মানুষটার সাথে এত বছর পর এভাবে দেখা হবে, সুরমা কোনোদিন ভাবতেও পারেননি…।
তিনি গিয়েছিলেন পূবালী ব্যাংকের মিরপুর শাখায়, টাকা তুলতে । তার স্বামী আবেদ গত দুই বছর ধরে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ নানা রকম রোগ নিয়ে বিছানায় মোটামুটি শয্যাশায়ী।
টাকা তোলা, বাজার-ঘাট আজকাল সব এক হাতে তাকেই করতে হয়। সুরমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ময়না। ময়নার বয়স এগারো বছর। সাহায্যকর্মী হলেও তিনি তাকে নিজের মেয়ের মতোই দেখেন।
সেদিন ব্যাংকে বেশ ভীড় ছিল। লাইনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষন ধরেই খেয়াল করছিলেন দূরে অন্য লাইন থেকে কালো শার্ট পরা মধ্যবয়সী একলোক… একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ।
সুরমা একইসাথে অবাক ও বিরক্ত হলেন । যথেষ্ট সুন্দরী হলেও তিনি কোন অল্প বয়সী নারী নন, তার বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি । বড় মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন, ছোট ছেলে ভার্সিটিতে পড়ে। এই বয়সে এসে পুরুষ মানুষের এইসব আচরণ তাকে ভয়াবহ অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।
কাজ শেষ করে ময়নাকে সাথে নিয়ে তিনি ব্যাংক থেকে বের হতে এগুতেই লক্ষ্য করলেন, গেটের কাছে সেই লোকটাই দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে ইস্ত্রি করা দামি শার্ট, মুখে কাঁচা পাকা দাঁড়ি । চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা।
লোকটা তাকে দেখে এগিয়ে এলো ।
— কেমন আছ সুরমা ? আমাকে চিনতে পেরেছ ?
কয়েক মুহূর্তের জন্য সুরমার মনে হলো তার হৃদপিন্ডটা যেন গলার কাছে আটকে গেল।
সে কি করে এই লোককে চিনতে পারল না ! যদিও চুলগুলো সাদা হয়েছে, মুখে দাড়ি, চোখে চশমা। কিন্তু সেই একই চেহারা, চোখগুলোও আগের মতোই আছে ।
— সুরমা,.. আমি বারেক। ডুমুলিয়া গ্রামের।
বারেক একটা কার্ড তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
— এটা আমার কার্ড। এখানে আমার ফোন নাম্বার আছে। রাখলে খুশি হব।
সুরমা নিজের হতভম্বভাব কাটিয়ে নিয়ে বিনা কারণে গলাটা কর্কশ করে বললেন,
— মাফ করবেন , আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না।
বারেককে পাশ কাটিয়ে তিনি দ্রুত একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়লেন ।
…বারেক, হ্যাঁ.. এটা সেই ডুমুলিয়া গ্রামের বারেকই। কত বছর পর আবার দেখা হলো !.. হিসাব কষতে গিয়ে সুরমা আশ্চর্য হলেন । হ্যাঁ, তা প্রায় ত্রিশ বছর তো হবেই । অথচ একটা সময় ছিল যখন দুইদিন বারেককে না দেখলে তিনি কেঁদে বালিশ ভেঁজাতেন।
স্কুলে তার থেকে দুই ক্লাস উপরে পড়ত বারেক। তাদের পাশের গ্রামের ছেলে। শ্যাম বর্ন, কোকঁড়া চুল। ভালো গান গাইত, ফুটবল খেলত । স্কুল থেকে ফেরার পথে সুরমার পেছন পেছন প্রায়ই সাইকেল চালিয়ে আসত সে । লোকমুখে তিনি জেনেছিলেন বারেক তাকে পছন্দ করে । প্রথম প্রথম তিনি বারেককে পাত্তা দেননি। কিন্তু কলেজে উঠতে উঠতে তাদের সম্পর্কটা কেমন কেমন করে যেন ভালোবাসায় রূপ নিয়েছিল ।
সুরমা ছিলেন তাদের চার বোনের মধ্যে দ্বিতীয় । বড় বোনের বিয়ে হয়েছিল আগেই । একে তো গ্রাম এলাকা তার উপর অনেক আগের কথা। সে সময় সমাজে প্রেম, ভালোবাসাকে চরম অপরাধ হিসেবেই গণ্য করা হতো। তাদের এই ভালোবাসার কথা তাই কোনো একভাবে বাবার কানে পৌঁছতেই তিনি আর দেরি করলেন না। নিজের ‘মান’ বাঁচাতে ঘটক ধরে দ্রুত বিয়ে ঠিক করে ফেললেন সুরমার । ছেলের নাম আবেদ আলী তালুকদার ।….. বি.এ পাশ, সরকারি চাকুরি করে। বংশ ভালো, এক বাপের এক ছেলে। প্রচুর জমিজমা তাদের।
বাবার কথার অবাধ্য হবার মতো দুঃসাহস সুরমার কোনো কালেই ছিল না। কাজেই সব মেনে চুপচাপ বিয়েতে রাজি হওয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু বিয়ের আগের রাতে ঘটল এক ঘটনা। বারেক তার বান্ধবী মুন্নীর হাত দিয়ে একটা চিরকুট পাঠালো খুব গোপনে । সেই চিরকুট খুলে সুরমা দেখলেন, তাতে লেখা… কাল দুপুর বারোটায় বারেক নাকি খসরুদের পুকুর ঘাটে অপেক্ষা করবে। তিনি যেন চলে আসেন। নইলে তার মৃত্যুর জন্য সুরমা দায়ি থাকবেন।
সেই চিরকুট পড়ে সারারাত সুরমার ঘুম হলো না। শেষে বারেকের কাছে পালিয়ে যাবেন বলে মনস্থির করলেন। কিন্তু কিভাবে..? শুক্রবার বাদ জুম্মা পাত্র পক্ষের আসবার কথা, তিনি বারোটার সময় চাচাতো ভাই সাদেককে ডেকে চিকন গলায় বললেন ,
— ‘সাদেক ভাই, টয়লেটে যাব।’
সাদেক তাকে ঘর থেকে বের করতেই তিনি সেদিন এক দৌড় দিয়েছিলেন খসরুদের ঘাটে যাবার জন্য। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারেননি। অল্প একটু যেতেই সবাই ধরে ফেলেছিল । বাড়ি এনে তারপর কী মারটাই না মেরেছিল তাকে সবাই মিলে । এরপর সব ভুলে তিনি বাবার পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করে সংসারেই মন দিয়েছিলেন। ভালো স্ত্রী ও মা হবার চেষ্টায় কেটেছে তার গত ত্রিশ বছর।
বাসায় ফিরে আবেদকে ঔষধ খাইয়ে সুরমা চুলায় রান্না বসালেন।
তার স্বামী আবেদ মানুষ খারাপ নন। কেবল, একটু কৃপণ আর খিটখিটে মেজাজ। অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়বার আগ পর্যন্ত কোনোদিন তিনি তার হাতে শখ করে পাচঁশোটা টাকাও দেননি । এসব নিয়ে খুব বেশি আক্ষেপ অবশ্য নেই সুরমার । তিনি জানেন দোষ ত্রুটিবিহীন মানুষ হয় না।
ময়নার কথা শুনে সুরমা অবাক হয়ে দেখলেন, সত্যি তাই ! দীর্ঘ ত্রিশ বছরের সংসার জীবনে আজ প্রথম তিনি ভাত পুড়ালেন।
শুধু তাই নয় বিকালে চা বানাতে গিয়ে চায়ের পাতিল, ডিম ভাজতে গিয়ে কড়াই পুড়িয়ে ফেললেন।
” আম্মা আফনের কি শইল খারাফ ?”
…সুরমা ভয়ানক বিব্রতবোধ করলেন।
তার বিশ্বাস ছিল বারেককে তিনি পুরোপুরি ভুলে গেছেন । তবে আজ এমন অস্থির লাগছে কেন তিনি বুঝতে পারছেন না । মানুষের বয়স বাড়ে সত্য। কিন্তু তার মন… ? মনের বয়স হয়ত কখনোই বাড়ে না ।
সুরমার মনে হলো বারেকের কার্ডটা না রেখে তিনি ভুল করেছেন। কী এমন হতো রাখলে…! এতদিন পর সেই সম্পর্কের তো আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। বারেকও নিশ্চয়ই বিয়ে করেছে । তার স্ত্রী, সন্তান সম্পর্কে জিজ্ঞেস, খোঁজ করা উচিত ছিল । আচ্ছা সে তো মিরপুর শাখাতে গিয়েছিল।… তার বাসা নিশ্চয়ই মিরপুরের ঐদিকে !
তেমন একটা দরকার ছিল না তবু্ও তিনি টাকা উঠানোর জন্য পরের সপ্তাহে আবার সেই পুবালী ব্যাংকে গিয়ে হাজির হলেন। কিন্তু বারেকের সাথে দেখা হলো না। কোন এক বিচিত্র কারণে তার পরের সপ্তাহে আবার গেলেন। সেবারও দেখা হলো না। তৃতীয়বার ফেরার সময় অভিমানে তার চোখে পানি চলে এলো।
এই বয়সে একজন পর পুরুষের জন্য কাঁদছেন ভেবে সুরমা প্রচণ্ড লজ্জা ও অপরাধবোধে ভিতরে ভিতরে কুকঁড়ে গেলেন।
যদিও খুব ভালো করেই জানেন, এবার দেখা হলেও তিনি বারেককে না চেনার ভান করতেন। ফোন নাম্বারও রাখতেন না।
….রিকশায় উঠে সুরমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে লাগল । ময়না বিস্মিত হয়ে বলল,
— আম্মা, আফনে কাঁনতেছেন ?
তিনি তাড়াতাড়ি চোখ মুছলেন।
— নারে ময়না, দেখিস না বাইরে কেমন রোদ। বয়স হয়েছে, আজকাল চোখে রোদ সহ্য হয় না। কেমন পানি চলে আসে।
সুরমা নিজের লজ্জা লুকাতে, হাত ব্যাগের ভেতর অদৃশ্য রোদ চশমা খুজঁতে লাগলেন ।
….পরানের গহীনে কত শত কথা থেকে যায়… কে রাখে তার খবর !
Leave a Reply