বিয়ের পর প্রথম যেদিন শশুর বাড়িতে শাশুড়ীর রান্না করা খাবার খেয়েছি সেদিন মনে হয়েছিলো আমি বুঝি এখনই ম’রে যাবো। কারণ প্রত্যেকটা তরকারি ছিলো অসম্ভব রকমের ঝাল, যা আমি মোটেও খেতে পারিনা। এক লোকমা খেয়ে আর খাওয়া সাহস হলোনা। কি করবো ভেবে না পেয়ে প্লেটের খাবারগুলো নাড়াচাড়া করছিলাম।
” কি হলো বউমা? খাচ্ছো না কেন? খাও।”
শাশুড়ীর কথা শুনে আমার স্বামী তাহামী আর আমার ননদ তাহামীনা আমার দিকে তাকাল। আমি একবার তাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে খেতে শুরু করলাম। এত পরিমাণ ঝাল ছিলো যে মনে হচ্ছিলো আমার গলা বুঝি পুড়েই গেলো। অনেক কষ্ট করে খাবারটা শেষ করে আমার জন্য বরাদ্দ রুমে চলে এলাম। রুমেই একটা জগে পানি রাখা ছিলো। আমি পারলে পুরো জগের পানিটাই যেন একসাথে খেয়ে ফেলতাম।
এরই মধ্যে আমার স্বামী তাহামী রুমে এলো। কিন্তু কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে গিয়েছে সে। ২/৩ মিনিট পর ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে একপলক আমার দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।আমার চোখে জল জমে গিয়েছে ইতিমধ্যে। বুঝতে পারলাম না তা ঝালের কারণে হলো নাকি তাহামীর এইধরণের ব্যবহারে।
বাবা-মায়ের বড় আর একমাত্র মেয়ে হওয়াতে আমি খুব একটা রান্নায় পারদর্শী নই। নিজের থেকে যা শিখেছি তাই ভালো রান্না করতে পারি।
গরম তেলের পাত্রে মাছ দিয়েছিলাম ভাজার জন্য। কিন্তু মাছ ভাজতে ভাজতে কবে যে নিজের পরিবারের চিন্তায় চলে গিয়েছি সেটা টেরই পেলাম না আমি। শাশুড়ী মায়ের চিৎকার শুনে চমকে নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলাম। পাত্রের দিকে তাকিয়ে দেখি মাছের একপাশটা পুরো পুড়ে গিয়েছে।
” মা কি রান্নাঘরের কিছুই শেখাইনি তোমাকে? রান্না কি করে করতে হয় সেটাও তো দেখি জানোনা।”
রাগী চোখে তাকিয়ে আমাকে বললেন তিনি। আমি অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি।
স্বামী তাহামী আজ বেতন পেয়েছে।তাই শাশুড়ী মা, ননদ আর আমার জন্য তিনটে শাড়ি কিনে এনেছে।তিনটে শাড়ি সে টেবিলে রেখে নিজের পছন্দ মতো নিতে বলে চলে গেলে রুমে। আমি এককোণে দাঁড়িয়ে শাড়ি গুলো দেখছি। এর মধ্যে লাল এবং নীল রঙ মেলানো শাড়িটা আমার পছন্দ হলো।আমি হাত বাড়ালাম সেটার দিকে কিন্তু তার আগেই আমার ননদ তাহামীনা সেটা উঠিয়ে নিলো। তার প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝলাম শাড়িটা তার পছন্দ হয়েছে। তাই আমি আর কিছু বললাম না,সবার আড়ালে নিজের হাতটা গুটিয়ে নিলাম।
ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। দুপুরে খাবার পর একটু ঘুমিয়েছিলাম আর তখনই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমি তাড়াহুড়ো করে বিছানা থেকে নেমে দৌড় দিলাম ছাদের উদ্দেশ্য কিন্তু শেষ রক্ষা হলোনা। সব কাপড় অনেক আগেই ভিজে জুবুথুবু হয়ে গিয়েছে। মন খারাপ করে কাপড়গুলো নিয়ে নিচে নেমে এলাম।কিন্তু দরজার কাছে পৌঁছে দেখলাম শাশুড়ী মা রাগী ভাব নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন।মাথা নিচু করে ওনার সামনে এসে দাঁড়ালাম। আমি দাঁড়াতেই তিনি কাপড়গুলো আমার হাত থেকে টেনে নিয়ে চলে গেলেন। আমি এখনো মুখ ভার করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই আমার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। বুঝতে পারছেন নাতো এই হাসির কারণ।
মুদ্রার এ পিঠটা তো দেখেছেন চলুন এবার আপনাদের মুদ্রার ও পিঠটা দেখায়।
জগের পানি প্রায় তলানিতে এসে পৌঁছেছে কিন্তু আমার ঝাল এখনো কমেনি। আমি ভেবেছিলাম তাহামী হয়তো আমাকে খেয়াল করেনি কিন্তু আমাকে ভূল প্রমাণিত করে দিয়ে এক মিনিটের মাথায় সে হাতে মধুর বোতল আর চামচ নিয়ে রুমে ফিরে এলো। আর সেই মধুটা চামচ দিয়ে যত্ন করে আমাকে খাইয়ে দিল।
” ঝাল খেতে পারোনা তো খেয়েছো কেন? আমাদের বলতে পারতে, আমরা নাহয় অন্যকিছু বানিয়ে দিতাম। শোন এরপর থেকে যেটা পারোনা সেটা পারো দেখাতে যেও না।”
এরপর থেকে খাবারে ঝাল কম করে দেওয়া হয়, নয়তো আমার জন্য আলাদা করে কম ঝাল তরকারি রান্না করা হয়।
মাছ পুড়িয়ে ফেলাতে আমার মনের মধ্যে খুবই অনুশোচনা হচ্ছিলো। ভেবেছিলাম শাশুড়ী মা হয়তো আমার মাকে দোষ দিচ্ছেন কারণ আমি ভালো রান্না পারিনা। কিন্তু না,ওনার এই কথা বলার অর্থ অন্যকিছু ছিলো।
” এই মেয়ে তোমাকে কি তোমার মা রান্নাঘরের কিছু শেখাইনি?নতুমি এটা জানোনা রান্না করার সময় চুলার থেকে একটু দূরে থাকতে হয় কিন্তু তুমি তো একেবারে চুলার সাথে লেগে দাঁড়িয়েছ। শোন মেয়ে আমার ঘরে এসব চলবে না। রান্না যেরকম হবে হোক কিন্তু রান্নার সময় সাবধান থাকতে হবে। না হলে কিন্তু তোমার রক্ষে নেই।”
মন খারাপ করে এককোণে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন আমার ননদ তাহামীনা এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
” দেখো ভাবী শাড়িটা সুন্দর না?”
এটা বলতেই সে শাড়িটা আমার গায়ে জড়িয়ে দিলো।
” এই শাড়িটাতে তোমাকে খু্ব সুন্দর লাগবে। এই শাড়িটা তাহলে তুমিই নাও। আমি কালো শাড়িটা নেবো।”
ননদের কথা শুনে খারাপ লাগাটা নিমেষেই চলে গেল। বুঝলাম ননদ আমাকে খেয়াল করেছে।
ভেজা কাপড় গুলো হাত থেকে নিয়ে শাশুড়ী মা চলে তো গিয়েছিলেন কিন্তু পরমুহূর্তেই তড়িঘড়ি করে একটা তোয়ালে নিয়ে আবারো ফিরে এলেন।আমার গায়ে থাকা পানিগুলো মুছে দিতে দিতে তিনি বললেন,
” এই বৃষ্টির মধ্যে ছাদে যাওয়ার কি দরকার ছিলো তোমার? কাপড়গুলো দরকার পড়লে আরো ভিজতো। এরকম আর করবে না। যদি কোন দূর্ঘটনা হয়ে যেতো তখন কি হতো। যাও তাড়াতাড়ি শাড়ি চেঞ্জ করে এসো, নয়তো অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
আমি শাশুড়ী মায়ের দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে ভেতরে চলে এলাম।
প্রত্যেকের জীবনে দুটো দিক থাকে। একটা মুদ্রার যেমন এপিঠ-ওপিঠ থাকে, তেমনি একটা ঘটনারও এপিঠ-ওপিঠ থাকে। আমাদের কোন বিষয়ের একটা দিক থেকে সেটাকে বিচার করা ঠিক নয়।সবসময় উচিত দুটো দিক দেখা। সব শশুড় বাড়ির লোকেরা যেমন ভালো হয়না, তেমনি সবাই কিন্তু খারাপও হয়না।
___________________সমাপ্ত_____________________
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply