শেষ পর্যন্ত জুনিয়রের প্রেমে পড়তে হবে কে জানত!
আরে আরে ভুল বুঝবেননা, ছেলেটা আর কেউ না, আমারই হাজবেন্ড। গত মাসের দশ তারিখ আমার থেকে দুই বছরের ছোট একটা ছেলের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। আসলে মাত্র দুমাসের ছোট। কিন্তু বেচারা হিফজ পড়তে গিয়ে দুই বছর লস দিয়েছিল, আর সার্টিফিকেটে তো একটু-আধটু কম করেই দেয় সবাই। তো সেই সার্টিফিকেটের সুবাদে বয়সে যেমন কমে গেছে, তেমন পড়াশোনায়ও হয়ে গেছে জুনিয়র। এমনিতে তো এমন অসম বিয়ে হওয়ার কথা না। কিন্তু আমার বাবা আর ওর বাবা বাচ্চাকালের বন্ধু। বড় হওয়ার পর যোগাযোগ হারিয়ে গিয়েছিল। এতদিন পর খুঁজে পেয়ে বন্ধুত্বকে আত্মীয়তায় পরিণত করতে আর দেরী করেনি কেউ।
ছেলে মা শা আল্লাহ সেই লেভেলের ব্রিলিয়ান্ট। মাত্র দুই বছরে সে হিফজ কমপ্লিট করেছে। চার চারটা সোনালী এ প্লাস এর মালিক গত বছর স্কলারশিপ নিয়ে লন্ডনে গিয়েছিল ডাক্তারি পড়তে। এদিকে তার বাবা মা তো ছেলের চরিত্র ঠিক থাকবে কিনা সেই টেনশনে রাতে ঘুমাতে পারেননা। কিছুদিন আগে নাকি সে ফেসবুকে ক্লাসমেটদের সাথে একটা গ্রুপ ফটো শেয়ার করেছিল। ছবির মেয়েদের ছোট ছোট পোশাক-আশাক দেখে তো আমার শশুরের মাথায় হাত। সাথে সাথে ছেলেকে ডেকে পাঠিয়ে আমার সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেন। এ সবই অবশ্য বিয়ের পর ননদের মুখে শোনা।
ছেলে আমার জুনিয়র শুনে তো আমি মহাখাপ্পা ছিলাম। কিন্তু বাবা মায়ের কথা জীবনে যে অমান্য করেনি সে আর কী করবে। কেঁদেকেটে একসা হয়েও শেষমেশ কবুল বলে ফেললাম ছেলেকে না দেখেই। অঘটনটা ঘটল বাসর রাতে। ওকে দেখেই আমি ধপাস করে পড়ে গেলাম। না না, বিছানা থেকে না, পড়লাম প্রেমে। এক্কেবারে যাকে বলে ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’। আমার বরের রূপের বর্ণনা দিতাম কিন্তু আপনারাও যদি ক্রাশ খেয়ে যান, তাই আর রিস্ক নিলামনা। তবে তার রিএকশন দেখে আমি একেবারে কনফিউজড হয়ে গেলাম।
বউ সাজে আমাকে দেখে কতক্ষণ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ এমনভাবে চোখ নামিয়ে নিল, যেন গায়রে মাহরাম মহিলাকে দেখেছে। ভাবলাম লজ্জা পেয়েছে। কিন্তু ব্যাটা মিনমিন করে বলে কিনা, “আব্বুর টেনশনে কয়েক রাত ঘুম হয়নি, আমি কি একটু ঘুমাতে পারি?”
যাব্বাবা, বিয়ের সময় আবার বাবাকে নিয়ে কিসের টেনশন? সে কাহিনী জানলাম পরদিন। তাকে নাকি আমার শশুর ভীষণ অসুস্থ, একথা বলে ডেকে এনে বিয়ে দেয়া হয়েছে।
যাই হোক, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমি সাইডে সরে তাকে শোয়ার জায়গা দিলাম। পাগড়ি খুলে ওই মোটা কাজ করা বিয়ের পাঞ্জাবি পরেই আমার দিকে পেছন ফিরে শুয়ে পড়ল। আমি বসে বসে কতক্ষণ উশখুশ করলাম, লুকিয়ে চুরিয়ে ওর চেহারা দেখার চেষ্টা করলাম। তখন হঠাৎ মনে পড়ল যে প্রথম রাতে দুজন মিলে নামাজ পড়তে হয়, বউয়ের চুল ধরে দোয়া পড়তে হয়, সে তো কিছু না করেই ঘুমিয়ে গেল। এবার একটু মন খারাপ হয়ে গেল আমার। উঠে গয়না টয়না খুলে ফ্রেশ হলাম, এশার নামাজ পড়লাম। কী পাগলামিতে ধরল, ওর মতো আমিও বিয়ের ভারি লেহেঙ্গা পরেই শুয়ে পড়লাম।
নতুন জায়গায় তো আর ভালো ঘুম হয়না, ফজরে যথারীতি ঘুম ভাঙলে দেখলাম সে বিছানায় নেই। আমার নামাজ পড়ার মধ্যেই সে ফিরে এসে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। তাকিয়ে দেখলাম, পাঞ্জাবি চেঞ্জ করেছে। ড্রেসিং টেবিলের উপর একটা সাদা টুপি চোখে পড়ল। মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিল বুঝে খুশি হলাম। আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে আমিও এবার চেঞ্জ করে শুয়ে পড়লাম।
ছেলে খেল দেখাল পরেরদিন। তার নাকি ইম্পর্টেন্ট প্রোজেক্ট জমা দেয়ার আছে, বাবার অসুস্থতার জন্য না এসে পারেনি, এখন আজকেই চলে যেতে চায়। আমার শশুরও কম যাননা। ছেলের মতিগতি হয়তো আগেই বুঝে ফেলেছিলেন। বিয়ের আগেই আব্বুর মাধ্যমে আমার ট্যুরিস্ট ভিসা বানানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। ব্যস, আর কী! বউভাতের পর বাপের বাড়ি না, বাক্য বিনিময় না হওয়া স্বামীর সাথে রওনা দিলাম এয়ারপোর্টের দিকে। গোটা জার্নিতে ওর ব্যবহার বড় অদ্ভুত ঠেকল। যেন বিয়ে করা বউ না, অন্য কোন মহিলাকে সাথে নিয়ে যাচ্ছে। সবথেকে হাস্যকর হলো, আপনি আপনি করে কথা বলছিল। এদিকে আমি নিজে বড় হওয়ার অধিকারবোধে প্রথম থেকেই তুমি করে বলে ফেলেছি। আমি কতবার বললাম তুমি করে বলতে, লাজুক হেসে বলে কিনা, আপনি তো বড়। শুনে মনে চাইছিল প্লেনের জানালা দিয়ে ব্যাটাকে নিচে ফেলে দিই।
বড়লোকের ছেলে বলে কথা, হোস্টেলে না থেকে নিজস্ব ফ্ল্যাটে থাকে। দুইটা রুম আর এক চিলতে ড্রয়িং কাম ডাইনিং এর ফ্ল্যাটটা এতো কিউট যে প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়ে গেল আমার। আমার লাগেজ নিয়ে একটা রুমে ঢুকে বলল, “এটা আপনার ঘর”
“আমার ঘর মানে?”
“হুম, ওপাশের ঘরটা আমার আর এটা আপনার”
ওর কথা শুনে এতটাই অবাক হলাম যে কী বলব বুঝতে পারলামনা। আমি দাঁড়িয়েই থাকলাম, ও সুন্দর করে বিছানার চাদর পালটে আমার শোয়ার ব্যবস্থা করে দিল। আমরা স্বামী স্ত্রী, আমাদের একসাথে থাকা উচিত, কথাগুলো বলতে গিয়েও বললাম না, কেমন একটা বাধোবাধো ঠেকল। হয়তো বয়সের ডিফারেন্স এর ব্যাপারটা আমার মাথাতেও কাজ করছিল আর নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে লজ্জা পাচ্ছিলাম। রাতে ও রান্না করে সার্ভ করল, খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন থেকে আমাদের আজব সংসার শুরু হল। সংসার বললে অবশ্য ভুল হবে। আমি দুদিনের জন্য বেড়াতে আসা গেস্ট এর মতো থাকতে লাগলাম আর ও আমার দেখাশোনা করছিল।
প্রব্লেম যা হচ্ছিল, তা শুধুই আমার। আমি মরে যাচ্ছিলাম প্রেমে। ও যতক্ষণ আমার সামনে থাকে, আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। ও আমার দিকে যখনই তাকায়, দেখে আমি তাকিয়ে আছি। বেচারা অপ্রস্তুত হয়ে যায়, কী করবে বুঝতে পারেনা। কিন্তু গাধাটা এটা বুঝতে পারেনা যে আমার চোখে ওর জন্য কী পরিমাণ ভালোবাসা খেলা করছে।
আমি না পারি একে কিছু বলতে না পারি সইতে। নিজের হাজবেন্ডের থেকে বড় বোন টাইপ আচরণ আর কাঁহাতক ভালো লাগে। সমস্যা হলো, আমি ওকে একদমই বুঝতে পারিনা। প্রয়োজনের বাইরে একটা কথাও বলেনা। সকালে যায়, বিকালে আসে। কোনদিন দেরি হবার সম্ভাবনা থাকলে বলে যায়। সকালে ব্রেকফাস্ট তৈরি করে, আমার জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে সে ক্লাসে যায়। বিকালে এসে আবার রাতের খাবার তৈরি করে। আমাকে কিছুই করতে দেয়না। হাতে হাতে হেল্প করতে গেলেও আনইজি ফিল করে। আর ও আসার আগে যে আমি রান্না করব, তারও উপায় নেই। প্রতিদিনের বাজার সে প্রতিদিন করে নিয়ে বাসায় আসে।
একদিন আমি আর থাকতে না পেরে মুখের ওপর বলেই ফেললাম, “বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছ বলে কি আমার কিছুই করার অধিকার নাই?”
বেচারা আমার উঁচু কণ্ঠে চমকে উঠল। বলল, “একথা বলছেন কেন?”
“বাসার মধ্যে খালি শুয়ে বসে আর ল্যাপটপ-মোবাইল গুতিয়ে দিন কাটানো যায়? এটলিস্ট রান্নাবান্না গুলো আমি করলে কি খুব গুনাহ হয়ে যাবে?”
সে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল কতক্ষণ। “আমি শুনেছিলাম আপনি অনেক আদরের মেয়ে, বাসায় তেমন কাজ টাজ করেননি কখনো। আপনার অভ্যেস নেই ভেবেই করতে দিইনি। আপনি নিজে থেকে করতে চাইলে করবেন, আমার কোন সমস্যা নেই”
এরপর আমরা একসাথে বাজার করতে গেলাম। সুপারশপটা আমাদের বাসা থেকে অনেক কাছে, পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। আশপাশের এলাকাটা খুব সুন্দর, পরিষ্কার। একটা শান্তি শান্তি ভাব আছে। রাস্তাঘাট, গাছপালা সব যেন পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা। আমি মুগ্ধ চোখে চারদিকে তাকাচ্ছিলাম, আসার পর থেকে তো ঘরেই বন্দী।
“যাক, অন্তত বাজার করার উসিলায় তো বাইরে বের হওয়া কপালে জুটল!” দীর্ঘশ্বাসের সাথে কথাটা বলতেই আমার দিকে মুখ ফেরাল ও।
“স্যরি, আমার আপনাকে নিয়ে একটু ঘুরাঘুরি করা উচিত ছিল বোধহয়”
কটমট করে তাকালাম ওর দিকে। বোধহয়! ভেড়া কি আর সাধে বলি? মাঝরাস্তা না হলে নিশ্চিত গাধাটাকে মেরে দিতাম। স্বামী তো কী হয়েছে, বয়সে ছোট তো, মারাই যায়! আমারও পোড়া কপাল, কটমটে দৃষ্টি দেখার জন্য কি আর সে তাকিয়ে আছে? হতাশ হয়ে মাথা নাড়লাম।
তবে এরপর থেকে আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে আচরণ অনেকটা সহজ হয়ে গেল, কথাবার্তা মোটামুটি ভালোই হয়। তবে এখনো তুমি বলাতে পারিনি। কোন রান্না ভালো হলে প্রশংসা করত, সেটা শুনে আমি আসমানে পাখা মেলতাম। একদিন তো বলেই ফেলল, আরও আগেই আপনাকে রান্না করতে দেয়া উচিত ছিল, নিজে এতদিন কী অখাদ্য যে রান্না করতাম, আপনি সেগুলো খেতেন কীভাবে? বলতে ইচ্ছা করল, ভালোবাসার মানুষের হাতের রান্না করা অখাদ্যও অমৃত লাগে, সেটা বুঝলে তো আর আমি তোমাকে গাধা বলতাম না। মুখে কিছু না বলে মিষ্টি করে হাসলাম। গাধাটা যেন একটু তাকিয়ে থাকল।
আমরা মাঝেমধ্যে ঘুরতে বের হতাম, হালাল রেস্টুরেন্টে খেতে যেতাম। কিন্তু সবখানেই যেন একটা অদৃশ্য দেয়াল থাকত।
হঠাৎ একদিন আমার ননদ এক দারুণ তথ্য দিল, যেটা শুনে আমি বুঝে গেলাম ওর এই অদ্ভুত আচরণের রহস্য।
আমার বর তখন ক্লাস নাইনে পড়ে, নতুন স্কুলে ট্রান্সফার হয়েছে। মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে এক ক্লাসমেট এর সাথে কথা বলছিল। হঠাৎ ওদের সামনে এসে দাঁড়ায় একটা মেয়ে। কিছু বুঝে উঠার আগেই মেয়েটা ঠাটিয়ে একটা চড় মেরে বসে ওকে। গালে প্রচন্ড ব্যথা আর চোখে সর্ষে ফুল নিয়ে ও শুনতে থাকে ওর জীবনে শোনা সবথেকে অপমানজনক কিছু বাক্য।
“তোর মতো একটা পুচকে ছেলের এতোবড় সাহস! আমাকে প্রেমপত্র দিস! মেয়ে দেখলেই হলো, বয়সে বড় ছোট কোন বাছবিচার নাই? কোথায় বড় আপু বলে সম্মান করবি, উলটা নাম ধরে লিখেছিস তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না!”
ঘটনার আকস্মিকতায় বেচারা এতটাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল যে, গালে হাত দিয়ে হা করে শুধু তাকিয়ে ছিল। মেয়েটার গালিগালাজের লিস্ট যেন শেষ হচ্ছিলনা, এমন সময় আরেকটা মেয়ে এসে থামায় ওকে। “ওই তুই এই ছেলেটাকে বকছিস কেন, আমি তো ওর পাশের জনকে দেখিয়েছি”
বেচারা পাশে তাকিয়ে দেখে ওর ক্লাসমেট বহু আগেই চম্পট দিয়েছে। মেয়েটা এবার প্রচন্ড অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কোনমতে মিনমিন করে বলে, “স্যরি ভাই, এক্সট্রেমলি স্যরি। আসলে জুনিয়র ছেলের থেকে লাভ লেটার পেয়ে মাথা ঠিক ছিলনা“ আরও কিছু হয়তো বলছিল, কিন্তু সে একটা কথাও না বলে ওখান থেকে চলে আসে। বাবাকে অনেক রিকোয়েস্ট করে স্কুল চেঞ্জ করে, বয়েজ স্কুলে ভর্তি হয়। এর পেছনের কারণ আর কেউ জানেনা, শুধু ওর বোনই জানে। ওরা আসলে টুইন। ছোট থেকেই খুনশুটি আর মারামারির সাথে সাথে দুজন দুজনের বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গিয়েছিল। আমার ননদ খুব রসিয়ে রসিয়ে অভিনয় করে ভিডিও কলে গল্পটা বলছিল, আমিও মজা পাচ্ছিলাম। কিন্তু যখন বলল, “ভাবী জানো, আমি ওকে ওইদিন বড় হওয়ার পর প্রথম কাঁদতে দেখেছিলাম। বিনা দোষে পাব্লিক প্লেসে এমন ঘটনা। লজ্জা আর অপমানে বাসায় এসে আমার সামনে কান্না করে দিয়েছিল ও” এরপর আর হাসতে পারলাম না। মনে চাইছিল ওই মেয়েটাকে গিয়ে ঠাটিয়ে কয়টা চড় মেরে আসি। আরও ভাবলাম, এত ইনোসেন্ট একটা ছেলেকে আল্লাহ আমার কপালে রেখেছিলেন!
সেদিন রান্না সব হয়েই গিয়েছিল, তাও আমি ওর জন্য পুডিং বানালাম। পুডিং যে ওর অনেক ফেভারিট, সেটাও ননদ প্রদত্ত ইনফরমেশন। সেদিন দরজা দিয়ে যখন বাসায় ঢুকছিল, ইচ্ছে করছিল কাছে গিয়ে বলি, “একটা ফালতু মেয়ের ভুলে আমাকে কেন কষ্ট দিচ্ছ?”
পুডিং দেখে ওর চোখজোড়া খুশিতে জ্বলজ্বল করছিল। খেতে খেতে অন্তত দশবার থ্যাংকস দিল ওর ফেভারিট জিনিস খাওয়ানর জন্য।
কয়েকদিন পরের কথা।
রাত এগারোটা বাজে। কাউচে শুয়ে পা দোলাতে দোলাতে বই পড়ছি। এখানে আসার পর এই প্রথম রাতের বেলা বাসায় আমি একা। ওর আগামীকালকে বড়সড় একটা এক্সাম আছে, তাই আজ বন্ধুদের সাথে গ্রুপ স্টাডি করতে হবে। অনেক রাত হয়ে যাবে বলে আর ফিরবেনা। হালকা ভয় কাজ করছে মনের মধ্যে।
হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে লাফিয়ে উঠলাম। খুশির চোটে দৌড়ে গেলাম দরজার কাছে। কিন্তু আইহোলে চোখ রাখতেই আত্মা শুকিয়ে গেল আমার। একটা অপরিচিত ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ও। তাড়াহুড়ো করে ওড়না ঠিক করে দরজা খুললাম।
ঘটনা শুনে তো আমার মাথা নষ্ট। যে বন্ধুর বাসায় গিয়েছিল ওরা, তার একটা বোন আছে। সে নাকি আমার বরকে পছন্দ করে। অনেকবার আচার আচরণে বুঝিয়েও যখন পাত্তা পায়নি, তখন আজ সফট ড্রিংকস এর সাথে ড্রাগ মিশিয়ে কিছু একটা করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার আগেই ওর বন্ধু ওদের দেখে ফেলে, মেয়েটার হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে ওকে।
আমি ওর দিকে এগিয়ে যেতেই চিৎকার করে উঠল, “ডোন্ট টাচ মি! আমার থেকে দূরে থাক শয়তান মেয়ে”
পুরো জমে গেলাম আমি। একটা বাইরের মানুষের সামনে এমন আচরণ করবে? চোখে পানি চলে আসল অপমানে। তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে ফেললাম।
ছেলেটা বোধহয় বুঝতে পারল আমার মনের অবস্থা। বলল, “ভাবি, ওর কথায় কষ্ট পেয়েননা, ও সম্ভবত নেশার ঘোরে আপনাকে সামান্থা ভাবছে। ও সামান্থার সাথে এমনই করছিল”
ওর কথায় সায় দিতেই যেন ও বলে উঠল, “দোস্ত প্লিজ, আমাকে বাসায় দিয়ে আয়”
আমার তাও খুব খারাপ লাগছিল, আমি ওকে সোফায় বসিয়ে দিতে বললাম।
ছেলেটা আরও যোগ করল, “নেশার মধ্যে ও বারবার একটা কথাই বলছিল, ‘আই এম ম্যারিড, আমার ঘরে বউ আছে, ডোন্ট টাচ মি’ ও ফ্রেন্ড সার্কেল এর কাউকে বলেনি বিয়ের কথা, আমি বাদে কেউ জানেনা। তাই আমিই ওকে নিয়ে আসলাম। এবার আপনি ওকে সামলান ভাবি, আমাকে যেতে হবে। আপনি খালি একটু দেখবেন, সকালে এক্সাম হলে যেন পৌঁছে যায়”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই, এত কষ্ট করে পৌঁছে দেয়ার জন্য”
“বন্ধু হিসেবে তো এটা আমার কর্তব্য ভাবি। ইয়ে একটু পানি পাওয়া যাবে?”
আমি কাহিনী শুনে নড়তে চড়তে ভুলে গিয়েছিলাম। এবার নড়লাম পানি আনার জন্য।
ওর বন্ধু চলে যাবার পরেও আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করবো। টেনে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়াই ভালো হবে। কিন্তু কাছে যেতেই ও আবার চিৎকার করে উঠল, “সরে যাও মেয়ে, বলছিনা আমি ম্যারিড! আই হ্যাভ এ ভেরি বিউটিফুল ওয়াইফ! স্টে এওয়ে ফ্রম মি” দুঃখের মাঝেও ফিক করে হেসে দিলাম আমি। গাধাটা তাহলে আমাকে তার বউ মনে করে! সুন্দরী বউ!
পরক্ষণেই রাগ উঠল আমার। সমান স্বরে চিৎকার করে উঠলাম, “বউ যদি এত সুন্দরই হয়ে থাকে, তার সাথে বন্ধুর বড় বোনের মত আচরণ করিস কেন রে গাধা? কাল আরেকবার আপনি করে বলে দেখিস, মুখ ভেঙে দিব। আর তোর কোন বন্ধুর কয়টা করে বোন আছে কালকে আমাকে লিস্ট দিবি। শুধু বোন না, গার্লফ্রেন্ড এন্ড বউয়ের লিস্টও দিবি। শুনেছি এ দেশের মেয়েরা হ্যান্ডসাম ছেলে দেখলেই পেছনে লেগে যায়। সবগুলোর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করতে হবে তোর। নাইলে কে আবার কবে কী খাইয়ে দেয়, বিশ্বাস নাই” এত দিন ধরে জমে থাকা সব মনের কথা উগরে দিয়ে থামলাম আমি। গাধা তো আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।
“এই মেয়ে, হোয়াই আর ইউ শাউটিং? আমি তোকে বলেছিনা আমার বউ আছে, সুন্দরী বউ। দূরে সর শয়তান মেয়ে” বিড়বিড় করে চোখ বুজল। একটু পর আবার চোখ খুলে শুরু করল সেই একই বকবক।
সে এখনো থামেনি, বকবক করে যাচ্ছে। আর আমি এগাল ওগাল হাসি নিয়ে ওর বকবকানি শুনে যাচ্ছি। ঘরে নিয়ে আর কাজ নেই, এখানেই পড়ে থাক। আমি বরং দুচোখ আর মন ভরে ওর মনের কথাগুলো শুনে নিই। সজ্ঞানে কবে বলতে শুনব তার তো আর ঠিক নেই!
বকবকানি থামলে লাইট অফ করে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। মৃদু হাওয়ায় চুলগুলো খুলে দিলাম। আজ একা হলেও কিছুদিন পর আমার সাথে ওও থাকবে, হাতে হাত রাখবে। চাঁদের আলোয় আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে, বাতাসে আমার চুলের উড়াউড়ি দেখবে। আচ্ছা আচ্ছা, স্বপ্ন আর আগে বাড়তে না দিই। ইশ! চাঁদটা এত বেশি সুন্দর কেন আজকে?
ভেতরে কাউচের উপর শুয়ে থাকা শরীরটা একটু নড়ে উঠল। তার ঠোঁটেও এখন মুচকি হাসির রেখা। প্ল্যান সাকসেসফুল! বউ হয়েছে তো কী হয়েছে, প্রপোজ করার আগে মনের ভাবটা বোঝার দরকার ছিল। বয়সে বড় মেয়েগুলোর হাতে যা জোর হয়না, ওরে বাবা!
(সমাপ্ত)
Leave a Reply