গতকালই আমি নতুন বউ হয়ে এ বাড়িতে এসেছি।আর আজই আমাকে আমার বর সহ পাশের এক বিল্ডিংয়ে ভাড়াটিয়া হিসেবে পাঠানো হলো।ব্যাপারটা আর যাই হোক, স্বাভাবিক না।
একটা বাড়ি পরেই যাদের নিজেদের বাড়ি আছে তারা ভাড়া বাড়িতে থাকতে যাবে কোন দূঃখে?
যদি নিজেদের বাড়িতে লোকের তুলণায় ঘর কম থাকতো, সেক্ষেত্রে হয়তো মেনে নেওয়া যেত।কিন্তু যে বাড়িতে পাঁচ পাঁচটা বেডরুম,অথচ মানুষ চারজন,সেখানে আর যাই হোক জায়গার অভাব কারণ হতে পারেনা।
নতুন সংসার উপভোগ করার চেয়ে এই বিষয়গুলোই আমাকে বেশি ভাবাচ্ছিলো।আবির, মানে যার হাত ধরে আমার এ বাড়িতে আসা,যার বউ হওয়ার কারণেই আমার এই মানুষগুলোর সাথে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো খুব অদ্ভুতভাবে।গ্রাজুয়েশান শেষ করার পর আমি হণ্যে হয়ে চাকরি খুঁজছিলাম,কেননা,বাসা থেকে বয়স বেশি হয়ে যাচ্ছিলো বলে চাপ দিচ্ছিলো খুব।আর আমি একটা চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত বিয়ে করতে রাজী ছিলাম না মোটেই।চাকরির প্রতি এই অস্বাভাবিক আগ্রহ তৈরি হয়েছিলো আমার বড় দুবোনের বিয়ের পর পরই।তারা দুজন লেখাপড়ায় খুব ভালো থাকা সত্ত্বেও শ্বশুরবাড়ি থেকে চাকরির জন্য নিষেধ করে দেয়।অথচ, তাদের চাহিদাও যে সব পূরণ করে দেয় তাও নয়। ম্যানেজ করে চলতে বলে। ঘরের বউ বাহিরে যাওয়া মানেই নাকি সংসারে অশান্তি কিন্তু সংসারে অভাব হলে কোন সমস্যা নাই এমন চিন্তাধারার মানুষ তারা।সেই চিন্তা থেকেই আমার সিদ্ধান্ত ছিলো আমি আগে চাকরি পাব তারপরই বিয়ে করব।এতে করে চাকরিজীবি বউকে নিয়ে তাদের কিছু বলার থাকবে না।
তেজগাঁও কলেজে লেকচার হিসেবে লিখিত পরীক্ষায় উতরানোর পর যেদিন ভাইভা দিতে গেলাম সেদিন লাস্ট দুজন ক্যানডিডেটই বাকী ছিলো যার মধ্যে আমি একজন আর আবির একজন।ইন্টারভিউবোর্ডে দুজনকে একসাথে ডেকে পাঠানো হলো।আমাদের দুজনেরই নাকি লিখিত পরীক্ষার রেজাল্ট সেম ছিলো আর দুজনেরই একইসাথে টপ নাম্বারও ছিলো।কিন্তু ওনারা যে কোন একজনকেই নিতে পারবেন কারণ আমাদের সাবজেক্টে একটা পোস্টই ফাঁকা আছে।ইন্টারভিউবোর্ডে আমাদের দুজনকে একটাই প্রশ্ন করা হলো,চাকরিটা আমাদের কেন দরকার।”
আমার কারণটা হয়তো ওনাদের কাছে হাস্যকর শোনাবে তাই আমি আবিরকেই আগে বলার সুযোগ দিলাম।আবির এক কথায় উত্তর দিলো একটু অন্যভাবে,”স্যার আমার সমস্যাটা আর্থিক প্রয়োজনের চেয়ে মানসিক বেশি।তিনবার আমি বিসিএস পরীক্ষায় টিকে ভাইভা থেকে ব্যাক করেছি।পাগলের মতো রাত দিন এক করে পড়তাম।কিন্তু লিখিততে টপ করার পরও ভাইভায় টিকতে পারতাম না।শেষের দিকে এটা আমাকে ভীষণ প্যানিক দিত।বাধ্য হয়ে এক সাইকিয়াট্রিস্টের সরণাপন্ন হলে উনি আমাকে ইমিডিয়েট যে কোন জবে ঢোকার পরামর্শ দেন।আপনাদের সারকুলারের ফর্মটাও আমি পূরণ করি নি।আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে আমি গিয়েছিলাম সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে।ওই আমাকে এই তথ্য দেন আর আমার থেকে প্রয়োজনীয় ইনফরমেশন নিয়ে ফর্মটি ফিলাপ করে দেয়।”
আবিরের কথা শুনে আমার ভীষণ মায়া লাগলো। ওর কথা শেষ হবার পর ইন্টারভিউবোর্ডের সবাই একই প্রশ্ন আমার দিকে ছুঁড়ে দিল।
আমিও আমার কারন জানালাম আমতা আমতা করতে করতে। এরপর আমাদের অপেক্ষায় থাকতে দিয়ে বিদায় জানালো।৭ দিনের ভেতর এপয়েন্টমেন্ট লেটার চলে আসে আমার হাতে।মনটা ভালো হবার চেয়ে খারাপ বেশি হয়।যখন বুঝতে পারি আমার জন্য আবিরের চাকরিটা হয়নি।জয়নিং এর দিন অবাক হয়ে যাই যখন আমার পাশে আবিরকে দেখি।ওনারা জানায়,শেষপর্যন্ত আমাদের দুজনকেই ওনারা নিয়েছেন।একজন পারমানেন্ট আরেক জন কিছুদিন গেস্ট টিচার হিসেবে থাকবেন। পরবর্তীতে পারমানেন্ট হবেন।যেহেতু আবির বলেছিলো মানসিক অবস্থার উন্নতির জন্য তার চাকরিটা দরকার,তাই তারা তাকেই গেস্ট টিচার হিসেবে এপয়েন্ট করেছেন।আর আবিরের সাথে এ ব্যাপারে নাকি তারা আগেই ফোনে কথা বলেছেন।আবির রাজী ছিল।
সেদিন কেন জানি ভীষণ আনন্দ হচ্ছিলো আবিরকে কলিগ হিসেবে পাবার পর।হয়তোবা মায়া থেকে ভালোলাগার জন্ম হয়েছিলো।কিন্তু এই ভালোলাগা যে একসময় ভালোবাসায় পরিণত হবে বুঝিনি।কিছুটা চোখে লাগলেও এটাই সত্য যে বিয়ের প্রস্তাবটা আমিই আগে আবিরকে দেই।ও বরাবরই একটু অন্যমনস্ক থাকতো। বিয়ের কথা বলার পরও প্রায় ভাবাবেগ শূণ্য হয়ে
বললো,”ঠিক আছে, আমি মা বাবাকে পাঠিয়ে দেব।”আমি ভাবলাম,হয়তো তার ক্যারিয়ার নিয়ে সে হীণমন্যতায় ভোগে।তাই অন্যমনস্ক থাকে।সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যাবে।
বিয়ে হলে এ বাড়িতে আসার পর থেকে এ পরিবারের সবাইকেই অন্যমনস্ক মনে হয়।সবসময় মনে হয় এড়িয়ে চলতে চায়।পরিবারের সবাই মিলে আড্ডা দেওয়ার ব্যাপারটা ওদের মধ্যে নেই।আমার দম ঘুটতে থাকে।লজ্জার মাথা খেয়ে বিয়ের তিন দিনের দিন আবিরকে প্রশ্ন করে বসলাম,”একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
আবিরঃ কেন নয়? বলে ফেল,প্লিজ।
পাশেই তোমাদের বাড়ি। অথচ আমরা এখানে থাকি কেন?আমরাতো একসাথেই থাকতে পারি।আমরাতো দুইটা মানুষ মাত্র।ও বাড়িতেই একটা রুমে থাকতে পারি।আর তাছাড়া পরিচয়ও তো সবার সাথে ঠিকভাবে হলো না।অনু আপার সাথেও এখন পর্যন্ত দেখা হয় নি।সেদিন আসার সময় মা শুধু বললো,ও ঘুমাচ্ছে।গতকালও তুমি বাজারে যাবার পর একবার গিয়েছিলাম।মা তখনও বললো,অনু আপা ঘুমাচ্ছে।ওনার সাথে যে কবে দেখা হবে?”
আবিরঃ একসাথে অনেক প্রশ্ন করে ফেললে। এবার আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করি।তোমার মাথায় কখনও আসেনি, অনু আপাকে আমি আপা ডাকি।তার মানে অবশ্যই আমার চাইতে বড় অথচ সে আমাদের সাথে থাকে কেন? তার বিয়ে হয়নি কেন?
আবিরের এমন প্রশ্নে আমি হকচকিয়ে গেলাম।আসলেই তো, আমার মাথায় প্রশ্নটা আসেনি কেন?
অনেক দিন পর দু পর্বের ছোট্ট ধারাবাহিক নিয়ে হাজির হয়েছি। আগামীকাল শেষ পর্ব দিয়ে দেব ইন শা আল্লাহ।
Leave a Reply