গতকালই আমি নতুন বউ হয়ে এ বাড়িতে এসেছি।আর আজই আমাকে আমার বর সহ পাশের এক বিল্ডিংয়ে ভাড়াটিয়া হিসেবে পাঠানো হলো।ব্যাপারটা আর যাই হোক, স্বাভাবিক না।
একটা বাড়ি পরেই যাদের নিজেদের বাড়ি আছে তারা ভাড়া বাড়িতে থাকতে যাবে কোন দূঃখে?
যদি নিজেদের বাড়িতে লোকের তুলণায় ঘর কম থাকতো, সেক্ষেত্রে হয়তো মেনে নেওয়া যেত।কিন্তু যে বাড়িতে পাঁচ পাঁচটা বেডরুম,অথচ মানুষ চারজন,সেখানে আর যাই হোক জায়গার অভাব কারণ হতে পারেনা।
নতুন সংসার উপভোগ করার চেয়ে এই বিষয়গুলোই আমাকে বেশি ভাবাচ্ছিলো।আবির, মানে যার হাত ধরে আমার এ বাড়িতে আসা,যার বউ হওয়ার কারণেই আমার এই মানুষগুলোর সাথে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো খুব অদ্ভুতভাবে।গ্রাজুয়েশান শেষ করার পর আমি হণ্যে হয়ে চাকরি খুঁজছিলাম,কেননা,বাসা থেকে বয়স বেশি হয়ে যাচ্ছিলো বলে চাপ দিচ্ছিলো খুব।আর আমি একটা চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত বিয়ে করতে রাজী ছিলাম না মোটেই।চাকরির প্রতি এই অস্বাভাবিক আগ্রহ তৈরি হয়েছিলো আমার বড় দুবোনের বিয়ের পর পরই।তারা দুজন লেখাপড়ায় খুব ভালো থাকা সত্ত্বেও শ্বশুরবাড়ি থেকে চাকরির জন্য নিষেধ করে দেয়।অথচ, তাদের চাহিদাও যে সব পূরণ করে দেয় তাও নয়। ম্যানেজ করে চলতে বলে। ঘরের বউ বাহিরে যাওয়া মানেই নাকি সংসারে অশান্তি কিন্তু সংসারে অভাব হলে কোন সমস্যা নাই এমন চিন্তাধারার মানুষ তারা।সেই চিন্তা থেকেই আমার সিদ্ধান্ত ছিলো আমি আগে চাকরি পাব তারপরই বিয়ে করব।এতে করে চাকরিজীবি বউকে নিয়ে তাদের কিছু বলার থাকবে না।
তেজগাঁও কলেজে লেকচার হিসেবে লিখিত পরীক্ষায় উতরানোর পর যেদিন ভাইভা দিতে গেলাম সেদিন লাস্ট দুজন ক্যানডিডেটই বাকী ছিলো যার মধ্যে আমি একজন আর আবির একজন।ইন্টারভিউবোর্ডে দুজনকে একসাথে ডেকে পাঠানো হলো।আমাদের দুজনেরই নাকি লিখিত পরীক্ষার রেজাল্ট সেম ছিলো আর দুজনেরই একইসাথে টপ নাম্বারও ছিলো।কিন্তু ওনারা যে কোন একজনকেই নিতে পারবেন কারণ আমাদের সাবজেক্টে একটা পোস্টই ফাঁকা আছে।ইন্টারভিউবোর্ডে আমাদের দুজনকে একটাই প্রশ্ন করা হলো,চাকরিটা আমাদের কেন দরকার।”
আমার কারণটা হয়তো ওনাদের কাছে হাস্যকর শোনাবে তাই আমি আবিরকেই আগে বলার সুযোগ দিলাম।আবির এক কথায় উত্তর দিলো একটু অন্যভাবে,”স্যার আমার সমস্যাটা আর্থিক প্রয়োজনের চেয়ে মানসিক বেশি।তিনবার আমি বিসিএস পরীক্ষায় টিকে ভাইভা থেকে ব্যাক করেছি।পাগলের মতো রাত দিন এক করে পড়তাম।কিন্তু লিখিততে টপ করার পরও ভাইভায় টিকতে পারতাম না।শেষের দিকে এটা আমাকে ভীষণ প্যানিক দিত।বাধ্য হয়ে এক সাইকিয়াট্রিস্টের সরণাপন্ন হলে উনি আমাকে ইমিডিয়েট যে কোন জবে ঢোকার পরামর্শ দেন।আপনাদের সারকুলারের ফর্মটাও আমি পূরণ করি নি।আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে আমি গিয়েছিলাম সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে।ওই আমাকে এই তথ্য দেন আর আমার থেকে প্রয়োজনীয় ইনফরমেশন নিয়ে ফর্মটি ফিলাপ করে দেয়।”
আবিরের কথা শুনে আমার ভীষণ মায়া লাগলো। ওর কথা শেষ হবার পর ইন্টারভিউবোর্ডের সবাই একই প্রশ্ন আমার দিকে ছুঁড়ে দিল।
আমিও আমার কারন জানালাম আমতা আমতা করতে করতে। এরপর আমাদের অপেক্ষায় থাকতে দিয়ে বিদায় জানালো।৭ দিনের ভেতর এপয়েন্টমেন্ট লেটার চলে আসে আমার হাতে।মনটা ভালো হবার চেয়ে খারাপ বেশি হয়।যখন বুঝতে পারি আমার জন্য আবিরের চাকরিটা হয়নি।জয়নিং এর দিন অবাক হয়ে যাই যখন আমার পাশে আবিরকে দেখি।ওনারা জানায়,শেষপর্যন্ত আমাদের দুজনকেই ওনারা নিয়েছেন।একজন পারমানেন্ট আরেক জন কিছুদিন গেস্ট টিচার হিসেবে থাকবেন। পরবর্তীতে পারমানেন্ট হবেন।যেহেতু আবির বলেছিলো মানসিক অবস্থার উন্নতির জন্য তার চাকরিটা দরকার,তাই তারা তাকেই গেস্ট টিচার হিসেবে এপয়েন্ট করেছেন।আর আবিরের সাথে এ ব্যাপারে নাকি তারা আগেই ফোনে কথা বলেছেন।আবির রাজী ছিল।
সেদিন কেন জানি ভীষণ আনন্দ হচ্ছিলো আবিরকে কলিগ হিসেবে পাবার পর।হয়তোবা মায়া থেকে ভালোলাগার জন্ম হয়েছিলো।কিন্তু এই ভালোলাগা যে একসময় ভালোবাসায় পরিণত হবে বুঝিনি।কিছুটা চোখে লাগলেও এটাই সত্য যে বিয়ের প্রস্তাবটা আমিই আগে আবিরকে দেই।ও বরাবরই একটু অন্যমনস্ক থাকতো। বিয়ের কথা বলার পরও প্রায় ভাবাবেগ শূণ্য হয়ে
বললো,”ঠিক আছে, আমি মা বাবাকে পাঠিয়ে দেব।”আমি ভাবলাম,হয়তো তার ক্যারিয়ার নিয়ে সে হীণমন্যতায় ভোগে।তাই অন্যমনস্ক থাকে।সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যাবে।
বিয়ে হলে এ বাড়িতে আসার পর থেকে এ পরিবারের সবাইকেই অন্যমনস্ক মনে হয়।সবসময় মনে হয় এড়িয়ে চলতে চায়।পরিবারের সবাই মিলে আড্ডা দেওয়ার ব্যাপারটা ওদের মধ্যে নেই।আমার দম ঘুটতে থাকে।লজ্জার মাথা খেয়ে বিয়ের তিন দিনের দিন আবিরকে প্রশ্ন করে বসলাম,”একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
আবিরঃ কেন নয়? বলে ফেল,প্লিজ।
পাশেই তোমাদের বাড়ি। অথচ আমরা এখানে থাকি কেন?আমরাতো একসাথেই থাকতে পারি।আমরাতো দুইটা মানুষ মাত্র।ও বাড়িতেই একটা রুমে থাকতে পারি।আর তাছাড়া পরিচয়ও তো সবার সাথে ঠিকভাবে হলো না।অনু আপার সাথেও এখন পর্যন্ত দেখা হয় নি।সেদিন আসার সময় মা শুধু বললো,ও ঘুমাচ্ছে।গতকালও তুমি বাজারে যাবার পর একবার গিয়েছিলাম।মা তখনও বললো,অনু আপা ঘুমাচ্ছে।ওনার সাথে যে কবে দেখা হবে?”
আবিরঃ একসাথে অনেক প্রশ্ন করে ফেললে। এবার আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করি।তোমার মাথায় কখনও আসেনি, অনু আপাকে আমি আপা ডাকি।তার মানে অবশ্যই আমার চাইতে বড় অথচ সে আমাদের সাথে থাকে কেন? তার বিয়ে হয়নি কেন?
আবিরের এমন প্রশ্নে আমি হকচকিয়ে গেলাম।আসলেই তো, আমার মাথায় প্রশ্নটা আসেনি কেন?
শেষপর্ব
আবির বললো,”আমি বলছি।আজ থেকে তিন বছর আগে আনু আপার বিয়ে হয়।তখন আনু আপা আমাদের পরিবারের মধ্যমণি ছিল।বাবা মার প্রথম সন্তান।প্রাণবন্ত,উচ্ছল।তার বর খুঁজতে গিয়ে আব্বা,আম্মার সেকি টেনশান।হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমার মনে হতো তখন আমাদের মতো সুখি পরিবার পৃথিবীতে ২য় টি ছিল না। আর্থিক দিক দিয়ে যেমনি হোক আমরা চাচ্চিলাম একটা ভালো পরিবার,ভালো মনের মানুষকে যে আনুপাকে বুঝবে।আল্লাহ ভরসা করে এক শুভ দিন দেখে আপার বিয়ে দিয়ে দিলাম।খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে গেল আপা, দুলাভাইয়ের।একদমই কল্পনাতীতভাবে বিয়ের এক বছরের মাথায় আমার দুলাভাই রোড এক্সিডেন্টে মারা যান।তখনও আপা নিঃসন্তান।আপার শ্বশুড় বাড়ি ছিলো রাজশাহী বিভাগের একটা মফস্বলে।আমরা অনেক বার আপাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম।আপা কিছুতেই আসতে চাননি।দুলাভাইয়ের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা এর প্রমাণ।সে দুলাভাইয়ের স্মৃতিকে আকড়ে ধরেই একাকি পুরো জীবন পাড় করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল।আরো এক বছর পর আপার শ্বশুর বাড়ি থেকে ফোন আসে। আপা নাকি খুব অসুস্থ।ছুটে যাই দেখতে।গিয়ে দেখি, আমার আপা আর আপা নেই।এ তো পুরো উন্মাদ। ওরা বললো,দুলাভাই গত হওয়ার পর থেকে নাকি আপা একটু একটু করে অদ্ভুত আচরণ করা শুরু করে। মাঝে মাঝেই বাড়িতে অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস খুঁজে পাওয়া যেত না।কয়েকদিন পর দেখা যেত, সেটা যে জায়গার জিনিস সেখানেতো নেইই।বরং অদ্ভুত কোন জায়গা, যেখানে সেটার থাকার কথা নয়, সেখানে কেউ যত্ন করে রেখে দিয়েছে।পরে সেটা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে আনুআপা বলতো,”ওটা আমি রেখেছি”।কারণ জানতে চাইলে বলতো, আমি তো ইচ্ছে করে রেখিনি।আপনার ছেলে বলেছিলো বলেই তো রেখেছি।তার শ্বাশুড়ি বলা তো,”কই, আমি তো আমার ছেলেকে দেখতে পাচ্ছি না।”তখন আনু আপা আরও কনফিডেন্টের সাথে বলতো,আমার মতো করে আপনার ছেলেকে আর কেউ ভালোবাসে না।তাই সবাই তাকে দেখতেও পায়না। প্রথম প্রথম কেউ আমলে নেয় নি তার এই বেসংলগ্ন কথাবার্তা।।ভেবেছে,দুলাভাই মারা যাওয়ার কারণে আপার হয়তো তাকে নিয়ে হ্যালুসিনেশান হচ্ছে। প্রায়ই উলটা পালটা বকত।ওনার শ্বশুড়িকে বলে,এই ডাইনি বুড়িটা আমার স্বামিকে মেরেছে।এইসব হাবিজাবি।সবাইকে সে তার শত্রু রূপে সন্দেহ করা শুরু করল।কেউ খেতে দিলে বলে “বিষ দিয়ে আমাকে মারতে এসেছিস?আমাকে মারলেই তো তোদের শান্তি।”
দুলাভাইয়ের দাদী তখনও বেঁচে ছিলেন।ওনার জোড়াজুড়িতে পরবর্তীতে বাড়িতে এক ওঝা আনা হয়। সেই ওঝা আপাকে দেখে বলেন,স্বামী ছাড়া থাকে বলে এক শক্তিশালী জিন নাকি তাকে আছর করেছে।বিয়ে দিলে নাকি ঠিক হয়ে যাবে।”
আমি শুধু গিলছিলাম আবিরের কথাগুলো।আর ভাবছিলাম। এই পরিবারটার কত সুখি হওয়ার কথা ছিল কিন্তু বাস্তবতা কতটা নির্মম।
আবির আবার বলা শুরু করল।
“আমরা আপাকে নিয়ে আসলাম।আমাদের দুনিয়া আপাতে আটকে গেল।নতুন নতুন আরও অনেক ঘটনা ঘটতে লাগলো। আপা আমাদেরকে সন্দেহ করা শুরু করল।এভাবে কখনও কখনও সারাদিন না খেয়ে থাকত।আম্মা একটার পর একটা পদ রান্না করে তার সামনে নিয়ে যায়।একেকটা পদে একেকটা সমস্যা বলে আপা একে একে সব খাবার ফিরিয়ে দেয়।বেলার পর বেলা না খেয়ে থাকে।তার চেহারার দিকে তাকানো যায় না।একদিন আব্বা হোটেল থেকে খাবার এনে বলল,” এটা তোর আম্মা বানায়নি মা।আমরা কেউ হাত দিয়ে ছুঁইনি।একটু খা মা।না খেলে তো বাঁচবিনা।প্রমাণ স্বরূপ আব্বা খাবারের প্যাকেট না খুলে তাকে দিয়ে বলে,”এই দেখ আনু,এই খাবারটা অমুক হোটেল থেকে এনেছি,প্যাকেটের গায়ে নাম লেখা আছে।”সেবার আপা দুদিন পর দানাপানি মুখে দিয়েছিলো।এরপর থেকে আপা না খেলেই আব্বা বাহির থেকে খাবার এনে দিত।তখন থেকে এভাবেই আমরা আপাকে ম্যানেজ করে চলা শিখে গেলাম।এখন মাঝে মাঝেই আপা সারারাত কাঁদে।ঘুমায় না।বলে “আমাকে মেরে ফেলল মা।আমাকে বাঁচাও।আমার চামড়া জ্বলে যাচ্ছে।”এভাবে আম্মা সারারাত আপাকে নিয়ে বসে থাকে।দিনের বেলা সে ঘুমায় মাঝে মধ্যে।তখন কোনভাবে সে জাগুক, আমরা তা চাইনা।কারণ,আম্মারওতো রেস্টের প্রয়োজন আছে।
আম্মা অবশ্য কিছুদিন ধরে বলছে,”আমার মেয়েকে অমুকে তাবিজ করেছে। আমার মেয়ে তো মিথ্যা কথা বলেনা।হয়তো ও যা যা বলছে সবই সত্যি।”আব্বাকে বলে, “তুমি অমুক মাজারে যাও,ওর জন্য পড়া পানি আনো। “
আপার ঘরেও চারকোণায় কি কি যেন লাগানো হয়েছে।
এখন তুমি বলো,আজ এই মসজিদ,কাল ওই মাজার এভাবে যাদের দিনরাত্রি কাটে, তারা কি চাইবে নতুন বউ এসে এই অবস্থার সম্মুখীন হোক।আমি অনেকবার বলেছি,একটা ডাক্তার দেখানোর কথা।কিন্তু,পাড়া প্রতিবেশী জানুক, এটাও আব্বা,আম্মা চান না।তখন নাকি এক কান থেকে শুধু শুধু দশ কান হবে।
আবির কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থাকল।তারপর,আমার দিকে না তাকিয়েই বললো,”পেয়েছ,তোমার সব প্রশ্নের উত্তর?
আমি অবাক হয়ে শুধু শুনছিলাম।মানুষ শিক্ষিত হলেই হয় না।মানুষের ধ্যান ধারণাতেও সেই শিক্ষিতের ছোঁয়া লাগতে হয়।একাবিংশ শতাব্দিতে এসে শুধু ওঝা, তাবিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলে না।
আমাকে আসলে আবির আর আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলতে হবে।অনেক সময় মানুষ পারিপার্শ্বিকতার কারণে এতোটা আপসেট থাকে যে, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।মানুষ অন্যের ভুল যতো সহজে ধরতে পারে।নিজেদের ভুলগুলো ততো সহজেই পাশ কাটিয়ে ফেলতে পারে।আর দেরী না করে আমি সেদিন রাতেই তাদের সাথে বৈঠকে বসলাম।
আমার শ্বশুড়ি আবার সময় পেলেই ইসলাম বিষয়ক অনুষ্ঠানগুলো দেখতেন টিভিতে।আমি এই বিষয়টাকে অস্ত্র ধরেই আগানো শুরু করলাম। আমি নেটে সার্চ দিয়ে একজন বিশিষ্ট মাওলানার মানসিক রোগের সাথে জিন বিষয়ক একটা আলোচনা সভা দেখালাম।সেখানে একজন মুসলিম জিজ্ঞাসা করেছিলো,ইসলাম জিন বিষয়ে বা জিনে ধরা বিষয়ে বা তার চিকিৎসা সম্পর্কে কি বলে?
তখন সেই মাওলানা স্পষ্ট জবাবে বলেছিল,”অবশ্যই ইসলাম বলে মানুষের মতো আল্লাহ ব্জিনকেও সৃষ্টি করেছেন।এবং অবশ্যই তাদের অস্তিত্ব আছে।মানুষের মতো তাদের মধ্যেও ভালো জিন, খারাপ জিন আছে।তবে, এটাও ঠিক,রোগি অসুস্থ হলে অবশ্যই তাকে আগে ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করানো উচিৎ।ডাক্তার দেখিয়ে কাজ না হলে তারপর… অন্যকিছু নিয়ে ভাবতে বললেন।
আমি ধীরে ধীরে বোঝানো শুরু করলাম আমার শ্বশুড়িকে। আমাকে যেন একটা শেষ চেষ্টা করতে দেওয়া হয়।আমি আশ্বাস দিলাম তাকে যথেষ্ঠ্য গোপনীয়তার সাথে অনুপাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে।
আবিরও আমার সাথে সুর মিলালো।অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে শেষ্পর্যন্ত আমার শ্বাশুড়ি রাজী হলেন।আমরা আনু আপার জন্য একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে এপয়েন্টমেন্ট করলাম।
একটা গাড়ি ভাড়া করে আমরা আনুপাকে দিয়ে রওনা দিলাম।ডাক্তারের সাইনবোর্ড দেখে আম্মা আর কিছুতেই নামবেন না গাড়ি থেকে।প্রচন্ড রেগে গেলেন আমাদের উপর। আবিরকে বললেন,”বৌ এর সাথে মিলে তুই নিজের বোনকে পাগলের ডাক্তারের কাছে আনলি?এরপর আমার মেয়েকে পাগলা গারদে পাঠাতে পারলে তো তোদেরই লাভ।বাড়িঘর, সম্পত্তি সব তোর বউয়ের হবে তখন।ছিঃ,ছিঃ আমিই কি তোকে পেটে ধরছিলাম?আমার মেয়ে পাগল না।ছোটকালে আমাদের পাশের বাড়ির রহমতের মেয়েকে একবার তার শ্বশুড়বাড়ির লোকজন তাবিজ করেছিলো।পরে এক হুজুর ঝাড়ফুক করে।তারপর সে ভালো হয়ে যায়।আমিও আমার মেয়েকে বড়, ভালো হুজুর দেখালে সে ভালো হয়ে যাবে,আমার বিশ্বাস।”
আবির আমার শ্বশুড়ির কথায় রেগে যেতে লাগলে আমি তাকে থামিয়ে দিলাম।মাকে রিকোয়েস্ট করে বললাম “মা,আপনি যা বলবেন তাই হবে।এসেই যখন পরেছি তখন একটা বার দেখিয়ে যাই ডাক্তারকে।প্লিজ মা,না করবেন না।আনুপা সুস্থ হলে সবচেয়ে বেশি খুশিতো আপনিই হবেন। আপনি তার মা।
চেম্বারে বিভিন্ন ধরণের রোগী অপেক্ষা করছিলো।তাদের দেখে তো মা চেম্বার থেকে বেড়িয়েই আসতে চাচ্ছিলেন।একেক জনের অবস্থা ভয়াবহ, করুণ,শোচনীয়।
আমাদের সিরিয়াল এলো।আনুপাকে নিয়ে চেম্বারে ঢুকলাম।
ডাক্তার খুঁটে খুঁটে অনেক প্রশ্ন করল।সব শুনলো।মার কথা।আবিরের কথা।এরপর আনুপার কথা।
ডাক্তার বললো,এটা আসলে এক ধরণের মানসিক রোগ।তবে সব মানসিক রোগ মানে কিন্তু পাগল না।এই রোগকে মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় আমরা বলি “সিজোফ্রেনিয়া “
বেশ কিছু পরিবর্তন আসে এক্ষেত্রে রোগীর মধ্যে।রোগী একা একা কথা বলে।নিজেকে ছাড়া অন্য সবাইকে সন্দেহ করা শুরু করে।গায়েবি আওয়াজ শোনে।তার কানে কানে কেউ তাকে দিক নির্দেশনা দেয়।ব্যাপারগুলো এতো সূক্ষ্মভাবে ঘটে যে রোগী নিজেকে সুস্থ মনে করে।কাউকেই সে বিশ্বাস করতে পারেনা।শারীরিক কিছু পরিবর্তনও ঘটে।এসময় রোগী একটি কল্পনার জগতে বাস করে।এমন কিছু আওয়াজ শোনে যার আসলে অস্তিত্ব নেই।রোগী এতে ধীরে ধীরে বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করে।অন্যদের সাথে তার ভাবনাগুলো মেলে না এবং অন্যরা তার কথা বিশ্বাস করে না বলে এরা ধীরে ধীরে একা হয়ে যেতে শুরু করে।
আমরা অবাক হয়ে শুধু শুনছিলাম।কমবেশি সবই আনুপার সাথে মিলে যাচ্ছিলো। আমার মনে অনেক প্রশ্ন জমা হচ্ছিল।আমি জিজ্ঞাসা করলাম,এই রোগটা হয় কেন?
ডাক্তার সাজ্জাদ আবার বলা শুরু করলেন, “আসলে এই রোগের অনেক গুলো কারণ আছে।কখনো বংশগত,কখনো মানসিক আঘাত কখনো পারিপার্শ্বিক প্রেসার,পরিবেশগত ভিন্নতা।আসলে সিজোফ্রেনিয়া শব্দটির অর্থ হলো “মন ভাংগা”। আপনাদের পেশেন্ট আনুর ক্ষেত্রে যা হয়েছে, তা হলো একেবারে আকস্মিক ভাবে এবং অকালে তার হাজবেন্ড মারা যাওয়ার কারণে তার উপর এক ধরণের মানসিক চাপ পড়ে।হয়তো ৫০, ৬০ বছরে তার হাজবেন্ড মারা গেলে তার এমনটা হতো না।কারণ,আমাদের দেশের গড় আয়ু এই রেঞ্জের ভেতরই পরে।মোট কথা, তার সাথে কল্পনাতীত কিছু ঘটেছিলো যা তার মস্তিষ্ক মেনে নিতে পারেনি।
আমি আবারও প্রশ্ন করলাম,আনুপা কি কখনো ভালো হবে না।মানে এর কি কোন চিকিৎসা নেই?
ডাক্তার সাজ্জাদ বললেন, অবশ্যই চিকিৎসা আছে।রেগুলার কিছু মেডিসিন আমরা এক্ষেত্রে ব্যবহার করি।অবশ্য এই চিকিৎসার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই।আমরা বলতে পারবনা ঠিক কবে নাগাদ উনি পুরোপুরি সুস্থ হবেন।তবে এখন উনি দৈনন্দিন জীবনে যে সমস্যাগুলো ফেস করছেন তা থেকে উনি মুক্তি পাবেন।স্বাভাবিক একটা জীবন পাবেন।তবে, মেডিসিন চলতে থাকবে।আর যদি চিকিৎসা না করান সেক্ষেত্রে একসময় লোকে তাকে উন্মাদ বলবে।এরকম অনেক পেশেন্টই চিকিৎসা না নেওয়ার কারণে একসময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।আর চিকিৎসা বহির্ভুত থাকলে দিন দিন ওনার অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হবে।দেখুন,আর দশটা সাধারণ রোগ নিয়ে মানুষ যেমন বেঁচে আছে এটা নিয়েও আপনি তেমনি বেঁচে থাকতে পারবেন।শুধু মেডিসিন কন্টিনিউ করতে হবে এই যা।
আমরা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম।আল্লাহ সময় থাকতে আমাদের সঠিক পথ দেখিয়েছেন।
আনু আপা এখন তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন।উনি মাস্টার্স পাশ ছিলেন জুওলোজিতে।৩ মাস যাবত সেই সাবজেক্টেই লেকরাচার হিসেবে জয়েন করেছেন একটা বেসরকারি কলেজে।নতুন করে আর বিয়ের পিড়িতে বসেননি।দুলাভাইয়ের স্মৃতিকে আকড়ে ধরেই উনি বাঁচতে চান। আমরাও আর জোড় করিনি।কোন ধরণের নতুন মানসিক চাপ আমরা ওনাকে আর দিতে চাই না।রহমান পরিবার আবার তার আগের চেহারা ফিরে পেয়েছে।গেল ঈদে আমরা পুরো পরিবার কক্সেসবাজার থেকে সমুদ্রবিলাস করে এলাম।সাথে একজন ছোট্ট নতুন অতিথিও ছিলো কিন্তু।যার অস্তিত্ব আমি অনুভব করা শুরু করেছি তিন মাস হচ্ছে।পুরো নয় মাস লাগবে তাকে দুনিয়ার রূপ দেখাতে।
জীবন আসলে অসহ্য রকমের সুন্দর।সুখ,দুখ এক মায়ের পেটের দু ভাইয়ের মতো পথ চলে এখানে।একের পর এক তার রূপ নিয়ে হাজির হয়।আমাদের একটু সে সময়টা নিজেদের ম্যানেজ করে চলতে হয়,এই যা।
বি.দ্রঃ গল্পের নাম মুমুক্ষা।যার অর্থ মুক্তি।এই গল্পের নায়িকা আনু যে একটা বিভীষিকাময় জীবন যাপন করছিলো।যেখান থেকে তাকে মুক্তির পথ দেখায় তার ছোট ভাইয়ের বউ।
আমরা যারা পাঠক।তাদের আশেপাশে এমন ঘটনা সচরাচর ঘটতে দেখা যায়।নিজে সচেতন হই।অন্যকেও সচেতন করি।আমি মনে করি ভালো থাকাটা জীবন নয়।ভালো আছি এই চিন্তা করে পথ চলার নাম জীবন।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply