মাঝরাতে বেলকুনির ঠান্ডা বাতাসে বসে গিটারটা নিয়ে হৃদযন্ত্রে ব্যা’থা দেওয়ার গান করি। সোজা বাংলায় যাকে লোকে বলে ছ্যাঁ’কা খাওয়া গান। আমার কাছে এগুলোই জীবনের গান, ভালোই লাগে বেশ। তবে পাশের বাড়ির বেলকুনিতে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে টপটপ করে চোখের জল ফেলে আর মাঝেমাঝে অদ্ভুত চাহনি দেয় আমার দিকে। তাকে দেখে মনে হয় সে খুব অসস্তিতে ভুগছে। স্থির হতে পারছে না। কি অদ্ভুত বিষয় !
এ বাড়িতে এসেছি মাত্র দশদিন হলো। গ্রাজুয়েশন শেষ করে চাকরির প্রিপারেশন নিচ্ছি। যদিও একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে আমি জয়েন করেছিলাম মাস খানেক। তবে বাবার স্বপ্ন সরকারি চাকুরি। এমন চাওয়া এসময়ে অবশ্য বেশ স্বাভাবিক। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে একটা শক্ত ভীত প্রয়োজন। সবাই তাই ভাবে। আর আমি ভাবি এটা বাবার স্বপ্ন। ব্যাস, সব ছেড়েছুড়ে স্বপ্ন পূরণে লেগে পড়েছি।
আমি ভার্সিটি লাইফ থেকেই শখের বসে টুকটাক গান করি। একা মানুষ। বসে বসে আর করিই বা কি। নিঃসঙ্গ মানুষদের জন্য গান একটা ভালো মানের ওষুধ। গান মানুষকে হাসায়, কাঁদায়, মনে প্রেম জাগায়। জীবনে সুখ দুঃখ সব ধরনের অনুভূতির দরকার আছে।
নভেম্বর মাস। হালকা শীত পড়া শুরু হয়েছে। ঢাকার এই যান্ত্রিক দূষিত শহরে শীতের প্রভাব খুব কম। তবে এ বছর একটু শীতের বাতাস পাচ্ছি। এই অনুভূতিটা আমার কাছে মন্দ নয়। রাত অনেক বড় যায়। কখনো কখনো বিরক্ত বোধ করি। মাঝেমাঝে পড়ার ফাঁকে মনে একটা শিল্পী ভাব চলে আসে আর আমাকে বলে, ‘প্লাবন, চল একটু তোর মনে প্রেমের সাইক্লোন ঘটিয়ে দিই।’ তখন আমি সব ফেলে বসে পড়ি গিটারের তারে টুঙটাঙ করতে।
বাড়ি ভাড়া নেওয়ার পরে যখন তল্পিতল্পা গুটিয়ে এ বাড়িতে প্রবেশ করছিলাম তখন বাড়িওয়ালা আমার কাধে ঝোলানো গিটারটা দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই, গানবাজনা করা হয় নাকি?’ প্রশ্ন শুনে খানিকটা থতমত খেয়ে গেলাম কারণ অনেকেই গানবাজনা করার মতো ভাড়াটিয়া রাখতে পছন্দ করে না। আমিও মানুষটা কারো সাতে পাঁচে যেতে চাই না। আমি চুপচাপ থাকতে ভালোবাসি। আমার কারণে কারো সমস্যা হোক আমি তা কেন চাইবো। আমি নিজেও শান্তি চাই, মানুষকেও শান্তিতে দেখতে চাই। সরল ভাষায় জবাব দিলাম, ‘গানবাজনা বলতে আমি মাঝেমাঝে গান করি তবে সেটার আওয়াজ নিচতলায় আপনাদের কান পর্যন্ত পৌছানোর কথা নয়।’
বাড়িওয়ালা আমার এক বন্ধুর আত্মীয়। সেই সুবাদে এ পর্যন্ত যতবার কথা বলেছি তা দেখে মনে হয় বাড়িওয়ালা খুব একটা জটিল মানুষ নয়। তিনি মুচকি হেসে বললেন, ‘না না, আমাদের সমস্যা হবে না। তবে একটু খেয়াল রাখবেন আমাদের পাশের বাড়ির লোকজনের যেন কোন অসুবিধা না হয়। একটু আস্তে গান করলেই হবে।’
আমি বললাম, ‘জ্বী আচ্ছা। এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকুন।’ বুঝলাম, কেউই অযাচিত কারণে প্রতিবেশীর কটা’ক্ষের মুখোমুখি হতে রাজি নয়। তা মাথায় রাখা আমার দায়িত্ব।
কিন্তু এখন পড়েছি বিপদে। আমার জন্য পাশের বাড়ির মেয়েটার অসুবিধা হচ্ছে তা আমি সাধারণ জ্ঞানেই বুঝে যাই।
এ বাড়িতে আসার পরে প্রথম দুদিন বাড়ি গোছগাছ করতেই কেটে গেল। একদিন পরিচ্ছন্ন শান্ত পরিবেশে টানা ঘুম দিলাম। সন্ধ্যায় এককাপ চা হাতে বেলকুনিতে এসে দাঁড়ালাম। চারপাশটা তখন রঙিন আলোয় পরিপূর্ণ। লক্ষ্য করে দেখলাম পাশের বাড়িতে কোন আলো নেই। হয়তো তারা বাড়িতে নেই। সেদিকে মাথা না ঘামিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে সন্ধ্যাটা উপভোগ করতে থাকলাম।
আজকাল কেন জানি আমি সবকিছু উপভোগ করতে শিখেছি। বরাবরই আমি মানুষটা অভিযোগ কম করি। যেটা যেমন তাকে তেমন ভাবতেই অভ্যস্ত। কিন্তু আজকাল অনুভূতিগুলো বেশ আলাদা। সবকিছুর মধ্যে ভালোলাগার ঘ্রাণ পেতে চেষ্টা করি। কারণ দিন তো ফুরিয়ে যাচ্ছে। সৈয়দ শামসুল হকের লেখায় এন্ড্রু কিশোর সুর মিলিয়ে বলেছিলেন, ‘হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলেই ঠু’স।’ কে বলতে পারে দমটা কখন ফুরিয়ে যায়। সময়গুলো যেমনই হোক, উপভোগ করা উচিত।
সে রাতে টানা কয়েকঘন্টা একঘেয়ে পড়াশোনার পরে আমি দম পেতে বেলকুনিতে এসে দাঁড়ালাম। অনেকদিন পরে একটু গান গাইতে ইচ্ছা হলো। তখন রাত আড়াইটা। টুল পেতে গিটারটা নিয়ে বসলাম। আমার আধুনিক গানের চেয়ে পুরোনো গানগুলো বেশি পছন্দের। সেগুলোতে একটা অন্যরকম সুর, হৃদয় ছোয়া কথা রয়েছে। বিশেষ করে আমার রবীন্দ্র অনেক ভালো লাগে। স্কেলে স্কেলে পরিপূর্ণ মিলাতে না পারলেও খুব বেশি খারাপ হয় না। নিজে উপভোগ করি। ভার্সিটির প্রোগ্রামে দুই একবার গানও করেছি। সবাই প্রশংসা করে। কতটুকু সত্য তা জানা নেই। প্রিয় একটা গান ধরলাম,
” আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে
আমি পাই নি, তোমায় দেখতে আমি পাই নি।
বাহির পানে চোখ মেলেছি, বাহির পানে।
আমার হৃদয় পানে চাই নি।….. “
গানের মধ্যে প্রচন্ড ডুবে ছিলাম। হঠাৎ খট করে একটা দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। মাঝরাতে এমন শব্দ সামান্য ভীতিকর। আশেপাশে তাকিয়ে তেমন আশ্চর্য কিছুই দেখলাম না। কিন্তু এবার আর গানে মনোনিবেশ করতে পারলাম না। রুমে চলে এলাম। রুমে ঢুকতেই দেখলাম অনেকগুলো চাকরির গাইড আমার দিকে তাকিয়ে হা পি’ত্তেশ করছিল, ‘গাধা ছেলে, গান গেয়ে হবে টা কি শুনি। দুদিন না খেয়ে থাকলে কি ঠোঁট দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি গান বের হবে? জীবনে টাকা দরকার রে পাগলা।’
আমি মুচকি হেসে বইগুলোর উপদেশ পালনে বসে পড়লাম।
তবে প্রতি রাতে গান আমাকে করতেই হয়। হোক সে দশ মিনিট বা ঘন্টাভর। এটা আমার কাছে সিগারেটের মতো ভালোবাসার। সিগারেট আমার প্রথম ভালোবাসা আর গান দ্বিতীয়। আর নারী গজ গজ মাইল মাইল দূরে রয়েছে। তবে জীবনে যে নারী চাই না তা ও নয়।
পরের দিন রাতে যখন গিটারটা নিয়ে গান ধরলাম। কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে পাশের বেলকুনিতে কেউ দাঁড়ালো। যদিও এ বাড়ি থেকে কখনো কাউকে বের হতে দেখিনি তবুও ধরেই নিলাম এটা মানুষ। কারণ ভুত আজ অব্দি আমার আশেপাশে আসে নি। ভূতেরা হয়তো আমাকে পছন্দ করে না। আমি গান চালিয়ে গেলাম। একটু পরে তাদের বেলকুনিতে একটি নীল ডিম লাইট জ্বলে উঠলো। আমি আড়চোখে দেখলাম মাত্র। মেয়েটি গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমার কন্ঠে সুরধ্বনি ছড়াচ্ছিলাম, ‘আমারে উড়াইয়া দিও পালের বাতাসে। আমারে ভাসতে দিও একলা আকাশে। রাইখো বন্ধু আমায় তোমার বুকেরও পাশে। সুখের আগুন নিভা গেলে দুঃখের হুতাশে….”
স্পষ্ট বুঝলাম মেয়েটা কাঁদছিল। সে বেশ অস্বস্তিতে ছিল। আমি তার দিকে তাকিয়ে থেমে গেলাম। ইচ্ছা হলো জিজ্ঞেস করতে তার কি হয়েছে। কিন্তু কি যেন ভেবে আর জিজ্ঞেস করা হলো না। নিজেও বেশ বিব্রত হলাম। তার কি কষ্ট আমি জানিনা তবে আমি তাকে একা থাকতে দিতে চাই। নিজের মনের আর্তনাদ প্রকাশের জন্য একা থাকা দরকার।
পরপর সাতটা দিন। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আমি রাতে গান করি। সে বেরিয়ে আসে। দাঁড়িয়ে থাকে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ে ওর। মাঝরাতে আমি গান করি, একজন নারী তা শোনে এটা একপ্রকার স্বর্গীয় অনুভূতি। কিন্তু তার মন খারাপ, তার চোখে অসহ্য য’ন্ত্রণা অামাকে ব্যাথিত করে। আমি না এসেও থাকতে পারি না। সে আমার প্রিয় কেউ নয়। তবে সে একজন নারী। সুদর্শন নারী। পুরুষ নারীসঙ্গ চায়। আমিও ব্যতিক্রম নই। কিন্তু তার কান্না আমাকে অস্থির করে। আমার মনোযোগ নষ্ট করে। একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘এক্সকিউজ মি। আপনি কি কোন প্রবলেমে আছেন?’ সে আমার দিকে ঘুরে তাকালো শুধু কিন্তু জবাব দিল না। দরজাটা বন্ধ করে রুমে চলে গেল। নিশ্চয়ই সে দরজার সাথে পিঠখানা লাগিয়ে কান্না করবে তবুও সে মুখ ফুটে আমাকে বলতে পারলো না।
মনে হচ্ছিল, ‘আচ্ছা সে কি কোনভাবে তার ভালোবাসার মানুষের থেকে কষ্ট পেয়েছে। এভাবে কাঁদে কেন? কষ্ট কেন পায়?’
পরের সপ্তাহে আমার একটা চাকরির পরীক্ষা ছিল। দিন চারেক গানবাজনা বন্ধ রেখে বইয়ে মুখ ডুবিয়ে রাখলাম আঠারো ঘন্টা।
পরীক্ষা শেষ করে বের হয়েছিলাম বন্ধুদের সাথে। সারাদিন ঘুরেছি। রাতে রুমে বসে কানে এয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনছিলাম। এই কয়েকদিনের ব্যস্ততায় মেয়েটাকে ভুলে গিয়েছিলাম। হঠাৎ মনে পড়তেই লাফিয়ে উঠলাম। দরজাটা খুলে বের হলাম। হাতে গিটার নেই। দেখলাম সে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিল। ফিরফিরে বাতাস বইছে। সে গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। আমিও তার মতো একইভাবে গ্রিল ধরে দাঁড়ালাম।
একটু পরে সে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল, ‘গত পাঁচদিন আসেন নি কেন?’
আমি বললাম,
— আপনি কথা বলা পারেন?
মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। তারপর বলল,
— আপনি ভালো গান করেন।
প্রশংসা পেয়ে একটু সুখ অনুভব করলাম। বললাম,
— আপনার এ ধরনের গান পছন্দ?
মেয়েটি মুচকি হাসলো। আবারো বেশ অবাক হলাম। বললাম,
— ওমা আপনি হাসতেও জানেন? আজকে
অনেক সারপ্রাইজ দিচ্ছেন কিন্তু। হজম হচ্ছে
না। বাই দ্য ওয়ে আমি প্লাবন।
মেয়েটি আবারো হাসলো। তার হাসিটা নেশা ধরানোর মতো ছিল। আমার বিশ্বাস দামী কোন ব্রান্ডের মদে হয়তো আমার এতো নেশা হবে না যতটা তার এক মুচকি হাসিতে চোখে ধাধা লাগিয়ে দিয়েছে। মেয়েটি বেশ আশা নিয়ে বলল,
— আমার জন্য একটা গান করবেন?
বললাম,
— চেষ্টা করে দেখবো জানিনা কতটুকু সফল
হবো। তবে এই ব্যর্থতায় আমার খারাপ লাগা
থাকবে না বিন্দুমাত্র, এটুকু নিশ্চিত থাকুন।
— আচ্ছা ঐ গানটা গেয়ে শোনাবেন, ‘যখন
পড়বে না মোর…
আমি বললাম,
— এটা আমার প্রিয় গান।
— একটু তাড়াতাড়ি শুরু করুন না।
— অনেক তাড়া আপনার?
মেয়েটি অস্থিরতায় ছিল কিন্তু জবাব দিল না। আমি রুম থেকে গিটারটা এনে গান শুরু করলাম,
” যখন পড়বে না পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইবো না, আমি বাইবো না মোর খেয়া
তরী এই ঘাটে।
………………………………………………………..
……………………………………………………….
তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি। সকল খেলা, সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি। আহা, কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি। নতুন নামে ডাকবে মোরে বাঁধবে। বাঁধবে নতুন বাহুডোরে, আসবো যাবো চিরদিনের সেই আমি। “
আমার গান শেষ হওয়ার আগেই মেয়েটি মুহূর্তেই মুখে কান্না চেপে রুমে চলে গেল। পরপর দুদিন সে এলো না। আমার খারাপ লাগতে শুরু করলো। আমার অনেক প্রশ্ন অপূর্ণই থেকে গেল।
পরপর পনেরোটা দিন আমি তার দেখা পাই না। প্রচন্ড ছটপট করি। বেলকুনিতে পাইচারি করি। সে আমার পূর্ব পরিচিত নয়, বন্ধু নয়, কোন আত্মীয় নয় তারপরেও ওকে না দেখে আমার অসহ্য অনুভূতি হয়। বারকয়েক চেষ্টা করেছি বাড়িওয়ালাকে জিজ্ঞেস করার। বাড়িওয়ালার বউ মাঝেমাঝে আমাকে এটা সেটা খাবার দিয়ে যায়। আত্মীয়তার সুবাদে মাঝেমাঝে কথা তো হয়ই কিন্তু সাহস করে বলতে পারি না। তাদের একটা ছোট্ট পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চা আছে। ওকে আমি জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করেছি কিন্তু এতো ছোট্ট ছেলের মাথায় আর কি থাকে। সে মেয়েটার সম্পর্কে কিছুই বলতে পারে নি।
শুক্রবার সকাল। ঘুম থেকে উঠতে বেশ লেট হয়েছে। দরজা ধা’ক্কানোর আওয়াজ পেলাম। চোখ মুছতে মুছতে উঠে দরজাটা খুললাম। বাড়িওয়ালা ভাবির সাথে আমার আম্মুর বয়সী এক অপরিচিত ভদ্রমহিলা উপস্থিত। আমি সালাম দিলাম। মহিলাটি আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়ে বিব্রত হচ্ছিল। আমিও চুপ ছিলাম। সহসা উনি বলে ফেললেন,
— আমি অবন্তীর মা।
আমি নিশ্চিত ছিলাম ঐ মেয়েটিই অবন্তী। যদিও সে আমাকে ওর নামটা জিজ্ঞেস করার সুযোগ পর্যন্ত দেয় নি। তবে এতদিন পরে আমার বুকচাপা পাথরটা নেমে গেল। জিজ্ঞেস করলাম,
— জ্বী আন্টি, কিছু হয়েছে?
উনি বললেন,
— আমাদের বাড়িতে একটু আসতে পারবে?
আমি বললাম,
— জ্বী দুই মিনিট সময় দিন।
আমি ফ্রেশ হয়ে কোন কথা ছাড়াই উনার সাথে যেতে রাজি হলাম। উনার সাথে হাটছিলাম। বলল,
‘আমার মেয়েটা দিনদিন কথা বলাই ভুলে যাচ্ছিল। বহুদিন পরে সে আমার কাছে কিছু চেয়েছে। তোমাকে এভাবে বলতে আমিও বিব্রত হচ্ছি বাবা। কিন্তু একজন মায়ের অনুভূতি তুমি হয়তো বুঝবে।’
আমি সঠিক বুঝলাম না তবে এটুকু বুঝলাম অবন্তী কোন সমস্যাই আছে আর তার মা বাধ্য হয়ে আমার কাছে এসেছে। ওর মা ভাবছে আমি কিছুটা জানি যদিও ও আমাকে কিচ্ছু বলে যায় নি। দোয়া করছিলাম যেন ওর খারাপ কিছু না হয়।
অবন্তীর মা আমাকে ওর রুমে নিয়ে এলো। আমি এটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। অবন্তী অসুস্থ। তার নাকে অক্সিজেন পাইপ লাগানো। হাতে ক্যানুলা করা। চোখের নিচে গাঢ় কালো দাগ। অবন্তীর মা বেরিয়ে গেল। অবন্তী ধীরে ধীরে উঠে বসলো। তারপরে আমাকে বলল,
— বসুন।
আমি নার্ভাস ছিলাম। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। চোখে অজান্তেই জল চলে আসছিল। অবন্তী মুচকি হাসলো। বলল,
— গিটার নিয়ে আসেন নি?
অামি মাথা নাড়িয়ে বললাম, ‘না।’
সে আস্তে আস্তে বলল,
— অনেকদিন আপনার গান শোনা হয় না।
— হ্যা, অনেকদিন আপনি বারান্দায় আসেন না।
— চিকিৎসার জন্য বাইরে গিয়েছিলাম।
— কি সমস্যা তোমার?
— ফুসফুসের ক্যান্সার। স্টেজ ওয়ান।
বেশ স্বাভাবিকভাবে সে বলে দিল কিন্তু আমি স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। আমার হাত পা কাঁপছিল। সে বলেই চলল,
— ডাক্তার বলেছে আমার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা
আছে। আচ্ছা আপনি বলুন তো আমি কি সুস্থ
হবো?
আজব কঠিন এক প্রশ্নের মুখোমুখি ফেললো সে আমাকে। ক্যান্সার থেকে অনেক মানুষ আজকাল সুস্থ হচ্ছে। আবার বেশিরভাগই তো সুস্থ হয় না। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। দীর্ঘক্ষণ চুপ থেকে বললাম,
— আমি দোয়া করবো তুমি যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে
যাও।
অনেকক্ষণ সে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তারপরে বলল,
— আমি ভালো চা বানাতে পারি। কিন্তু শরীরটা
এতো দূর্বল যে…
— থাক না। সুস্থ হবার পরে না হয় দিও। তোমার
হাতের চা খাওয়ার অপেক্ষায় থাকবো।
অনেকটা সময় আমি অবন্তীর পাশে বসে গল্প করলাম।
বুঝলাম দুনিয়াতে সব কষ্ট প্রেমের নয়। কিছু ল’ড়াই জীবনের। কিছু আকুতি, কিছু কান্না বাঁচার জন্য।
সেদিন বাড়ি ফিরে দরজাটা বন্ধ করে দেওয়ালে মুখ চেপে আমি অনেক কেঁদেছি। জানিনা কেন। এত অল্প সময়ের পরিচয়ে আমি ওকে আপন করে ফেলেছি। ওকে হারাতে চাই না আমি। সেদিন আমি অবন্তীর জন্য আমার প্রথম ভালোবাসা সিগারেটকে জীবন থেকে সরিয়ে দিলাম। কারণ কেউ কেউ সুস্থভাবে নিঃশ্বাসটুকু নিতে পারছে না। আর আমি শখের বসে সেটাকে নষ্ট করছি। ছেড়ে দিলাম সিগারেট। আমি এই শহরের দূষিত বাতাসে হলেও স্বাভাবিক নিঃশ্বাস উপভোগের প্রত্যাশা রাখি। প্রথম ভালোবাসার জায়গাটা দখল করলো কয়েকদিন সেই অপরিচিতা মেয়েটি যে এখন আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
এখন নিয়ম করে তার বাড়ি যাওয়া হয়। তাকে গান শুনাই। ওর ধীর কন্ঠে গল্প শুনি। ওকে গল্পের বই পড়ে শুনাই। চেষ্টা করি হাসাতে। বাঁচার আশ্বাস দিতে। মাঝেমাঝে তাকে বেশ স্বাভাবিক দেখায় আবার কখনো কখনো বেশ অসুস্থ হয়ে যায়। আমি আশা ছাড়ি না। হার মানার পাত্র অামি নই। যদিও সব নিয়তির খেলা তবে ওর সাথে শীতের সকালে এ শহরের দূষিত বাতাসে, কোন এক নদী তীরে, কোন এক ভার্সিটির সোজাসাপ্টা রাস্তায় হাটতে চাই। ওর বানানো এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে নতুন গল্প বুনতে চাই। আমি চাই আমার যেনতেন কন্ঠের গান সে শুনুক। আমি চাই সে আমার হোক। জানিনা সে কতদিন বাঁচবে তবে তার বাকি সময়টা আমার হোক। তার ভালোবাসাটা আমার হোক আর আমারটা তার।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply