এনামুল সকাল বেলা তৈরি হচ্ছে মাকে আনতে যাবে বলে।
তার চোখ মুখ খুশিতে উজ্বল! সেদিকে তাকিয়ে তার বৌ মালা, গলায় বিষ ঢেলে বলল, তুমি এত খুশি ক্যান?
এনামুল বলল, তুমি তো জানো আজ মা আসবো … তাকেই তো আনতে যাইতেসি! কত বছর পরে মা আসবো ! মালা ততোধিক গলায় বিষ ঢেলে বলল, হ্যা…যেই না মা!
তার জন্য আবার এত খুশি! এনামুল খুব জোরে ধমকে
উঠে বলল, খবরদার আর একটা কথা যদি মুখ দিয়ে বের করছো! একবারে শেষ করে ফেলবো!
মালা একটুও না দমে বলল, হ্যা! সেটা তো পারবাই! যেই
মা খুনের দায়ে চৌদ্দ বছর জেল খেটে বাইরে আসছে, সেই মায়ের ছেলে তো ইচ্ছা করলেই মানুষ মারতে পারবো ! কথায় বলে যেমন গাছ তেমন তার ফল।
এনামুল রাগী চোখে এমন ভাবে তাকালো যে মালার মনে ভয় ধরে গেলো! মালা কিছু না বলে রান্না ঘরে চলে আসলো।
মালা ভাবছে , এনামুল আজব ছেলে… সে যতটুকু শুনছে ,
তার শ্বশুর আব্বা এনামুলের যখন সাত বছর তখন মারা যায়। এরপর শাশুড়ি মা আর বিয়ে করে নাই! এ ছেলে নিয়েই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছিলো! এনামুলের যখন চৌদ্দ বছর তখন নাকি তার মা জামিলউদ্দিন নামে একজন গ্রামের মেম্বারকে নিজে হাতে হত্যা করে! কারন সে লোক তার সম্ভ্রম হানি করতে চেয়েছিলো।
মা নিজের মুখেই তা স্বীকার করে… আইনের চোখে সে অপরাধী… মেম্বারের পরিবার বলেছিলো এনামুলের মা
মিথ্যা কথা বলছে।এনামুলের মার উদ্দেশ্য খারাপ ছিলো…সেটা পুরা না হওয়ায় সে জামালউদ্দিনকে হ্ত্যা করে! মালা আসল সত্য জানে না! তবে এ সব শুনে সে শাশুড়ি মাকে একেবারেই পছন্দ করে না।এনামুলের চাচা কোর্ট কাচারি করে। শেষ পযর্ন্ত আদালত মাকে চৌদ্দ বছর কারাদন্ড দেয়।ঐ রকম মাকে এনামুল গভীর শ্রদ্ধা করে ,ভক্তি করে! কিভাবে করে মালা ভেবে পায় না।
এনামুলের আব্বা মারা যাওয়ার পর এনামুলের দাদা যেটুকু সম্পত্তি ছিলো তা দুই ভাইকে ভাগ করে দেয়।এরপর দাদাজানের মূত্যু হলে এনামুল আর মা, দাদা বাড়ি থেকে একটু দুরে সম্পত্তি হিসাবে পাওয়া তাদের বাড়িতে উঠে যান। চাচাজান তাদের দেখ ভাল করতেন ।এ ঘটনা ঘটার পর এনামুলকে চাচাজান নিজের কাছে নিয়ে যান।
সময় বহতা নদী… এক সময় এনামুল পড়া শেষ করে… গন্জে দোকান দেয়। ভালই চলছে ।এরপর এনামুল নিজেদের বাড়ি ঠিকঠাক করে এ বাড়িতে উঠে আসে।তারপর বিয়ে।এখন পাঁচ বছরের এক সন্তানের বাবা।
এনামুলকে মালার আব্বা খুব পছন্দ করে।তাই মালার সাথে এনামুলের বিয়ে দেয়। তবে পরিবারের অনেকেই এর বিরুদ্ধে ছিলো।কারন এনামুলের মা খুনী এবং জেলে।আব্বার আদেশ আমান্য করার সাহস মালার ছিলো না। বিয়ের পর এনামুলকে তার ভাল লেগে যায়। ভাল মানুষ… শুধু মা পাগল ছেলে …. যে মা খুনী! তাকে কেন যে এত শ্রদ্ধা ভক্তি করে এটা মালা বোঝে না। এ বিষয়েই মালার সাথে খুঁট খাট লেগে যায়।এ ছাড়া মালাকে এনামুল খুবই ভালবাসে।
মালা রান্না ঘরে এসে দেখলো এনামুল, মায়ের পছন্দ মত এক গাদা বাজার করে এনেছে।এখন তাকে এ সব রান্না করতে হবে। না করলে ভীষন রাগ করবে।এমনিতে শান্ত, শিষ্ট তবে রাগলে অন্যরুপ।
মাকে নিয়ে আসতে আসতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলো।এনামুল, মালা আর ছেলে বাবুকে ডাকতে ডাকতে বাড়িতে ঢুকলো। বলল, দেখো কে আসছে? আমার মা, আমার মা!গলায় খুশি ঝরে ঝরে পড়ছে!
মালা দেখলো একজন মধ্য বয়স্কা মহিলা ঋজু ভঙ্গীতে ঘরে
ঢুকলো।মালা বুঝলো উনি মা।উনার ভিতরে কোন দীনতা, হীনতা নেই! উনি যে জেল খেটে ফিরছে তার বিন্দু মাত্র আভাস তার চেহারায় নেই।খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল, তুমি এনামুলের বৌ? খুব মিষ্টি মুখ! এমন সময় বাবু মায়ের পিছন থেকে উঁকি দিলো! মা হেসে হাত বাড়িয়ে তাকে কোলে তুলে নিলো!
মায়মুনার( মা) খুব ভাল লাগছে… এই স্বাধীনতা, এই মুক্ত
বাতাস আর হারিয়ে যাওয়া পরিবারের মাঝে ফিরে! কিন্তু এনামুলের বৌয়ের চোখে সে স্পষ্ট ঘৃনা দেখতে পেলো! ভিতরটা মুচড়ো উঠলো! মালা অনেকটা জোর করে বাবুকে টেনে নিয়ে বলল, আপনি ঘরে গিয়ে গোসল করেন আমি খাবারের ব্যবস্থা করি। মালা যেতে যেতে আরেক বার ঘৃনার দৃষ্টিকে মায়মুনাকে দেখলো।
এনামুল সব দেখলো কিন্তু কিছু বলল না। মাকে বলল, চলো তোমার ঘরে… একবারে গুছানো, ফিটফাট ঘর।
এনামুল মাকে সব দেখিয়ে বাইরে এসে মালাকে ডাকলো ।
মালা ঘরে ঢুকে বলল, কি বলবা? তাড়া তাড়ি বলো! আমার কাজ আছে। এনামুল বিছানায় হেলান দিয়ে বসা। সে সোজা হয়ে বসে বলল, মালা তুমি আমার কাছে বসো!এখন আমি যে কথাগুলি তোমাকে বলতেছি তা আগে কখনো কাউকে বলি নাই.. আজ তোমাকে সব বলবো।মালা অবাক হয়ে বলল, কি কথা?
সেদিন ছিলো ঝড়, বৃষ্টির রাত। আমি, আর মা শোয়ার তৈয়ারি করতে ছিলাম। এমন সময় দরজায় কে যেন কড়া নাড়লো। মা বলল, এত রাতে কে আসলো? আমি দরজা খোলার জন্য আগালাম! মা বলল, তুই খুলিস না আমি দেখি কে!
মা জিজ্ঞেস করল কে? কেউ একজন বলল, দরজা খুলো ! মা বলল, কেউ মনে হয় বিপদে পড়ছে… বলে দরজা খুলে দিলো! আর তক্ষুনি জামালউদ্দিন মেম্বার মাকে ধাক্কা দিয়া ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।মেম্বার একটা লম্পট মানুষ ছিলো। এ হেন খারাপ কাজ নাই যে করে নাই।গ্রামের সবাই জানে।কিন্তু তার দাপটে কেউ কিছু বলতো না। আগেই সে মায়ের উপর কুদৃষ্টি দিছিলো।
এবার মাকে সামনে পেয়ে হুঁশ হারায়ে তার উপর হিংস্র ভাবে ঝাঁপাইয়া পড়লো! আমি তারে টেনে ধরলাম! কিন্তু ঐ জানোয়ারের সাথে আমার মত একটা কিশোর কিভাবে পারবো ?সে আমাকে থাপ্পর দিয়া নিচে ফেলে দিয়া বলল, চক্ষু বন্ধ কইরা চুপ কইরা থাক।মাকে লোকটা টেনে বিছানায় ফেলল, তারপর মার ব্লাউজ… এনামুল আর বলতে পারলো না!ওর চোখ বেয়ে ঝর ঝর করে পানি গড়িয়ে নামলো!
মালা বাকরুদ্ধ হয়ে শুনছে! এনামুল একটু পর বলল, আমি দিশেহারার মত দৌড়ে রান্না ঘরে গিয়ে, বাঁশ কাটার ধারালো দা-টা নিয়া আসলাম! মা তখন,জোরে ধাক্কা দিয়া জানোয়ারটাকে বিছানায় চিত করে ফেলে দিয়েছে! আমি দৌড়ে গিয়ে মেম্বারের গলায় কোপ দিলাম! আমার গায়ে জোর ছিলো! স্কুলে নিয়মিত ফুটবল খেলতাম। এক কোপে মেন্বারের গলা দু ফাঁক …ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো!
মা হতভম্ব হয়ে তাকায়ে ছিলো.. হুঁশ আসতে বলল, কি করলি? এইটা কি করলি?আমার তখন হুঁশ হলো!আমি মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে থাকলাম আর ভয়ে কেঁদে ফেললাম। এদিকে মেম্বারের দুইজন চ্যালা দরজা ধাক্কাইতেছে!মেম্বারের রক্ত বিছানা থেকে মেঝেতে গড়ায়ে নামলো। মা গিয়ে মেম্বারের পাশে পড়ে থাকা দা হাতে তুলে নিলো…, আর অস্বাভাবিক ঠান্ডা গলায় বলল, একটা কথাও বলবি না! যা বলার আমি বলবো! আমার কসম খা বলবি না! আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম কসম বলবো না!
ঐ সময় ধাক্কার চোটে দরজা খুলে গেলো! ওরা ভিতরে আসলো।মা বলল, আমি মেম্বাররে খুন করছি! এনামুল এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো !এরপর কান্না থামলে, দীর্ঘক্ষন চুপ করে থেকে বলল, এক মাত্র একজন মা-ই সন্তানের জন্য এমন ত্যাগ করতে পারে। তারপর বলল, এবার বলো আমার মা কি অসাধারণ নাকি সাধারন ?
মালা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো!
রাত বাড়ছে… মালা টেবিলে খাবার দিয়ে মায়ের ঘরে গিয়ে
বলল , খেতে আসেন।মা, ছেলে খেতে বসলো।মা বলল,
বৌ তুমিও বসো। মালা হেসে বলল, জ্বী না মা,আপনারা দুজনে খান!আমি দেখি! আমি পরে খাবো। মায়মুনা রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে দেখলো… মালার চোখে এখন কোন ঘৃনা নেই! সেখানে বিরাজ করছে শ্রদ্ধা !ব্যাপারটা কিছুই বুঝলো না!
এনামুল আর মা খাচ্ছে…মালা ঝাপসা চোখে এক আসাধারণ মাকে দেখছে…
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply