আমার স্বামী অনিক এই নিয়ে আজ সপ্তমবারের
মতো মাথা নেড়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
— শম্পা, তুমি অসুস্থ। খুব অসুস্থ..।
আমি বিছানায় বসে মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে, শান্ত ভঙ্গিতে বললাম,
— হতে পারে । তবে কিছু কিছু অসুখ ভেতরে লালন করতেই আমার ভালো লাগে। আমি চাই না আমি সেরে উঠি।
অনিক কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। রাগে ওর মুখ লাল হয়ে গেছে ।
মনে হলো, অতিরিক্ত বিরক্তিতে সে হয়তো কথা খুঁজে পাচ্ছে না
আমি বিছানা থেকে নেমে কঙ্কার রুমে চলে এলাম।
আমার পাঁচ বছরের মেয়ে কঙ্কাবতী ঘুমাচ্ছে। গোলাপি ফুল আঁকা চাদরের বিছানার মাঝখানে লাল কম্বল গায়ে ওকে ঠিক যেন রূপকথার গল্পের কোন এক রাজকন্যা বলে মনে হচ্ছে।
অনিকের মতো আমিও আজকাল বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, আমার অসুখ করেছে। ভয়াবহ কোন অসুখ। কঙ্কা বিছানায় শুয়ে আছে। আমি ওর ফুলের মতন সুন্দর, পবিত্র মুখটার দিক থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
সমস্যা হলো, কঙ্কাকে কেউ সুন্দর বললে আমি সহ্য করতে পারি না। শুনে খুশি হবার বদলে ভয়ানক বিরক্ত লাগে । মাঝে মাঝে উল্টো পাল্টা রিয়্যাক্টও করে বসি আমি । মেয়ে বড় হচ্ছে, সাথে আমার সমস্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে।
অনিক আজ আমার সাথে ভয়ানক রাগ করেছে এর পেছনে কারণও সেটাই । আমার ননদ তরী
বিকালে এসেছিল ওর বান্ধবী জুঁইকে নিয়ে। কঙ্কা সে সময় বসার ঘরে সোফায় বসে ওর ডল হাউজ নিয়ে খেলছিল। জুঁই কঙ্কার গাল টিপে আদর করে বলল,
— তরী, ওতো দেখছি পুরাই একটা পরি । বড়ো হলে সব পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দেবে দেখিস.. !
তরী গর্বিত মুখে হাসতে হাসতে বলল,
— দেখতে হবে না তার ভাস্তি ! ছেলেরা ওর রূপে দিওয়ানা হবে না তো কার রূপে হবে… .?
আমি ফট করে কথার মাঝে বলে বসলাম,
— রূপ – সৌন্দর্য আর পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দেয়া এটাই কি মেয়েদের সব থেকে বড় যোগ্যতা তরী ? গুন বলেও যে একটা জিনিস আছে তার কি কোন মূল্য নেই ?
তরীর মুখ অপমানে লাল হয়ে গেল। সে মুখ গোমড়া করে বলল,
— এইটুকু মেয়ে এখনই ওর গুন কিভাবে দেখব ভাবী ? বড় হোক তারপর না হয় দেখা যাবে।
আমি ভদ্রতার ধার না ধেরে বললাম,
— কিন্তু ওর সামনে ছোটোবেলা হতেই যদি রূপ রূপ করে সেটাই মুখ্য বিষয় করে তোল তোমরা, গুন বলেও যে একটা জিনিস আছে তার কদর করতে কি মেয়েটা শিখবে কখনো ?
তরী অপমানে উঠে দাঁড়ালো। নাস্তা না খেয়েই জুঁইকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
ওরা বেরিয়ে যাবার পর , আমারও মন খারাপ হলো একটু । ব্যাপারটা খুব খারাপ হলো হয়তো ! এভাবে না বললেও পারতাম।
কঙ্কার স্কুলেও এমন ঘটনা ঘটিয়েছি আমি । স্কুলের সীমা মিস প্রথম দিন যখন কথায় কথায় বলছিলেন,
— বাহ, ওকে নিয়ে পাঁচটা খুব সুন্দর মুখ ভর্তি হলো এবার এই ক্লাসে।
আমি বলে বসলাম,
— শুরুতেই বাচ্চাদের সুন্দর আর অসুন্দর এই দুই ভাগে ভাগ করে জীবনের শিক্ষা শুরু করলে সেটা কতটা সুশিক্ষা হবে আমার সন্দেহ আছে।
সীমা মিস শীতল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এরপর থেকে অন্য অভিভাবকদের সাথে কথা বললেও আমায় তিনি এড়িয়ে চলেন।
আমার এই স্বভাব নিয়ে সংসারেও কম অশান্তি হচ্ছে না। তরীর কাছ থেকে সবটা শুনে আজ অনিকও মন খারাপ করেছে ভীষণ ।
সকালে নাস্তা না খেয়ে রাগ দেখিয়ে সে অফিসে চলে গেল। আমি বেলকনিতে চা হাতে এসে দাঁড়ালাম। কঙ্কার স্কুল সাড়ে ন’টা হতে শুরু, এখন মাত্র সাতটা বাজে।
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কঙ্কাকে আমি সব সময়ই খুব সাধারণত সাজ, পোশাকে রাখি। দামি পোশাক বা সাজসজ্জা হতে দূরে। সে আমার সাজের জিনিসপত্রের দিকে হাত বাড়ালে, অজানা ভয়ে বুক কেঁপে উঠে আমার । সবাই বিরক্ত হয়, ভাবে বাড়াবাড়ি করছি আমি।.. কিন্তু এর পেছনের কাহিনীটা ওদের অজানা।
আমাদের তিনবোনের মধ্যে আমি ছিলাম সবচেয়ে অসুন্দরী। আমার বড়ো বোনদের মতো আমার গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা নয় । ছোটবেলায় থাকতামও খুব সাদামাটা । আমার ধারণা অসাধারণ রূপবতী বোনদের মাঝে আমায় হয়তো সব সময় ভীষণ বেমানান দেখাতো, সেই গল্পে পড়া কুৎসিত হাঁসের ছানার মতোই।
স্কুলে পড়তে একবার বাড়িতে দূর সম্পর্কের এক মামা বেড়াতে এলেন। আমায় দেখে উনার চোখ কপালে উঠে গেল। মা’কে ডেকে বললেন,
— ও শালু, তোর ছোট মেয়ে এতো কালো হয়েছে কেনরে ? এটা তোর নিজের মেয়ে তো ? নাকি পালক এনেছিস একে ?
মা বিব্রত হয়ে মাথা নীচু করে রইলেন। আমি কেন কালো হয়েছি এর উত্তর মা’র জানা ছিল না।
খুব ছোটবেলা হতেই আমি বুঝতাম খুব মূল্যবান কোন কিছুর কমতি আছে আমার । আমি বেড়ে উঠছিলাম খুব হীনমন্যতার মধ্যে। বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলে আমি সহজে তাদের সামনে যেতাম না।
আরেকবারের ঘটনা, সে সময় কলেজে পড়ি। বড়ো দুই বোনের তখন বিয়ে হয়ে গেছে। পাড়ার এক আন্টি একদিন ওদের বিয়ের ছবি দেখতে দেখতে আমায় বললেন,
— শম্পা, তোমার বড় দুই বোন এতো সুন্দর ! তুমি তাদের মতো রূপবতী নও, অসুন্দরী বলে তোমার মন খারাপ হয় তাই না ? দুঃখ করেও তো আসলে কিছু করার নেই।
এমন সরাসরি প্রশ্নে ভীষন বিব্রত আমি সেদিন মাথা নীচু করে ছিলাম। আমার বোনেরা সুন্দরী আমি অসুন্দর, খারাপ .. এই চিন্তা আর হীনমন্যতা আমায় সর্বক্ষণ কুঁড়ে খেত।
অথচ আমার বাকী বোনদের তুলনায় আমি মেধাবী ছিলাম সেটা কখনো কারো চোখে পড়ত না।
এমন আরও ছোট ছোট কিছু ঘটনা আমার ভেতরটা বদলে দিল এক সময়। কলেজ পড়ুয়া আমি বিশ্বাস করতে শুরু করলাম পৃথিবীতে রূপ, সৌন্দর্য আর বাহ্যিক চাকচিক্যের চেয়ে বড়ো আর কিছু নয়।
আমি নিজেকে সুন্দরী হিসেবে গড়ে তুলতে মরিয়া হয়ে উঠলাম । সাদামাটার খোলস ছেড়ে স্মার্ট আর আধুনিক হতে সে সময় বাবার থেকে নানা সময় নানা মিথ্যে কথা বলে বলে টাকা নিয়ে পার্লারে নিজের পেছনে খরচ করতে লাগলাম আমি । আগের মতো সাধারণ পোশাকে থাকি না। বাবা, মাকে চাপ দিয়ে দামী জামা কাপড় আদায় করে, দামি কসমেটিকস আর প্রসাধনীতে নিজেকে সুসজ্জিত রাখতে শুরু করলাম সব সময় । দ্রুত পরিবর্তন হয়েছিল হয়তো আমার। রাস্তায় বেরুলে লোকজন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে , পরিচিতরা রূপের রহস্য জানতে চাইত ; গর্বে বুক ফুলে উঠত আমার। আমি খুব ফর্সা হয়তো হয়ে যাইনি কিন্তু নিয়মিত পরিচর্চায় কিছু জৌলুষ এসেছিল আমার চেহারায়। মেকাপ আর চাকচিক্যের নীচে ঢাকা পড়েছিল আমার শ্যাম বর্ন।
এ সময় সাজসজ্জা করে নিজেকে সুন্দরী হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরার এক ভয়ানক নেশা পেয়ে বসলো আমাকে। ফেসবুক খুলে প্রতিদিন নিত্যনতুন ছবি আপলোড দেই । এক পোশাক দ্বিতীয়বার পড়ি না। ছবি দেখে বন্ধুরা প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দেয় আমায়। আমি পূর্বের সব অপমানের শোধ তোলার তীব্র আনন্দ পাই।
দিনে দিনে যেন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলাম, সাথে আত্মকেন্দ্রিকও। বেছেবেছে বড়লোক সব বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে উঠাবসা করতে শুরু করলাম। আমার চাহিদাও হয়ে উঠলো লাগামহীন। প্রথম প্রথম আমার বাহ্যিক পরিবর্তন দেখে বাবা-মা খুশিও হয়েছিলেন হয়তো কিন্তু এখন এর ভার বইতে না পেরে মন খারাপ করে থাকেন তারা।… আমি পাত্তা দেই না। পড়ালেখাকে আমার বড্ড মূল্যহীন বলে মনে হয়। দিনে কয়টা ছেলে আমায় দেখে ক্রাশ খেলো, কয়জন মেয়ে ঈর্ষা করল সেই হিসেব কষেই দিন কাটে আমার।
আমি আমার সব মানবিক গুনগুলো যেন হারিয়ে ফেলেছিলাম সে সময়। আমাদের মধ্যবিত্ত সংসারের টানাপোড়েনের গল্প শুনলে আমি বিরক্তবোধ করি। বাবা সাধ পূরণ করতে অপারগ হলে আমি ক্ষেপে যাই। তাকে আমার অযোগ্য, পরাজিত পিতা বলে মনে হয়। কেউ বোঝাতে আসলেও আমার ভয়ানক রাগ লাগে। আমি আগের সেই আনন্দহীন একঘেয়ে অপমানের জীবনে আর ফিরে যেতে চাই না। এভাবেই দিন কাটছিল।
একদিন বান্ধবীর হলুদে সাজব বলে টাকা চেয়েছিলাম। মা জানালেন মাসের শেষ , পার্লারের খরচ দেবার মতো টাকা নেই তার হাতে। আমি মুখের উপর বললাম,
— কী দুর্ভাগ্য আমার ! এমন ফকিরের মেয়ে হয়ে জন্মেছি আমি।
বাবা আঁড়ালে দাঁড়িয়ে সেদিন শুনেছিলেন সে কথা। ওই রাতেই উনার বুকে ব্যথা উঠেছিল। হাসপাতালে নিতে নিতে মৃত্যু।
আর সেই মৃত্যু সংবাদ পাওয়া মাত্র আমার যেন হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে এলো, বাস্তবে ফিরে এলাম আমি ।
… কী করেছি আমি এতোদিন ? প্রচণ্ড অপরাধবোধ আমার ভেতরটা কুড়ে কুড়ে খেতে লাগলো..!
বাবার মৃত্যুর জন্য আমি নিজেই কী দায়ী নই ?
সুন্দর, অসুন্দরের যে হিসেবটা এতোদিন মিলাতে পারছিলাম না। আচমকা সেদিনই যেন হিসেবটা মিলাতে পারলাম ।.
… আসলে আমি কোনকালেই অসুন্দর ছিলাম না। আমি আগেও সুন্দর ছিলাম এখনো তাই আছি। আসলে ভুল ছিলেন তারা, যারা কেবল বাহ্যিক চাকচিক্য আর রঙ দেখে একজন মানুষকে বিচার করেছিলেন।
তবে, এখন আমি জানি প্রকৃত সুন্দর মানুষ কাকে বলে। সত্যিকারের সুন্দর মানুষ তাঁরাই যাদের বাহির নয়,.. ভেতরটা সুন্দর।
আর সর্বপ্রথমে সেই ভেতরের মনটার সৌন্দর্য বৃদ্ধিরই চেষ্টা করা উচিত সবার ।
আমি চাই আমার মেয়ে মানবিক গুনসম্পন্ন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক।
হ্যাঁ,আমার মেয়েকে কেউ সুন্দর বললে আমি সহ্য করতে পারি না। ভয়ে আমার অন্তর কেঁপে উঠে।…. ভাবনা হয়। ও কেবল রূপের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে, রূপসর্বস্ব মানুষ হয়ে গড়ে উঠুক আমি চাই না…! আমি উদভ্রান্তের মতো আচরণ করি।
আমার স্বামী গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
— শম্পা তুমি অসুস্থ। খুব অসুস্থ…।
আমি শান্ত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে সায় দেই। তবে এই অসুখ থেকে মুক্তি পেতে আমার ইচ্ছে জাগে না।
*****
কঙ্কাকে নিয়ে আমি স্কুল হতে ফিরছি। রিকশা চালক একজন মধ্যবয়সী পুরুষ । প্রচণ্ড গরমে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে আছেন। প্রতিদিন স্কুল হতে ফেরার সময় কঙ্কা মোড়ের দোকান থেকে দু’টো সিঙ্গারা কেনে । সে সিঙ্গারা খেতে ভীষণ ভালোবাসে। আজও রিকশা থেমে আছে, আমি সিঙ্গারা কিনছি। আমার পাঁচ বছরের মেয়ে হঠাৎ বলল,
— মামনি, আজ আমার সিঙ্গারা দুটো যদি অন্য কাউকে খেতে দেই তুমি কী রাগ করবে ?
— কাকে দিতে চাচ্ছ মা ?
— এই চাচ্চুকে ।
সে আঙুল দিয়ে আমাদের রিকশা চালককে দেখালো।
আমি চমকে উঠলাম।
… তাইতো… রিকশা চালক অনেকক্ষন ধরেই দোকানের সিঙ্গারাগুলোর দিকে খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন।… নিশ্চয়ই খুব ক্ষুদার্থ.. । কেন এতোক্ষন আমার চোখে পড়েনি এটা ? ..
কি আশ্চর্য..!
আমার ছোটবেলার সেই দূর সম্পর্কের মামা, পাড়ার সেই আন্টি অথবা তরী বা সীমা মিসের মতো মানুষেরা হয়তো কেবল সুন্দর সন্তান জন্ম দেবার আনন্দ কেমন তা ধারণায় রাখেন,… কিন্তু একজন মানবিক গুন সম্পন্ন সন্তান জন্ম দেবার আনন্দ যে তার চেয়েও বহুগুনে বেশি সেই সত্য কি তারা আদৌ কোনদিন জানবেন ?
রিকশা চলতে শুরু করেছে। কঙ্কাকে জড়িয়ে ধরে আমি বসে আছি। তীব্র আনন্দে আমার চোখ বার বার ভিঁজে উঠছে।
Leave a Reply