প্রতিদিনের মতো রাত দশটায় যখন সজল আমার পিছনে এসে দাঁড়াল। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। এটা কীভাবে সম্ভব!
প্রতিদিনের মতো আজও সজল খালি হাতেই বাসায় ফিরেছে! অবশ্য হাত খালি বলা যাবে না। এক হাতে অফিসের ব্যাগ আর অন্য হাতে মায়ের জন্য ঔষধ।
আজ আমার জন্মদিন। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে এটাই আমার প্রথম জন্মদিন। সজল খালি হাতে ফিরবে এটা যেন আমার কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। সে জানে আজ আমার জন্মদিন। ফেসবুক তাকে যথাসময়ে নোটিফিকেশন পাঠিয়েছে। আমি গল্পোচ্ছলে কতবার তাকে বলেছি নিজের জন্মদিনটা আমার কাছে অনেক বেশি স্পেশাল।
অথচ সারাটা দিন সে কাটিয়ে দিলো অফিসে বিশেষ কাজের বায়না দিয়ে। একটা কল পর্যন্ত করেনি। ঘড়িতে সময় রাত সাড়ে দশটা বাজে। আর মাত্র দেড়ঘণ্টা বাকি আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার জন্মদিনের সময়টুকু ফুরিয়ে যাবে।
কাল রাতের বারোটার পর থেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবাই উইশ করেই গেছে। কত সুন্দর সুন্দর শুভেচ্ছা বার্তা দিয়ে। কেউ ফেসবুকে, কেউ ম্যাসেঞ্জারে, কেউ কল দিয়ে, কেউ বা স্বশরীরে এসে গিফটসহ উইশ করে গেছে। অথচ শরীর খারাপের অজুহাতে সজল সারারাত নাক ডেকে ঘুমিয়েছে।
কোনো কিছুতেই আমার মন ভরছিল না। আমি অধির আগ্রহে অপেক্ষায় করছি সজলের জন্য। আজ সে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবে, সাথে করে আমার জন্য বিশাল এক ফুলের তোড়া নিয়ে আসবে। আমরা শপিং করব, লং ড্রাইভে যাব। তারপর কোনো এক রেস্টুরেন্টে গিয়ে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার শেষ করে বাসায় ফিরব।
অথচ তার নিরবতায় আমার বুকের ভেতর কষ্ট জমেছে। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মাঝে আকাশ পাতাল ব্যাবধান, আমার ভেতরটাকে কুঁকড়ে দিয়েছে। কয়েকদিন ভেতর থেকে আমি স্বাভাবিক হতে পারিনি সজলের সাথে।
এমন অনুভূতিহীন মানুষকে জীবন সঙ্গী হিসাবে পেয়ে নিজের দুর্ভাগা রমণী মনে হলো।
ভীষণ মনে পড়ল রায়হানের কথা। বিয়ের আগে কোনো বছর সে আমার জন্মদিন ভুলেনি। ঠিক রাত বারোটায় সারপ্রাইজ দিতে চলে আসত। তার সাথে পরিচয় হওয়ার পর পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তার আগে কেউ উইশ করতে পারেনি আমার জন্মদিনে। অথচ প্রেমিক হিসাবে ভালো না লাগায় কখনো তাকে বন্ধুত্বের সীমা অতিক্রম করতে দেইনি।
যেদিন বিয়ের কার্ড দিতে গেয়েছিলাম। সে কোনোভাবেই অশ্রু সংবরন করতে পারেনি। আমি না দেখার ভান করে চলে এসেছিলাম। কারণ আমি তাকে কখনো কথা দেইনি। সে আকাশ কুসুম কল্পনা করলেই আমাকে সে কল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে এমন কোনো কথা নেই।
বাবা -মা আমাকে উচ্চ শিক্ষিত, সুদর্শন, ভালো পরিবার, পয়সাওয়ালা, বড় ব্যাবসায়ী দেখে বিয়ে দিয়েছিলেন । অথচ বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত লোকটার কোনো ভালো গুণই আমার চোখে পড়েনি।
সে শিক্ষিত হওয়ায় তার মনে হয় তার মতো জ্ঞানী আর কেউ নেই। সে কথায় কথায় আমাকে বুঝিয়ে দেয় জ্ঞান বিজ্ঞানে তার ধারে কাছেও আমার অভিজ্ঞতা নেই।
আমি যথা সম্ভব এসব বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। তবে মনে মনে কষ্ট পাই। কিছু মেয়ে না হয় আমার মতো জ্ঞান-বিজ্ঞানে একটু কমই জ্ঞান রাখে। তাই বলে সবসময় সূক্ষ্মভাবে অপমান করতে হবে?
তার ব্যাবসায়ে প্রচুর লাভ হচ্ছে। প্রতি মাসে কম হলেও কয়েক লক্ষ টাকা তার উপার্জন আছে। অথচ আজ বিয়ের বছর হতে চলল, কোনো মাসে হাত খরচের জন্য সে দু’টো হাজার টাকা পর্যন্ত আমার হাতে তুলে দেয়নি। লজ্জায় কাউকে বলতেও পারি না।
অন্তর্মুখী আমিও কখনো মুখ ফুটে কিছু বলিনি। কোনো কিছু লাগলে সাথে সাথে এনে দিয়েছে, সেটা অবশ্য অস্বীকার করব না। কিন্তু নিজ হাতে টাকা খরচ করার যে আনন্দ সেটা আমি পুরো এক বছরেও পাইনি। সবাই জানে আমি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকি। বরের ব্যক্তিগত গাড়ি আছে। রান্নার জন্য বাবুর্চি আছে। বর মাসে লাখ লাখ টাকা রোজগার করে।
কিন্তু এতসব কিছুর মাঝে যে আমার অবস্থান খুব গৌণ। সেটা কাউকে বলে বুঝাতে পারি না। আমি কেবল রোজ নিয়ম করে তার শয্যাসঙ্গী হই। সেখানেও পারপরমেন্স তার মনমতো না হলে প্রতি মুহূর্তে শুনতে হয়
” বিয়ে করে আর লাভটাই বা হলো কী!”
বিয়ে করে কী লাভ হলো সেটা আমি তাকে বোঝাতে ব্যর্থ হই।
তার কাছে তার জীবনটাই সবচেয়ে মূল্যবান। তার জীবনের সাথে জড়িত তার বাবা-মা, ভাই -বোন, বন্ধু-বান্ধব এরাই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আর বাকি সব তুচ্ছ। জীবনের প্রয়োজনেই বাকিদের আগমন। যেখানে ইচ্ছে হলেই এদের বাতিলের খাতায় রেখে দেয়া যায়। বাতিলের খাতায় রাখা মানুষের মধ্যে স্ত্রী অন্যতম।
আমি ভেতরে ভেতরে শুকনো পাতার মতো মরমর করে ভেঙে পড়ি প্রতিদিন। বাবার বাড়িতে বলেও কারো কাছে ঠাঁই পাই না।
বাবা বলেন
” পুরুষ মানুষের আলাদা জগৎ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সব কিছুতে নাক না গলানোই ভালো। তোমার সব কিছু ঠিকমতো হলেই তো হলো”।
ঠিকমতো সব হওয়া বলতে তাঁরা ভাত কাপড়কে মনে করেন। সেসবের তো অভাব বর্তমানে আমি কেন, পুরো পৃথিবীতে কারোই নেই।
মা বিরক্ত হয়ে আমার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দেন। তিনি শ্বশুর বাড়িতে কত কষ্ট করেছেন। রাতভর রান্নাঘরে কাজ করেছেন। অথচ পাতিলের তলানির খাবারও কোনো কোনো সময় ভাগ্য জোটেনি। এখন শ্বশুর বাড়িতে মেয়েরা বিলাসি জীবন-যাপন করেও মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে খুত বের করে।
কত ভালো জামাই, কোনো বদ স্বভাব নেই। সিগারেট, মদ, নারী এসব নিয়ে কোনো বদনাম নেই। অফিসের চোখে, পরিবারের চোখে, সমাজের চোখে, শ্বশুর পরিবারের সবার চোখে সবচেয়ে ভালো ছেলেটার স্ত্রীর চোখের জলে বালিশ ভিজে রোজ।
সে বন্ধুদের সাথে কলিগদের সাথে হর হামেশায় বাইর থেকে ডিনার করে আসে। কখনো বাসায় এসে আমাকে বলার প্রয়োজনও মনে করে না। খেতে না চাইলে কারণ জানতে চাইলে এড়িয়ে যায়।
আমি তার জন্য না খেয়ে বসে ছিলাম বললে, বিরক্ত হয়। যে ব্যক্তি অহেতুক না খেয়ে থাকার মাঝে কেমন ভালোবাসা সেটা বুঝতে পারে না। একসাথে দুজন ব্যক্তি খাওয়ার মাঝে কেমন আনন্দ সেটা সে কীভাবে বুঝবে?
তাই একটা সময় আমিও একা খাওয়ার অভ্যাস করে নেই। একই বাসায় দুজন মানুষ, অথচ তাদের খাওয়ার সময় আলাদা।
এমন অদৃশ্যমান অশান্তিতে থাকতে থাকতে আমি দিনকে দিন নিজেকে হারিয়ে ফেলতে শুরু করি। আমার চোখের নিচে গাঢ় কালির অাস্তরন পড়ে। দুধে আলতা গায়ের রঙ ফ্যাকাসে হতে শুরু করে। আমি না খেয়ে থাকতে থাকতে মাসের ত্রিশ দিনের মধ্যে প্রায় পনেরো দিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকি।
আমি বিস্মিত হই, তাতেও তার কিছু যায় আসে না। আমার বদলে যাওয়ার কারণ, খারাপ থাকার কারণ সে খুঁজে বের করে না। উল্টো আমার উপর বিরক্ত হয়।
ঘরে এসে অসুস্থ স্ত্রী দেখলে তার বিরক্ত লাগে, বাসায় আসতে ইচ্ছে করে না। সে বুঝতে পারে না, তার স্ত্রী কীসের অভাবে মন মরা হয়ে পড়ে থাকে।
বাধ্য হয়ে বেঁচে থাকার বিকল্প পথ খুঁজে বের করি। রোজ বিকালে বাইরে হাঁটতে বের হই কলোনিতে। আমি একা নই আমার সাথে আরও অনেক নারী আছে। একদিন পরিচয় হলো পাশের ফ্ল্যাটের নাজমা ভাবীর সাথে।
ভাবীকে হাসিমুখে দেখলে ভালো লাগে। কী সুন্দর প্রতিদিন তিনি নতুন করে বাঁচেন! নতুন নতুন পোশাক পরেন, ভালো ভালো রান্না করেন। এসবের গল্প করেন আমার সাথে। এক-দুই দিন পরপর শপিং করতে চলে যান মার্কেটে। রোজ রোজ নতুন নতুন ছবি পোস্ট করেন ফেসবুকে।
ভাবীকে আমার সৌভাগ্যবতী মনে হয়। কপালগুণে এমন স্বামী পেয়েছেন জীবনে। যে প্রতিদিন নতুন করে বাঁচতে শেখায়।
আর আমি প্রতিনিয়ত কষ্ট লালন করে বেঁচে থাকি। প্রায় ইচ্ছে করে ভাবীর সাথে নিজের কষ্ট শেয়ার করতে। কিন্তু নিজেকে কারো কাছে ছোট করতে ইচ্ছে করে না।
একদি সাহস করে বলেই ফেললাম
” ভাবী আপনি ভীষণ সৌভাগ্যবতী নারী। ভাইয়া আপনার প্রতি অনেক যত্নবান তাই না!”
ভাবী দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বললেন
” কী বলেন ভাবী! স্ত্রীর প্রতি যত্নবান পুরুষ আছে না-কি পৃথিবীতে! এরা তো কয়েকশ বছর আগেই ডাইনোসরের মতো বিলুপ্ত হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে।”
ভাবীর কথা বলার ঢং দেখে আমি হেসে ফেলি।
” না মানে ভাবী, ভাইয়ার সাথে আপনার বোঝাপড়া অসাধারণ। মন বুঝতে পারা, কষ্ট বুঝতে পারা জীবনসঙ্গী পাশে থাকলে একজীবনে অনেক কিছু না থাকলেও চলে।”
ভাবীর চোখে টলমলে জল
” কোন পুরুষ নারীর মন বুঝতে পেরেছে, বলেতে পারেন? আপনার বাবা বুঝেছে আপনার মাকে? আপনার ভাই বোঝে তার স্ত্রী কে? আপনার দুলাভাই বোঝে আপনার বোনকে? আপনার বর বোঝে আপনাকে?
উত্তর নিশ্চয়ই না! তাহলে আপনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন পৃথিবী নামক একই গ্রহে অন্য এলিয়েন নিয়ে আমি সংসার করি।”
আমি যেন ভাষা খুঁজে পেলাম না ভাবীর দৃঢ়চেতা কণ্ঠস্বর শুনে। আসলে তো কখনো তো এভাবে ভেবে দেখিনি।
আমি ভাবীর মুখের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলাম।
ভাবী পুনরায় বলতে শুরু করলেন
” ভাবী আমরা অন্যের দৃষ্টিতে সুখী কেন জানেন? আমরা সহ্য করি, ধৈর্য ধরি, চুপ থাকি। সেকারণে আমাদের ভেতরের পোড়া গন্ধ কেউ টের পায় না। আমাদের কষ্টের সমুদ্র দেখে কেউ চমকে উঠে না।”
আমি পূর্ণচোখে ভাবীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাই না। কোনো শব্দ বের হয় না আমার গলা থেকে।
তিনি শব্দ করে হাসেন, তার চোখ থেকে মুক্তোর দানার মতো অশ্রু গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে।
আমার চোখেও তখন শ্রাবণের ঢল নামে। জানি না এই কষ্ট কার জন্য ভাবীর জন্য, না-কি নিজের জন্য, না-কি সকল ধৈর্যশীল নারী জাতীর জন্য বুঝতে পারি না।
একটা সময় আমদের গল্প শেষ হলে আমি উঠে দাঁড়াই, ভাবী আমার কাঁধে নির্ভরতার হাত রেখে বললেন
” আমরা প্রতিদিন বাঁচব, নতুন করে বাঁচব আর নিজের জন্য বাঁচব। কে যত্ন নিলো আমাদের, কে নিলো না এসব চিন্তা করার সময় পান কই আপনি? “
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply