোখ চিকচিক করে উঠলো। খিচুড়ির কথা শুনেই জিভে জল এলো।
“দাও মা। বেশি করেই করো, সবাই মিলে খাবো।”
রাজিয়া কিছু বললো না। রান্নাঘরে চলে গেলো। রায়া মায়ের পিছু পিছু এলো। দেয়ালে হেলান দিয়ে মায়ের কাজ দেখতে লাগলো।
“কিছু বলবি?”
রায়া চমকে উঠলো। মা কি করে জানলো যে ও মাকে কিছু বলতে চায়? রায়া ইতস্তত করছিলো। মাকে কথাটা বলা কি ঠিক হবে? এমনিতেই মা কষ্টে আছে আর কষ্ট দিয়ে কি লাভ।
“বলে ফেল, এতো ভাবনার দরকার কি?”
“কাল বাবাকে দেখলাম মা! বাবা ভালোই আছে আমাদের ছাড়া।”
চাল ধুতে ধুতে এক সেকেন্ডের জন্য রাজিয়ার হাত থেমে গেছিলো। নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে আবার আগের মতো কাজ করতে থাকলো। বুকে ঝড় বয়ে গেলেও মেয়ের সামনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো প্রানপনে। রায়া জানে মায়ের এখন ভীষণ কান্না পাচ্ছে কিন্তু ওর সামনে কাঁদতে চায় না মা তাই রায়া নিঃশব্দে মার কাছ থেকে সরে এলো। মা একটু কাঁদুক একা একা, মনটা হালকা করুক।
“ছোটপা, কি করিস?”
টিয়া এসে বোনের জড়িয়ে ধরে ঝুলে পড়লো। রায়া তখন মন দিয়ে ছয়তলার বারান্দা থেকে নিচের ব্যস্ত শহরটা দেখছিলো।
“কিছু না। তোর স্কুল নেই আজ? বড়পা উঠেছে ঘুম থেকে?”
“হুম উঠেছে। স্কুল আছে, যাবো একটু পরে।”
জবাব দিয়ে টিয়াও দাঁড়িয়ে পড়লো বোনের সাথে। আমতা আমতা করে বলে ফেলে-
“ছোটপা, স্কুলের বেতন বাকি পড়েছে কয়েক মাসের। সামনে পরীক্ষা আছে আপা, বেতন না দিলে পরীক্ষা দেওয়া হবে না।”
রায়া চোখ মেলে বোনকে দেখে। ক্লাস টেনে পড়ে টিয়া। এই বয়সটাতে তবুও রায়া অনেক নির্ভার ছিলো। মাথার উপর বাবার ছায়া ছিলো, টিয়ার মতো এতো ভাবনা ছিলো না মাথায়। আহা! বোনটা তার কিশোরী বয়সটা এনজয় করতে পারছে না। ছোট বোনের প্রতি এক অপার্থিব মায়ায় রায়ার মন আদ্র হয়। টিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে-
“দু একদিনের ভেতর দিয়ে দেবো। তোর এক্সাম কবে?”
“সামনের মাসে।”
“মন দিয়ে পড়িস কিন্তু। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে রে। জীবন কত কঠিন দেখছিস তো?”
“হুম।”
টিয়া কি বুঝলো কে জানে। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। বোনকে ভীষণ ভালো বাসে টিয়া। তার বোনের মনটা নরম খুব। নিজে যত কষ্টেই থাক না কেন ওদেরকে একটুও কষ্ট পেতে দিতে চায় না। একেবারে বাবাদের মতো করে আগলে রাখে ওদের। বাবাদের মতো? না কখনোই না। ও বড় বোনের মতোই আগলে রাখে। নিজের মনে সগতোক্তি করে টিয়া। হঠাৎই মনে পড়ে গেলো কাল ও জুয়েল ভাইকে দেখেছিলো। মনে পড়তেই ফট করে বলে ফেললো বোনকে-
“আপু, কালকে জুয়েল ভাইকে দেখলাম রে।”
“কোথায়?”
“এই তো, স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিলাম তখন। সাথে খুব সুন্দরী একটা মেয়ে। কি খুশি লাগছিলো জুয়েল ভাইকে! পৃথিবীর সব পুরুষগুলো কি এইরকম হয়রে আপু? বাবা আর জুয়েল ভাইয়ার মতো? ভালো মানুষ নেই নাকি পৃথিবীতে?”
রায়া বোনকে কাছে টেনে নেয়-
“জানি না রে। আছে হয়তো কিন্তু আমরা দেখতে পাই না।”
“জানিস আপু, আমার ভীষণ ঘেন্না হয় ওদের। কেন এরা সবাই এমন আপু? আমাদের সাথেই কেন এমন হয়?”
তীব্র কষ্ট দলা পাকিয়ে ওঠে টিয়ার মনে। রায়া বোনকে জড়িয়ে ধরে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মনেমনে বলে-
“আমারও ঘেন্না হয়রে টিয়া কিন্তু কিছু বলতে পারি না। তোর মতো এতো সহজে প্রকাশ করতে পারি না রে? কষ্টগুলো পুষে রাখছি বুকের ভেতর। কষ্টগুলোকে পেলেপুষে বড় করছি। কোনোদিন যদি আমারও সুযোগ হয় তবে একদিন হিসেব নিকেশ করবো, দেখে নিস।”
*******
“ভাইয়া, আমি আজ থেকে এখানেই থাকবো। ও বাড়িতে আর ফিরে যাবো না। মা সারাক্ষণ আমার পিছে লেগে থাকে, ঘ্যানঘ্যান করে। আমার ভালো লাগে না। তুমি থাকতে দেবে তো আমাকে?”
ইনা ভাইকে দেখে দৌড়ে এলো। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছিলো ইহানের। ভাবছিলো রুমে ঢুকেই বিছানায় ঝাপিয়ে পড়বে। কিন্তু বোনকে দেখে ঘুম ছুটে গেলো।
“তুই কখন এলি?”
“সন্ধ্যায় এসেছি। আজ ক্লাসে যাইনি। দেখো কাল রাতে মা আমাকে কি রকম মেরেছে?”
ইনা জামার হাতাটা গুটিয়ে উপরে তুললো। বোনের হাতের কালসিটে দেখে ইহান চোখ ফিরিয়ে নিলো।
“কিছু করেছিস?”
“হ্যা করেছি তো?”
“কি করেছিস?”
“মা আমাকে দিয়ে মডেলিং করাতে চায়। আমি রাজি হইনি তাই…”
কান্নায় ইনার গলা ভারী হয়ে গেলো। রাগে ইহানের চোয়াল শক্ত হলো।
“তুই এখানেই থাক, ও বাড়িতে যাওয়ার দরকার নেই কোনো। ঠিক আছে?”
ইনা ঘাড় নেড়ে সায় জানালো।
“শোন, আমি আগামী সপ্তাহে ব্যাংকক যাবো সপ্তাহ খানেকের জন্য। দাদিমা অসুস্থ, কাউকে পাচ্ছিলাম না যে কাছে থাকবে। তুই তাহলে একটু দাদিমাকে দেখে রাখিস আমি আসা পর্যন্ত। কি পারবি না? “
“এ আর এমন কি কাজ ভাই, খুব পারবো। তুমি নিশ্চিন্তে যাও।”
ইনা ভাইকে আস্বস্ত করলো।
“আর শোন, আমার অনুপস্থিতিতে কেউ যেন না আসে বাড়িতে। বুঝতে পারছিস? কেউ না মানে কেউ না!”
“ঠিক আছে। কেউ এলে আমি কাউকে ঢুকতে দেবো না।”
“দ্যাটস লাইক এ গুড গার্ল। আমি গেলাম, আজ টায়ার্ড ভীষণ।”
ইহান নিশ্চিত মনে ঘুমাতে গেলো। যাক, একজনকে তো পাওয়া গেলো দাদিমার কাছে থাকার জন্য। কিন্তু তবুও দাদীমা কি মানবে? কথিত প্রেমিকাকে না দেখালে কি ছাড়বে ওকে? দেখা যাক সাবের কি ব্যবস্থা করে। ইহান হাসলো মনেমনে। মেয়েরা ভালোটা বোঝে না। মনে কেবল আত্মসম্মান নামের একটা ভারী বোঝা বয়ে বেড়ায়। আরে ভরা মজলিসে যে অপমান হলি তাতে তোর আত্মসম্মান কোথায় গেলো? নেহায়েত মেয়েটাকে দেখে ভালো লেগেছিল তাই এই প্রস্তাব দেয়া। কিন্তু ওর তো ভালো লাগলো না। ইহানকে ফিরিয়ে দিয়ে কতটুকু ভালো হলো তোমার সে তুমিই ভালো বুঝবে। আমি শুধু তোমার খারাপ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি যদি তা না বোঝো তবে আমি কি করতে পারি? ইহান বিরবির করে নিজের অনুযোগ প্রকাশ করে অদৃশ্য কারো কাছে।
*******
আজ ভার্সিটিতে এসেই রিজভীকে খুঁজলো রায়া।
টিয়াকে টাকার কথা তো বলে দিয়েছে কিন্তু কিভাবে জোগাড় করবে এতোটাকা? কালকের পাওয়া অর্ধেক পেমেন্টর টাকা মার হাতে দিয়েছে বাজার করতে। এখন হাত একেবারেই ফাঁকা।
এদিকে সামনে জোয়ার ডেলিভারি ডেটও এগিয়ে আসছে। সেখানেও একটা বড় খরচ করতে হবে। কি করবে রায়া ভেবে পায় না। জোয়ার বরের টাকাপয়সা আছে। ইচ্ছে করলেই জোয়া শশুরবাড়িতে থেকে ডেলিভারিটা করাতে পারতো কিন্তু করাবে না। তাতে নাকি তার মানসম্মান থাকবে না। বড়বোনের কথা শুনলে রায়ার হাসি পায়। যে মেয়ের বাবা বুড়ো বয়সে এসে নিজের বউ মেয়েদের ফেলে পরস্ত্রী বিয়ে করতে পারে, যার মা বোনরা নিজেদের দৈনন্দিন খরচ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে তার আবার মানসম্মান? একসময় রায়া ভেবেছিলো বড়বোন আর দুলাভাই তাদের বিপদের দিনে বটগাছ হবে। কিন্তু রায়া ভুল ছিলো বরাবরের মতো। তার বোনটা ঠিক বাবার মতো স্বার্থপর হয়েছে। আর দুলাভাই কেমন লোক তা আদৌও বোঝে না রায়া। লোকটা ওদের কোনো ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। ওরা কেমন আছে সে খোঁজও করে না। মাঝে মাঝে বাসায় এসে জোয়াকে দেখে যায়, ওর পচ্ছন্দের খাবার নিয়ে। তখন দু চারটা ভালো মন্দ কথা জিজ্ঞেস করে এই যা।
“খোঁজ করছিলি আমার?”
রিজভী নিঃশব্দে এসে রায়ার পাশে দাঁড়ায়। কলা ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলো রায়া আর আনমনা হয়ে দূরে তাকিয়ে আছে। ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে হাজারো মানুষ আর গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। রায়া
রিজভীর কন্ঠ শুনে ওর দিকে ফিরলো-
“বিপদে তোকেই মনে পড়ে, কি করবো বল?”
শুকনো ঠোঁটে জোর করে হাসলো।
“তোকে এমন লাগছে কেন?”
“রাতে জ্বর এসেছিলো তাই হয়তো।”
রিজভী গতদিনের কথা জিজ্ঞেস করতে যেয়েও করলো না। কি দরকার মেয়েটাকে বিব্রত করে। যদি নিজে থেকে বলে তো বলবে। গ্রামের ছেলে রিজভী রায়ার সাথেই পড়ে। নিজের খরচ চালানোর পাশাপাশি বাড়িতেও খরচ পাঠাতে হয় ওর। আঁকার হাতও দারুণ। নিজের প্রয়োজনের তাগিদে এই শহর চষে বেড়ানো রিজভী নিজের কমিউনিকেশন স্কিলে নিজেই চমকিত। সহজেই সকলের সাথে মিশে যাওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা রিজভীর এই কঠিন শহরে বেঁচে থাকার রসদ। মনে মনে রায়াকে পচ্ছন্দ করে রিজভী। মেয়েটার প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ আছে রিজভীর মনে। একবার খুব বড় বিপদ থেকে বাচিয়েছিলো রায়া তাকে নিজের জীবন তুচ্ছ করে। সেসব মনে করেই রিজভীর মনটা ব্যাথাতুর হয়। ও সবসময় চেষ্টা করে যে কোন ভাবে রায়াকে সাহায্য করতে।
ওর যদি কখনো সুযোগ হয় তাহলে অবশ্যই এই মেয়েটার জন্য কিছু করবে রিজভী। রায়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ তারপর বলে-
“আচ্ছা, এখন বল কেন খোঁজ করছিলি?”
“বড় কোনো কাজের খোঁজ আছে তোর কাছে? একসাথে অনেক টাকা পাওয়া যাবে এমন কাজ। আমার খুব টাকার দরকার রে।”
রিজভী অবাক হলো। রায়া সচরাচরই এমন কথা বলে। তারমানে, এবার সত্যি হয়তো ইমার্জেন্সি।
“তোকে তো সব কাজ দিতে পারিনা আর তুইও করতে চাস না। আমি কি করবো বল?”
“এবার বলে দেখ করবো।”
“তাহলে ঐ চুলের বিজ্ঞাপনের মডেল হয়ে যা। ওরা এখনো ভালো মডেল খুঁজে পায়নি। বেশ ভালো এমাউন্ট পাবি। আর যদি তোর বিজ্ঞাপন হিট হয়ে যায় তাহলে তো কথাই নেই। তোর আর কাজ খুঁজতে হবে না কাজই তোকে খুঁজে নেবে।”
মিডিয়ায় কাজ করবে না বলে বারবার মানা করা রায়া এবার আর মানা করলো না। গত কয়েকদিন ধরে সে কেবল ভাবছে। এভাবে আর কতোদিন চলবে? এরকম ছোট খাটো কাজ করে আর হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা গতদিনের চড়টা ওর গালে নয় যেন ওর অন্তরে লেগেছে। চোখ বন্ধ করলেই চড়টা কানে বাজে। আহ! সময়টা দ্রুত কেটে যায় না কেন? স্মৃতিগুলো ধুসর হয়ে যায় না কেন? রায়া হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো-
“তুই আমাকে জানা কবে কাজ থেকে হবে, আমি করবো। শুধু এই কাজ না এরকম আরো কাজ পেলেও করবো। তুই আমাকে ফোন করিস।”
রিজভী অবাক হয়ে রায়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ও এতোটাই অবাক হয়েছে যে চায়ে চুমুক দিতে ভুলে গেছে। মিডিয়ায় কাজ করবে না বলে পন করা মেয়েটার আজ কি হলো? রায়া কি কারো উপর রাগ করে এমন সিদ্ধান্ত নিলো? অবাক রিজভীকে পেছনে ফেলে রায়া কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হেঁটে চলে গেলো।
*******
বিজ্ঞাপনের মডেল হওয়ার কাজটা শেষ পর্যন্ত হতে হতেও হলো না। কি জন্য হলো না তা আর রিজভী বলতে পারলো না। এমনকি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর কাজ থেকেও ডাক পাচ্ছে না। ওর জন্য নাকি এখন কোনো কাজ নেই। গত তিনটে দিন হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছে রায়া। সেদিনের পাওয়া টাকাতো বাজার করেই শেষ। বাজার ও প্রায় শেষ। টিউশনির থেকে আগেই এ্যাডভান্স পেমেন্ট নিয়েছে। আজ যদি কোনো কাজ না পায় তাহলে দারুণ প্রবলেমে পরে যাবে। এদিকে টিয়ার স্কুলের ফিস দেওয়ার ডেডলাইন মাথার উপর ঝুলছে। উফফ, চিন্তায় চিন্তায় রায়ার মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রিজভীকে ফোন দিচ্ছে সেই সকাল থেকে কিন্তু রিজভীর কোনো খবর নাই। রিজভীকে আবার ফোন দিলো, রায়া মনেপ্রাণে চাইছে যেন রিজভী ফোনটা তোলে।
“হ্যালো।”
রায়া যেন দেহে প্রান ফিরে পেলো।
“রিজভী, কই ছিলি সারাদিন? এতবার ফোন দিলাম ধরলি না যে?”
“সরি রে আজ একটু বিজি ছিলাম সারাদিন এজন্যই ফোনটা ধরতে পারিনি। বল কি বলবি?”
রিজভীর নিরুত্তাপ কন্ঠস্বর শোনা গেলো।
“দোস্ত, একটা কাজও পাচ্ছি না। অথচ তুই বললি মডেলিং এর কাজটা নাকি আমি পাবো? আজ তিনদিন হলো কোনো কাজেরই খবর নাই। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর ওরাও তো ডাকছে না। আমি দোলার কাছে খোঁজ নিলাম, ওদের তো গত দু’দিনই কাজ ছিলো। আমাকে যেতে মানা করেছে। কেন করেছে কিছুই জানি না। তুই কি জানিস কিছু?”
রিজভী চুপ করে রইলো কিছু সময়। রায়া অস্থির হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো-
“কি হইলো দোস্ত, চুপ কেন? আমাকে বলতো কি সমস্যা?”
“দেখ নেগেটিভলি নিস না ব্যাপারটা। তোরে নাকি কাজে নিতে মানা করা হইছে। মার্কেটে তোর দূর্নাম ছড়ানো হইছে। তুই নাকি যথেষ্ট প্রফেশনাল না। মন উড়ু উড়ু থাকে তোর। আর তাছাড়া তুই নাকি অফার পেলেও কাজ করিস না। এই জন্য কেউ তোকে ডাকতেছে না। আমি অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু কিছু করতে পারলাম না। সরি রে!”
“কি বলিস, আমি আবার কার কাজ করলাম না?
মিডিয়ায় তো আমি কাজই করিনাই। তাহলে কে এমন কথা ছড়াবে?”
“জানি না। আমার যে সব জায়গায় পরিচিত আছে তোর কথা বললাম কিন্তু কেউ রাজি হয় না। আর যেসব কাজ পাওয়া যাচ্ছে তা করে তোর কোনো লাভ হবে না। খুবই অল্প টাকা, এর চাইতে দিনমজুরও বেশি পায়।”
রায়া একবার বলতে চাইলো, যেটাই হোক না কেন আমাকে দে। কিন্তু কোথায় যেন বাঁধো বাঁধো ঠেকলো।
“ঠিক আছে ভালো থাক” বলে ফোন কেটে দিলো।
কালকে কিভাবে চলবে সেই ভাবনায় রায়ার মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আজকের দিনটা কোনোরকমে পার হয়েছে। মাকে বলে রেখেছে কাল আবার বাজার করবে। রায়া মন খারাপ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। ভাবছে, কে ওর কাজের দুর্নাম করবে? ওকে চেনেই বা কয়জন? হঠাৎ ফোনটা বাজতেই ভাবনার জাল ছিন্ন হলো। একটা আননোন নাম্বার।
“হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। “
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। ম্যাডাম, আপনি চাইলে কিন্তু এখনো তেলের বিজ্ঞাপনের মডেল হতে পারেন। শুধু শুধু একটা সুযোগ মিস করবেন কেন?”
অপরিচিত কন্ঠ বলে উঠলো।
“আপনি কে বলছেন?”
“আমার পরিচয় দিয়ে আপনার কি কাজ ম্যাডাম? আপনার তো কাজ পেলেই হলো। আমি জানি কাজটা আপনার জন্য কতটা জরুরি।”
“তাই, তাহলে দিচ্ছেন না কেন? আমি তো করতেই চাইছিলাম। তা কাজ পাওয়ার জন্য আমাকে কি করতে হবে শুনি?”
কন্ঠে ব্যঙ্গের সুর ফুটিয়ে রায়া বলে।
“ইহান স্যারের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান ম্যাডাম। আপনার কাজের অভাব হবে না।”
কথাগুলো যেন রায়ার সর্বাঙ্গে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। ওহ, তবে এসব কান্ড কীর্তি ওই বদ লোকটার! তাইতো ভাবছে, কে এসবের পেছনে। রায়ার ইচ্ছে হলো, কাছে যেয়ে লোকটার গালে সপাটে চড় মারতে।
“আচ্ছা! তা আপনার স্যারকে বলুন না একজন নায়িকা ফায়িকাকে বিয়ে করে নিতে? আমার মতো চুনোপুঁটির সাথে তার কি মিলবে? আমি তার দয়া চাইনা, মিস্টার সাবের।”
রায়ার মুখে নিজের নাম শুনে চমকে গেলো সাবের। তাকে চিনে ফেললো? এইজন্যই বুঝি স্যার একে নিজের কাজে চাইছে। বুদ্ধি আছে মেয়েটার। দাদীমা যে চালাক, তাকে সামলাতে একেই দরকার। সাবের নিজেকে সামলে নিয়ে বললো-
“ম্যাডাম, এসব ছোট খাটো ব্যাপারে স্যার কখনো ডিল করে না। নেহাত স্যার প্রবলেমে পড়ে আমাকে জানালো। দাদীমার ব্যাপার না হলে কখনোই এসব করতাম না ম্যাডাম। আমি অনুরোধ করছি রাজি হয়ে যান। আর হ্যা, আপনি ভাববেন না যে এসব স্যার করিয়েছে। উনি এসব কিছুই জানে না। প্লিজ ম্যাডাম, একটু কনসিডার করুন।”
রায়া ফোন কেটে দিলো। মেজাজ তার এতোই খারাপ যে হাত পা কাঁপছে রীতিমতো। দু’মিনিটের ভেতর তার ফোনে ম্যাসেজ এলো-
“কেন জেদ করছেন। আপাতত আপনি কোনো ভদ্র গোছের কাজ পাবেন না যত চেষ্টাই করুন না কেন। তাই বলছি সময় নষ্ট না করে স্যারের প্রস্তাব মেনে নিন। কয়েকটা দিনেরই তো ব্যাপার।”
“আপু, এই আপুনি, ও আপু, কি এতো ভাবছো বলোতো? কখন থেকে ডাকছি তোমায়। আজ কাজে যাবে না?”
রায়া চমকে উঠলো টিয়ার ঝাঁকুনিতে। মাথা নেড়ে জানালো আজ কাজে যাবে না। টিয়ার মুখটা একটু চুপসে গেলো সে কথা শুনে। সে শুকনো মুখে রায়াকে জিজ্ঞেস করলো-
“তুমি কি টাকা এরেন্জ করতে পেরেছো? কাল টাকা না জমা দিলে আবার জরিমানা দিতে হবে।”
রায়া দু’মিনিট বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। আহারে, কতো অসহায় লাগছে ছোট্ট মুখটা। রায়ার বুকটা মায়ায় আদ্রতায় কেঁপে উঠলো। কিছু একটা ভেবে নিয়ে বললো-
“ভাবিস না, কাল এ্যারেন্জ করে ফেলবো টাকা। যা পড়তে বয়।”
টিয়া খুশি মনে চলে বেনী দুলাতে দুলাতে চলে গেলো। রায়া সাবেরের নাম্বার ডায়াল করলো। কিছু শর্ত ওর তরফ থেকেও দেয়া হোক নায়ক সাহেবকে!
চলবে—–
সাতদিন পর ইহান যখন বাংলাদেশে ফিরলো তখন ঢাকার রাস্তার বিলবোর্ডগুলো সব জুড়ে আছে রায়ার ছবিতে। রায়ার দীঘল কালো চুলের বিজ্ঞাপন ভাসছে সব বিলবোর্ডে। ইহানের নজরে পড়তেই সে অবাক হয়ে তাকালো সাবেরের মুখের দিকে।
“মিস রায়া মনেহচ্ছে সাবের?”
“জ্বী স্যার।”
“মেয়েটাকে দেখে তো মনে হয়নি যে সে মিডিয়ায় কাজ করতে চায়।”
“মানুষকে একবার দেখে কি চেনা যায় স্যার?”
“ঠিকই বলেছো। তবুও ওকে আমার অন্যরকম মনে হয়েছিলো। কিন্তু দেখো…”
ইহান মনে মনে দুঃখী হলো। একজন পুরুষের বাহুতে মুখ লুকিয়ে রায়া লাজুক হাসি দিচ্ছে। এ্যাডটা দেখেই ইহানের বুকের ভেতরটা কেমন জ্বলে গেলো। এই মেয়েটাকে নিয়ে কেন সে এমন জেলাসিতে ভুগছে? জীবনে প্রথম এমন অনুভূতি ইহানের। মেয়েরা ওর কাছে মুল্যহীন, স্বার্থপর শ্রেনীর প্রানী। মানুষ শুনলে হয়তো হাসবে, যে নায়ক ইহানের রায়া নামক এক ননগ্ল্যামারাস মেয়েকে ভালোলাগে। বিলবোর্ড থেকে যেন ইহানের চোখ সরে না। রায়ার দীঘল কালো চুলযুক্ত হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ইহান অপলক। ওর কেন যেন ওই পুরুষটাকে হিংসে হচ্ছে যার কাঁধে রায়া মাথা রেখেছে।
*****
মনের ভেতর মিশ্র অনুভূতি দলা পাকিয়ে থাকলেও দাদিমাকে সোফায় বসা দেখে তা আনন্দে রুপ নিলো। তারমানে কি দাদিমা সুস্থ হয়ে গেছে? একরাশ বিস্ময় আর ভালোলাগা নিয়ে ইহান দৌড়ে এসে তার দাদিমাকে জড়িয়ে ধরলো।
“ওহহ দাদিজান, আপনি সুস্থ হয়ে গেছেন দেখছি? আমি তো ভাবতেই পারছি না দেশে ফিরে এসে এতো বড় সারপ্রাইজ পাবো? আমি যাওয়ার পর আপনি সুস্থ হবেন জানলে অনেক আগেই চলে যেতাম দাদিমা?”
একদমে কথাগুলো বলে ইহান।
“তুমি আমারে যে ওষুধ দিয়া গেছো সুস্থ না হইয়া পারি? তারউপর আইজকা তুমি আইলা এই খুশিতে এক্কেবারে ফিট হইয়া গেছি গো ভাই। তোমারে দেইখা একটু বেশি সুখ লাগতেছে শরীরে। কাম অইছে তো ঠিক মতোন?”
“খুব হয়েছে দাদিজান। মনটা খারাপ ছিলো কিন্তু আপনাকে দেখে তো শরীর মন সব ভালো হয়ে গেলো! এই চমৎকার কি করে হলো দাদিমা? “
পাশে বসে দাদিকে জড়িয়ে ধরলো ইহান। জামিলা নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়-
“আমি তো সেইদিনই সুস্থ হইয়া গেছি ভাই যেইদিন তোমার বউ দেখা করতে আইলো আমার লগে। খুব লক্ষী মাইয়া। কি সুন্দর কইরা কথা কয়! আমাকে যখন দাদীজান ডাকে মনটা ভইরা যায় একেবারে। প্রত্যেকদিন আমার খবর নিছে ফোন কইরা।”
চোখ চকচক করে উঠলো ইহানের, সেই সাথে বিস্ময়। যাক, মিস রায়া তাহলে কথা রেখেছে? মনটা প্রশান্ত হলো ইহানের। জামেলা দাঁত বের করে হাসলো-
“ছবি দেখছো?”
“কিসের ছবি দাদীজান?”
“বউয়ের? ওর আজকা তেলের বিজ্ঞাপন আইছে? দেখোনাই? আমি তো সারাদিন টিভির সামনে বইসা ছিলাম।”
“বিলবোর্ড দেখলাম।”
ইহান মনে মনে সংকুচিত হলো। দাদীজানকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। দাদীজান তো সবসময় বলতো সিনেমা নাটক করা মেয়ে ভালো না। তাহলে রায়াকে কিভাবে পচ্ছন্দ করলো এতো? আর রায়াই বা কি বলে দাদীকে ম্যানেজ করলো? রায়ার প্রসঙ্গ আসলেই মনে কেমন একটা জ্বলুনি আসছে। তাই কথা ঘুরিয়ে নিতে চায় ইহান-
“কি রান্না করেছেন দাদিমা? গন্ধ শুনে আমার তো এখনই জিভে জল চলে আসলো।”
“তোমার পচ্ছন্দের লাল মরিচের ভর্তা, বেগুন ভাজি, করকরা ইলিশ মাছ ভাজি আর গরুর মাংস কষা।”
“উফফ দাদিজান, আপনাকে এইজন্যই এতো ভালোবাসি। খুব মিস করছিলাম আপনার হাতের খাবার। সেই কবে খেয়েছিলাম?”
বলেই চট করে দাদির গালে চুমু দিলো ইহান। পরক্ষনেই কিছু মনে হতে বললো-
“কিন্তু ইনা কোথায় দাদিমা? ওকে দেখছিনা যে?”
“আছে নিজের রুমে। তুমি আগে গোসল কইরা আসো ওরে ডাকতাছি।”
ইহান ঘাড় নেড়ে শিস বাজাতে বাজাতে চলে গেলো। জামিলা পেছন থেকে ইহানকে দেখে হাসলো। ছেলেটার মধ্যে এখনো কিছু বাচ্চামো রয়ে গেছে। এতো কিছুর পরেও কি ভীষণ নিস্পাপ তার নাতি। জামিলা মনে মনে খুব করে দোয়া করলেন নাতির জন্য।
দোতলা থেকে নামতে নামতে খাবারের সুবাসে পাগল হয়ে যাচ্ছিলো ইহান। খিদেটা যেন আরো জেগে উঠলো। দাদির হাতের রান্নার কোনো তুলনা হয়না। ইহানকে দেখেই নিজ হাতে একটা প্লেট রেডি করলো জামিলা। পাশেই রান্নার কুক মলি দাঁড়িয়ে আছে। সে এগিয়ে আসতেই জামিলা হাতের ইশারায় ওকে থামিয়ে দিলো। বরং তাকে ডাইনিং এর সাথে লাগোয়া টিভিটা চালাতে বললো। ইহান কোনোদিকে না তাকিয়ে টেবিলে বসেই খাওয়া শুরু করলো। টিভিতে তখন রায়ার তেলের বিজ্ঞাপনটি চলছিলো। ইনা আর জামিলা একে অপরের দিকে চোখাচোখি করলো। ইহান কিছু বলছে না বলে নিজেরাও খাওয়া শুরু করলো।
“কিরে, কি খবর তোর? এই কদিন বাইরে বেরোসনি নাকি?”
ইহান ইনাকে প্রশ্ন করে।
“উহু। তোমার কি খবর বলো? এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে যে?”
“কাজ শেষ তাই চলে এলাম। আপাতত বাকী কাজ দেশেই হবে।”
“হুমমমম।”
ইনা জামিলাকে ইশারা করলো কিছু বলতে। ইহান মাথা নিচু করে খাচ্ছে বলে সে ইশারা দেখতে পেলো না। হঠাৎই জামিলা কথা বলে-
“নাতবৌ এর চুল মাশাল্লাহ। কি দাদাভাই, ঠিক বলছি না?”
দাদিজানের কথাতেই ইহান টিভির দিকে তাকালো। সেখানে রায়াকে দেখেই ও যেন জমে গেলো। টিভির পর্দায় মেয়েটাকে যেন আরো সুন্দর লাগছে। ইহান পুরো বিজ্ঞাপনটা দেখলো হা করে। তারপর জ্ঞান হলো যে ও ডাইনিং এ বসে খাচ্ছিলো। টিভি থেকে চোখ সরিয়ে খাবার খেতে শুরু করলো আবার। আড়চোখে বোঝার চেষ্টা করলো দাদিমা আবার কিছু টের পায়নি তো?
“কি গো দাদাভাই, কিছু বলছো না যে?”
ইহান নিজেকে লুকাতেই যেন আরো বেশি করে খাওয়াতে মন দিলো-
“আমি কি বলবো দাদিজান? আপনার যেটা মনে হয় সেটাই।”
“আমার কিন্তু মাইয়াটারে ভালো লাগতেছে খুব। কয়দিন ধইরা দেখতেছি। কি বলস ইনা?”
“হ্যা, দাদি। দেখতে যেমন মিষ্টি কথাও তেমন মধুর। “
“আমারও তাই মনে হইছে। আমি তো ভাবলাম বুড়ি মানুষ আমি, কাকে দেখতে কাকে দেখছি? তা দাদাভাই, এভাবে আর কতোদিন বলোতো? আমার তো বয়স হইছে মেলা তার উপর অসুস্থ থাকি প্রায় সময়। এইবার তাইলে বিয়েটা করো। মরার আগে তোমার বউকে একটু জ্বালাই। “
“ওহহহ দাদিমা! কতোদিন তোমাকে বলেছি এসব মরা টরার কথা বলবে না আমাকে। কিন্তু তুমিতো শুনবে না কিছুতেই। “
ইহান কোনোরকমে পাতের ভাত শেষ করে উঠে পরে।
“কোথায় যাচ্ছো? বসো… বসো এখানে?”
দাদির কন্ঠে সুদ্ধ ভাষা আর কঠোরতা টের পেয়ে ইহান বসে যায়। মনে মনে একটু ভয় পায় ইহান। দাদিমা শেষ কবে এমন করে কথা বলেছিলেন মনে করতে পারলো না ইহান।
“তোমাকে সেই কবে থেকে বিয়ের কথা বলছি তুমি কানেই তুলছো না। এবার আমি তোমার কোনো কথা শুনবো না। আমি নিজেই নাতবৌ এর সাথে কথা বলবো।”
দাদি গম্ভীর মুখে কথাগুলো বললো। ইহান মনে মনে শংকিত হলো দাদীর কথায়। মিস রায়া এসব শুনলে ওকে কি ভাববে? মিস রায়াকে কেবল একটু অভিনয় করতে বলেছিলো, এখন দাদী যদি এমন করে তবে তো বিশাল সমস্যা হয়ে যাবে। কিভাবে বোঝাবে দাদীকে? ইহান এবার উল্টো পথ ধরলো-
“এরকম কিন্তু কথা ছিলো না দাদীজান! আপনি বলেছিলেন শুধু দেখা করিয়ে দিতে আর এখন বিয়ে পর্যন্ত চলে গেলেন। ও এইজন্যই তো দেখা করতে রাজি ছিলো না। ওর কেবল ক্যারিয়ার শুরু হলো। আমি এখন কোন মুখে ওকে এসব বলবো? না, দাদীজান, আমি পারবো না। আমায় মাফ করুন প্লিজ!”
“বউয়ের চিন্তা তোমার করুন লাগবে না। তার সাথে আমি কথা বলবো দরকার হইলে। তার আগে কও তুমি রাজি কিনা?”
“আমাকে কিছুদিন সময় দিন দাদিমা। হাতে এতো কাজ আর মিডিয়া যদি কোনোভাবে আমার বিয়ের কথা টের পায় তবে অনেক ক্ষতি হবে। কত মানুষ কত টাকা লগ্নি করবে, আমি কিভাবে তাদের টাকা লসে ফেলবো দাদিমা? আমার সাথে কত মানুষের ইনকাম জড়িয়ে আছে। আর তাছাড়া আমার নিজের ইনকামও তো বন্ধ হয়ে যাবে?”
“আমি এতো কিছু বুঝি না ভাই। তুমি কি করতে চাও তা আমাকে জানাবে খুব দ্রুত।”
“জ্বী।”
ইহান চিন্তিত মুখে উঠে গেলো। ইহান দেখতে পেলো না, ও উঠে আসার পর পরই ইনা আর দাদিমা দুজনে হাত মিলিয়ে দাঁত বের করে হাসছে।
*******
রায়ার হাতে এখন প্রচুর কাজের অফার। শহরের প্রায় সব বিলবোর্ডে নিজেকে দেখে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয় রায়ার। মাত্র পনেরো দিনের ব্যবধানে ওর জীবন কোথা থেকে কোথায় চলে এসেছে তাই ভাবছিলো বসে বসে। এখন আর টিউশন করে না। এমনকি সব পার্টটাইম কাজও বাদ দিয়েছে রায়া। দু’দিন হলো আরো একটা বিজ্ঞাপনের কাজ শেষ করেছে। হাতে আছে আরো আট দশটা কাজের অফার। কোনটা রেখে কোনটা করবে ভেবে পাচ্ছে না। মনে মনে রিজভীকে হাজারো ধন্যবাদ দিলো রায়া। ছেলেটা সেদিন ওভাবে না বললে কখনো এই কাজটা করতো না রায়া। মজার বিষয় হলো এই বিজ্ঞাপনের জন্য রায়ায় বেশি কিছু করতে হয়নি। না বেশি সাজগোছ না মেকআপ। বাকীটুকু পরিচালক যেভাবে বলেছে সেভাবেই করেছে। পরে টিভিতে নিজেকে দেখে নিজেই চমকে গেছে। বারবার মনে হয়েছে এতো ভালো অভিনয় কি সে আদৌও করেছে? ভার্সিটিতে সহপাঠী বন্ধুরা আর শিক্ষকরা যখন ওর প্রসংশা করে তখন সত্যি লজ্জা পায় রায়া। বুঝে পায় না সত্যি সত্যি সে এতো প্রসংশা পাওয়ার যোগ্য কিনা?
রায়া বারান্দায় বসেই টিয়াকে স্কুল থেকে আসতে দেখলো। প্রায় ছুটে ছুটে আসছে টিয়া। মুখটা খুশিতে টগবগ করছে। রায়া মনের অজান্তেই ছোট বোনকে এতো খুশি হতে দেখে হাসলো। আজ কি বলবে কে জানে। রায়ার মডেলিং এ সবচেয়ে খুশি মনে হয় টিয়াই। টিভিতে বিজ্ঞাপন যাওয়ার পর থেকেই প্রতিদিন স্কুল থেকে বাসায় এসে কিছু না কিছু বলবেই রায়াকে। রায়ার কাজের কে কতটা প্রসংশা করলো সেসব গল্পই বেশি। এই গল্প করতে যেয়ে টিয়া যেন আহ্লাদে আটখানা হয়ে যায়। বারান্দায় বসেই টিয়ার হৈ-হল্লা টের পাচ্ছিলো রায়া।
“ছোটপা, আজ কি হয়েছে জানো?”
“কি হয়েছে?”
রায়া টিয়াকে কাছে টেনে নেয়।
“আজ প্রিন্সিপাল ম্যাডাম নিজে ক্লাসে এসে আমাকে তোমার কথা বললেন। আমার না অনেক ভালো লেগেছে আপু।”
“তাই? শুধু আমার কথা বলতে তোর ক্লাসে এসেছিলো?”
“উহু। একটা বই পড়া প্রতিযোগীতা হয়েছিলো সেটাতে আমি ফাস্ট হয়েছি তাই বলতে। তখনই তোমার কথাও বললেন।”
” ওরেএএ, কনগ্রাচুলেশনস। এভাবেই এগিয়ে যা সবদিক দিয়ে। আমার লক্ষী বাচ্চাটা।”
বোনকে আদর করে দেয় রায়া। পেছনেই ওদের মা আর জোয়া দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিলো।
“এহহহ, কিসে না কিসে প্রথম হয়েছে তাতেই এতো আদর দিচ্ছিস? পড়ালেখায় ভালো করলে বুঝতাম।”
জোয়ার এমন কথা শুনে টিয়া মন খারাপ করলো আর রায়া বিরক্ত হলো। বড়পাটা একেবারে যাচ্ছে তাই। সব সময় তিরস্কার করাটাই শিখেছে।
“এভাবে বলছো কেন বড়পা? দেখবে ও পরীক্ষায় ও ভালো করবে। তাই না রে টিয়া পাখি?”
রায়া কথা শুনে টিয়া খিলখিল করে হেঁসে দিলো। ছোটপার টিয়াপাখি ডাকটা শুনলেই টিয়ার মন ভালো হয়ে যায়। দুই বোনের আদর সোহাগ দেখেই যেন জোয়ার পিত্তি জ্বলে গেলো। সে মুখ ঝামটা দিলো-
“হুহহ, ঢং দেখে আর বাঁচিনা। বেশি আদর দিয়ে মাথায় তুলো পরে মজা বুঝবে।”
বলেই রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। রাজিয়া রক্তচক্ষু নিয়ে বড় মেয়েকে দেখলো। কিছু বলতে যেয়েও নিজেকে সামলে নিলো শেষতক। এই অবিবেচক মেয়েকে কিছু বলে এখন আর নিজের মন নষ্ট করতে চাইলেন না। সে স্নেহময় দৃষ্টিতে দুই মেয়েকে দেখতে লাগলো। তখনই বেল বাজলো। রাজিয়া আর একবার মেয়েদের দেখে নিয়ে দরজা খুলতে গেলো।
রায়া প্রথমে এতোটাই অবাক হয়েছে যে সে অনেকক্ষণ মুখ খোলা রেখে বসেছিলো। পরে তার পাশে বসে থাকা রিজভী ওর কানে ফিসফিস করে কিছু বলতেই রায়ার হুশ হলো। সে ফট করে হা করা মুখটা বন্ধ করলো সেই সাথে লজ্জাও পেলো।
“ম্যাম, এটা আপনার জন্য অনেক বড় অপারচুনিটি। আমরা বিজ্ঞাপনটিতে এতোটাই সারা পেয়েছি যে আবার নতুন করে এটার সিকুয়েল করতে হচ্ছে। পাবলিক ডিমান্ড, বুঝলেন ম্যাডাম। তবে এবার সারপ্রাইজ আছে দর্শকদের জন্য। আমরা পুরুষ মডেল হিসেবে নায়ক রিজওয়ান খান কে নিচ্ছি। আশাকরি এবারও গতবারের মতো একটা দারুণ কাজ হবে।”
গরগর করে বলে গেলো রিজভীর সাথে আসা লোকটি। রায়ার নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। সে কি ঠিক শুনেছে? অতোবড় নায়ক কেন একটা বিজ্ঞাপন করবে? রায়া শিওর হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলো আবার-
“কার কথা বলছেন? নায়ক ইহান? এতো ছোটখাটো কাজ কি উনি করেন?”
“জ্বী ম্যাম। আমরা আগে ওনার সাথেই কথা বলেছি। স্ক্রিপ্ট শুনে কাজ করতে রাজি হয়েছেন। এখন আপনি হ্যা বললে কাজ শুরু করবো।”
রায়া কি বলবে ভেবে পেলো না। ইহান কেন শুধু শুধু ওর সাথে কাজ করতে রাজি হলো? কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে? তার প্রেমিকা সেজে দাদীর সাথে দেখা করেছে সেজন্য? নাকি অন্য কোনো কারন? কারণ যাই হোক রায়ার বেশ মজাই লাগলো। শুটিং এর সময় জ্বালানো যাবে লোকটাকে। লোকটার বড্ড নাকউঁচু, সবাইকে নিজের আজ্ঞাবহ মনে করে। একটু উল্টো পাল্টা করলেই দাদীর ভয় দেখানো যাবে। ভেবেই মনে মনে হাসি পেলো রায়ার।
“আমি রাজি আছি। কবে থেকে শুরু হবে কাজ?”
“আরো দিন পনেরো লাগবে ম্যাম। আর এবার কাজ কিন্তু ঢাকার বাইরে হবে ম্যাম। সি বিচে মানে কক্সবাজার শুটিং হতে পারে। সেইভাবে প্রিপারেশন নেবেন।”
“ঢাকার বাইরে?”
রায়া থমকে গেলো।
“কোনো সমস্যা ম্যাম? বেশি না মাত্র দু’দিন শুটিং হবে। আপনি চাইলে আপনার মাকে সাথে নিতে পারেন।”
“ঠিক আছে কোনো সমস্যা নেই। আপনারা বরং আমাকে দু’দিন আগে রিমাইন্ডার দেবেন। হাতের কাজগুলো গুছিয়ে নেবো।”
“জ্বী। থ্যাংক ইউ। আমরা আসি তাহলে।”
রায়া মাথা নেড়ে সায় দেয়। রিজভী ওদের সাথে বেড়িয়ে যাচ্ছিলো। রায়া ওর হাত টেনে ধরলো-
“তুই বয় একটু কথা আছে। “
রিজভী অবাক হয়ে হাতের দিকে তাকালো। এই প্রথম রায়া ওর হাত ধরলো, তাও একটু অধিকারের সাথে। রিজভী তাকানো দেখে রায়া হাত ছাড়িয়ে নিলো।
“বল, কি বলবি?”
“তুই যাবি আমার সাথে চিটাগং। একা একা আমার ভয় করবে।”
“আমার নিজের কাজ আছে না?”
রিজভী হাসলো একটু।
“ভয় পাচ্ছিস কেন? ওখানে জিনাত থাকবে, মেকআপ আর্টিস্ট। ওকে বলে দেবো তোর সাথে সাথে থাকার জন্য। ঠিক আছে? “
“থ্যাংকস রে। তুই অনেক করছিস আমার জন্য।”
“চড় খাবি?”
রিজভীর কথায় ঘাবড়ে যায় রায়া। তারপর হেঁসে বলে-
“দে। তোর মতো বন্ধুর হাতের চড়েও কোনো না কোনো উপকার পাবো।”
“আর কোনোদিন থ্যাংস বললে ঠিকই কষে চড় লাগাবো। মুখে বন্ধু বলিস আবার থ্যাংকস ও বলিস, মানে কি? “
“ঠিক আছে আর বলবো না।”
“দ্যাটস লাইক আ গুড গার্ল। আজ আসি, আমার যেতে হবে।”
“থাক না, আমাদের সাথে একসাথে ডিনার কর?”
“অন্যদিন। আর শোন, পারলে বাসাটা চেন্জ কর। একেতো বাসাটা রাস্তা থেকে অনেক ভেতরে তার উপর ছয়তলা। এখন তো অনেকেই আসবে তোর কাছে তাই বলছিলাম আর কি?”
“হুম করবো। আরো কিছুদিন যাক। অবস্থা এখনো এতোটা ভালো হয়নিরে।”
“তোর যা ঠিক মনেহয়।”
রিজভী বেড়িয়ে যেতেই টিয়া দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো রায়াকে। রায়া যানে টিয়া এতোক্ষণ পর্দার আড়ালে দাড়িয়ে সব কথা শুনছিলো।
“আপুওওও আপু, কি সৌভাগ্য তোমার। নায়ক রিজওয়ান খান এর সাথে কাজ করবে তুমি?”
“কেন রে সে কি মানুষ না নাকি?”
“কি বলছো আপু? তুমি বুঝতে পারছো না কি বিশাল ব্যাপার হচ্ছে তোমার সাথে। সবাই ওনাকে কি ভীষণ পচ্ছন্দ করে জানো? প্লিজ আপু, আমাকে নিয়ে যাও তোমার সাথে। ওনাকে সরাসরি দেখবো।”
“পাগল! মন দিয়ে পড়ালেখা কর। ওসব নায়ক টায়কের কথা মন থেকে ঝেড়ে ফেল। পরে অনেক সুযোগ আসবে সরাসরি নায়ক নায়িকা কে দেখার, বুঝলি?”
রায়া টিয়ার মাথায় টোকা দিয়ে উঠে গেলো। মনের মধ্যে ঝড় বইছে তারও। ইহানের সাথে কাজ করতে হবে ওর। ও পারবে তো? কেন পারবে না? পারতেই হবে ওকে। ইহানকে কোনো সুযোগ দেওয়া যাবে না ওকে কথা শোনানোর। বরং ভালো কাজ করে ইহানকে সেই সাথে আরো দু’টো মানুষকে বুঝিয়ে দিতে হবে, জবাব দিতে হবে যে, ওরও যোগ্যতা আছে কাজ করার। কারো সাহায্য ছাড়াই রায়া তার জীবন চালাতে পারবে এটা খুব ভালো মতো দেখিয়ে দিতে হবে ওদের…
চলবে—–
ভোরের দিকে কক্সবাজার পৌঁছেছে রায়া। মনের ভেতর একটা ভয় কাজ করছিলো একা আসতে। কিন্তু গাড়িতে উঠে টিভি নাটকের জনপ্রিয় অভিনেত্রী সাইদা ইকবাল, যিনি খুব দাপটের সাথে মা খালা নানি দাদির চরিত্রে অভিনয় করেন তাকে দেখে রায়ার ভয় অনেকটাই কমে গেলো। তবুও একটা জড়তা ছিলো, এতো নামীদামী অভিনেত্রী আর ও রীতিমতো নবীন শিল্পী। ওনার যে দু’একটা নাটক রায়া দেখেছে তাতে ওনাকে ভীষণ রাগী মানুষই মনে হয়েছে। তাই খুব জড়সড় হয়ে সাইদা ইকবালের পাশে বসেছিলো রায়া। কিন্তু মহিলা কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর সাথে যেভাবে আলাপ জুড়ে দিলেন তাতে রায়ার মনের ভয়ডর তো পালালোই সেই সাথে মনটাও ফুরফুরে হয়ে গেলো। যাক, কাউকে তো পাওয়া গেলো যার সাথে গল্প করে সময় কাটানো যাবে? রায়ার মনে স্বস্থি ফিরে এলো। আউটডোর শুটিং নিয়ে ভয় ছিলো মনে সেটাও অনেকাংশে দূর হয়ে গেলো। প্রায় পুরোটা সময় দুজনে গল্প করতে করতে কখন কক্সবাজার পৌঁছে গেলো কেউই টের পেলো না। গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে সাইদা ইকবালের পায়ে টান পড়লো। বয়স হওয়ার দরুন তার হাঁটু ফুলে যায়, হাঁটতে সমস্যা হয়। রায়া বুঝতে পেরেই নিজে থেকে জোর করে ধরলো সাইদা ইকবালকে। ধীরে ধীরে হাত ধরে নামিয়ে আনলো গাড়ি থেকে। সাইদা ইকবাল গাড়ি থেকে নেমেই রায়াকে বললো-
“বুঝলে রায়া, এদের হচ্ছে শয়তানি। ইচ্ছে করেই আমাদের গাড়িতে পাঠালো। দেখবে নায়ক কিন্তু ঠিকই আসবে আকাশে উড়ে উড়ে। আমরাও কিন্তু আসতে পারতাম এয়ারে। কিন্তু এই সুবিধা আমাদের দেবে না। কেন বলো তো?”
“জানি না, ম্যাম। আমি নতুন মানুষ কিভাবে বলবো?”
“তুমি নতুন আর আমি দাদি আম্মা তাই। আমাদের ভ্যালু কম বুঝলে? দেশটা মেয়েমানুষ চালালেও পুরুষগুলো সুযোগ পেলেই এই রাগ আমাদের মতো সাধারণ মেয়েদের উপর এভাবেই উসুল করে।”
রায়া হেঁসে দিলো। সাইদা ইকবাল রায়ার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে থমকে গেলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো রায়ার দিকে-
“মেয়ে, তোমার খুব মজা লাগছে তাই না? এই জগৎ বড়ই খারাপ বুঝলে? শুরুতে সবাই তোমার মতো এরকম স্বপ্নময় হাসি হাসে তারপর আস্তে আস্তে হাসি ফিকে হতে শুরু করে। তবে যাইহোক, এ কথা মানতে হবে যে, তোমার হাসিটা বেশ মিষ্টি।”
আচমকা এরকম প্রশংসায় রায়া লজ্জা পেলো। সে মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলো। সাইদা ইকবাল রায়াকে দেখে নিয়ে বললেন-
“যাবে নাকি হাঁটতে সমুদ্র পাড়ে?”
“আপনার না পায়ে ব্যাথা? এখান থেকে কিন্তু বেশ দূর হবে? এতোদূর হাঁটতে পারবেন এখন?”
সাইদার প্রস্তাবে কিছুটা অবাক রায়া। মহিলার সাহস আছে বটে। কিছুক্ষণ আগেই পায়ের ব্যাথায় কাতর ছিলো আর এখনই হাঁটতে যেতে চাইছে।
“ব্যাথা তো আছেই। তবে এখানে আসলে আমি হাঁটার সুযোগটা মিস করি না। এতো ফ্রেশ আবহাওয়া ঢাকায় কোথায় পাবো বলোতো? তুমি আগে এসেছো?”
“হুম, বহুবার এসেছি। আর তাছাড়া সমুদ্র আমাকে অতটা টানে না। আমার তো পাহাড় ভালো লাগে, পানিতে ভয় লাগে। “
“কি বলো? সাতার জানো না বুঝি?”
রায়া না সুচক মাথা নাড়ে।
“এইজন্যই তো পানিতে এতো ভয়। চলো, আজ তবে হোটেলেই ফেরত যাই। একটু ঘুমাতেও হবে তা না হলে কাজ করবে পারবো না।”
“জ্বী, চলুন।”
হোটেল পৌঁছে সাইদা ইকবালকে তার রুমে দিয়ে এসে রায়া লম্বা একটা সাওয়ার নিলো। সারারাত না ঘুমানোর কারণে ঘুমে চোখ দুটো জড়িয়ে আসছো। বিছানার আরামদায়ক গদি যেন রায়াকে ডাকছে। শুটিং শুরু হওয়ার কথা বারোটা থেকে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে সাতটা বাজে। তিনঘণ্টা আরামে ঘুমানো যাবে ভেবেই রায়া বিছানায় গেলো। শোয়া মাত্রই নরম বিছানায় দেবে গেলো শরীর, চোখে নেমে এলো গভীর ঘুম।
দুমদাম আওয়াজে কানে তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম। রায়া উপুড় হয়ে শুয়ে কানের উপর বালিশ টানলো। ইশশশ, কি আরামের ঘুমটাই না ঘুমাচ্ছিলো। কে যে আওয়াজ করছে এতো জোরে জোরে? কানে বালিশ নিয়েও হলো না, আওয়াজ যেন বেড়েই চলেছে। কিন্তু আওয়াজটা হচ্ছে কোথায়? রায়া বিরক্ত মুখে উঠে বসতেই টের পেলো ওরই রুমের দরজায় আওয়াজ হচ্ছে আর কেউ তার নাম ধরে ডেকে চলেছে অনবরত। রায়া এতোক্ষণে যেন সম্বিত ফিরে পেলো। দৌড়ে যেয়ে গেট খুললো। সামনে অনেকগুলো চিন্তিত মুখ দাঁড়িয়ে আছে। এতো মানুষ দেখে রায়া ঘাবড়ে গেলো। কাউকেই তেমন চেনে না, শুধুমাত্র সাইদা ইকবাল ছাড়া। রায়া বোকার মতো প্রশ্ন করলো-
“কি হয়েছে?”
একটু গম্ভীর ধরনের গোঁফওয়ালা একজন ছেলে এগিয়ে এলো-
“মিস রায়া?”
“জ্বী!”
অবাক হলো রায়া, লোকটা দেখি ওকে চেনে!
“এখন কয়টা বাজে? আর কক্সবাজার আপনি কি কাজে এসেছেন?”
রায়া আশেপাশে তাকিয়ে ঘড়ি খুঁজলো, রুমের ভেতরই আছে ঘড়ি, তবে সেটায় টাইম দেখে রায়ার ঘাম ছুটে গেলো। দুপুর একটা বেজে বিশ মিনিট। হায় আল্লাহ! তার তো বারোটা থেকে শুটিং শুরু হওয়ার কথা ছিলো? আর সে কিনা এই বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে আছে? ছেলেটা কঠিন মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রায়ার বুক কেঁপে উঠলো দুরুদুরু।
“সরি, আসলে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি টের পাইনি।”
“আমরা সবাই সেট রেডি করে বসে আছি এমনকি ঢাকা থেকে নায়ক রিজওয়ান খান এসে তৈরি হয়ে গেছে আর আপনারই কোনো খবর নেই? আপনি নতুন মানুষ হয়ে এতোটা ইরেসপনসিবল কিভাবে হলেন? জানেন, রিজওয়ানের সিডিউল পেতে কতোটা ঝামেলা করতে হয়? আপনার জন্য সকালের শিফটের কাজই বাতিল করতে হলো। প্রডাকশনের কতো লস হলো আইডিয়া আছে আপনার?”
ইহান চলে এসেছে আবার কাজের জন্য রেডিও হয়ে গেছে শুনেই রায়ার মাথা ঘুরে গেলো। প্রথম চান্সেই হেরে গেলো রায়া? ভাবতেই নিজের মাথার চুল নিজেরই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। রায়াকে গোঁফওয়ালা আরো কিছু বলতে চাইছিলো হয়তো কিন্তু সাইদা ইকবাল থামিয়ে দিলো-
“আহ, মিলন! হয়েছে তো আর বলতে হবে না। যা হওয়ার তাতো হয়েছেই। তোমরা বরং একটা লাঞ্চ ব্রেক দিয়ে দাও। মেয়েটা নতুন তার উপর সারারাত জার্নি করে এসেছে। আমরা খেয়ে দেয়ে দুটোর মধ্যে চলে আসবো স্পটে। তুমি যাও, আমি ওকে বুঝিয়ে বলছি। বাকী সবাইও যার যার কাজে চলে যাও।”
রায়া দেখলো গোঁফ মিলন কিছু না বলে ওর দিকে রাগী দৃষ্টি হেনে চলে গেলো। দরজার কাছের ভীর পাতলা হতেই সাইদা ইকবাল রুমে ঢুকলো।
“মেয়ে, তুমিতো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে আমাকে। এরমধ্যে দু’বার ডেকে গেছি তোমায় তবুও উঠলে না। এমন মরা ঘুম ঘুমালে চলবে?”
“সরি ম্যাম। আসলে নিজেও বুঝিনি কি থেকে কি হলো।”
সাইদা ইকবাল রায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো-
“শুরুতে এরকম একটু হয়েই যায়, কোনো ব্যাপার না। আমি বসছি তুমি বরং ঝটপট তৈরি হয়ে যাও। এবার ভুল হলে কিন্তু আমিও বাঁচাতে পারবো না তোমায়?”
রায়া মাথা ঝাকিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। মনের ভেতর শঙ্কা, ইহান আবার কোনো ইস্যু না বানায় এটা নিয়ে!
*******
নিখুঁত মেকাপে ফর্সা রায়া এখন শ্যামসুন্দরী। আয়নায় নিজেকে দেখে ভালোই লাগছে রায়ার। এ্যাডের থিমটাও সুন্দর। এ্যাডে রায়ার চরিত্রের নাম রাত্রি। বারবার বিয়ে ভেঙে যায় বলে মন খারাপ রাত্রির। শ্যামা গায়ের রং বলে দাদি নিজ হাতে তেল দিয়ে দেন নাতনির চুলে। দাদির কথা-
“দেখিস বুড়ি, কেউ তোর এই গভীর চোখ আর দীর্ঘ কালো চুলের প্রেমে পড়বে। এই দুটোই তোর সম্পত্তি নয় সম্পদ। বুঝলি?”
দাদির কথা মনে গেঁথে নিয়ে রাত্রিও খুব যত্ন করে তার চুলের। তখনই একদিন দাদির সাথে হাঁটতে বের হয় সমুদ্রের ধারে। পথে দাদি পড়ে যেয়ে পায়ে ব্যাথা পায়। দাদির জন্য চিন্তিত রাত্রির সাহায্যে এগিয়ে এলো নায়ক। ভাগ্যক্রমে রাত্রির দীঘল কালো চুল দেখে নায়ক ফিদা। শেষে নায়কের সাথে বিয়ে আর আয়নায় নায়িকার মুখ দেখে নায়কের কবিতা আবৃত্তি-
“তোমার কাজল কালো আখি আর কালো দীঘল কেশ
পাগল করলো আমায় তোমার প্রেমে পরলাম বেশ।”
শেষের লাইন দু’টো পড়ে ভীষণ হাসি পাচ্ছিলো রায়ার। কেমন বাচ্চা বাচ্চা টাইপ কবিতা । রায়া ভাবছিলো এই লাইন দু’টো বলতে যেয়ে ইহানের কেমন লাগবে? আর ওকে লাগবেই বা কেমন? রায়ার ডাক পড়লো। শুরুতেই নাকি ইহানের সাথে শুট। রায়ার বুক কাঁপছিলো, ও পারবে তো ঠিকঠাক?
ইহানকে দেখে বুকে একটা ধাক্কা মতো খেলো রায়া।
একটা ব্লু ডেনিম ফেব্রিক্স এর শার্ট এর সাথে অফ হোয়াইট প্যান্ট, চোখে সানগ্লাস, সিল্কি চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে, সেই সাথে হাতে ধরে থাকা ডিএসএলআর ক্যামেরা। এতোটাই হ্যান্ডসাম লাগছিল যে রায়াও সবভুলে তাকিয়ে ছিলো তিরিশ সেকেন্ড। ইহান কোনো কথাই বললো না রায়ার সাথে। পরিচালক মিলন মাজহার দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন দু’জনকে। ইহান বার দুয়েক ঘাড় হেলালো-
“মিলন, তুমি ওনাকে বুঝিয়ে দাও ভালোমতো। তা না হলে দেখা যাবে ডায়লগ ভুলে হা করে তাকিয়ে আছে বোকার মতো। আর বার কয়েক তাকে এক্সপ্রেশন গুলোও বুঝাও।”
অপমানে রায়ার গাল লাল হলো, কান দু’টো ঝা ঝা করছিলো। প্রতিবাদ করার জন্য মুখ খুলতে চাইলো কিন্তু কোনো শব্দ বেরুলো না মুখ দিয়ে। ইচ্ছে হলো ইহানের সিল্কি চুলগুলো টেনে ছিড়ে ফেলতে। ভেতরে ভেতরে রাগে ফুলছিলো রায়া।
“রিজু ভাই, এক কাজ করুন না। একবার একটু রিহার্সাল দিয়ে দিন দুজনে। না না, আপনার জন্য বলছি না। ম্যাডামের জন্য বলছি৷ তাহলে ফাইনাল ডেলিভারিটা ভালো হতো।”
মিলন মাঝে ফোড়ন কাটলো। রায়া এবার মুখ খুললো-
“লাগবে না মিলন ভাই। আপনি একেবারে ফাইনাল টেকই নিন। আমি তৈরি আছি আপনি আর একবার ব্রিফ করুন প্লিজ। আর তাছাড়া এর আগের এ্যাডটা তো আমিই করেছি, নাকি?”
চোখে সানগ্লাস থাকার কারনে বোঝা গেলো না ইহান আদৌও ওকে দেখছে কিনা? কিন্তু ওর ঠোঁটে একটা বাঁকা হাসি লেগে রইলো। রায়ার কথা শুনে মিলন একবার রায়া আর একবার ইহানের দিকে তাকালো। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে রায়াকে ব্রিফ করা শুরু করলো।
একশটে রায়া আর ইহানের অংশের দৃশ্য ধারন হলো। প্রথম দেখা হওয়া, চোখে চোখে কথা আর লম্বা চুল দেখে ইহানের হতবাক হওয়া। দু চারটে ডায়লগে দৃশ্য ধারন শেষ। সবাই হাততালি দিলো। দূরে বসে সাইদা ইকবাল দেখছিলো ওদের শুটিং। এর পরের অংশে উনিও আছেন। রায়া যেয়ে ওনার পাশে বসতেই উনি হাসলেন-
“দারুণ হয়েছে তোমার এক্সপ্রশন, রায়া। এভাবে ডেডিকেশন নিয়ে কাজ করলে অনেক দূর যাবে মেয়ে।”
“ধন্যবাদ, ম্যাম।”
“মেয়ে, আমাকে তুমি আন্টি ডাকতে পারো আমি কিছু মনে করবো না।”
সাইদা ইকবাল হাসলেন। রায়া মাঝে মাঝে সাইদা ইকবালের সাথে গল্প করছে হাসছে। ও খেয়াল করলো না ইহান দূর থেকে ওকে বিশ নজরে দেখছে।
আরো দু’টো দৃশ্যের শুটিং করে একটা ব্রেক দেওয়া হলো। নতুন ডেকোরেশন হবে সেটের। বিয়ে বাড়ির ডেকোরেশন। রায়া একা একা উঠে পরলো। একটু হেঁটে আসবে আশেপাশে। জায়গাটা বেশ সুন্দর। কক্সবাজার থেকে হিমছড়ি যাওয়ার মাঝে এই জায়গাটা পড়ে। রাস্তা ছেড়ে কিছুদূর গেলেই মোটামুটি বড় একটা মাঠের মতো সেখানেই শুটিং এর সেট লাগানো হয়েছে। আর ঠিক পিছনে পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে অসংখ্য বুনো ফুল ফুটে আছে। রায়ার ভালো লাগছে হাঁটতে। কিছু পুরনো স্মৃতি বারে বারে হানা দিচ্ছে মনে। বাবা থাকতে বার কয়েক এসেছে কক্সবাজার, ফ্যামিলি ট্যুর। কি আনন্দে কেটেছে সেই সব দিন। বাবা মাকে দেখে কখনো মনে হয়নি যে তাদের ভেতরে কোনো প্রবলেম ছিলো। বরং অন্য আর দশটা দম্পতির থেকে বাবা মাকে সুখী মনেহতো অনেক। হয়তো সুখীই ছিলেন তারা, তা না হলে বাবার এমন কাজের কথা মা কিছুতেই বিশ্বাস করছিলো না কেন? রায়া একটা মাটির টিবির উপর বসে হাঁটুতে মুখ রেখে ভাবছিলো, একটা মানুষের কতো রুপ? একজনম একসাথে থেকেও চেনা যায় কেন? মা মাঝে মাঝে একটা কথা বেশ বলে-
“যার পরিবর্তন হওয়ার সে হবেই। কোনো কিছু দিয়ে তাকে বেধে রাখতে পারবি না। এই পাল্টে যাওয়াটা তার ভেতরেই থাকে। বাকীসব অজুহাত মাত্র।”
কথাটা ভীষন সত্যি মনেহয় রায়ার। মা হয়তো তার জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে কথাটা বলেছে যা পরবর্তীতে রায়ার জীবনে ফলে গেছে। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা রায়াকেও তো পাল্টে দিয়েছে। তার মানে কি, এটা তার ভেতরে ছিলো? এই যে অভিনয়, টাকার চিন্তা,সংসারের দায়িত্ব নিয়ে ভাবনা এসবই না তাকে পাল্টে দিলো? এই মুহুর্তে মায়ের কথাটা খুব কন্ট্রাডিকটরি লাগলো রায়ার। এ যেন একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। তাহলে কি একটা কথারও দুটো দিক থাকবে? হয়তোবা?
ভাবনায় বিভোর রায়া টের পেলো না কেউ এসে ওর পাশে বসেছে। হালকা হিমেল হাওয়া রায়ার ভাবনাকে যেন আরো তাল দিচ্ছে। দূরে ফুটে থাকা হলুদ ফুলগুলোর দোল খাওয়া দেখতে দেখতে তার ভাবনায় ডুবে যায়। আরো বিভোর হয়ে ভাবতে বসার আগেই কেউ গলায় আওয়াজ দিলো-
“উহুম উহুম…”
রায়া চমকে পাশে তাকাতেই দেখলো ইহান ঠিক তার পাশটাতে বসে আছে। রায়া দাঁড়িয়ে গেলো-
“আপনি!”
“হুম। অনেকক্ষন ধরে আপনাকে দেখছিলাম, কি ভাবছেন এতো গভীরভাবে বলুনতো?”
“যাই ভাবি, আপনাকে বলবো কেন?”
হঠাৎ মেজাজ খারাপ হয় রায়ার। ভাবনা আর সে একে অপরের বন্ধু। দুইবন্ধু যখন আলাপ করে তখন কেউ বিরক্ত করতে রায়া অসম্ভব রেগে যায়। ওর রাগ বুঝতে পেরে ইহান মজা পেলো। সে হাসতে হাসতে বললো-
“বলুন, বললে কোনো পাপ হবে না। বলতেই পারেন, আমি আপনার সহকর্মী এই হিসেবেও বলতে পারেন।”
“শুনুন, অনেকদিন একসাথে কাজ করলে তাদের সহকর্মী বলে। আপনার সাথে এটাই আমার প্রথম কাজ, তাও দুদিনের কাজ। আপনাকে কি ঠিক সহকর্মী বলা যায়? আর তাছাড়া আপনি এতো বড় নায়ক আমার মতো সামান্য নতুন মডেল কি আপনার সহকর্মী হওয়ার যোগ্য?”
রায়া বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে থাকলো ইহানের দিকে।ইহান সে দৃষ্টি আর খোঁচা দেওয়া কথা দুটোই অগ্র্যাহ্য করে রায়াকে পাল্টা প্রশ্ন করে-
“মিডিয়া নিয়ে আপনার মতামত কি বলুন তো?”
“মানে?”
“এই ধরুন, আমরা যারা এই লাইনে কাজ করি তাদের সম্পর্কে কেমন ধারণা পোষন করেন?”
“সত্যি কথা বলতে খুব একটা ভালো না। আমার কখনো ইচ্ছে ছিলো না এদিকে কাজ করার। বাধ্য হয়ে আসতে হলো।”
কথা বলতে বলতে ইহানের পাশে বসলো রায়া। নিজের অজান্তেই ইহানের কথার পিঠে কথা বলতে শুরু করেছে রায়া। তা বুঝেই যেন ইহানের মুখের হাসিটা বিস্তৃত হলো-
“বাধ্য? কেন? পার্টটাইম জবে হচ্ছিল না?”
“উহু। হচ্ছিল না বলার চেয়ে বলা ভালো যে, মানুষ হতে দিচ্ছিলো না। অসহায় অবস্থায় পড়লে মানুষ আপনাকে কাজের লোক কিংবা বিয়ে বিনা বউয়ের মতো ট্রিট করে।”
কথাগুলো বলেই রায়া ইহানকে দেখলো। কিন্তু ইহানের মুখে কোনো এক্সপ্রেশনই দেখা গেলো না। উল্টো মুচকি হাসিটা প্রানখোলা হাসিতে পরিনত হলো। রায়া অবাক হয়ে দেখলো, হাসলে ইহানকে বাচ্চাদের মতো লাগে। মনে মনে নিজেকে বকা দিলো রায়া, কি হচ্ছে রায়া! তুই আজকাল দেখি খুব গায়েপড়া হয়ে যাচ্ছিস? ইহান অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললো-
“আপনি কি এখনো রেগে আছেন আমার উপর?”
“নাহ, আমি কারো উপর রেগে নেই। মানুষ তার উপর রাগ করে যার উপর তার অধিকার থাকে।”
কথাটা শুনেই ইহান একটু গম্ভীর হলো, মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেলো আচমকা-
“শুনুন, আপনি আমার কথা রেখেছেন সেজন্য আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা। দাদীজান খুব খুশি আপনার উপর। “
“আপনি কি সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই আমার মতো একজন উঠতি মডেলের সাথে কাজ করলেন?”
“আপনার এমনটা কেন মনে হচ্ছে?”
“আপনার মতো নাক উঁচু মানুষ কেন আমার মতো একজনার সাথে কাজ করবে?”
“নিজেকে এতো হীন ভাবার মতো কিছু হয়নি।”
হইান রায়ার দিকে তাকালো।
“আমি নিজেকে ভালো চিনি। তবে কারো অযাচিত সাহায্য নেওয়ার ব্যাপারে খুব কঠোর।”
রায়ার কন্ঠে নির্লিপ্ততা।
“দেখুন মিস রায়া, আত্মসম্মান বোধ থাকা ভালো কিন্তু তাই বলে সেটা নিয়ে বেশি গরিমা থাকা ভালো না। মিডিয়ায় টিকে থাকা সহজ হবে না। তাই সময় থাকতে নিজেকে শুধরে নিন।”
কথাগুলো বলে ইহান উঠে হাঁটা ধরলো, প্রচন্ড রাগে তার মাথার শিরা দিপদিপ করছে। বেয়াদব মেয়ে একটা, সবকিছুতে দয়া নয়তো অপমান খোঁজা! এরজন্য আবার দাদীজান পাগল। এই রুক্ষ এরোগেন্ট মেয়েকে কে বিয়ে করবে?
চলবে—–
সুর্যাস্ত দেখার জন্য সমুদ্রের ধারে আসতেই চমকে গেলো রায়া। দূর থেকেই ইহানকে চিনতে পারছে। প্যান্টের দু পকেটে হাত দিয়ে সমুদ্রের জলে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রায়া ভাবলো, ছেলেটা অদ্ভুত, নিজের খেয়ালে চলে। সেদিন নিজ থেকে কথা বললো অথচ এরপর এই দু’দিন চুপচাপ কাজ করলো। ওর সাথে একটা কথাও বলেনি। এমন ভাব যেন ওকে চেনেই না। রায়া কিছুক্ষণ ইহানকে দেখলো। চেহারা দেখা যাচ্ছে না কিন্তু কেন যেন রায়ার মনে হলো ইহানের মন খারাপ। রায়া তো ভেবেছিলো ইহান ঢাকায় ফেরত চলে গেছে। এতো ব্যস্ত মানুষের তো এভাবে সময় নষ্ট করার কথা নয়? যাগগে, যা খুশি করুক ওর কি? রায়া নিজের ভাবনার রাশ টেনে ধরলো। একবার মনেহলো না হেঁটে ফেরত চলে যায় হোটেলে। পরে আবার নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে হাঁটতে শুরু করলো। এ দিকটায় লোকজন কম, ভীড়ও কম। তাই সচেতন ভাবেই রায়া এখানে এসেছিলো। শুটিং শেষ। রাতের গাড়িতে ঢাকা ফিরবে। যাওয়ার আগে ভাবলো একটু সাগরের পানিতে পা ভিজিয়ে যায়। রায়া ইহানের চোখ এড়িয়ে একটু দূরত্ব রেখে হাঁটতে লাগলো। আর কিছুক্ষণের ভেতরে সূর্য ডুবে যাবে। আকাশ লাল আকার ধারন করেছে। সাগরের জল আর আকাশের লাল মিলে পরিবেশটা একেবারে মোহনীয় লাগছে। রায়া থমকে দাঁড়ায়, একদম নিবিড় হয়ে এই সৌন্দর্য্যটুকু উপভোগ করে। এতো সুন্দর দৃশ্য সামনে থাকলে পৃথিবী থমকে যায়। রায়ার মনেহলো, এই মুহুর্তে ওর চাইতে সুখী আর কেউ নেই। এতো সুন্দর মুহূর্ত উপভোগ করাও ভাগ্যের ব্যাপার। আরো দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে রায়া হোটেলের দিকে হাঁটতে শুরু করে। হালকা হিমেল বাতাসে মনটা খুব ঝরঝরে লাগছিলো রায়ার। শীত পরতে শুরু করেছে, ঠান্ডা লাগছে রায়ার তাই শাড়ির আঁচলটা ভালো মতো গায়ে জড়িয়ে নিলো। হোটেলে ফিরেই শাড়িটা পাল্টে ফেলতে হবে মনে মনে ভাবলো রায়া।
“মিস তাসনিম!”
পেছনে থেকে নিজের ভালো নাম শুনে থমকে গেলো রায়া। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলো ওর একহাত দূরত্বে ইহান দাঁড়িয়ে।
“জ্বী! “
“চলে যাচ্ছেন?”
“হুম। হোটেল ফিরে সব গোছগাছ করবো। আপনি এখানে যে? আমি তো ভেবেছি আপনি ঢাকায় চলে গেছেন?”
“না একটা জরুরি কাজ আছে তাই থেকে গেলাম। আজ রাতে ফ্লাইট আমার। আপনার
সমস্যা না হলে আমার সাথে একটু হাঁটবেন?”
ইহানের এতো মোলায়েম স্বরে দেওয়া প্রস্তাব শুনে রায়া অবাক হলো। এর আবার কি হলো? কিছুটা হতবিহ্বল রায়া ইহানকে অনুসরণ করে হাঁটতে শুরু করলো। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ হেঁটে একটু আরো একটু নির্জন জায়গায় এসে থামলো ইহান। রায়া একবার তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো ইহানকে। অন্ধকার বলে কিছু বোঝা গেলো ন, শুধু ওর সবুজ চোখেদুটো জ্বলজ্বল করছিল। রায়ার মনে অজানা অনুভূতির জন্ম নেয়। ইহান যখনই ওর দিকে তাকায় মনেহয় যেন চোখ ভরা মায়া। নাকি অন্যকিছু? রায়া বুঝতে পারে না। রায়াই কথা বললো-
“কিছু বলবেন?”
“আমার প্রস্তাবটা আপনার কাছে উদ্ভট লাগতে পারে তবুও বলি, আপনাকে বিয়ে করতে চাই।”
রায়া যেন কিছু বুঝতে পারলো না তাই আবার জিজ্ঞেস করলো-
“কি বললেন?”
“আই ওয়ান্ট টু ম্যারি ইউ। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। শুনেছেন?”
“আর ইউ ম্যাড?”
রায়া চেচিয়ে ওঠে।
“নোপ।”
নির্লিপ্ত কন্ঠে জবাব দেয় ইহান।
“তাহলে এ ধরনের অসভ্যতার মানে কি?”
“এখানে অসভ্যতার কি হলো? আমি তো আপনাকে বাজে প্রস্তাব দেইনি, বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি! বিয়ের প্রস্তাব হলো সমাজ স্বীকৃত সবচাইতে ভদ্র প্রস্তাব, এতে কি অসভ্যতা হলো?”
অবাক কন্ঠে ইহান জানতে চায়।
“আশ্চর্য! চিনি না জানি না অথচ আপনি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দেবেন সেটা অসভ্যতা নয়?”
“এ্যারেন্জ ম্যারেজে কি চেনাজানার অপশন থাকে? ধরে নিন এটা এ্যারেন্জ ম্যারেজ।”
“ধরে নেবো কেন? কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ একজনকে ডেকে বললেন, তোমায় বিয়ে করতে চাই। বলি, বিয়েটা কি ছেলেখেলা আপনার কাছে?”
“ছেলেখেলা কেন হবে? আপনারা মেয়েরা এতো পেচুক কেন বলুন তো? আমি তো খুব সাধারণ একটা কথা বলেছি এতে এতো রিয়্যাক্ট করার কি আছে বুঝলাম না? আমি প্রস্তাব দিলাম আপনি ভেবে উওর দেবেন, ব্যস!”
ইহান কাঁধ ঝাঁকালো বিরক্ত হয়ে। ইহানের এতো নিস্পৃহ আচরণে রায়ার রাগ দ্বিগুণ হলো। লোকটা কি ওর সাথে ফাজলামো করছে? ও শুনেছে যারা খুব সাকসেসফুল হয় তাদের মধ্যে নানারকম পাগলামি থাকে। তারা হুটহাট যে কোনো কাজ করে মানুষকে অবাক করতে চায়। ইহান কি সেরকম কিছু করতে চাচ্ছে? এই মুহূর্তে বিয়ে তো দূরে থাকুক নিজের জীবন নিয়েই ভাবছে না রায়া। তার উপর কতো দায়িত্ব। তারচেয়ে বড় কথা, নিজের সাথে করা কমিটমেন্টটাই বাই কম নাকি? পরিবারকে নিয়ে সমাজে মাথা উচু করে চলতে চায় রায়া। মায়ের যে সম্মান ছিলো তা মাকে ফিরিয়ে দিতে চায়। ছোট বোনটাকে মানুষের মতো মানুষ করতে চায়। আর নিজেরও তো কতো কিছু করা বাকি। এখনো পড়ালেখাই শেষ হয়নি? একটা চাকরি করার ইচ্ছা বহুদিনের। মাত্রই জীবনটা গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে, সেখানে কোনো ভাবেই এখন বিয়েটা আসে না। চরম বিরক্ত রায়া কিছু না বলে ইহানের দিকে তাকালো।
“দেখুন এটা সম্ভব না। “
” কেন সম্ভব না? আমি জনপ্রিয় নায়ক বলে? নাকি মিডিয়া পারসন বলে?”
রায়া দ্বিধাবোধ করে। কি বলবে এই লোককে?
“আসলে আমি এখন বিয়ে নিয়ে মোটেও ভাবছি না। আমার এখন অনেক কাজ করতে হবে।”
“তো করবেন কাজ, কে আপনাকে বাঁধা দেবে?”
“দেখুন ব্যাপারটা তা নয়। আমি আমি আসলে..”
রায়া খুব অসস্তি ফিল করে। এতো বড় একজন মানুষ এরকম ছেলেমানুষী কেন করছে?
“আমাকে ঘেন্না করেন না তো মিস তাসনিম? রঙিন পর্দার মানুষদের নিয়ে সাধারণ মানুষ অনেক ফ্যান্টাসিতে ভুগলেও কেন যেন শিক্ষিতরা তাদের নিজেদের জীবনের সাথে জড়াতে চায় না। আপনিও তেমন নন তো?”
ইহান খুব ধীরে ধীরে কেটে কেটে প্রতিটা কথা উচ্চারণ করে। রায়া অসহায় ফিল করে। আসলেও তো সে এদের নিয়ে ভালো ধারণা পোষন করতো না। এখন বাধ্য হয়ে নিজে এ পেশায় এসেছে এটা সত্যি কিন্তু তবুও কোথায় যেন একটা অনীহা তো আছেই। ইহান একাগ্রচিত্তে রায়াকে দেখে। ওর মনের টানাপোড়েন যেন স্পষ্ট বুঝতে পারছে ইহান। নিজেকে আড়াল করতেই রায়া মুখ খোলে-
“দেখুন ব্যাপারটা আসলে তা না। আসলে আমিই আপনার যোগ্য না।”
রায়ার কথা শুনে ইহান হেঁসে দিলো।
“ভালো বলেছেন। তা কারনটা জানতে পারি?”
রায়া নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে –
“কারনটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত। নিজের ব্যাক্তিগত কথা কারো সাথে শেয়ার করি না আমি। আর তাছাড়া, আপনার এই প্রস্তাব আমার কাছে পাগলামি ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না। আপনি নামি-দামি মানুষ, তাই এসব হয়তো আপনার কাছে ছেলেখেলার মতো ব্যাপার।”
রায়ার জবাব ইহানকে পাথর বানিয়ে দিলো। তার সিরিয়াস বিয়ে ভাবনা নাকি পাগলামি? সে হাসবে না কাঁদবে? মেয়েটা কি একটুও বুঝতে পারছে না যে ইহান সত্যিই ইন্টারেস্টেড? তা না হলে সে কেন শুধু শুধু ওকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে?
“দেখুন মিস তাসনিম, আপনি আমার সম্পর্কে ভুল ভাবছেন। ইন্ডাস্ট্রিতে একটু খোঁজ নিলেই বুজবেন আমি মোটেও কোনো বিষয়ে এরকম পাগলামি করার মানুষ না। আমি সত্যিই আপনাকে বিয়ে করতে চাই।”
“কিন্তু আমি চাই না। সবে জীবন গোছানোর পথ খুঁজে পেয়েছি, এখনই কোনো বাঁধনে জড়াতে চাই না।”
“কিন্তু বিয়ে কি আপনার জীবন গোছানোর পথে বাঁধা? কাজ তো আপনি বিয়ের পরও করতে পারবেন? বরং আমার সাথে বিয়ে হলে আপনি কাজের ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা পাবেন।”
“কিরকম?”
রায়া না বুঝে জিজ্ঞেস করে ইহানকে। ইহান একটু হাসলো-
“এই সেক্টরে মাথার উপর কেউ থাকলে আপনি কত ধরনের প্রেশার থেকে বেঁচে যাবেন এটা আমি ঠিক আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না। উমমম, ব্যাপারটা অনেকটা ধরে নিন যে, আমি কোম্পানির মালিক আর আপনি এমডি, আমার ওয়াইফ। কেউ আপনাকে কিছু বলার সাহস পাবে না।”
রায়া ইহানের কথায় চরম অপমানিত বোধ করলো। ইহান কি ভাবে নিজেকে? লোকেপ্রিয় হয়ে মাথা কিনে নিয়েছে? চ্যারিটি করবে রায়ার জন্য? ও এটা ভাবলো কি করে যে রায়া ওর হেল্প নিয়ে এগিয়ে যাবে ওর লক্ষে? রাগে লাল রায়া নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে দাঁত চেপে বললো-
“তা আমার প্রতি আপনার এতো সদয় হওয়ার কারন কি? এই প্রফেশনে আমিই তো একমাত্র নতুন না? আরো মেয়ে আছে আপনি বরং তাদের হেল্প করুন। তারা হয়তো আপনার হেল্প পেয়ে বিগলিত হবে?”
“রাগ করছেন নাকি মিস তাসনিম? আমি কিন্তু এভাবে বলতে চাইনি আপনাকে। জাস্ট আপনাকে বোঝানোর জন্য উদাহরণ দিলাম। তবে সত্যি বলতে বাস্তবতা এর চাইতে ওরস।”
“ওওহহ, প্লিজ! ডোন্ট ডু দ্যাট। আপনার জ্ঞান আপনার কাছেই রাখুন। কেউ অকারন জ্ঞান বিতরণ করতে চাইলে আমি খুব বিরক্ত হই। আমি এডাল্ট মেয়ে, ঢাকা ভার্সিটির মতো জায়গায় পড়ছি। নিজের ভালো মন্দ বোঝার মতো যথেষ্ট জ্ঞান আমার আছে। আর জীবনে কিছু করার জন্য আমার কাউকে সিড়ি হিসেবে ইউজ করার দরকার নেই। হ্যা, এতে হয়তো আমার কষ্ট বেশি করতে হবে সেটা করতে আমি রাজি আছি। তাই বলে কারু হেল্প নিয়ে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে বড় হতে হবে এরকম মেয়ে আমি না। আপনি ভুল জায়গায় ট্রাই করছেন মিস্টার রিজওনাল খান ওরফে ইহান। “
“দেখুন আপনি ব্যাপারটা সম্পুর্ন অন্যরকম ভাবছেন। আমি মোটেও এতোকিছু মিন করে কথাটা বলিনি। আপনি প্লিজ ঠান্ডা মাথায় একটু ভেবে দেখুন। ইউ নিড টু আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট আই মিন।”
“ঠিক এসব কারনে আমি পুরুষদের সহ্য করতে পারি না, বুঝলেন? অলওয়েজ ডমিনেটিং, নিজেরা যেটা বোঝে সেটাই ফাইনাল। বাকী দুনিয়া জাহান্নামে যাক কিন্তু তালগাছ আমার এরকম মনোভাব আপনাদের। আপনার আজকে ইচ্ছে হলো আপনি একজনকে বিয়ে করলেন, তাকে এবং তার পরিবারকে সাপোর্ট দিলেন তারপর সুযোগ বুঝে কোনো একদিন তাকে বুঝিয়ে দিলেন, তুমি আজ যা কিছু তার সবই আমার দান। আবার কাউকে ভালোবাসলেন, আশা ভরসা দিলেন তারপর মেয়েটার যখন বিপদ, আপনাকে প্রয়োজন হবে খুব বেশি তখন তাকে ছেড়ে দিলেন। বিশ্বাস, ভালোবাসা, কমিটমেন্ট এসব আপনাদের কাছ থেকে আশা করাই ভুল। আপনারা মেয়েদের শুরু পাপেট ভাবেন যাকে যেমন খুশি যখন খুশি নাচাবেন। কিন্তু শুনুন, আমি পাপেট না। আপনাদের মতো পুরুষদের আমি কখনো নিজের জীবনে জড়ানোতো দূরে থাক তার আশেপাশে থাকাও পচ্ছন্দ করবো না। “
রায়ার কথার তোড়ে ইহান যেন খেই হারিয়ে ফেলে। প্রতিটা কথা তীরের মতো বিধছে ইহানের বুকে। জীবনে প্রথম কোনো মেয়ের সাথে যেচে কথা বলার জন্য এতোটা অপমান হতে হবে ভাবেনি ইহান। সারাজীবন মেয়েদের থেকে দূরে থেকেছে। দাদির পরে কাউকে ওর আপন মনে হয়নি জীবনে। কি বললো রায়া? ঘেন্না করে পুরুষদের। কিন্তু সেও তো মেয়েদের ঘেন্না করে, তাই বলে রায়ার উপর তো সে তার সেই ঘেন্নার ভার চাপিয়ে দেয়নি? ইহান বড্ড বেশি অপমান বোধ করলো। লজ্জা অপমানে ইহানের আর কোন কথাই বলতে ইচ্ছে করলো না। সে আসলে ঠিকই ভাবে মেয়েদের নিয়ে। এরা কেবল টাকা বোঝে। ভালো ব্যবহারে এদের এলার্জি আছে। সম্মান পাওয়ার এরা যোগ্য না। একটু আহলাদ দিলে এরা মাথায় চড়ে নাচতে চায়। ইহানের মুখটা যেন করলার মতো তেতো হয়ে গেলো। সে আর কিছু না বলে রায়াকে রেখেই উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করলো। রায়া নামের যে ভুত এতোদিন তার মাথায় চড়েছিলো তা যেন এক নিমিষে গায়েব হয়ে গেলো। পরিবর্তে এখন রায়ার জন্য একরাশ ঘৃনা উথলে উঠছে। পেছন থেকে রায়া ফোড়ন কাটলো-
“কি? এতো তাড়াতাড়ি বিয়ের ভুত নেমে গেলো মাথা থেকে?”
ইহান তার সবুজ চোখ জোড়া মেলে ঘুরে তাকালো রায়ার দিকে। বুকটা ধক করে উঠলো রায়ার। চোখ দুটো রং পরিবর্তন হয়েছে। এই ক’দিন ধরে ইহানের চোখে তার জন্য যে অন্যকিছু টের পেতো তা দেখলো না। ইহান বিদ্রুপের হাসি দিলো-
“মিস তাসনিম, আপনি আসলে আমার প্রস্তাবের যোগ্য না। আমি আপনাকে নিয়ে ভুল ভেবেছিলাম। আপনিও গতানুগতিক অন্য দশটা মেয়ের মতোই। সরি, আমি ভুল করে আপনাকে সম্মানিত করতে চাইছিলাম। অথচ সম্মান তো আপনার দরকার নেই, তাই না? তাই আমি আমার প্রস্তাব ফিরিয়ে নিলাম। ভালো থাকবেন।”
ইহান খুব দ্রুত হেঁটে রায়ার চোখের আড়ালে চলে গেলো। ইহানের কথাগুলো রায়ার বুকে নতুন করে আগুন জ্ালালো। আগের আগুনই তো এখনো নেভেনি, ইহান সেই আগুনে ঘি ঢাললো যেন। রায়া জ্বলজ্বলে চোখে ইহানের চলে যাওয়া দেখলো-
“তোমার সম্মান পেতে আমার বয়েই গেছে মিস্টার রিজওয়ান খান। ওটা তুমি তোমার কাছেই রাখো। যথাসময়ে তোমার কাছ থেকে তা আদায় করে নেবো, দেখে নিয়ো।”
বিরবির করে নিজের বুকের আগুনে তুশ ছিটালো রায়া। তারপর নিজের হোটেলের দিকে রওনা দিলো।
একটা ভালোবাসার গাছ গজানোর আগেই যেন তিক্ততার ঝড়ে গাছটি উপরে গেলো। তবে সেখানে ঘৃনার গাছটি কিন্তু ঠিকই গজিয়ে গেলো! কি হবে রায়া আর ইহানের সম্পর্কের? আদৌ কি কোনোদিন মিলবে ওরা? নাকি অন্য কেউ আসবে ওদের জীবনে?
চলবে—–
আজকাল ইহানের মেজাজের পারদ সবসময় উর্দ্ধমুখি। ইহানের মেজাজ হ্যান্ডেল করতে সাবেরের রীতিমতো হিমশিম অবস্থা। কথায় কথায় সাবেরের সাথে চিৎকার চেচামেচি জুড়ে দিচ্ছে ইহান। এখন ইহান ডাকলেই সাবেরের বুক গুড়মুর করে। সে মনে মনে বকা খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই ইহানের সামনে যায়। ইহানের এতো মেজাজ সাবের আগে কখনো দেখেনি। কক্সবাজার থেকে আসার পর থেকে স্যারের কি হলো সাবের ভেবে পাচ্ছে না। একবার ভাবলো দাদিমাকে জানায় ইহানের ঘটনা। পরে আবার পিছিয়ে গেলো। ইহান জানতে পারলে ওকে আস্ত রাখবে না মনেহয়। এর চাইতে বকা হজম করাই ভালো।
“স্যার, আসবো?”
মন দিয়ে মোবাইলে কিছু দেখছিলো ইহান। বিরক্ত হয়ে সাবেরকে দেখলো একবার, তারপর দৃষ্টি আবার মোবাইলে নিবন্ধ করলো-
“এসেই তো পরেছো। এখন যেটা বলতে চাও সেটা তাড়াতাড়ি বলে কেটে পড়ো।”
“হিতৈষী মাল্টিমিডিয়ার মৃদুল ভাই আপনার সাথে আজ একটা মিটিং করতে চাইছিলেন। কি বলবো তাকে?”
“মৃদুল! কিন্তু ওর সাথে তো আমি কাজ করবো না! গতবার ওর বাপ কি করেছিলো আমার সাথে ভুলে গেছো?”
“স্যার, ওর বাবা তো এখন অসুস্থ তাই আপাতত বিজনেসটা মৃদুলই সামলাচ্ছে। আর ছেলেটা স্যার ওর বাবার মতো না। নতুন করে সবকিছু গুছিয়ে নিতে চাচ্ছে আর ওর কাজও বেশ পরিস্কার। বর্তমানে সমালোচক মহলে ওর ছবির বেশ নামডাক। আমার মনেহয় একবার আলোচনা করলে খারাপ হবে না।”
“কিন্তু ও তো ছবি বানায় না। নাটক আর এ্যাড বানায়।”
“জ্বী স্যার। শুনে দেখুন উনি কি বলে।”
সাবেরের কথায় দু’মিনিট ভাবলো ইহান তারপর
ঘড়ি দেখলো। বেলা এগারো টা বেজে বিশ মিনিট।
“আজ আমার কি কি কাজ?”
“স্যার, আজ কেবল ডাবিং আছে ‘সরোবর’ মুভির। এছাড়া আর কোনো কাজ নেই। স্যার, মৃদুল ভাই আর্জেন্ট জানতে চায়।”
“তবে বিকেলের দিকে একটা মিটিং ফিক্সড করো।”
“ঠিক আছে স্যার।”
সাবের এগুতেই ইহান ডাকলো-
“এক মিনিট সাবের। মৃদুল কেন মিটিং করতে চায় কিছু জানো তুমি?”
“ডিটেইলস জানি না স্যার। তবে হালকা যা শুনেছি তাতে মনেহলো উনি মুভিতে নামতে চায়। হিরো হিসেবে হয়তো আপনাকে চাইছে।”
“ঠিক আছে, যাও তুমি।”
ইহানের আজকাল ছবিতে কাজ করতে ভালো লাগছে না। খুব একঘেয়েমি লাগছে। প্রতিদিন নিয়ম করে একই কাজ, একটা ব্রেক নেওয়াটা জরুরি হয়ে গেছে। তাছাড়া, আজকাল অল্পতেই রেগে যাচ্ছে। মনটা এতো বিক্ষিপ্ত আর উচাটন হয়ে আছে যে নিজেই নিজেকে সামলাতে পারছে না। মোবাইলটা অবহেলায় দূরে ছুড়ে ফেললো। তারপর টিভি চালিয়ে বিছানায় হেলান দিলো। টিভি খুলতেই রায়া আর ওর বিজ্ঞাপন চোখে পড়লো। ইহানের এখন রায়ার চেহারা দেখলেই রাগে শরীর কাপে। বাধ্য হয়ে একের পর এক চ্যানেল পালটে চলেছে। প্রতিটা চ্যানেলে ওদের বিজ্ঞাপন। ইহানের সহ্য হলো না কেন যেন। না চাইতেই রায়ার বলা কথাগুলো কানে বাজতে থাকলো। ওর কেবলই নিজেকে রিজেক্টেড মনে হতে থাকে। মেয়ের সাহস কি করে হয় ওকে মুখের ওপর না বলার। মেয়ে কি জানে না, ইহানের সবুজ চোখের প্রেমে মেয়েরা হাবুডুবু খায়? ওকে নিয়ে মেয়েরা কতটা ক্রেজি? দুইদিন হলো মিডিয়ায় কাজ করে নিজেকে রথি মহারথি ভাবতে শুরু করেছে রায়া যে ইহানকে ঠুকরে দেয়? চোখের সামনে এই বেয়াদব মেয়েটাকে দেখে নিজের মেজাজ হারিয়ে টিভির দিকে সজোরে রিমোট ছুড়ে মারলো ইহান। ঝনঝন শব্দে টিভি ভেঙে পড়লো। আওয়াজে সাবের, ইনা, দাদিমা সকলেই দৌড়ে এলো ইহানের রুমে। বিয়াল্লিশ ইঞ্চি টিভির অবস্থা দেখে সকলেই অবাক। এরকম আচরন এই প্রথম করলো ইহান। দাদি জামিলা ইহানের লাল মুখচোখ দেখে কিছু একটা অনুমান করেই সাবের আর ইনাকে ইশারা করলো রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে। ওরা চলে যেতেই জামিলা ইহানের পাশে এসে বসলো-
“ও বাই, তোমার কি হইছে কও তো? মেলাদিন থিকা দেখতাছি তোমার ছটফটানি। কি হইছে দাদিমারে কইবা না?”
“কিছু না, দাদিমা।”
ইহান ভাঙা গলায় জবাব দিলো।
“আমি ঠিক আছি।”
“দেখতাছি তো কেমুন ঠিক আছো। তোমারে সময় দিলাম মেলা কিন্তু কিছুই করলা না। এইবার আমি আমার আমার কাম করুম তোমার কথা আর শুনুম না। আর পরে আমারে কিছু কইতেও পারবা না কইলাম?”
“আমি বিয়ে করবো না দাদি। বিয়ে করে কি হবে? বিয়ে তো আব্বাও করছিলো?”
“হুম তো? বিয়া করছিলো দেইখাইতো তুমি দুনিয়াতে আইছিলা, নাকি?”
“দুনিয়াতে এসে তো আর এমন কোনো পূন্য করি নাই, দাদিমা। বরং জঞ্জাল বাড়ছে এই দুনিয়ার।”
“ছি, কিসব কথা বাই? আর কোনোদিন যেন এমুন না শুনি। তুমারে বিয়া করামু এইটা ফাইনাল।”
“কেন খামোখাই একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করবেন দাদিমা? মেয়েদের আমি পচ্ছন্দ করি না জানেন তো?”
“মাইয়া আর বউ কি এক? বউ খুব সোহাগের জিনিস গো বাই। তোমার দাদাজান যে আমারে কি সোহাগই না করতো, তুমি তো জানো না।”
“ওইদিন গেছে, দাদিমা। আমিও দাদার মতো না আর অন্য কেউ তোমার মতো হবে না। এই যুগের মেয়েরা ভালোবাসতে জানে না, দাদিমা।”
“পাগল! কেউ কি কারো মতোন হয়? আল্লাহর সৃষ্টি সবই আলাদা। আর কি কইলা? মাইয়ারা ভালোবাসতে জানে না? শুনো বাই, যুগ যতই পাল্টাই যাক মাইয়া জাতের কোনো পরিবর্তন নাই। এরা সবসময় ভালোবাসতে জানে, বুঝলা?”
“নাহ। বুঝি না বুঝতে চাইও না।”
“বুঝবা বুঝবা,ঠিকই বুঝবা। যখন বিয়া করবা বউ জানপ্রান দিয়া ভালোবাসবো তখন ঠিকই বুঝবা। কোনো সাধুর ক্ষমতা নাই, মাইয়া মানুষের ভালোবাসা ফিরত দেয়।”
“এতো বোঝার দরকার নাই আমার দাদিমা। আমি এমনই ভালো আছি।”
“পাগল পোলা! ভালোবাসা পাইলে এইসব রাগ কই যাইবো?”
জামিলা নাতির মাথা হাতিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বেড়িয়ে যায়। ইহান ভাবে, সত্যি সত্যি কি ভালোবাসা পেলে ও ঠিক হয়ে যাবে? কোনো মেয়ের ভালোবাসা কি আদৌও ওর কপালে জুটবে? আর যদি সত্যিই কেউ জুটে যায় তাহলে সারাজীবন কি মেয়েটা ওকেই ভালোবাসবে নাকি মায়ের মতো হবে?
*******
“আরিফ সাহেব, আপনি তো ভাই দিন দিন কৃপন হয়ে যাচ্ছেন?”
সহকর্মী খলিলের কথা শুনে আরিফ সাহেবের ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হলো। তিনি মনে করার চেষ্টা করলেন গত কয়েকদিনে এমন কিছু হয়েছে কিনা যাতে তাকে কৃপন বলা যায়।
“ভাই, আমি আবার কি করলাম?”
আরিফ সাহেব কুন্ঠিত কন্ঠে জানতে চায়।
“বুঝলাম যে নতুন সংসার নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন। তাই বলে কি নিজের সন্তানদের ভুলেই গেলেন?”
আরিফ সাহেব মনে মনে শঙ্কিত হলেন। এই বুঝি কথার তীর ছুটে এলো তার দিকে।
“কি হয়েছে ভাই?”
“আরে আপনার মেয়েটা কি দূর্দান্ত কাজ করছে, ঢাকার সমস্ত বিলবোর্ডে তো তাকেই দেখা যাচ্ছে। অথচ আপনি বাপ হয়ে মেয়ের খুশিতে আমাদের একটু মিষ্টি পর্যন্ত খাওয়ালেন না। ইনকাম তো ভাই কম করেন না। তা মেয়ের খুশিতেই না হয় আমাদের একটু মিষ্টি মুখ করালেন? অন্য খরচ থেকে যেহেতু বেঁচেই গেছেন। ভাই ভাগ্য বটে আপনার। আর মনের জোরও বেশ। তা না হলে এই বয়সে এসে বেশ ভালোই নতুন মানুষ নিয়ে সংসার পেতেছেন। আপনাকে মাঝে মাঝে হিংসাই লাগে, ভাইসাহেব।”
বাঁকা হাসি দিয়ে খলিল চলে গেলো। নীরবে কথাগুলো হজম করে নিলেন আরিফ সাহেব। কোনো উপায় নেই, সরকারি চাকরি তাই চাইলেই ছেড়ে দেওয়া যায় না। দিনাকে কতবার বললেন, চল ট্রান্সফার নিয়ে অন্য কোনো শহরে যাই। দিনা কিছুতেই যাবে না। তার এক কথা, সমস্যা তোমার। তোমার জন্য আমি কেন আমার শহর ছাড়বো? আমার বাচ্চার ভবিষ্যৎ কেন নষ্ট করবো।”
এর বেশি বললে ঝগড়া, অশান্তি বাড়ে কিন্তু সমাধান হয় না কোনো। গত পাঁচ বছর ধরে তাই সহ্য করে যাচ্ছেন। একই শহরে পুরনো মানুষজনের মাঝে তাকে নিয়ে ছি ছিক্কার। লোকজন আগে আড়ালে বলতো এখন মুখের উপরই বলে। অফিসে আগে তাকে নিয়ে প্রচুর ফিসফিসানি টের পেতেন। ইদানীং সেটা কমে এসেছে। এজন্য তিনি রাজিয়া আর তিন মেয়েকে মনে মনে অনেক ধন্যবাদ দেন। ওদেরকে একপ্রকার রাস্তায় বসিয়ে এসেছিলেন। তবুও রাজিয়া বা মেয়েরা কখনো তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। তীব্র ঘৃনা হয়তো ওদের বাঁধা দিয়েছে। ওদের ঘৃনাতে আরিফ সাহেবের কিছু এসে যায় না। তিনি বরং বেচে গেছেন যে ওরা ওনার জীবন থেকে খুব সহজে বিদায় নিয়েছিলো। যত সমস্যা যেন এই সমাজের লোকদের। রায়া বিজ্ঞাপন এর মডেল হয়ে নাম কামাচ্ছে। আর রাজিয়া কিছুই বলছে না মেয়েকে? এইভাবে মেয়েদের অধপতনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে রাজিয়া? আর এসব দেখে খুশি হবে আরিফ সাহেব? কখনোই না। মেয়ে গোল্লায় যাচ্ছে যাক তাতে ওনার কি? ভালো হয়েছে ওদেরকে ছেড়ে এসেছেন। আটপৌরে রাজিয়াকে তার খুব অসহ্য লাগছিলো দিন দিন। মেয়েরা বড় হচ্ছিল আর রাজিয়া দূরে সরে যাচ্ছিলো। একটু কাছে টানলেই মেয়েদের অজুহাত। প্রতিদিন অফিস শেষে বাড়ি ফেরাটাকে কঠিন শাস্তি মনে হচ্ছিল। দিনার কথা মনে হতেই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। আহা, কি সুন্দর দেখতে দিনা, কি ফিগার! ছেলেটা হওয়ার পর একটু মুটিয়ে গেলেও সেটা যেন ওর সৌন্দর্য্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। মুহুর্তেই কলিগের বলা কটু কথাগুলো ভুলে গেলো আরিফ। মাথায় কেবল দিনা ঘুরছে।
*******
মায়ের ইমার্জেন্সি ফোন পেয়ে শুটিং ফেলে রায়া হসপিটালে ছুটে এসেছে। জোয়ার ডেলিভারি পেইন উঠেছে। ঢাকার নামি-দামি এক হসপিটালে এডমিট করেছে জোয়াকে ওরই ইচ্ছেতে। এই হসপিটাল ছাড়া নাকি সে ডেলিভারি করাবে না। রাজিয়ার বারকয়েক মেয়ের সাথে এই নিয়ে বচসা হয়েছে। কিন্তু জোয়া কোন কিছু মানতে নারাজ। রায়া মনে মনে একটা প্রিপারেশন নিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু তবুও ওটিতে নেওয়ার আগে বিল পেমেন্টে যেয়ে রায়ার মাথা ঘুরতে লাগলো। এতো টাকা তো এখন রায়ার হাতে নেই। কিভাবে কি করবে? সংসারের সমস্ত খরচ চালিয়ে যতটুকু সম্ভব জমায় রায়া। প্রচুর কাজ আসছে ঠিক কিন্তু পড়ালেখার পাশাপাশি সব কাজ করা সম্ভব হয় না। নিজের পড়ালেখাটা কিছুতেই ছাড়তে চায়না রায়া। খুব ইচ্ছে ভালো রেজাল্ট করে একটা নয়টা পাঁচটা চাকরি করবে। এসব নাটক ফাটক করে আর কতোদিনই বা চলবে? বিলিং কাউন্টার এর সামনে দাঁড়িয়ে রায়া আকাশ পাতাল ভাবছিলো। হঠাৎ পিঠে কারো হাত পড়লো। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলো দুলাভাই হাসিব দাঁড়িয়ে। রায়াকে দেখে হাসলো হাসিব-
“কি ভাবছো এতো? সরো দেখি কত বিল হলো দেখতে দাও আমাকে।”
রায়া বিলের কাগজ আড়াল করে চোখ কুঁচকে বললো-
“কেন? আপনি দেখে কি করবেন?”
“কি করবো আবার বিল দেবো!”
অবাক কন্ঠে হাসিব জানায়।
“থ্যাংক ইউ। এই উপকার করার কোনো দরকার নেই। আমি দিতে পারবো বিল।”
রায়া ফাইল হাতে নিলো।
“রেগে আছো মনেহচ্ছে? দেখো রায়া, আমি জানি বোন জামাই হিসেবে আমি কখনো তোমাদের প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন করিনি। কিন্তু বিশ্বাস করো এতে আমার কোনো দোষ নাই। আমি যতটুকু বা করতে চেয়েছি তোমার বোন কখনো সারা দেয়নি। এখন আমি কি করবো বলো? আমি খুবই লজ্জিত যে তোমাদের কোনো কাজে লাগিনি। অথচ আমার উচিত ছিলো বড় ভাইয়ের মতো তোমাদের পাশে থাকা।”
রায়া কিছু বললো না কেবল একটা শ্বাস ছাড়লো। সে জানে তার বোনটাই খারাপ তবুও শুনে ভালো লাগলো না।
“আচ্ছা, সেসব বাদ দাও। এখন তোমার বোন নেই, দাও আমাকে বিল দিতে দাও। ও জানতে পারবে না কে বিল দিলো।”
“ও সত্যিটাই জানবে। ও জানবে যে বিল আমিই দিয়েছি। আপনি ভাববেন না কোনো মিথ্যে বলতে হবে না। “
“কেন জিদ করছো বলো তো? বললাম তো আমার ভুল হয়েছে। এখানে অনেক বিল আসবে, তোমাদের কষ্ট হয়ে যাবে।”
হাসিব বিলের ফাইল নেওয়ার জন্য হাত বাড়ায়।
“অনেক ধন্যবাদ হাসিব ভাই। যেহেতু আমার বোন চেয়েছে সেহেতু বিল আমিই দেবো যত কষ্টই হোক না কেন। আপনি ভাববেন না এতোদিন যখন ম্যানেজ করতে পেরেছি এখনও পারবো। আপনি বরং আপুর কাছে যান।”
“ওর কাছে সবাই আছে। আমার মাও এসেছেন। তুমি ভেবো না।”
“তবুও আপনি যান। সবার থাকা আর আপনার থাকা একনা। যান, এদিকটা আমি সামলে নেবো।”
হাসিব বুঝলো রায়া কিছুতেই ওকে বিল দিতে দেবে না। মেয়েটা বড্ড জেদি, আত্মসম্মান বোধ খুব বেশি। হাসিব মনে মনে জোয়ার বাচ্চামি আচরণে বিরক্ত হলো। মেয়েটা একটু বেশিই স্বার্থপর। নিজের মা বোনের কষ্ট বুঝবে না? বিল যখন ওরাই দেবে তাহলে এতো দামী হাসপাতালে জোয়া কেন আসবে? এটা কি ধরনের স্বার্থপরতা হাসিব বুঝে পেলো না। জোয়া কেন যেন যে করেই হোক ওর মাকে কষ্ট দিতে চায়। কিন্তু কেন?
চলবে—–
“টাকার জোগার কি করতে পারলা, ইনামের মা?”
“টাকার কি গাছ লাগাইছি নাকি? দুইদিন পর পর টাকা কই পাবো?”
মুখ ঝামটা দিলো লাইলি।
“পোলার কাছে একটু কইলেই তো হয়। ও কি তোমাকে ফিরায়ে দিবো?”
“আপনের লজ্জা লাগে না এমন কথা বলতে? আর কতো ছোট হবো আপনার জন্য? এই পর্যন্ত কতোবার টাকা চায়ে আনছি আপনার জন্য হিসাব করেন তো?”
“এই শেষবার। এইবার দেখবা ঠিক ঠিক ব্যবসা করতে পারবো।”
“মাফ করেন আমাকে, আমি আর ইহানের কাছে টাকা চাইতে পারবো না। গতবার মিথ্যা কথা কয়ে আপনেকে টাকা আইনা দিলাম, আপনে সেই টাকা দুইদিনে উড়ায়া শেষ করলেন। আর ইহান আমাকে কতো কথা শুনাইলো সেইবার। তার কষ্টের টাকা আমরা অপচয় করতেছি। কথা তো ঠিকই বলছে?”
রাগে ফেটে পড়লো লাইলি। তার ফর্সা মুখ টকটকে লাল হয়ে আছে। সেই রাগ দেখেই কিছুটা দমে গেলো কফিলউদ্দিন। তবুও গলায় সুর তুলে বললো-
“তুমি মা, সন্তানের ইনকামে তোমারও ভাগ আছে তো।”
“কচু আছে। মুখটা আমার খুলায়েন না। আমাদের ভরনপোষণ দায়িত্ব কার, আপনার নাকি ইহানের? ইনাম তো এখনো ঘুরে ঘুরে খায়। ঠিকঠাক মতো পড়ালেখাটাও করেনা। আপনের মতোই বাদাইম্মা হইছে।”
“এইটা কি কইলা? তোমাকে কিছু না কইলেই তুমি উল্টা পাল্টা বকা শুরু করো দেখতেছি। এতোদিন তাইলে সংসারটা চালাইছে কে?”
“এহহ, কি আমার সংসার চালাইছো? একবেলা খাইলে দুইবেলা উপাস থাকা লাগছে। এখন এতো কথা বুঝি না, আমি আর টাকা চায়া আনতে পারবো না সোজা কথা। “
কফিলউদ্দিন কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে কিছু না বলেই চুপচাপ ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো। লাইলিও থম ধরে রইলো। এই যে এতো কথা শুনাইলো লোকটাকে কিন্তু তবুও এই লোক কিছুই করবে না। কিছুক্ষণ ঘুরে টুরে এসে আবার একই ঘ্যানঘ্যান শুরু করবে। সেটা ভেবে লাইলির আরো বেশি মেজাজ খারাপ হলো। এমন সময় ইনাম এসে ঢুকলো-
“মা, হাজার পাঁচেক টাকা দাও তো?”
“কেন? কি করবি টাকা দিয়ে? আর গতদিনই না তোকে পাঁচ হাজার টাকা দিলাম?”
“গতদিন!”
আকাশ থেকে পরে ইনাম।
“মা, সেটা দুইদিন আগের কথা। সেই টাকা তো কবেই শেষ? এখন তাড়াতাড়ি দাও তো টাকাটা?”
ইনাম হাত নাড়লো। লাইলি রাগী চোখে একবার ছেলেকে দেখলো। ইনাম দেখতে ঠিক যেন ইহানের বিপরীত। ইহান দেখতে সুন্দর, প্রায় ফর্সা বলা যায়, চেহারায় একধরনের মায়া আছে ইহানের। আর ইনাম হচ্ছে ধবধবে ফর্সা কিন্তু চেহারার দিকে তাকালেই বুকটা ধক করে ওঠে। কেমন এক ধরনের নিষ্ঠুরতা আছে ওর চেহারায়। ইহানের মধ্যে মায়া মমতা ভালোবাসা সবই বেশি বেশি যদিও ইহান তা প্রকাশ করে না। আর এই ছেলেটা একেবারে কঠিন হৃদয়ের। কারো প্রতি কোনো টান নেই ওর। নিজের জগতে ব্যস্ত থাকে সে। দুজনের স্বভাবের পার্থক্য সাদা আর কালো রঙের মতোই জ্বলজ্বলে। খুব বেশি খোঁজার দরকার হয় না। লাইলি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ইনামকে বলে-
“তোর কি মনেহয়, আমি টাকার গাছ? এসে বললেই গাছ থেকে টাকা পেড়ে তোকে দেবো?”
ইনাম মাকে জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে-
“তুমি না হলেও তোমার ছেলেটাতো টাকার গাছই। তাকে ঝাঁকি দিলেই টাকা পাবে।”
ইনামের কথা শুনে কাঁদতে ইচ্ছে হলো লাইলির। এরা সবাই ভাবেটা কি? এদের কি লজ্জা শরম সব নাই হয়ে গেছে? কিভাবে আরেকজনার টাকায় চলছে একটুও কি বোধ নেই? এতো কেন বেহায়া এরা?
“শোন ইনাম, আমার কাছে কোনো টাকা নেই। আর তোমাদের এই লাগামহীন চাহিদা মেটানোর জন্য আমি বারে বারে ইহানের কাছে ছোট হতে পারবো না। আর তুমি যথেষ্ট বড় হয়েছো, অনার্স শেষ করেছো, এখনতো অন্তত নিজের খরচ নিজে করতে শেখো? আর কত অন্যের কাছে হাত পাতবে?”
লাইলির কথা শুনে ইনাম মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে দাঁড়ালো।
“দেখো মা, আমি নায়ক ইহানের ভাই। আমার একটা প্রেস্টিজ আছে। এখনো মাস্টার্স শেষ করতে পারিনি আর এখনই চাকরি খুঁজতে হবে? আর খুঁজতেই বা হবে কেন? তুমি বরং ভাইয়াকে বলো আমায় একটা চাকরি জোগাড় করে দিতে। ভাইয়া বললে ভালো কোথাও আমার জব হয়ে যাবে।”
“তাকে কি তোমার জাদুর বাক্স বলে মনেহয় যে সে বললো আর জব হয়ে গেলো? সে একজন নামকরা নায়ক মাত্র, সে কিভাবে চাকরি দেবে? আর তুমি শিক্ষিত ছেলে, নিজ যোগ্যতায় চাকরি নেবে। আরেকজনের দেয়া চাকরি তুমি নেবে কেন?”
“ওহহহ মা, এতো কথা না বলে টাকা দাও। আমার দেরি হচ্ছে।”
অসহিষ্ণু কন্ঠে বললো ইনাম।
“বললাম তো টাকা নেই। নেই মানে নেই।”
“না থাকলে জোগাড় করো। আমার আজ রাতের ভেতর পাঁচ হাজার টাকা চাই। আপাতত আমি যাচ্ছি কিন্তু রাতে যেন টাকাটা পাই। তা না হলে তুমি তো জানোই কি হবে?”
ইনাম শয়তানি হাসি দিয়ে বেড়িয়ে গেলো। লাইলি নিজের অসহায়তা হাতের কাছে থাকা মোবাইল এর উপর ঝাড়লো, মেঝেতে ছুড়ে ফেললো হাতে থাকা মোবাইলটা। বাপ ছেলে একই রকম। এদের কামাই করার মুরোদ নেই অথচ খরচ করার মুরোদ ষোলআনা। আর তার মুল্যই বা কি এদের কাছে? প্রয়োজনে টাকার জোগান দেওয়া এটাই কি এদের কাছে তার একমাত্র পরিচয়? আর ইহান! সে তো তাকে কিছুই মনে করে না। অথচ বারে বারে তার কাছে যেয়েই হাত পাততে হয়। এইজন্যই লাইলি চেয়েছিলো মেয়েটাকে যদি ফিল্মে নামানো যেতো আর কোনোভাবে নাম কামিয়ে ফেলতো তাহলে অন্তত ইহানের কাছে হাত পাততে হতো না। কিন্তু মেয়েটা হয়েছে সতী সাবিত্রী। সে নাকি ওসব ছবি টবি করবে না। তাই ভাইয়ের কাছে যেয়ে বসে আছে। সবকিছু মিলিয়ে লাইলির অসহায়তায় নিজের প্রতি নিজেরই করুনা জাগে। অজানা নিস্ফল আক্রোশে লাইলি বসে বসে কাঁদে, হাপুস নয়নে কাঁদে।
*******
“দোস্ত, তুই কি একটু আসতে পারবি আমার বাসায়?”
রায়ার কন্ঠে উদ্বেগ শুনে রিজভী আর না করতে পারে না। আজ ছুটির দিন, ভেবেছিলো সারাদিন ঘুমিয়ে গত ছয়দিনের কাজের ক্লান্তি কাটাবে। কিন্তু দশটা বাজতে না বাজতেই রায়ার ফোন। মেয়েটা কি আজকাল একটু বেশিই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে তার উপর? তা না হলে যে কোন ব্যাপারে পরামর্শের জন্য তাকেই খোঁজে কেন? আগে তো এমন ছিলো না? যদিও ব্যাপারটা রিজভীর ভালো লাগে। কিন্তু সেই সাথে সে এটাও জানে যে রায়ার সাথে তার কোনোদিন কোনো স্পেশাল ব্যাপার সম্ভব না। এটা কেবল পচ্ছন্দ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকতে পারে কিংবা তার দিক থেকে একতরফা কোনো ব্যাপার স্যাপার হতে পারে। এর বাইরে রায়াকে নিয়ে সে কিছু ভাবতে পারে না। কেন যেন এরকম কোন ভাবনাই ওর মনে আসে না। অথচ রায়াকে ভালো না বেসে থাকা যায় না। ও মেয়েটাই এমন। সবাইকে বোঝে সবারটা ভাবে, কেবল নিজের জন্য কিছু ভাবতে পারে না মেয়েটা।
“কি রে কোথায় হারিয়ে গেলি? ফোন কানে ধরে রাখতে রাখতে তো হাত ব্যাথা হয়ে গেলো। আসছিস তো নাকি?”
“হুম আসছি। ঘুম থেকে উঠলাম মাত্র।”
“আচ্ছা বাসায় আয় একসাথে নাস্তা করবো তাহলে।”
“ওকে।”
আরাম করে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলো রিজভী। কথাটা শুনে মুখ থেকে চা ছিটকে পড়লো।
“কি বললি? আবার বল তো?”
রায়া ভয় পাওয়া গলায় বললো-
“ফিল্মের অফার পেয়েছি। পরপর তিনটে ফিল্মের জন্য চুক্তি করতে চায়। ওরা কিছু শর্ত দিয়েছে সেসব মানতে পারলেই ডিল সাইন হবে।”
“কি কি শর্ত?”
গম্ভীর মুখে জানতে চায় রিজভী। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না রায়া ছবি করতে পারে। যে মেয়ে মিডিয়ায় কাজ করতে চায়নি সে কিনা এখন ছবি করবে?
“তুই কি সিরিয়াস?”
“মানে?”
“মানে ছবির ব্যাপারে সিরিয়াস? নাটক বা এ্যাড করা একরকম কিন্তু ছবি? তুই তো এ্যাডই করতে চাইছিলি না আর এখন ছবি?”
“আমি ডিসিশন নিতে পারছি না বলেই তো তোকে ডাকলাম। প্লিজ ভাই বলতো কি করবো? টাকার অংকটা কিন্তু বেশ ভালো। এজন্যই একটু ভাবছি কি করবো? আপাতত টাকাটাও ভীষণ জরুরি।”
“কি শর্ত দিয়েছে ওরা?”
“এই যেমন ধর, নায়ক যেই হোক আপত্তি করা যাবে না, চুক্তির সময় অনুযায়ী অন্য কোন ছবিতে বা নাটক বা এ্যাড করতে পারবো না, ছবির চিত্রনাট্য যদি ডিমান্ড করে তাহলে সব ক্যারেক্টারই প্লে করতে হবে, চুক্তিকালীন সময় বিয়ে করা যাবে না এরকম আরো কয়েকটা আছে।”
রিজভী কিছুক্ষণ ভাবলো।
“দোস্ত, ফ্র্যাংকলি স্পিকিং, একটু রিস্কি মনেহচ্ছে। এরা চুক্তি টুক্তি করে নায়িকাদের দিয়ে আজেবাজে দৃশ্য ধারন করিয়ে নেয়। যদিও এই জগৎ নিয়ে আমার আইডিয়া কম। তবুও চুক্তির শর্ত শুনে কিন্তু এরকমই মনেহচ্ছে।”
“নামকরা মিডিয়া, এরা কি এমন করবে? ওই যে, নায়িকা সীমানার নামকরা মুভি ‘মুক্তির আনন্দ’, দেখেছিলি না ছবিটা? এরাই তৈরি করেছিলো।”
“তুই যদি রিস্ক নিতে চাস তাহলে করতে পারিস। এছাড়া আর কিছু মাথায় আসছে না। আমি তো এসব ব্যাপারে এতো এক্সপার্ট না যে বলবো।”
“করেই ফেলি কি বলিস? পরেরটা পরে দেখা যাবে।”
“হুম। করে ফেল। কিন্তু ছবির শুটিং করতে যেয়ে তোর পড়ালেখা হ্যাম্পার হবে না?”
“নারে। আমি এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম। ওরা বলেছে ওরা এ বিষয়ে যথেষ্ট ছাড় দেবে। এজন্যই আমি রাজি হতে চাইছি।”
“তাহলে তো প্রবলেম সলভ হয়েই গেলো। রাজি হয়ে যা।”
রায়ার মুখে হাসি ফুটলো। যেন ও এতোক্ষণ রিজভীর হ্যা এর অপেক্ষায়ই বসে ছিলো। রায়ার বিশ্বাস রিজভী যেটাতে হ্যা বলে সে কাজে আর ঝামেলা হবে না। রিজভীকে ও মনে মনে লাকি চার্ম মনে করে। যদিও রিজভী এসব বিষয়ে কিছুই জানে না। রায়া হাসি মুখে উঠে দাড়ালো-
“দে তোকে আরেক কাপ চা খাওয়াই। তখনকার টা তো ঠিকমতো খেতে পারিসনি।”
রিজভী অবাক হয়ে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিলো। রায়া গুনগুন করতে করতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। রাজিয়া মেয়ের পিছন পিছন রান্নাঘরে এলো,মেয়ের হাত থেকে চায়ের কেতলি নিতে নিতে বললো-
“হ্যারে তাসনি, এগুলো না করলে কি হতো না? এসব ছবি টবি করার কি দরকার রে তোর? কোনোরকমে পড়ালেখাটা শেষ করে ভালো একটা চাকরিতে ঢুকে যেতি? সবার জন্য নিজের জীবনটা কেন চুলোয় তুলছিস?”
“মা, এই মুহুর্তে টাকাটা খুব দরকার। আপার অপারেশন এ অনেক টাকা বেড়িয়ে গেছে, ধার করে হাসপাতালের বিল দিয়েছি। যদিও হাসিব ভাই টাকা দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমি নেইনি। আমি ঠিক কাজ করেছি না মা? আত্মসম্মানবোধটা তোমার কাছ থেকেই শিখেছি মা। তুমি যেমন পঁচিশ বছর সাথে থাকা লোকটা বিশ্বাস ভাঙার পর তার সব সাহায্য পায়ে ঠেলেছো ঠিক তেমনি আমিও পারি না মা। তুমিতো জানোই এসব করতে আমার মোটেও ইচ্ছে করে না। আবার কারো কাছে হাত পাততেও ইচ্ছে করে না। কি করবো বলো তো? নিজের পড়ালেখা, টিয়ার পড়ালেখা, সংসার অনেক খরচ মা। সবসময় টানাটানি আর ভালো লাগে না। এরচেয়ে বরং কিছুদিন কষ্ট করি তারপর না হয় সব ছেড়ে দিবো। ঠিক আছে? “
রাজিয়া চোখ মুছলেন, মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন-
“আমি ব্যার্থ মা। তা না হলে আমি বাড়িতে বসে আছি আর তোকে এই সংসারের জন্য ছুটে মরতে হচ্ছে? মাফ করে দিস আমায়। তোদের জন্য কিছু করতে পারছি না। মাফ করিস রে মা।”
“শশশশশ মা, আর কখনো এমন বলো না। তুমি আছো বলেই আমরা আছি। তা না হলে কবেই আমরা রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতাম। তোমার জন্য সব করতে রাজি আছি কিন্তু তোমাকে হারাতে রাজি নই। আর কখনো বলো না এমন, বুঝলে?”
রাজিয়া চোখের জল মুছতে মুছতে মেয়ের জন্য দোয়া করেন আর এক অতি স্বার্থপর পুরুষকে মনে মনে শাপশাপান্ত করেন।
*******
“মৃদুল, অন্য কাউকে নাও। ছবির কাহিনি চমৎকার, এতো আনারি নায়িকা এ চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারবে না। এই মেয়ে অভিনয়ের অ জানে না।”
মৃদুল কিছুটা সময় হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইলো ইহানের দিকে। সাবের নিজেও অবাক হয়েছে।
“রিজু ভাই, এই মেয়ের সাথে আপনি একটা এ্যাড করেছেন। আপনাদের দুজনার জুটি চমৎকার মানিয়েছিলো, আর আপনার সাথে পাল্লা দিয়ে মেয়ে অভিনয় করেছে। তবুও এ কথা বলছেন কেন ভাই?”
মৃদুলের কথা শুনে মুখের চোয়াল শক্ত হলো ইহানের। মনে হলো এক ঘুষিতে মৃদুলের মুখ চোখ ফাটিয়ে দেয়। নিজেকে অনেক কষ্টে স্বাভাবিক রাখলো ইহান, মুখে একটু কৃত্রিম হাসি ফুটালো-
“আমি ওর সাথে কাজ করেছি বলেই বলছি, তুমি যে চরিত্রে ওকে নিতে চাইছো সে চরিত্র ও ফুটিয়ে তুলতে পারবে না। ও মাঝে ওই ব্যাপারটা নেই।”
“কিন্তু ভাই, আমি ওকে নেবো বলেই ঠিক করেছি। আপনাদের এ্যাড দেখে মুগ্ধ হয়েই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আর মেয়েটার সাথেও চুক্তি করে ফেলেছি।”
“তুমি তাহলে অন্য কাউকে দেখো মৃদুল। আমি এ ছবিতে অভিনয় করবো না।”
“রিজু ভাই, প্লিজ এমন বলবেন না। আমার প্রথম মুভি, আপনাকে ভেবেই লিড ক্যারেক্টার লিখেছি। এখন যদি আপনি এরকম কথা বলেন তাহলে কিভাবে কি করবো। আপনি প্লিজ রাজি হয়ে যান। আমি কথা দিচ্ছি, এই মেয়ের কাছ থেকে বেস্ট অভিনয় বের করে আনবো। প্লিজ ভাই!”
মৃদুল অনুনয় করলো। ইহানের ক্রোধ ইহানকে কিছুতেই হ্যা বলতে দিচ্ছে না। রায়ার চেহারাও দেখতে ইচ্ছুক না ইহান। এই রকম নাক উচু মেয়ে, যে ওকে রিজেক্ট করেছে তার সাথে কিভাবে অভিনয় করবে ইহান? ইহান চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাড়ালো-
“ভাই, মেয়েটা কিন্তু জানেইনা ওর প্রথম ছবি আপনার সাথে। আচ্ছা, ঠিক আছে ভাই আপনি ওকে একটা সুযোগ দিন। অন্তত আমার জন্য হলেও একবার সুযোগ দিন। যদি ফাস্ট সিন ও ঠিকঠাক না করতে পারে তাহলে ওকে বাদ দিয়ে দেবো। ডিল থাকলো আপনার সাথে। “
মৃদুলের কথায় মুখে হাসি ফুটলো ইহানের। মনে মনে এই ভেবে আর একটু খুশি হলো যে, রায়া ওর সাথে অভিনয়ের ব্যাপারটা জানে না।
“ঠিক আছে, মৃদুল। তাহলে ওই কথাই রইলো, ফাস্ট সিন ওকে না হলে কিন্তু ও বাদ। আর হ্যা আমার কোনো ব্যাক্তিগত পচ্ছন্দ নেই। তুমি তোমার ইচ্ছে মত যে কাউকে আমার অপজিটে নিতে পারো।”
“ধন্যবাদ, ভাই। “
“দাও, কন্ট্রাক্ট পেপার দাও সাইন করে দেই।”
ঘষঘষ করে সাইন দিয়ে ইহান বেড়িয়ে যাচ্ছিলো। হঠাৎই তার মাথায় এলো, এই ছবিতে অভিনয়ের সুত্র ধরেই রায়ার উপর শোধ তুলতে পারে ইহান। ইহানকে অপমানের বদলা নিতে একটা ছবিতে একসাথে অভিনয় এর সুযোগই যথেষ্ট। এই মেয়েকে পেরেশান করার যথেষ্ট সুযোগ পাওয়া যাবে শুটিং এর পুরোটা সময়। ইহানের মুখে ক্রুর একটা হাসি ফুটে উঠলো। আহ, ভাবতেই শান্তি লাগছে। আচ্ছা, মৃদুলকে বলবে নাকি যে নায়িকা বদলাতে হবে না। ওই রায়াই থাক নায়িকা। থাকগে, এতো বলাবলির ঝামেলায় যাওয়ার কোনো দরকার নেই। শুটিং শুরু তো হোক, তারপর দেখা যাবে কি করা যায় ওর সাথে । এবার আমিও দেখবো মিস রায়া তোমার আত্মসম্মানবোধ কতোটা প্রবল। কিভাবে আমার সাথে কাজ কমপ্লিট করবে আমিও দেখতে চাই। তুমি কতোদূর সহ্য করতে পারো সেটাও যাচাই করতে চাই। আমার সাথে পাঙ্গা লাগা? কি করবে এবার? আমার সাথে না পেরে ছবির শুটিং বন্ধ করবে? প্রফুল্লচিত্তে শিস বাজাতে বাজাতে ইহান গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। পেছনে বিস্মিত সাবের মাথা চুলকে ইহানের পিছু পিছু আসছে। ওর মাথায় কিছুই ঢুকছে না। স্যার এইমাত্র রাগ করে ছিলো আবার এখনই হাসছে। কি যে চলছে স্যারের মাথায় আল্লাহই ভালো জানে! মনেহচ্ছে, রায়া ম্যাডামের এবার খবর হয়েই যাবে?
চলবে—–
May be an image of flower and tree

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..