আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন আমার বাবা মারা যান। মা সড়ক দূর্ঘটনায় এক পা হারিয়ে ফেলেন। খুড়িয়ে খুড়িয়ে বাসার সব কাজ তিনিই সামলান। আমি টুকটাক রান্নার কাজে সাহায্য করি। আমরা এক ভাই এক বোন। আমার নাম তানিয়া। আর আমার বড় ভাইয়ের নাম তুষার। আমার বড় ভাই তখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র।
বাবা মারা যাওয়ার পরে আমার বড় ভাই সংসারের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নেয়। যারফলে তার আর পড়াশোনা করা হয় না।
বাগেরহাটের মতো মফস্বল শহরে আমাদের নিজেদের বাড়ি থাকার সুবাদে, ভাইয়ার অল্প আয়েই আমরা বেশ ভালো ভাবেই খেয়ে পরে ছিলাম। কিন্তু বিপত্তি ঘটে আমার পড়াশোনা নিয়ে। যদিও ভাইয়া মনেপ্রাণে চাচ্ছিলো আমি পড়াশোনা করি। কিন্তু তার সামান্য আয়ে সেটা সম্ভব হচ্ছিলো না। আর তাই ভাইয়া নিজে এলাকা ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টসে চাকরি করে। ভাইয়া এতোসব ত্যাগ করছিলো শুধুমাত্র আমার জন্য। যাতে আমি পড়াশোনা ঠিকমতো করতে পারি। আমার বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল আমাকে ডাক্তারি পড়ানোর। আর সেই স্বপ্ন কে বাস্তবায়ন করতেই আমার ভাইয়া এতো কষ্ট করছে।
এভাবে দেখতে দেখতে পার হয় ৪টি বছর। আমি এসএসসি তে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে পাশ করি। আমার ভাইয়া সেদিন এতো খুশি হয়েছিল যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। ইন্টারেও আমি সায়েন্স নিয়ে পড়ি। কারণ আমাকে ডাক্তারি পড়তে হবে। ভাইয়া তখন আমার পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খেয়ে যান। অফিসে রাত জেগে ওভার টাইম ডিউটি করেন। এক্সট্রা কিছু টাকা পাওয়ার আশায়। অনেক বেশি পরিশ্রম করার ফলে দিন দিন ভাইয়ার শরীরের অবনতি ঘটছে। কিন্তু সেসব সে হাসি মুখেই এড়িয়ে যেতো। তার কষ্ট টা আমাকে কখনোই বুঝতে দিতো না। আর আমিও আমার ভাইয়ার কষ্ট কে সার্থক করে তুলতে দিনরাত এক করে পড়াশোনা করছি।
ইন্টার পরীক্ষার ঠিক ১ মাস আগে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমাকে ডাক্তার দেখানো হলে, ডাক্তার জানান অনেক বেশি দুশ্চিন্তা করার ফলে এমন টা হয়েছে। আমার অসুস্থতার কথা শুনে ভাইয়া এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসেন।
এই এক সপ্তাহ ভাইয়া আমাকে একটুও বই পড়তে দেননি। সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে গিয়েছেন। এটা সেটা খাইয়েছেন। অনেক গল্প শুনিয়েছে। মাত্র এক সপ্তাহেই আমি সুস্থ হয়ে উঠি। আর কোনো দুশ্চিন্তা কাজ করে না আমার মাঝে।
অবশেষে ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে মেডিকেলের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। ইন্টারেও ভালো রেজাল্ট করি। এখন শুধু একটাই স্বপ্ন, মেডিকেলে চান্স পাওয়া। তাহলে এতোদিন আমার ভাইয়ার কঠোর পরিশ্রম আর আমার চেষ্টা সার্থক হবে।
ঢাকা মেডিকেলে চান্স হয় আমার। সেদিন আমার থেকে আমার ভাইয়া যেন বেশি খুশি হয়েছিলেন। ভাইয়া সেদিন এতোটাই খুশি হয়েছিলেন যে রাস্তায় সামনে পাচ্ছিলো, তাকেই বলছিলেন “জানেন আমার ছুটকি ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে।” ভাইয়া আমাকে আদর করে ছুটকি বলে ডাকেন।
সংসারের দায়িত্ব এবং আমার পড়াশোনার খরচ চালাতে ভাইয়া এতোটাই মগ্ন ছিলেন যে, নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি কখনোই কোনো পরিকল্পনা করেনি। আমি মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার দুমাস পরে আমার মা মারা যান৷ কিন্তু আমি সেদিন নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়েছিলাম। কারণ আমি যদি ভেঙে পড়ি তাহলে আমার ভাইয়া আরো বেশি কষ্ট পাবেন। ভাইয়ার কষ্ট কিছু টা লাঘব করতে পড়াশোনার পাশাপাশি আমি একটা টিউশনি পড়াতে শুরু করি।
অন্যান্য দিনের মতো একদিন বিকালে আমি টিউশনি পড়ানোর উদ্দেশ্যে বের হই। ছাত্রীর বাড়িতে গিয়ে জানতে পারি তারা শপিংয়ে গিয়েছে। বাড়িতে তখন ছাত্রীর বড় ভাই আর তার কয়েক জন বন্ধু ছিল। আমি চলে আসার সময় তারা আমাকে বাজে প্রস্তাব দেয়। আমি অসম্মতি জানালে তাদের মধ্যে একজন আমাকে জাপটে ধরে বেডরুমে নিয়ে আসে। তারা ছিল ছয়জন। এতোজন ছেলের সঙ্গে আমি শক্তিতে পেরে উঠবো না। আর তাই আমি তাদের হাতে পায়ে ধরে আকুতি মিনতি করতে থাকি।
কিন্তু তাদের মনে সামান্যতম মায়া হয় না। তখন আমি জোরে চিৎকার করতে শুরু করলে আমার মুখ শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হয়। আর সাউন্ড বক্সে ফুল ভলিউমে গান ছেড়ে দেয়। যাতে বাইরের কেউ আমার গোঙানি শুনতে না পারে। তারা ক্ষুধার্ত জানোয়ারের মতো আমার উপরে পালাক্রমে নির্যাতন চালাতে থাকে৷ একটা সময় আমি আর সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
আমার যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমি নিজেকে আমাদের বাড়িতে দেখতে পাই। পাশে আমার ভাইয়া বসে আছে। আমার জ্ঞান ফেরার পরে আরো দুদিন কেটে যায়। ভাইয়া সারাক্ষণ আমাকে চোখে চোখে রাখেন। ভাইয়া বাইরেও বের হয় না। পিছে আমি কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলি সেই ভয়। এভাবে একসপ্তাহ কেটে যায়। একদিন বিকালে ভাইয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করে।
ছুটকি তোর এই অবস্থার পিছনে কে কে দায়ী শুধু তাদের নাম গুলো আমাকে বল।
আমার মুখ দিয়ে তখন কোনো শব্দ বের হচ্ছিলো না।আমি ভাইয়া কে কিছুই বলতে পারি না। ভাইয়া কখনোই আমার সামনে কান্না করে না। কিন্তু প্রতিদিন গভীর রাতে আমি খেয়াল করেছি ভাইয়া বাথরুমে ঢুকে পানির কল ছেড়ে দিয়ে ফুপিয়ে কান্না করে। পানির শব্দের আড়ালেও ভাইয়ার কান্না আমার কানে এসে পৌঁছায়। তখন আর আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারি না। ভেতরে ভেতরে গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করতে থাকি। যারা আমার সাথে এই অন্যায় কাজ করেছে তারা এতোটাই প্রভাবশালী যে তাদের নামে মামলা করেও কোনো লাভ হবেনা। উল্টো আমারই সম্মানহানি ঘটবে। আবার ভাইয়াকেও আমি এমন অবস্থায় সহ্য করতে পারছিলাম না। আবার ভাইয়া কে আমি মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছিলাম না।
অবশেষে আমি চিরকুটে সবটা লিখে ভাইয়া কে দেই। সেদিন বিকালে ভাইয়া ৪ টা খরগোশ এর ছানা নিয়ে আসেন। ভাইয়া জানতো খরগোশ আমি অনেক পছন্দ করি। ভাইয়া খরগোশ দিয়ে বলে ওগুলোর দিকে যেন খেয়াল রাখি। ভাইয়া জরুরি কাজে একটু বাহিরে যাচ্ছেন।
আমাকে ব্যস্ত রাখতেই যে ভাইয়া খরগোশ গুলো এনেছে সেটা খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি।
একসপ্তাহ পরের কথা। রাজধানীর একটি লেকে ছয়জন যুবকের নগ্ন লাশ পাওয়া গিয়েছে। লাশের সঙ্গে গোপনাঙ্গ এবং চোখ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেউ যে তীব্র ঘৃণা নিয়ে তাদের কে হত্যা করেছে সেটা সুস্পষ্ট। পুরো দেশ আতঙ্কে তটস্থ হয়ে আছে। কারণ তাদের মধ্যে দুজন এমপির ছেলে এবং একজন মন্ত্রীর ছেলে। বাকি তিনজনের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ও বেশ ভালো। আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরেছি এই প্রতিশোধ কে নিয়েছে। ভেবেছিলাম আমি আত্মহত্যা করবো। কিন্তু পরক্ষণে আবার মত বদলে নিয়েছি।
কারণ আমাকে আমার ভাইয়ার স্বপ্ন সত্যি করতে হবে। যেভাবেই হোক আমাকে ডাক্তার হতেই হবে। যেন আমার ভাইয়া বুক ফুলিয়ে সবাই কে বলতে পারে, “জানেন আমার ছুটকি আজ ডাক্তারি পাশ করেছে। আমার ছুটকি এখন ডাক্তার।”
আমার লিখা প্রথম গল্প এটা।
সবাই লিখার ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দিবেন।
ধন্যবাদ।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply