সময়টা মাঝরাত। চারপাশ অতিমাত্রায় শান্ত। সেই শান্তির নিস্তব্ধতা ভেঙে হুট করে একটা কবুতরের ভূতুরে ডাক কানে এসে বিঁধতেই বিন্নি চমকে লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে। মলিন চৌকিখানা ক্যাচক্যাচ শব্দ তুলে নড়ে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে। তারাবানু ঘুম জড়ানো কণ্ঠে ধমক দিলেন,
“কী হইলো? মাঝরাইতে ফাল দেস ক্যান?”
বিন্নি বুকে থুতু দিয়ে মিনমিন করে বলল,
“ডরাইছিলাম দাদি।”
“চুপ কইরা ঘুমা। চৌকিডা এমনিতেই ঘুণপোকে খাইয়া শেষ দিছে। কবে না জানি ভাইঙ্গা যায়।”
বিন্নি আস্তে করে শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুম সহসাই চোখের পাতায় ধরা দিলো না। বিন্নি এপাশ ওপাশ করতে লাগল। তারাবানু বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“এত মোচরাছ ক্যান?”
“পেশাবের বেগ আইছে, দাদি।”
“হের লইগ্যাই কই রাইত বিরাইতে বেশি পানি খাইছ না। কাঁচা ঘুমডা গেলোনি কাইট্যা?”
“তুমি হুইত্তা থাহো। আমি একলাই যাইতাছি।”
“যুবতী মাইয়া আন্ধারে একলা বাইর হওন ভালা না কতবার কইতাম? হের উপরে নতুন বিয়া হইছে। শইল্যেরতন এহনো নতুন বউয়ের গন্ধ যায় নাই।”
বিন্নি ঠোঁট টিপে হাসল। আঁধারে তা তারাবানুর দৃষ্টিগোচর হলো না। বিন্নি বলল,
“আমি তো কুনু গন্ধ পাই না। তুমি পাও? আর নতুন বউয়ের গন্ধ পাইলেও কী হইবো?”
“কথা না কইয়া কুপিডা ধরা।”
বাইরে বাতাস নেই। পরিবেশ গুমোট হয়ে আছে। বিন্নিদের টয়লেট বাড়ির পেছনে ঝোপের কাছে। জায়গাটা কেমন ছমছমে। তারাবানু কুপির স্বল্প আলোয় পা ফেলছেন। বিন্নি উনার পেছনে পেছনে হেঁটে টয়লেট থেকে ফিরল। চৌকিতে উঠে তারাবানু ফু দিয়ে আলো নিভিয়ে বললেন,
“এইবার ঘুমা। কালদিন বাদে আবার তোর হউড় বাড়ির মানুষ আইবো তোরে নিতে। পিডা বানানির লইগ্যা ঢেকিতে চাইল ভাঙাইতে হইব। হাঁটুতে জোর পাই না। তুই মায়ের লগে ঢেকি পাড়াইয়া দিস।”
তারাবানু পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। কিছু সময়ের ব্যবধানে ঘুমিয়েও পড়লেন। বিন্নির চোখে ঘুম নামে না। সে কান খাঁড়া করে রাখে। থেকে থেকে তারাবানুর নিশ্বাসের ভারী শব্দ কানে সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছে। বিন্নির মনে হলো দাদির নিশ্বাসের শব্দ ঘুটঘুটে আঁধারে যেন ফিসফিস করে নিগূঢ় কোনো রহস্য রচনা করছে। কিছুক্ষণ পর আবারো কবুতরের ডাক কানে আসতেই বিন্নি সতর্ক হয়ে গেল। দাদিকে ভালোমতো পরখ করে সে ধীর গতিতে বিছানা ছাড়ল। বিন্নিদের বাড়ি টিনের হলেও দাদির ঘরখানা মাটির। অনেকদিনের পুরোনো ঘর। ঘরের দরজা টিনের। বিন্নি শব্দ না করার আপ্রাণ চেষ্টা করে খালি পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। উঠানে পা দিয়ে শাড়ির কুচি সামলে চঞ্চল পায়ে ছুটে গেল বিলের দিকে।
বিন্নি বিলের ধারে পৌঁছাতেই হঠাৎ একটি ছায়ামূর্তি নড়ে উঠল। ছায়ার অধিকারীকে চিনতে অসুবিধা হয়না তার। নারিকেল গাছের পেছন থেকে বেরিয়ে এসে রাজিব বলল,
“আমি তো ভাবছিলাম তুমি আইজ আইবা না।”
“দাদি জাইগা গেছিল। ঘুমানোর পর বাইর হইছি।”
“এত লুকানোর কী আছে? আমি কী তোমার পর?”
“তো তুমি লুকাইয়া বিলের ধারে আইছো ক্যান? বাড়িত আইতে পারো নাই?”
রাজিব উত্তর না দিয়ে বিন্নির হাত চেপে ধরে ঘাটে নামতে শুরু করল। বিন্নি চাপা চিৎকার করে বলল,
“আরে আস্তে নামো। পইড়া যামু।”
“এই রাজিব থাকতে তোমার কিছু হইবো না।”
ঘাটে একটি ছোট ডিঙি নৌকা বাঁধা। তাতে একটি হারিকেন জ্বলছে মৃদু তেজে। রাজিব বিন্নিকে কোলে তুলে নৌকাতে উঠিয়ে দিলো। এরপর নিজে উঠে বৈঠা বাইতে শুরু করল। বিলের একপাশে পানিতে বড় বড় ঘাস জন্মেছে। ডিঙি নৌকা সেখানে গিয়ে থেমে গেল। রাজিব উঠে মাঝ বরাবর বসা বিন্নির পাশে বসে ওর হাত ধরল। বলল,
“মুখ ফিরাইয়া আছো ক্যান? তোমারে দেখতে নদী পাড়ি দিয়া আইলাম। দেখতে দেও।”
বিন্নি ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে বলল,
“বিয়া করা বউরে চুপিচুপি দেখতে আহো ক্যান?”
“জানো তো মায় প্রতিদিন আওন পছন্দ করে না। আমি আইলেই মায়ের কাছে খবর যাইব। বউ পাগল হইছি, বউয়ে তাবিজ করছে এডি কইয়া কষ্ট পাইব। কিন্তু আমি যে তোমারে না দেইখা থাকতে পারি না। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হইলো রাইতের আন্ধার। আমিও খুশি, মাও খুশি।”
“আম্মায় এহনো আমারে মাইনা নিতে পারে নাই, তাই না?”
“তেমন কিছু না। আমার মামারে তো দেখছো?”
“ভালোবাইসা বিয়া করছিল। সংসার টিকল না। মামী ছাইড়া দিয়া আরেক লোকের লগে ভাগল। মামাও শোকে পাগল হইলো। মা মামারে অনেক ভালোবাসে তো। তাই মামার এই অবস্থা দেইখা মনে করে ভালোবাসার বিয়া সুখের হয় না। আমি তো জোর কইরা, হুমকিধামকি দিয়া রাজি করাইয়া তোমারে বিয়া করলাম। তুমি কষ্ট পাইয়ো না। মায়ের বয়স হইতাছে তো। এমনে মনডা তুলার মতোন নরম। একলগে থাকতে থাকতে দেখবা তোমার উপরেও নরম হইছে।”
বিন্নি কিছু বলল না। বছরখানিক প্রেমের পর ওদের বিয়ের তিনমাস হলো সবে। শ্বাশুড়ি মানুষটা সারাদিন গালমন্দ করলেও বিন্নির খুব একটা মন্দ লাগে না। আজ নয়দিন সে বাপের বাড়ি এসেছে। মাঝে তিনদিন রাজিব থেকে গেছে। আর তিনদিন রাতের আঁধারে চলে এসেছে দেখা করতে। কবুতরের ডাক নকল করার চেষ্টা করে সে বিন্নিকে সংকেত পাঠায় দেখা করতে।
বিল গিয়ে মিশেছে নদীর সঙ্গে। নদীর দিক থেকে স্রোতের সঙ্গে আসা মৃদু বাতাসে বিন্নির শাড়ির আঁচল উড়ছে। হারিকেনের ম্লান আলোয় ওর মুখটা সোনা কমল আভা ছড়াচ্ছে। যা রাজিবের হৃদয়ে বিলের জলের চেয়েও অধিক উত্তাল স্রোতের সৃষ্টি করে। রাজিব আরেকটু গা ঘেঁষে বসতে বিন্নি লজ্জায় নুইয়ে পড়ল। রাজিব ওকে দুইহাতের মাঝে বন্দি করে বলল,
“ও বউ, আমার জোনাকপরী, জলদি বাড়িত ফিরা আহো। দূরত্ব যে সয় না।”
“দেখতে দেখতে দিন চইলা যাইবো।”
“বাত্তির নিভাইয়া ঘুম দিবা।”
“তার জন্য আমার এই জোনাকিরে দরকার। আমার ঘরে হারিকেন, কুপি না জ্বলুক। কিন্তু জোনাকির টিপটিপ আলো না জ্বললে যে মন ভরে না। ঘুম আহে না।”
“এইবার তো মনে হইতাছে আম্মায় ঠিকই কয়।
তুমি বউ পাগল হইছো। কয়দিন পর বাইরের মাইনষেও কইবো।”
বিন্নি শব্দ করে হেসে ফেলল। রাজিব কপট রাগ দেখাবার ভান ধরে বলল,
“বউ আমার, আমি পাগল হই আর যাই হই, অধিকার আছে।”
“এত ভালো কেমনে বাসো? ক্লান্ত লাগে না?”
“একটুও না। আরো শক্তি আহে শইল্যে।”
“আমি তো আহামরি রূপসী কেউ না।”
“আমার কাছে তো রূপসী। আর কারো কাছে হওন লাগব না।”
রাজিব বিন্নির খোপা খুলে তাতে কিছুক্ষণ মুখ ঘষে। অনেকটা সময় একান্ত নীরবে অতিবাহিত হওয়ার পর বিন্নি আহ্লাদি স্বরে বলে,
“ও মাঝি ভাই, বেহান হইতে তো আর দেরি নাই। নাও ঘুরাও। গন্তব্যে পৌঁছায় দিয়া আহো।”
রাজিবও দুষ্টুমির ছলে উত্তর দিলো,
“বিনিময়ে কী দিবা, সখী? এই মাঝি কিন্তু বাকিতে কাম করে না।”
চাঁদহীন, তারা শোভিত আকাশের নীচে টলটলে জল ঠেলে ডিঙি নৌকাখানা গন্তব্যের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করলো। বৈঠা চালনার ফলে সৃষ্ট ছলাৎ ছলাৎ শব্দে দুজনের মন গহীন অনুভূতিতে বিবশ হয়ে রইলো। ঘাটে নাও ভিড়িয়ে রাজিব বিন্নির দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচায়।
“আমার পারিশ্রমিক?”
রাজিব কাদায় নেমে বিন্নিকে কোলে তুলে ডাঙায় এনে নামায়। বিন্নি রাজিবের গলা ছাড়ার আগে হুট করে তার খোঁচাখোঁচা দাড়িতে ঠোঁট ছুইয়ে দিলো। রাজিব কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগেই ছুটে দূরে সরে বলল,
“এইবার ভাগো মাঝি। নাইলে বেহানের আগে গেরামে পৌঁছাইতে পারবা না। পরে আম্মায় দুইজনরেই গাইল দিবো।”
“আরে খাঁড়াও। আরেকটু থাকো।”
“উহু। আর কোনো পাগলামি করবা না। কাইল নদী পাড়ি দিয়া এতখানি পথ আহনের দরকার নাই।।এক্কেরে পরশু আইয়া আমারে নিয়া যাইবা।”
রাজিবের কথার বিপরীতে বিন্নি খিলখিল করে হাসে। এরপর ছুটে বাড়িতে ঢুকে যায়। উঠানে পা পড়তেই গতি কমিয়ে চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আব্বার ঘর থেকে নাক ডাকার মৃদু শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বিন্নি পা টিপে টিপে দাদির ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। বিছানায় উঠে সন্তুষ্টির সঙ্গে চোখ বুঝতেই তারাবানু বললেন,
“গন্ধ পাইলে কী হয় উত্তর পাইছোসলো বিন্নি? নতুন বউয়ের গন্ধ পাইলে মানুষ সাত সাগর, তেরো নদী পাড় হইয়া ছুইটা আহে। এই সুবাস জাগতিক সব সুবাসরে হার মানায়।”
বিন্নি লজ্জা পেয়ে দাদির বুকে মুখ লুকায়।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply