আমার এক কলিগের সাথে বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে জানতে পারলাম তার চট্টগ্রামে থাকা বাড়িটা তিনি তার মেজো ছেলেকে দিয়ে দিবেন। তার একটা ই বাড়ি। তিনজন সন্তান। আমি খুব কৌতহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম ওমা আপনার না দুইটা মেয়ে আছে! ওরা কি পাবে তাহলে? তিনি হেসে হেসে বললেন :
-ওদের দুজনকে একটা জায়গা দিয়ে যাবো। বুকিং দিছি। ওরা করে নিবে যা হয় কিছু একটা। আসলে আপনার ভাবীর সিদ্ধান্ত এগুলো। ভেবে দেখলাম ঠিকি তো আছে। মেয়েদের তো বিয়ে দিলেই চলে যাবে। ছেলেটাই তো সব। বুড়ো বয়সে আমাদের দেখলে তো ছেলেই দেখবে। মেয়েরা তো দেখবে না। শশুর বাড়ি সামলাবে নাকি আমাদের দেখবে?
-তাই বলে পুরো বাড়িটা ছেলেকে দিয়ে দিবেন? আর জায়গা থেকেই বা ছেলে কে বঞ্ছিত করবেন কেন? সে যদি আপনার মেয়েদেরকে কখনো এ বাড়িতে আসতে না দেয়? অথবা ওরা স্বামীর বাড়িতে সুখী না হয়। তখন কি হবে? এতো গুলো ফ্ল্যাট। অন্তত একটা করে ফ্ল্যাট দিতে পারেন।
-না না কি যে বলেন? অমন পরিবারে মেয়ে বিয়েই দিবোনা। আর দেখে শুনে বিয়ে দেবার পর ও যদি সুখ না হয় সেইটা ওদের ভাগ্য। এমনিতে আমার ছেলে মেয়ের মধ্যে খুব মিল মহব্বত ছেলেটা বোনদের ফেলে দিবেনা। আর তাছাড়া ওদের আমি বিয়ে দেবার সময় ঘর ভরে দিবো, অনেক গয়না দিবো, আর ভালো পারিবার দেখে বিয়ে দিলে ওদের এই বাড়ির সম্পদ দিয়ে কি হবে? ঐ জায়গা টা ই তো পড়ে থাকবে।
আমি উনার চিন্তা ভাবনার কথা চিন্তা করে যার পর নাই অবাক হয়ে চুপ করে রইলাম। আর উনি কথাগুলো বলে খ্যাক খ্যাক করে হাসলেন! আমার অসহ্য লাগছিল উনার হাসি। সেদিনের পর থেকে উনাকে আমি কেনো যেন খুব এড়িয়ে চলি। অজানা কারণে আমি ঘৃণাও করি উনাকে। এসবের কোনো কারণ নেই। উনার সম্পদ উনার সন্তান। উনি যা খুশি করুন। আমার কি তাতে? তবুও উনার এই বৈষম্য মূলক আচরণ আমার ভালো লাগেনি।
এর কিছুদিন পর উনার এক ভাই এসেছিলো আমাদের অফিসে। পরনে লুঙ্গি পাঞ্জাবি। খুব সম্ভবত মাস খানেক ধরে ধোয়া হয়নি। গলায় সবুজ লাল ডোরা কাটা একটা মাফলার। থুতনিতে সামান্য দাঁড়ি। প্লাস্টিক কিংবা রাবারের এক জোড়া সেন্ডেল পায়ে। যেগুলো সচারচর মধ্যবিত্ত দের বাথরুমের সেন্ডেল হয়ে থাকে। আমি খুব ভালো করে উনাকে লক্ষ্য করলাম। কারণ চেহারায় মিল থাকলেও বেশ ভূষা দেখে আমি কিছুতেই দুজনকে আপন ভাই মানতে পারছিলাম না। উনারা কয় ভাই বোন এটা আমার জানা হয়নি। তবে পরে জানতে পেরেছিলাম আমার কলিগ যে বাড়ি টা উনার ছেলেকে দিতে চাইলেন এই বাড়ির জায়গা টা উনি উনার বাবার থেকে পেয়েছিলেন। আর উনার ভাই পেয়েছিলেন কুমিল্লার গ্রামের জমি। কারণ তার বাবার মনে হয়েছে বড় ছেলে বুদ্ধিমান, পড়াশোনায় ভালো তাকে শহরের জমি দিলে সে সেখানে ভালো করতে পারবে। আর ছোট জনকে গ্রামের জমি দিয়েছেন কারণ সে পড়াশোনায় অত ভালো ছিলোনা। বরং কর্মঠ ছিলো। তার মনে হয়েছে এই ছেলে গ্রামের জমির দেখভাল করতে পারবে। অথচ তিনি দুই জায়গা থেকে কিন্তু দুজন কে সমান ভাগে সম্পদ দিতে পারতেন। তাতে দুজনের জন্যেই মঙ্গল হত। এমন না যে উনার ঐ খারাপ ছাত্র ছেলেটা নেশাখোর, বখে যাওয়া। শুধু পড়াশুনো টা কম বুঝতো।
এত বড় গল্পটা শেয়ার করার কারণ টা এবার বলি। উনার ভাই কে দেখার পর আমার মনে হয়েছে আমার কলিগ যে তার সন্তানদের মধ্যে বিভেদ করলেন এটা আসলে তার দোষ না। এটা তিনি পেয়েছেন তার বাবার কাছ থেকে। কারণ তার বাবা তাকে শিখিয়ে গেছে সন্তান সব সমান না। অথচ বিষয় টা কত ভয়ানক একবার ভেবে দেখেছেন? শহরের ভাইয়ের বাচ্চাদের মত জীবনযাপন করতে গ্রামের ভাইয়ের বাচ্চাদের কয়েক যুগ লেগে যাবে। যে ঐ লোকের এই সন্তানের মধ্যে পুরো কয়েক জেনারেশনের তফাৎ হয়ে গেছে। এই যে দুই ভাই এর মধ্যে জেনারেশন গ্যাপ, এইটা তৈরী করে গেলেন ঐ পিতামাতা। গায়ের ছেলেটি শুধু মাত্র এই কারণে যদি কোনোদিন মা বাবার জন্যে মোনাজাতে না কাঁদে সেটা কি খুব অন্যায় হবে?
আল্লাহ মাফ করুন। সম্পদ কিছুই না আবার এই সম্পদ ই সব। দুনিয়ার যত দাঙ্গা যত রকম সম্পর্কের ভাঙ্গন তার অধিকাংশ ই এই সম্পদের জন্যে। আর তাই আমার আজকের লেখা টা শুধু মাত্র তাদের জন্যে যারা ভাবছেন আপনার দুই ছেলের মধ্যে পার্থক্য আছে। যারা ভাবছেন ছেলেকে বেশি সম্পদ দিবো মেয়েকে কম তাদের জন্যে। যারা ভাবছেন একজনের নামে সম্পদ করে দিলাম অন্যজনকে দেখবেই। না ভাই দেখে না। ভাই বোনের সম্পর্ক চিরদিন এক রকম থাকেনা। আপনি যদি চান তারা মিলে মিশে থাকুক বেঁচে থাকতে সমান ভাবে সম্পদ ভাগ করে দিন। আপনার অসম ভাগের কারণে ভাই বোন, ভাই ভাই, বোন বোন এর মধ্যে সম্পর্ক নস্ট হয়। একজন আরেকজনকে হিংসা করে। দেখুন সন্তান শুধুই সন্তান। বড় সন্তান, ছোট সন্তান, ছেলে সন্তান, মেয়ে সন্তান সব এক। সবাই সন্তান। এদেরকে প্লিজ আলাদা করবেননা। আপনার মৃত্যুর পর যেনো কোনো সন্তান আপনাদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে এটা না বলে যে ” আমি কি তোমাদের প্রিয় সন্তান ছিলাম না?”
Leave a Reply