মা প্লীজ মা আমাকে এই খেলনাটা কিনে দেও না। আমি তোমার কাছে আর কখনো কোন খেলনা চাইব না,মা।
আমি অসহায় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। ব্যাগের চেইন খুলে একবার ভিতরে দেখে নিলাম। যদিও জানি দেখে কোন লাভ নেই। আমার কাছে সবসময় টাকা হিসেব করাই থাকে। ছেলেটা আমার এমনিতেই খুব লক্ষ্মী । বাবা এই জিনিস এখন মা কিনে দিতে পারবো না; বলার পরে ঐ খেলনাটার দিকে কিছুক্ষন চেয়ে থাকবে তারপরে আর কখনো ঐ খেলনাটার কথা বলবে না। কিন্তু আজ যে কি হল ! এই বাইনোকুলারটা দেখার পর আর আমি ওকে এই দোকানের সামনে থেকে সরাতে পারছিনা। ১০০ টাকা দিয়ে এই খেলনা আমি এখন কেন ; আগামী মাসেও ওকে কিনে দিতে পারবো না আমি জানি। আমাদের যে বড় হিসেবি সংসার। আমার ছেলেটাকে কখনই ভাল কোন খেলনা আমি কিনে দিতে পারিনি। ওর বাবা মাঝে মাঝে গুলিস্তান থেকে ২৫-৩০ টাকার কিছু সস্তা খেলনা নিয়ে আসে তাতেই ও খুব খুশি হয়। তাও আমি মানুষটাকে বকাবকি করি। কারন আমিতো জানি দুপুরে খাবার না খেয়ে সেই টাকা দিয়ে এই খেলনা কিনে আনে । ওর বাবা আমাকে বলে থাক না আমি একদিন না খেলে আমার শরীরটা একটু শুকাবে, কিন্তু টুকুনের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখো ও কতো খুশি হয়েছে। আসলে ওর শরীর এমনেতেই শুকনো , মাঝে মাঝেই ও না খেয়ে এটা সেটা কিনে, খুবই সস্তা জিনিস,আমি রাগ করলেই ও এই কথা বলে।
আমি টুকুনকে এবার রাগ করলাম চল বাবা তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে। তোমাকে এই খেলনা পরে বাবা আসলে কিনে দিবে। ওকে আর কোন কথা বলতে না দিয়ে হাঁটা দিলাম । কিছুক্ষন হাঁটার পরে বুঝতে পারলাম ছেলেটা কাঁদছে। কিন্তু আমি ওকে কিছু বললাম না। বাসায় এসে ছেলেকে পাশে নিয়ে বসলাম – বাবা তুমি তো কখনো কোন জিনিস কিনার জন্য এমন করো না আজ এমন করলে কেন সোনা ?
– আমার তো ঐ বাইনোকুলারটা খুব পছন্দ হয়েছে মা। আমার তো ঐ রকম একটা ও খেলনা নেই। জানো মা আমাদের ক্লাসের সবার বাসায় কি নাইস নাইস খেলনা আছে । রোবট আছে রিমোট কন্ট্রোল কার আছে , পাজাল আছে আরও কতো কি, মা ওরা আমাকে বলে । মাঝে মাঝে ইশান, আবির ওরা স্কুলেও নিয়ে আসে। মা কিন্তু আমাকে কখনো ধরতে দেয় না। কি বলে জানো মা; বলে কিনা আমি আগে কখনো চালাইনি তাই নাকি ওদের খেলনা আমি নষ্ট করে ফেলব । বাবা আমার জন্য যে খেলনা আনে ওগুলো তো বাবুদের খেলনা মা বলেই ছেলে আমার কাঁদতে লাগলো ।
আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। অনেক কষ্ট করে চোখের পানি আটকালাম । ছেলের সামনে কাঁদা যাবে না, তাহলে ওর মন ছোট হয়ে যাবে । আমি টুকুনকে কেছে টেনে বসালাম। বললাম বাবা তোমার বয়স এখন ৮ বছর। মা তোমাকে আজ অনেক গুলো কথা বলবো এই কথাগুলো তুমি সারা জীবন যদি মনে রাখো তাহলে আর কখনো কষ্ট পাবে না। ও চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল হুম বল। আমি মনে রাখব তোমার কথা।
বাবা শুন তোমার বাবা খুবই কম বেতনের একটি চাকরি করে। সেই টাকা থেকে তোমার দাদু-দাদি কে গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়, আমাদের বাসা ভাড়া দিতে হয়,বাজার করতে হয়, তোমার স্কুলের টিউশন ফি দিতে হয়, এই খরচগুলো করতে করতে তোমার বাবার কাছে আর টাকা থাকে না সোনা । এই যে তুমি মাকে বল মা তুমি প্রতিদিন এই বোরকা আর এই ওড়না পরে যাও কেন? কি করবো বাবা মার যে এই একটাই ভাল ওড়না আছে। আর একটি হিজাবের তো কম করে হলেও দুই থেকে তিনশ টাকা দাম। এই টাকাটাও আমাদের জন্য অনেক টাকা । এই যে মা তোমাকে কোন খেলনা কিনে দেই না সেই টাকা দিয়ে মা তোমার জন্য টিফিন দেই । তুমি কি জানো তোমার বাবা দুপুরের খাবার না খেয়ে সেই টাকা দিয়ে তোমাকে খুশি করার জন্য খেলনা কিনে আনে ? এখন তুমি যদি বল বাবার খেলনা তোমার পছন্দ হয়নি তাহলে বাবা কষ্ট পাবে না? তুমি জানো তোমার বাবা – মার কতো জিনিস পছন্দ হয় কিন্তু আমরা ওগুলো কিনি না। কারন ঐ টাকাটা আমরা আমাদের টুকুন সোনার স্কুলে দিতে হয় ।
কেন জানো বাবা কারন আমরা তো টুকুন সোনাকে ভাল ভাল খেলনা কিনে দিতে পারিনা, ভাল ভাল খাবার খাওয়াতে পারিনা , তাই আমরা চাই আমাদের বাবু যেন ভাল করে লিখা পড়া করে অনেক বড় হয়। আর নিজের জন্য সব ভাল ভাল জিনিস কিনতে পারে । বাবা আমি জানি মার এই কথা বুঝার মত বয়স তোমার হয়নি কিন্তু কি করবো বল বাবা ,তোমাকে এই কথাগুলো বুঝতে হবে। এখন থেকে তুমি যদি মার পাশে না থাক তাহলে যে মা শক্ত হতে পারবোনা। তুমিইতো মায়ের শক্তি ।
আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম । টুকুন আমাকে শক্ত করে ধরে বলতে লাগলো মা আমি আর কখনো এমন অন্যায় আবদার করবোনা। আমি খুব মন দিয়ে পড়ব মা । বড় হয়ে তোমাকে আর বাবাকে তোমাদের পছন্দের সব জিনিস কিনে দিবো তুমি আর কেঁদো না মা ।
আমার ছেলে তার কথা রেখেছে ও খুব মন দিয়ে লিখাপড়া করেছে। বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরিতে ঢুকেছে । সেই দিনের ঐ কথাগুলো কিভাবে যে আল্লাহ ওকে বুঝার তৌফিক দিয়েছেন আমি জানিনা। কিন্তু তারপর থেকে এই এত বছরে যে জিনিস না হলেই না সেই জিনিস ছাড়া আমার ছেলে আমাদের কাছে কিছুই চায়নি । আজকে আমার টুকুন আমাকে আর ওর বাবাকে নিয়ে বসুন্ধরাতে এসেছে । ছেলে আমার আজ প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে বাবা-মাকে কিনা- কাটা করে দিবে । আমাদের বলল তোমরা এইখানে একটু দাঁড়াও আমি তোমাদের জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসি । আমি ডান দিকে ফিরতেই দেখি কতো বড় এক খেলনার দোকান কি সুন্দর সুন্দর খেলনা ভিতরে । আমি টুকুন কে কখনো ভাল কোন খেলনা কিনে দিতে পারি নাই। তাই সবসময় খেলনার দোকান দেখলেই আমার বুকের ভিতরে এক ধরনের রক্তক্ষরন হয় । ছেলে মেয়ে কিছু চেয়েছে আর সেই জিনিস দিবার সাধ্য নাই। এটা যে কতো কষ্ট এই কষ্ট শুধু বাবা-মাই বুঝে ।
মা , আমি তাড়াতাড়ি আমার চোখের পানি মুছে ফেললাম । টুকুন বলল এই দোকানে যাবে মা ?
– না বাবা এখন আর এই খেলনার দোকানে গিয়ে কি করবো?
– কেন মা আজ আমি খেলনা পছন্দ করবো আর তুমি আমাকে সেই খেলনা গুলো কিনে দিবে। বলেই ও কি সুন্দর করে হাসল। তারপর জোর করে আমাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে সত্যি সত্যি অনেক খেলনা কিনে ফেললো ।
ও বলল- মা আমি জানি তুমি সব সময় খেলনার দোকানের সামনে গেলে আমার জন্য মনে মনে কতো খেলনা পছন্দ করতে। কিন্তু কিনতে পারতে না , লুকিয়ে কাঁদতে । আজ তাই আমি তোমার মনের আশা পূর্ণ করলাম।তুমি আমার জন্য কতো খেলনা কিনে দিলে।
তুমি খুশি হয়েছো মা?
বাবা এখন এই খেলনাগুলো দিয়ে কি করবো?
কেন মা বাসায় যেতে যেতে দেখবে কতো বাচ্চারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তাদের তোমার টুকুন মনে করে একটি একটি খেলনা দিয়ে দিবে ।
-আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম বাবা তুই যা চেয়েছিস কখনো তোকে তা দিতে পারিনি।
– মাগো যদি চাইলেই সব পেতাম তাহলে যে শুধু পাওয়ার আনন্দ পেতাম।কিন্তু অন্যর না পাওয়ার কষ্ট বুঝতাম না ।
আমি আর ওর বাবা স্বপ্নেও ভাবিনি আমাদের গরিব ঘরে আল্লাহ টুকুনের মত এত বড় রত্ন দিবেন । আজ আবারও আমি ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম ।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply