-‘আমি আমার শশুর বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। আমার স্বামীকে হসপিটালাইজেশন করা হয়েছে। আজ রাতেই তাঁর অপারেশন। অপারেশন শেষে জ্ঞান ফিরতেও বেশ অনেকটা সময় লাগবে৷ এতো বড় সুযোগ আমি আর কখনোই পাবো না। তাই এই সুযোগ টা হাতছাড়া করতে চাইনা৷ খুব ভোরে এ শহড় ছেড়েও চলে যাবো। ঝড়,বৃষ্টি শুরু না হলে এতোক্ষণে আমি শহড়ের বাইরেও চলে যেতাম৷ প্লিজ ম্যাম আজকের রাতটা আপনার বাসায় জায়গা দিন আমায়৷ আপনি ছাড়া কেউ আমায় বাঁচাতে পারবেনা। কেউ পারবেনা আমাকে এই ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করতে’।
ভার্সিটির প্রফেসর সালমা রহমান সাবার পা জরিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কথা গুলো বললো আহি। ওয়াইফ অফ হ্যাভেন তালুকদার। এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য হুমায়ুন তালুকদার এর একমাএ পুএবধূ মিসেস আহিয়ানা আহি। সালমা রহমান সাবা ভ্রু কুঁচকে সন্দেহী চোখে তাকালো আহির দিকে। আহি অসম্ভব সুন্দরী একটা মেয়ে। ভার্সিটির সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েদের তালিকা করা হলে প্রথম সাড়িতেই হবে তাঁর স্থান৷ বলিউডের নব্বই দশকের হিরোইন দিব্যা ভারতীর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যায় আহিকে। অমায়িক এই সুন্দরীর হাজব্যান্ড অবশ্যই বেশ সুদর্শন হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু নাহ তা হয়নি।
এ পৃথিবীটা বড়ই অদ্ভুত সেই সাথে অদ্ভুত এ পৃথিবীর নিয়মগুলো। তা না হলে কি আহির মতো চাঁদ সুন্দরীর কপালে জোটে কৃষ্ণবর্নের হ্যাভেন তালুকদারের মতো স্বামী?
ভার্সিটিতে প্রায় অনেক স্টুডেন্টকেই হ্যাভেন আর আহিকে নিয়ে কানাঘুষা করতে শুনা যায়। কেউ বলে, আহিকে হ্যাভেন ক্ষমতার জোরে তুলে এনে বিয়ে করেছে। পাওয়ার আছে বলেই না কুৎসিত দেখতে হলেও বউ পেয়েছে চাঁদ সুন্দরী।
আবার কেউ কেউ বলে, আহির পরিবার অত্যন্ত দারিদ্র্য। যার ফলে অর্থ,সম্পদ আর ক্ষমতার লোভেই আহির বাবা,মা হ্যাভেন তালুকদারের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়েছেন। কেউ বলে, হ্যাভেন আর আহির দাম্পত্য জীবন খুবই সুখের। কেউ বলে, তাঁদের দাম্পত্য জীবন খুবই দুঃখের। কেউ বলে তাঁরা একে অপরকে পাগলের মতো ভালোবাসে। কেউ বলে, হ্যাভেন শুধু সৌন্দর্যের পূজারী। আর আহি উপায় না থাকায় এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে, বিতৃষ্ণা নিয়ে প্রতিনিয়ত অভিনয় করে যাচ্ছে। কিন্তু ভিতরের সত্যি টা হয়তো আহি আর হ্যাভেনই সঠিকভাবে বলতে পারবে। এই দম্পতি যে ভীষণ রহস্যে ঘেরা তা বুঝতে আর বাকি নেই সাবার।
এক স্টুডেন্টের মুখে শুনেছিলো, হ্যাভেন তালুকদারের উপরও যেমন কালো ভিতরও তেমনই কালো। তাঁর জীবনে আলোর ছিটেফোঁটাও নেই। কিন্তু কোথায় এমন বউ যার ঘরে আছে তাঁর জীবনে অন্ধকার থাকার প্রশ্ন আসে কোথায় থেকে? নাকি আহি তাঁকে মন থেকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারেনি? এজন্যই কি স্বামীকে মৃত্যুশয্যায় রেখে বাসা থেকে পালিয়ে এসেছে সে?
আহির দিকে এক ধ্যানে চেয়ে আছে সাবা। মেয়েটার ভয়েস কখনো এমন স্পষ্ট ভাবে শুনেনি সে। ভার্সিটিতে সবসময় মাথা নিচু করে স্বামীর হাত ধরে যায়। ক্লাসে চুপ করে বসে আবার চুপ করে মাথা নিচু করেই বেরিয়ে যায়। তাদের স্বামী-স্ত্রীর সামনে পিছনে সবসময় কমপক্ষে সাত,আটজন করে ছেলেরা থাকে। মেয়েটাকে কখনো কোন বান্ধবী বা বন্ধুর সাথে মিশতে দেখেনি। প্রয়োজনও কি পড়ে না? পড়লেই বা কি? শহড়ের নামকরা নেতার পুএবধূ, নামকরা নেতার বউ। তাঁদের কেই সাধারণ মানুষের প্রয়োজন পড়ে সচরাচর। সাধারণ মানুষ কে তাঁরা বড়সড় স্বার্থ ছাড়া স্মরণ করে না।
.
এ বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন হ্যাভেন তালুকদার। তারুণ্যের বিজয়ে দলীয় কার্যালয়ে নতুন এমপিকে স্বাগত জানাতে চলছিলো ফুলের শুভেচ্ছা ও মিষ্টি বিতরণের উৎসব। উৎসব পালন করে রাত আটটার দিকে নিজ বাড়ি ফেরে হ্যাভেন।
নিয়ম করে রোজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় স্ত্রীর কপালে ভালোবাসার গভীর চুম্বন একে দেয় হ্যাভেন। এবং বাড়িতে প্রবেশ করার সময়ও সদর দরজায় দাঁড়িয়ে সর্বপ্রথম স্ত্রীর কপালে চুম্বন একে ভেতরে প্রবেশ করে। আজো তাঁর ব্যাতিক্রম করে নি। কিন্তু সে সময়ই পিছন থেকে পরপর তিনটে গুলি এসে লাগে তাঁর পিঠে। আহত অবস্থায়ই স্ত্রী কে জরিয়ে ধরে হ্যাভেন। কঠিন কন্ঠে বলে,
-‘আমি যদি আজ এ মূহুর্তে মারা যাই তাহলে তোমার পড়াশোনা আজ এ মূহুর্ত থেকেই বন্ধ। এ বাড়ির চৌকাঠে পা দেওয়ার সাহসও কোনদিন করবে না তুমি। তোমার দেহ,মন শুধুই আমার। আমার জিনিসে আমি কাউকে ভাগ বসাতে দেইনি মৃত্যুর পরও দেবো না। তুমি শুধু এক আমারই’।
আহি হ্যাভেনকে দুহাতে ধরে কেঁদে ফেললো। হ্যাভেন ঢলে পড়লো তাঁর বুকে। হ্যাভেনের মা, বোন আর ভাইরা এগিয়ে আসতে নিতেই হাত ওঠিয়ে বললো,
-‘উহুম কেউ এগোবে না এটা যদি আমার শেষ সময় হয়,যদি এ সময়ের নিঃশ্বাসটুকুই হয় আমার শেষ নিঃশ্বাস তো সেটুকু সময়, সেটুকু শ্বাস আমি আমার প্রিয়তমার বক্ষঃস্থলে মাথা রেখে নিতে চাই। প্রিয়তমার বক্ষঃস্থলে কান পেতে শুনতে চাই তাঁর বিধ্বস্ত হৃদয়ে আমার নামটি। অনুভব করতে চাই আমার প্রিয়তমার আমার প্রতি সকল বিতৃষ্ণাকে, সকল ঘৃনাকে, সকল ভয় কে’। বলতে বলতে নেতিয়ে পড়লো আহির বুকে।
হ্যাভেনের মা রুবিনা তালুকদার মেঝেতে বসেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। হেভেনের দুই ভাইই বাড়ির বাইরে শত্রুর অনুসন্ধান করতে গেছে। দ্রুত এম্বুলেন্সও এসে পড়ে। তখনো জ্ঞান হারায়নি হ্যাভেন। অমন আহত অবস্থায়ও স্ত্রীকে দুহাতে জরিয়ে ভালোবাসার স্পর্শ দিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে সে। সে মূহুর্তেও আহি অনুভব করে লোকটা মেন্টালি সিক। বাড়ির সকলে মাথা নিচু করে ছিলো, হ্যাভেন যখন দূর্বল মাথাটা উচিয়ে কাঁপা হাতে আহির দুগালে স্পর্শ করে তাঁর ওষ্ঠদ্বয়ে নিজের ওষ্ঠদয় মিলিত করতে উদ্যত হয় আহি তখন নিচু স্বরে বলে,-‘আপনি ওনাদের অনুমতি দিন আপনাকে নিয়ে যেতে। আপনার চিকিৎসা প্রয়োজন, প্লিজ পাগলামি করবেন না’।
হ্যাভেন তখন ক্ষিপ্ত হয়ে আঁকড়ে ধরে তাঁর ওষ্ঠদয়। উপস্থিত সকলেই মাথা নিচু করেই ছিলো। লজ্জায়,ভয়ে কেউ চোখ তুলে তাকানোর সাহস করেনি। একসময় হ্যাভেনের অনুমতি পেয়েই তাকে এম্বুল্যান্স করে নিয়ে যাওয়া হয় হসপিটালে।
বাড়ির সকলের মধ্যে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক, গুরুতর আহত অবস্থায়ই হ্যাভেনকে ঢাকা মেডিকেল হসপিটালে ভর্তি করানো হয়। বাংলাদেশে সংসদ সদস্যদের সাথে সাধারণত: পুলিশ সদস্য দেহরক্ষী হিসেবে থাকে। তবে পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম জানিয়েছেন, বাসায় হ্যাভেন তালুকদার দেহরক্ষী রাখতেন না। বাসার বাইরে গেলেই শুধুমাত্র দেহরক্ষী নিয়ে যাবে বলেছিলেন তিনি।
সকলেই হ্যাভেনকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। তালুকদার বাড়িতে রুবিনা, আহি আর কাজের কটা মেয়ে ছাড়া কেউ ছিলোনা৷ তাঁদের বাড়ির বউদের বাইরে যাওয়ার নিয়ম নেই। স্পেশালি আহির তো আরোই না। মৃত্যুশয্যায় থেকেও হ্যাভেন কড়াভাবে বলে গেছে আহি যেনো রুম ছেড়ে নিচেও না আসে। সকলেই যখন আতঙ্কের মধ্যে আহি তখন মুক্তির পথে পা বাড়ায়। হ্যাঁ মুক্তি, মুক্তি চায় সে। হ্যাভেন নামক আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেতেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। পুরো বাড়িতে পুলিশ গার্ডে থাকবে জানামাএই তাঁরা আসার আগেই পালায় আহি।
ঝড়,বৃষ্টির রাতে বের হয়ে কোথায় যাবে বুঝে ওঠতে পারেনা৷ কিন্তু তাঁকে তো পালাতেই হবে। যতো যাইহোক না কেনো মৃত্যু কে বেছে নেবে তবুও আর তালুকদার বাড়ি ফিরবে না সে। এমন একটা বাড়ি তালুকদার বাড়ি যেখানে না শান্তিতে বাঁচা যায় আর না শান্তিতে মরা যায়। একদিন হ্যাভেনই আহিকে সাবা ম্যামের বাসা চিনিয়েছিলো। আর আজ এই বিপদে সেই চেনাটাই কাজে লেগে গেলো। কলিং বেল বাজানোর পর দরজা খুলতেই সাবাকে দেখে আহি আতঙ্কিত গলায় আশ্রয় চায়।
.
যেখানে এমপির বাড়ির প্রতিটি সদস্য হসপিটাল রয়েছে৷ এলাকায় প্রায় ধ্বংস লীলা চলছে। সেখানে এমপির স্ত্রী আহিয়ানা আহি বাড়ি থেকে পালিয়েছে শহড় ছেড়ে চলে যাবে বলে? এতো এতো ভাবনায় মাথা ধরে গেলো সাবার। এদের নিয়ে শুরু থেকেই কৌতুহল ছিলো তাঁর আজ যেনো তা দ্বিগুণ মাএায় বেড়ে গেলো। ধীরস্থির ভাবে আহিকে নিয়ে সোফায় বসালো সাবা। এক গ্লাস পানি ভরে আহির সামনে ধরতেই আহি গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিলো।
মেয়েটার চোখে মুখে মারাত্মক ভয় দেখতে পাচ্ছে সাবা৷ ফুলের মতো মেয়েটার জীবন কি ভীষণ জটিলতায় ঘেরা? সাবা আর চুপ থাকতে পারলো না প্রশ্ন করলো,-‘স্বামীকে মৃত্যুশয্যায় রেখে এভাবে পালাচ্ছো কেনো আহি’?
হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো আহি। ভয়ে কাঁপছে মেয়েটা। কাঁপা গলায়ই বললো,-‘কাউকে বলবেন না প্লিজ ম্যাম। আপনি আমাকে সাহায্য করুন আপনি ছাড়া কেউ নেই আমাকে সাহায্য করার’।
-‘কিন্তু তোমার স্বামীর হাত কতোটা লম্বা তা আশা করি তুমি জানো? যদি সে তোমায় খুঁজে বের করে কি হবে’?
-‘প্রাণে মারবেনা ম্যাম। যদি তাই হতো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহারটাই আমাকে দেওয়া হতো’।বলেই অঝড়ে কাঁদতে লাগলো।
সাবার মনে হাজারো প্রশ্ন ওকি বুকি করছে। অতিরিক্ত উত্তেজনায় তাঁরও গলা শুকিয়ে গেলো। নিজেকে কিছুটা দমিয়ে সে বললো,
-‘তুমি কি জানো বিয়ের পর হাজব্যান্ডের থেকে পারমিশন না নিয়ে এভাবে হাজব্যান্ডের বাসা থেকে বের হওয়া উচিত নয়। আর তুমি যা বলছো এটা ঘোর অন্যায়, পাপ’।
-‘নাহ অন্যায় নয়, পাপ নয় বরং দিনের পর দিন আমার সাথেই অন্যায় হচ্ছে, পাপ হচ্ছে’।
-‘কি করে বিশ্বাস করবো? তোমার শশুড় বাড়ির প্রতিটি ব্যাক্তিই খুব সম্মানীয় এবং আদর্শবান। দেশ এবং জনগণের পরম বন্ধু তাঁরা তাঁদের সাথে তুমিও তো অন্যায় করতে পারো’?
-‘আমি অন্যায় করছিনা। আমি বাঁচতে চাই, আমি প্রাণখুলে নিঃশ্বাস নিতে চাই, আমি শান্তিতে ঘুমাতে চাই। দম বন্ধ করা জীবন কাটাতে আর ভালো লাগেনা আমার ম্যাম, আর ভালো লাগেনা ‘।
-‘তুমি কি কোনভাবে জোর জুলুমের শিকার আহি। যদি তাই হয় তাহলে সবটা খুলে বলো আমায়। আমি তোমায় সাহায্য করবো’।
সাবার দিকে তাকালো আহি। বললো,-‘যেখানে নিজের বাবা,মা’ই এসব থেকে বাঁচাতে পারেনি সেখানে আপনি কিভাবে পারবেন ম্যাম’?
-‘সবটা বলো আমায় তোমাদের বিয়েটা কিভাবে হয়েছিলো সত্যি কি জোর করে নাকি তোমার বাবা,মা টাকার লোভে পড়ে বিয়ে দিয়েছেন তোমায়’?
-‘হ্যাঁ জোর করে, এই বিয়েতে আমার মতই ছিলোনা। জোর করে তুলে এনে বিয়ে করেছেন ওনি আমায়। গতো দেরবছরে যা যা ঘটেছে সবটাই জোর,জবরদস্তি করে। বৈধভাবে দিনের পর দিন ধর্ষিত হচ্ছি আমি। দিনের পর দিন রোবটের মতোন জীবন পার করে যাচ্ছি। আমি ক্লান্ত ম্যাম খুব ক্লান্ত আমি’।
-‘কিভাবে হলো দেখা তোমাদের? কি করে নজরে পড়লে ওর? বিয়ের বয়স বছরখানেক হওয়ার পরও কেনো মেনে নিতে পারছোনা? বউ করে যখন ঘরে তুলেছেই তাহলে কিসের এতো জোর জুলুম? নাকি তুমিই তাঁকে মেনে নিতে পারোনি স্বামী হিসেবে’?
-‘কি করে পারবো ম্যাম? আপনি হলে পারতেন? যদি আজ আমার জায়গায় আপনি থাকতেন পারতেন মেনে নিতে’?
সাবা চুপ হয়ে গেলো। মলিন চোখ, মুখে চেয়ে রইলো আহির বিধ্বস্ত মুখপানে। মলিন হাসলো আহিও। বলতে শুরু করলো তাঁর জীবনে শুরু হওয়া কালো অধ্যায়ের গল্পঃ
___________________________
২০১৮ সালের ১৪ই এপ্রিল ছিলো সেদিন। বান্ধবী দের সাথে মেলায় গিয়েছিলাম। ছোট বোনের জন্য পতুল কিনবো বলে কয়েকটা দোকানে ঘুরছিলাম। হঠাৎ বান্ধবী মিনা বললো,-‘দেখ দেখ ছেলেটা কি লম্বা পুরাই রিত্তিক রওশান সামনে পিছে এতো ছেলে কেনোরে এ কোন নেতা নাকি’?
ওর বলা কথাটা শুনে ওর ইশারা করা হাতকে অনুসরণ করে তাকাতেই দেখতে পেলাম মাঠের মাঝখানে গোল করে অনেক ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে। তাঁদের মাঝখানে রয়েছে কৃষ্ণবর্ণের একজন অপরিচিত পুরুষ।
লম্বাচওড়া পুরুষটির গায়ের রং কালো হলেও চেহারায় বিশেষ মাধুর্য রয়েছে। ভাবমূর্তি দেখে বোঝাই যাচ্ছিলো বড়সড় কোন নেতা হবে। আমি মুচকি হেসে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আবারো পুতুল দেখায় মনোযোগ দিলাম। কিন্তু আমার বান্ধবী রা ছিলো প্রচন্ড দুষ্টু প্রকৃতির। ওরা সেই পুরুষ টিকে নিয়েই গবেষণা করতে থাকলো। মিনা তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ আর আঁখি নাক ছিটকালো বললো,
-‘উমহ কি ঢং কালার কালা চোখে আবার কালা চশমা দিছে বিশ্রি দেখা যাইতাছে ব্যাটারে। নেতার খ্যাতা পুড়ি এমন কাইলারে ক্যাডায় নেতা মানে হুহ’।
-‘ইশ এভাবে বলিসনা কালো হলেও ওনার মধ্যে অন্যরকম একটা সৌন্দর্য রয়েছে। এভাবে নিন্দা করিস না। বলা তো যায় না ওনার মতো দেখতে বর যদি তোর কপালে জোটে’?
-‘ওবাবা কি ব্যাপার আহি? লোকটার জন্য দেখছি তোর হেব্বি দরদ। শেষমেশ এই কাইলা ভূতকেই তোর মনে ধরলো? ওকে জানু তোমার মনের কথা আমি দায়িত্ব নিয়ে ওনাকে জানিয়ে দিচ্ছি ‘ বলেই আঁখি দৌড়ে ছেলেগুলোর কাছে চলে গেলো। আমি আর মিনা তো ভয়ে শেষ। এই মেয়ে সবসময় কোন না কোন অঘটন ঘটিয়েই ছাড়ে। কোন ভয়ডর নেই এই মেয়ের মনে। কলেজে, পাড়ায় যেমন সাহস দেখায় সেদিনও মেলায় সাহস দেখিয়ে ফান করতে যায়। আর ফাঁসিয়ে দেয় আমাকে।
ভীরের ভিতর ঢুকে এক দমে বলে,
-‘ভাইয়া ভাইয়া আপনাকে দেখে আমার বান্ধবী হেব্বি ক্রাশ খাইছে বলছে আপনার মধ্যেও নাকি অন্যরকম একটা সৌন্দর্য আছে। আপনি কি’ বাকি কথা বলতে দেয়নি, মিনা ভীড় থেকে টেনে নিয়ে আসে আঁখি কে। আমিও চোখ রাঙিয়ে ওর হাত টেনে নিয়ে বকতে শুরু করি। আমরা তিনজনের কেউ আর পিছন দিক তাকাইনি। তাকালে হয়তো দেখতে পেতাম প্রায় দশ বারোজন ছেলে পিছু নিয়েছে আমাদের।
মিনা বলে-‘আরে আখি তোর মাথা খারাপ হয়েছে আমাদের আহি খাবে ঐ ছেলেকে দেখে ক্রাশ? আমি ক্রাশ খেয়েছি বলে আহিও খাবে নাকি। কোথায় আহি কোথায় ঐ ছেলে। আহির পাশে ওকে আদেও মানাবে? আহিকে ঐ ছেলের পাশে কেমন লাগবে জানিস বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা’ বলেই খিলখিল করে হাসতে লাগলো। আবারো বললো,’বুঝলি না তো মানে ঐ ছেলে বাঁদর আর আমাদের আহি মুক্তোর মালা ‘।
মিনার ঐ একটা কথাটাই আমার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ালো।
পিছন থেকে একটি পুরুষালী কন্ঠ ভেসে এলো,
-‘তাই নাকি তাহলে তো মুক্তোর মালা গলায় পড়তেই হয়’।
আমরা তিনজনই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ পিছন ঘুরে যেই দশ,বারো জন ছেলে দেখলাম অমনি তিনজনই তিনজনের হাত চেপে ধরে দিলাম দৌড়।কিন্তু বাড়ি ঢুকতেই আরেক দফা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমাদের ওঠানে সেই দশ,বারো জন পুরুষ চেয়ারে বসে আছে। একপাশে আট টা বাইক আমার সাথে তখন মিনা,বা আঁখি কেউ ছিলোনা৷ ভয়ে দুরুদুরু বুকে এগিয়ে গেলাম ঘরের দিকে। আমার বাবা, আর মায়ের করুন মুখের দিকে তাকাতেই ভয়ে শিউরে ওঠলাম। ছোট বোন দৌড়ে এসে জিগ্যেস করলো,
আমি কোন উত্তর না দিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলাম,
-‘ আম্মু এরা এখানে কেনো? আমার নামে বিচার দিতে এসেছে’?
আম্মু তখন আমাকে জরিয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। আর জানালেন ওখানে যারা বসে আছে তাঁরা শহড়ের নামকরা নেতার চ্যালা,ফ্যালা। এবং একজন নামকরা নেতা হুমায়ুন তালুকদারের বড় ছেলে হ্যাভেন তালুকদার। তাঁরা এসেছে আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। আর পাএ হিসেবে হ্যাভেন তালুকদার কে গ্রহণ করে নিতে। আম্মুর কথা শুনে আমার বুক কেঁপে
ওঠলো। আমি উত্তেজিত হয়ে বলে ফেললাম,
তখনি রুমে ঢুকলেন হ্যাভেন তালুকদার। মেলায় দেখা সেই কৃষ্ণবর্ণের অপরিচিত পুরুষটি। তাঁকে দেখেই আমি রেগে বললাম,
-‘এটা কি ধরনের অসভ্যতামো? কারো রুমে ঢুকতে হলে নক করে পারমিশন নিয়ে ঢুকতে হয় তা কি আপনি জানেন না ‘?
আম্মু তখন আমার হাত চেপে ধরলো। আতঙ্কিত হয়ে বললো,-‘ চুপ কর আহি চুপ কর। বাবা বসো তুমি কিছু মনে করো না মেয়ে আমার বুঝতে পারেনি ভুল করে ফেলেছে’।
আমি অবাক হয়ে তাকালাম মায়ের দিকে। হ্যাভেন তখন মুচকি হেসে বললো,
-‘ আই লাইক ইট শাশুড়ী মা। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড আমি কি আমার হবু বউয়ের সাথে আলাদা কথা বলতে পারি? যদি মাইন্ড করেন তাহলে আই এম এক্সট্রিমলি সরি শাশুড়ী মা আপনি এবার আসতে পারেন ‘ বলেই আম্মুকে দরজার দিকে ইশারা করলো।
সে মূহুর্তেই আমি বুঝে গেলাম লোকটা অসভ্যের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করছে, বেয়াদবের চরম সীমানায় পৌঁছে গেছে।
আমার বাবা, মা নিরীহ মানুষ। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার আমাদের। এলাকায় বড় বড় নেতা ঢুকেছে এতেই এলাকার মানুষের ভয়ের শেষ নেই। তাঁরা নিজ ঘরে চোরের মতো বসে আছে। কেউ এগিয়ে আসেনি আমাদের সাহায্য করতে। বাবা, মা, বোন ওঠানে মাথা নিচু করে বসে ছিলো। আর রুমের ভিতর ছিলাম আমি আর হ্যাভেন। আম্মু বের হওয়ার সাথে সাথেই দরজা লাগিয়ে দেয় হ্যাভেন। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে যায়। আমার সেই ভয়ার্ত মুখ দেখে হোহো করে হেসে ওঠে হ্যাভেন কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
গা ঘিনঘিন করে ওঠে আমার। দুহাতে নিজের কাপড় খামচে ধরি। হ্যাভেন অসভ্যের মতো আমার আশে,পাশে ঘুরতে থাকে। একসময় বিছানায় পায়ের ওপর পা তুলে বসে। আমি ঠায় দাঁড়িয়েই আছি। সে আমার দিকে বিশ্রি নজর বুলাতে থাকে আর বলে,
-‘অশুভ তিথি তে জন্ম আমার। আমার সান্নিধ্যে এলে সকল শুভ হয়ে যায় অশুভ। সকল সুন্দর হয়ে যায় অসুন্দর। সকল ভালো হয়ে যায় খারাপ। সব ঠিক হয়ে যায় বেঠিক। আমার উপস্থিতি সকলের জন্য হয়ে ওঠে শ্বাসরুদ্ধকর। আমার আমিকে না গ্রহণ করা যায়, না বর্জন করা যায়৷ সেই আমি কে স্বামীর স্থান দিতে হবে তোমায়। স্বামী মানে বোঝোতো তোমার আমার ধর্মে বলা আছে আল্লাহর পর যদি কাউকে সেজদা করা জায়েজ হতো তাহলে স্ত্রীকে বলা হতো নিজ স্বামীকে সেজদা করতে। তোমার সেই অমূল্য মানুষ টি হবো আমি। তোমার সারা অঙ্গের নামকরণ হবে আমার নামে। তোমার প্রতিটা নিঃশ্বাস সঞ্চালন করবে আমার নামে। তোমার ধ্যান হবে আমি তোমার জ্ঞান হবে আমি৷ তুমি পুরোটাই হবে আমিময়’।
কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ
চলে এলাম নতুন গল্প নিয়ে প্রথম পার্টে সকলের ভালো সাড়া পেলে নেক্সট পার্ট দ্রুত লিখবো।
Leave a Reply