শরতের সকালবেলা, ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে আটটা বাজে পনেরো মিনিট। ঘণ্টা দুই ধরে ঢাকা শহরে উদ্দেশ্যহীন হাঁটছে জসীম। কেন হাঁটছে সে জানেনা তবুও হাঁটছে। সূর্যটা খুব সুক্ষ্মভাবে তার কিরণ ছড়াতে শুরু করেছে। আশেপাশে মানুষের অভাব নেই দম ফেলবার জায়গা নেই এতোই ব্যস্ত শহর অথচ প্রচণ্ড গরম আবহাওয়া কিন্তু মানুষের সেসব ভাবার সময় নেই। চিবুক বেঁয়ে ঘাম গরিয়ে পড়ছে জসীমের। হাঁসফাঁস লাগছে তার এতো গরমে আর এতো লোকারন্যের মাঝে। তার উপর ঢাকা শহরের যা অবস্থা, চারিদিকে ধুলাবালি গাছের দেখা পাওয়া দুষ্কর, অক্সিজেন যে পাওয়া যাচ্ছে এটাই ভাগ্য।
আজ দশ বছর পর দেশে এসে তার অবস্থা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি প্রবাদের মতো। এতো বছর পর দেশে এসে ঢাকা শহর ঘোরার লোভটা সে সামলাতে পারেনি, এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি ঢাকা সফরে বের হয়েছে কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে সে ভুল করেছে। মূলত বাড়ি যেতে সে ইতস্তত বোধ করছে যার দরুন সে ঢাকার মাঝেই সময় কাটাচ্ছিল কিন্তু এভাবে কতক্ষণ। বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে সে। সকালের হালকা নাস্তা দ্বারা উদরপূর্তি করেই সাড়ে নয়টার বাসে উঠে পরে, উদ্দেশ্য রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত নওগাঁ জেলা।
দশ বছর, সময়টা চলমান থাকাকালিন হয়তো ততোটা দীর্ঘ মনে হয় না, কারণ সময় স্রোতের মতো। তবে যদি একটু গাঢ় করে ভাবা হয়, দশ বছর নেহাৎ অল্পও না। এক সেকেন্ডে কতো কিছুর পরিবর্তন সাধিত হয় আর সেখানে দশ বছর অনেকটা সময়। বাসে বসে জসীমের এই কথাটাই আগে স্মরণ হল। জসীমের পুরো নাম জসীম উদ্দিন হাওলাদার। বড় শখ করে নামটা রেখেছিলেন তার বাবা। জসীমের বাবা খুব বেশী পড়ালেখা করতে না পারলেও তার পড়ালেখার প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল। বিশেষ করে বাংলা কবিতার প্রতি। প্রতিদিন এক দুই পয়সা করে সে তার আমলে জমিয়ে রাখতেন কবিতার বই কেনার জন্য। এজন্য বাসায় অসংখ্য কবিতার বই তার সংগ্রহে। বলতে গেলে তার গ্রামে তিনিই সবচেয়ে বেশী শিক্ষিতদের তালিকার প্রথম সাড়িতে। তার সংগ্রহে থাকা বা তার পড়া কবিতার মাঝে তার সবচেয়ে পছন্দের কবিতা ‘কবর’। তিনি কবি জসীম উদ্দিনের বিরাট ভক্ত ছিলেন যার মূল কারণ নিজের সন্তানের নাম জসীম রাখা। তার বাবা এতো বার করে এই কবিতা পড়ে শোনাতো যে আজও তার কবিতার কিছু লাইন মনে আছে।
“এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মত মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।”
বাবা যখন মারা গেলো তখন জসীম সবে পা রেখেছে কলেজের গণ্ডিতে। অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুটা তাদের পরিবারের অনুভূতিকে হেলিয়ে দিয়ে গিয়েছিল তবে বাবার সম্পদ যা ছিল তা দিয়ে তার জীবনের হেঁসে খেলে কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব, তাই আর্থিক টানাপোড়নের ভয় তাদের মাঝে বিন্দুমাত্র লক্ষিত হয়নি। তাই শোক কাটিয়ে উঠতেও সময় লাগেনি তেমন। এরপর মা আর ছোট বোনের সাথে কলেজ লেবেলটা খুব ভালোভাবেই কেটে গেলো তার। তারপর মাথায় কি ভুত চাপলো কে জানে তার ইচ্ছে হল বিদেশ যাবে, উচ্চতর পড়াশোনা সে বিদেশের মাটিতেই সম্পন্ন করবে। এই সিদ্ধান্তে তার মা বেজায় অসুখী ছিলেন। তার এক কথা,” দেশেত্ কি ইস্কুল কইলেজ নাই যে বিদেশত্ যাওন লাগে।” তবে এসব ছুটকো কথায় কান দেয়নি জসীম তার সিদ্ধান্ত সে নিয়েছিল আর সে একবার যা ভেবে নেয় তা তার করা যেন অত্যাবশ্যকীয় কাজ, ভাব এমন না করলে সে মৃত্যুর পরেও শান্তিতে থাকতে পারবেনা। তাই আর তার মায়ের গাইগুয়ে বিশেষ কোন লাভ হয়নি।
উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নিল কল্পনায় বিদেশ যাবার সিদ্ধান্ত সে খুব তাড়াতাড়িই নিয়ে নিল। অনাড়ম্বরে সে বাবার জমির একাংশ কিঞ্চিৎ লসে বিক্রি করে দেয়। ছেলের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবে তেমন কিছুই বলতে পারেননি জসীমের বিধবা জননী। সম্পদগুলো কাদের জন্য সন্তানদের জন্যই তো। তারপরের ঘটনাগুলো খুব তাড়াতাড়ি ঘটে, পরীক্ষার ফলাফল সে অনুযায়ী বাইরের ভার্সিটিতে এপ্লাই এসবের মাঝে আইএলটিএস কোর্স করা তাছাড়া পাসপোর্ট তৈরি বলতে গেলে খুব ব্যস্ত সময় কাটে তখন জসীমের। বাবার টাকায় রাজার হালে সে চলে যায় কানাডা। তার জীবনের পরিবর্তন ঘটে তখন থেকেই সাথে তার মা বোনের জীবনেরও।
জসীম যখন তার গন্তব্যে এসে পড়ে তখন গগনে দিবামনি পশ্চিম দিকে চলমান,অনেকটা হেলানো অবস্থায়। যদি ইংরেজিতে সময়টাকে আখ্যা দেওয়া হয় তাহলে বলা যায় “গুড আফটারনুন”আর বাংলায় বললে শুভ বিকেল। বিকেলের শুরুটা এখন। পশ্চিমে হেলানো সূর্যের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে জসীম, বাড়ির কাছে এসে হঠাৎ-ই অপরাধবোধ ঘিরে ধরেছে তাকে। মনটা খুব করে খচখচ করছে, অস্থির লাগছে তার ভেতরটা অজানা আশঙ্কায় পুড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কিছু ঘটছে যা খুব খারাপ, তার অস্থিরতা যেন বাড়ল। কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে? জানা নেই তার কিন্তু হচ্ছে। তার খারাপ লাগছে,খুব খারাপ একটা অনুভূতি হচ্ছে তার। পেট গুড়গুড় শব্দ শুনে জসীম তার পেটের দিকে তাকায়। না তার খিদে পায়নি বাসে বসে অনেক কিছুই সে খেয়েছে তাছাড়া ফুড ভিলেজ নামক জায়গায় সময়ের আগেই সে মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিয়েছে। এখন যা হচ্ছে হয়তো টা মূলত হজমের জন্য। এই শব্দ ‘বরবোরাইগমি’ নামে পরিচিত। নাড়ির মধ্য দিয়ে যখন বাতাস এবং তরল চলাচল করে, তখনই এ ধরনের শব্দ উৎপন্ন হয়। আবার পাকস্থলী ফাঁকা থাকলেও এমন শব্দ হয়ে থাকে। জসীম সেদিকে আর মাথা ঘামায় না তার এখনকার চিন্তা বাড়ি গিয়ে সে মা বোনের সামনে দাড়াবে কীভাবে। বোনটা নিশ্চয় খুব বড় হয়ে গিয়েছে, মাও হয়তো বুড়িয়ে গিয়েছে। দশ বছর! সময়টা তো আর কম না।
নওগাঁ শহর থেকে আরও ভেতরের দিকে জসীমের গ্রাম। গ্রামে পৌঁছাতে আরো ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগলো তার। গ্রামের বড় রাস্তার মোড়ে সে নেমে যায়। এখান থেকে মিনিট পনেরো হেটে গেলেই তার ছোট্ট রাজপ্রাসাদ, সেই প্রাসাদে একটা রাণী আর একটা ছোট্ট রাজকুমারীর বসবাস। বোনের কথা মনে হতেই জসীমের মুখে হাসি ফুটে উঠে। বোনটা তার থেকে প্রায় বছর পনের কি ষোল ছোট। সে হবার পর একটা কন্যা সন্তানের অভাববোধ করতেন তার মা। অনেক চেষ্টার পরও সে আবার জননী হবার ভাগ্য লাভ করছিলেন না। গ্রামের যে যা করতে বলতো যেই কবিরাজের কথা বলতো তার মা সেখানেই দৌড়রাতো। ভাব এমন এসব করলে তার সন্তান হবে। গ্রামের মানুষের এই এক দিক অন্ধবিশ্বাস তাদের মাঝে খুব বেশী। তবে ফলাফল অজানা না এসবের ফলে কিছুই ঘটেনি। কবিরাজের কাছে যাওয়া বাদ দিয়ে সে নামাজে চোখের জল ফেলতে শুরু করে। আল্লাহ্ হয়তো মায়ের উপর খুশি হয় তখনি তাদের বাড়ি আলো করে আসে রহমত। এই রহমত ঘরে আসার মাস খানেক পরই তার বাবার আচমকা প্রয়াত ঘটে। এ নিয়েও গ্রামে খানিক আলোচনা শুরু হয়। আলচনার বিষয়বস্তু ছিল,”মেয়েটা মনহয় অলক্ষ্মী আইতে না আইতে বাপরে খাইসে।” তবে এতে জসীম বা তার মায়ের কোন প্রতিক্রিয়া ছিলনা।
জসীম গ্রামের পথ দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। রাস্তাটা পাকা করা হয়েছে আগে এটা মাটির রাস্তা ছিল। আশেপাশে থোম্বা পোঁতা দেখতে পারছে সে হয়তো বিদ্যুৎ ও পৌঁছে গেছে। এসব দেখে হাসল জসীম, সময় যায় দিন বদলায় তার সাথে বদলে যায় আমাদের আশপাশ। চারপাশ দেখতে দেখতে এগোতে থাকে জসীম। এখন আশেপাশে অনেক ইটের বাড়িঘর তৈরি হয়েছে আগে তো সবার মাটির বাড়ি ছিল। একটু ঘন বসতিও দেখা যাচ্ছে। এই রাস্তা ছেড়ে ধ্যান খেতের আল দিয়ে হেটে গেলেই জসীমদের বাড়ি পাওয়া যায়। জসীম ধানের আল দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। অদূরে একটা তালের গাছ দেখা যাচ্ছে, গাছতা আজও আছে দেখে জসীম অবাক হল ক্ষানিক। এই তো সেই গাছ প্রথম যখন সে ওই দেখা যায় তাল গাছ ছড়া পড়েছিল তার বাবা এখানে তাকে নিয়ে এসেছিলো আবার তাল গাছ এক পায়ে দাড়িয়ে কবিতাটা পড়ার দিনের কথাও তার স্মরণ হয়। তার বাবা খুব সুন্দর করে মুখ নাড়িয়ে হাত নাড়িয়ে আবৃত্তি করতেন। তার গলার স্বর ছিল স্বচ্ছ, সাবলীল আর স্পষ্ট। তার বাবা ছিলেন প্রাণবন্ত স্বভাবের একজন মানুষ গম্ভিরতা তার ধাঁতে নেই। কাব্যিক মানুষ ছিলেন বটে, এ নিয়ে সমাজে ভালো খ্যাতিও ছিল তার। একটু এগিয়ে যেতেই জসীমের চোখে পড়ে জামরুল গাছটা। এই গাছও যে আজও আছে। এই গাছের তলেই তো তার বোন ছোট্ট পাখির ছানার মতো বসে তার কলেজ থেকে আসার অপেক্ষা করতো। আধো আধো বুলিতে ডাকতো তাকে,”ভাআআয়া ভায়া চক্কেট চক্কেট।” কতো মিষ্টি দেখাতো পাখিটাকে তখন। পাখিটাকি আজও এমন ভাবে ডাকবে, ডেকে কি বলবে ভাইয়া চকলেট দাও চকলেট দাও নাকি অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিবে। জসীম হাত দিয়ে তার কাঁধের ব্যাগের ভেতরে দেখল অনেকগুলো চকলেট সে কিনেছে। বিদেশ থেকে কেউ আসলেই তাদের কাছে ছোটদের মাঝে একটা উত্তেজনা থাকে চকলেটের জন্য। জসীম তার ছোট্ট বোনের চকলেট খাবার দৃশ্য কল্পনা করে একটু হাসল।
জসীম যতো ভেতরে প্রবেশ করতে লাগলো ততোই মানুষের মধ্যে উত্তেজনা লক্ষ্য করলো। সবাই কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। কেউ কেউ তার দিকে বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে। তারা হয়তো ভাবছে কে এই নতুন মানুষ। জসীমের পরিহিত কাপড় খুব আধুনিক। আশেপাশের কাউকেই জসীমের কাছে পরিচিত মনে হলনা। আজ তার গ্রামে এসে মনে হচ্ছে সে কি ভুল কোথাও চলে এলো কিনা। তবে তার ধারণা নিমিষেই ভুল প্রমাণিত হল যখন সে পরিচিত কারো মুখ দেখতে পেলো।
“আসসালামু আলাইকুম চাচা।” অন্যমনস্ক রফিজ মিয়া কারো সালামের শব্দে চোখ তুলে তাকায়।
“ওআলাইকুমুসসালাম। কেডা বাপজান তুমি? মুই তোমারে চিনি?” মোটা কাঁচের চশমাটা আরো এঁটে চোখ ছোট ছোট করে তাকাল রফিজ মিয়া জসীমের দিকে। জসীম একটু অপ্রস্তুত হল আসলেই দশ বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। হয়তো সেও অনেক বদলে গেছে তাই হয়তো ছোট থেকে বেড়ে উঠতে দেখেছে যেই চাচা সেই তাকে আজ চিনতে পারছে না।
“চাচা চিনো নাই আমারে আমি জসীম গো।” বৃদ্ধ একটু নড়েচড়ে উঠলেন, তার চোখ ছলছল করে উঠলো। অতি বিস্ময়ে তার গলা কেঁপে উঠলো। কাঁপা গলায় সে বলে উঠলো, “জসওঅসীম, তুই আমগো জসীম।” লোকটা তার ভগ্ন দুটি হাত বাড়িয়ে দিলো জসীমের দিকে। বৃদ্ধর চোখ বেঁয়ে অশ্রু গরিয়ে পড়তে শুরু করলো। জসীম অসহায় অনুভব করলো নিজেকে তবে বুঝল না এ অশ্রু কীসের। এই সেই চাচা যে বাবা মারা যাবার পর সবচেয়ে বেশী সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল। এই মানুষ তার বিদেশ যাবার সিদ্ধান্তে বিদ্বেষ প্রকাশ করেছিল বিঁধায় জসীমের চক্ষুশূল ছিলেন তবে আজ, আজ বড্ড আপন মনে হচ্ছে বৃদ্ধকে। এই লোকের সাহায্যেই তো মা বোনের সাথে সে বিদেশ গমনের পরেও যোগাযোগ রাখতে পারতো। কিন্তু মানুষটা তার রক্তের কেউ না। কিছু মানুষের সাথে রক্তের সম্পর্কের প্রয়োজন হয়না তারা এমনিই আপন হয়। হঠাৎ-ই তার মায়ের কথা মনে পরে গেলো।
“চাচা আমার আম্মা।” কথাটা শুনেই বৃদ্ধ এবার জোরে কাঁদতে শুরু করলো। রফিজ মিয়ার কান্না দেখে জসীমের মনে ভয় ঢুকে গেলো। সেই আগের অস্থিরতা এবার দ্বিগুণ হতে শুরু করলো। ভেতরটা তার কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আশংকা করতে আরম্ভ করলো। সে এবার কাঁপা স্বরে শুধাল,” চাচা কাঁনতাছো কেন, ডর লাগে তো।” রফিজ মিয়া কিছু না বলে জসীমের হাত ধরে হাঁটতে আরম্ভ করলো। চাচার এই নিশ্চুপ থাকাটা জসীমের মনের আশংকাকে জোরালো করলো। অজানা ভয়ে তার আত্মা শুকিয়ে আসার জোগাড়।
শেষ রক্ষা বোধহয় আর হলনা। জসীমের আসতে আজ বড্ড দেরি হয়ে গেলো। মনের ভেতরের সেই ছটফটানি সেই অজানা আশংকা আজ সত্যি হয়ে দেখা দিলো। সময়ের পরিক্রমায় এতটা অসহায় সে কখনোই অনুভব করেনি। জীবনের এ কোন মোড়ে এসে সে উপস্থিত হয়েছে। আজ তার নিজেকে বড্ড কাপুরুষ মনে হচ্ছে, তার মতো ব্যর্থ মানুষ বুঝি এ জগতে আর একটি নেই।
“আম্মা।” ক্লান্ত ভগ্ন হৃদর নিয়ে ছলছল চোখে মায়ের পানে তাকিয়ে সে ডেকে উঠলো। তবে যে তার সোনার সেই সংসার আজ সংসার নেই। কোন বিষম কালবৈশাখীর প্রকোপে পড়েছে,তচনচ করে দিয়ে গেছে সবটা এখন শুধু ধ্বংসস্তূপ অবসিস্থ।
“আম্মা, ও আম্মা কথা কইবা না।” জসীমের গলার আকুতি পৌঁছে না জামিলা বেগমের কর্ণ অবধি। সে নিশ্চল হয়ে বসে আছে ভগ্নদশার ঘরখানার চৌকাঠে। ‘অল্প শোকে কাঁতর অধিক শোকে পাথর’ জামিলা বেগমের অবস্থা আজ পাথরের মতো। বাহ্যিক সে শক্ত হয়ে আছে ভেতর তার হাহাকারে ভরা।
“জসীম রে তোর আম্মা হেই তহন থাইকা থম ধইরা বইসা আছে এতো কইরা কইতাছি আম্মা কান্দেন এমনে থাইকেন না। কে শোনে কার কতা তোর আম্মায় তো কতায় কয় না রে।” পাশের বাড়ির সেলিম ভাইয়ের বৌ কথাগুলো বলতে বলতে কাঁদতে শুরু করলেন। জসীম একবার সেদিকে তাকায় তারপরই সে তার মায়ের দিকে তাকায়। তার মা এখনো সেই শুষ্ক চোখে উঠোনে চেয়ে আছেন।
“আইলি তো আইলিরে জসীম আর কইদিন আগে আইবার পারলি নারে। তোর আম্মা কতো কানসে আমগো কাসে তোর লাইগা। তোর বোনডা তুই টুকুন মাইয়া কতো কানসে রে জসীম।” অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে জসীমের হৃদয়কুল। অসহায় চোখে তাকালো সে উক্তি করা মানুষটির দিকে, এ তার রহিমা খালা মায়ের দূরসম্পর্কের বোন। জসীম আর মায়ের কাছে বসে থাকেনা। এগিয়ে যায় উঠোনে বোনের কাছে হাঁটুমুড়ে বসে পরে। বোনটা কতো সুন্দর সাদা জামা পরিহিত অবস্থায় শান্তির খুম ঘুমাচ্ছে। জসীমের বারবার বোনটাকে জাগ্রত করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সে গলা ফাতিয়ে চিৎকার করলেও আজ তার বোন উঠবে না, না উঠবে না আর কোনদিনও না। জসীমের গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। বোনটার বয়স কতোই বা বারো কি তেরো। এতটুকু মেয়ের এই পরিণতি, নিজেকে আজ বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে জসীমের। আজ তার একসাথে অনেক অনেক অনুভুতি অনুভূত হচ্ছে। এইটুকু মেয়ের ক্যান্সার! যদি সে সেই সময় থাকতো তবে হয়তো আজ এই পরিণতি হতো না, হয়তো! কিন্তু সে তো আর তার নিজের মাঝে ছিল না। সে হারিয়ে গিয়েছিল মিথ্যে ভালোবাসার উষ্ণতায়, লোপ পেয়েছিল তার বিবেক বুদ্ধি। যখন সে উষ্ণতা হারিয়ে ফেললো বুঝল এসব ছিল শুধু ছলনা তখন বুঝল সে কি করেছে। আজ আশেপাশে সবার ক্ষোভের দৃষ্টি তার উপর।
বাদ এশা জসীম তার ছোট্ট পরীকে শুয়িয়ে দিয়ে আসে অনন্তকালের জীবনে। যেখানে তার বোনকে একাই থাকতে হবে, কিভাবে থাকবে ছোট্ট পাখিটা একা? আর কোনদিন এই বোন তার জন্য অপেক্ষা করবে না আর কোনদিন ভাইয়া বলে ডাকবে না আর কোনদিন না। বাড়ির পাশের পুকুরপাড় আজও আছে তবে তাদের সেই রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িটা আজ আর বাড়ি নেই এটাকে বস্তির ভাঙ্গাচোরা বাড়ির সাথেও তুলনা করা যায়না, এতোই খারাপ অবস্থা বাড়ির।
“এখন আফসোস করে কি হবে?” জসীম পাশ ফিরে তাকায় তার থেকে সাত আট ধাপ দুরে দাড়িয়ে রেশমা। পুকুরপাড়ের বাঁধানো ঘাটে একটা বাল্বের ব্যবস্থা আছে, সম্ভবত এখানে মাছের চাষ হয়। সেই বাল্বের নিচেই দাড়িয়ে আছে রেশমা। ষাট ওয়াট বাল্বের হলুদ আলোতে রেশমাকে দেখতে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। এই তো সেই মেয়ে তার বাল্যকালের সখী। সময়টা আগের মতো হলে মেয়েটা হয়তো এতো দুরে দাড়িয়ে থাকতো না।
“তা স্বাপ্নিক মানুষ স্বপ্নরাজ্য থেকে আজ এখানে কেন? ওখানকার স্বাদ বুঝি উঠে গেলো।” জসীম অসহায় চোখে তাকাল রেশমার দিকে কিন্তু রেশমার কোমল চোখে আজ তার জন্য ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। যদি একটু অভিমান দেখা যেতো তবে হয়তো বুঝত এ তার আপন মানুষ।
“আমি জানি আমি ভুল করেছি। কিন্তু তখন……।”
“কিন্তু তখন তোমার স্বপ্নটাই সব ছিল আর বিদেশ গিয়ে নতুন পাখনা নব্য স্বাধীনতা ভুলিয়ে দিলো তোমার একটা অতীত আছে, তাই না? স্বপ্ন দেখা ভালো কিন্তু নিজেকে ভুলে গিয়ে স্ট্যাটাস নামক ফালতু শব্দ নিজের ব্যক্তিত্বে বজায় রাখার কোন সুশিক্ষিত মানুষের কম্য নয়।” জসীম অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরায় তার আজ কিছুই বলার নেই।
“তুমি জানো তুমি যোগাযোগ বন্ধ করে দেবার পর চাচির কি অবস্থা হয়েছিল, জানো তুমি যেই পুচকিটাকে নিজের হাতে মাটি চাপা দিয়ে আসলে তার কি অবস্থা হয়েছিল। এক বিধবা মা আর এক এতিম বোনকে রেখে কিভাবে ছিলে? নিজের জীবনের আনন্দটাই তোমার কাছে সব ছিল। ওই ভিনদেশে এমন কি মধু ছিল যা তোমার অতীত ভুলিয়ে দিলো। নাকি নজরের পরিবর্তন ঘটেছিল।”
“চুপ করো, দয়া করে চুপ করো। আমার এসব শুনতে ভালো লাগছে না। আর এখন এসব বললে কি অতীত পরিবর্তিত হবে কখনো।”
“না অতীত তো পরিবর্তন হবে না কিন্তু আমার বুকের জ্বালা তো একটু হলেও নিভবে। শুনবে না, কি করে চলেছে সেই দিনগুলো তোমার মা বোন। না শুনতে চাইলেও শুনতে হবে কারণ আমি বলবোই। তোমার খায়েশ পুরো করার জন্য একে একে সব জমি বিক্রি করতে থাকে চাচি, প্রতিবার যখনি ফোন দিতে তোমার মা ভাবতো ছেলেটা আমার কথা স্মরণ করেছে তোমার বোন মায়ের কোঁচার কাছে বসে থাকতো ভাইয়ের সাথে একটু কথা বলবে বলে। কিন্তু তার ভাই কি আর ভাই ছিল সে তো ভিনদেশীদের সাথে চলে ফিরে ভিনদেশীতে রূপান্তরিত হয়েছিল। যখন মা আর টাকা দিতে পারলো না তখন ছেলে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো। হায়রে ছেলে! সে কি জানতো তার মা ততদিনে কাঙ্গালি হয়ে গেছে। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটানো শুরু হয় তাদের। যেই আবাদি জমির ফলনে তাদের মাস চলতো তা তো তাদের সাত রাজার ধন মানিকরাজ নিঃশেষ করেছে। জানো তোমার রাজরানীর মতো মা মানুষের বাড়ি কাজ করতে শুরু করলো কিন্তু গ্রামে কি আর বড়লোক আছে যে তাকে স্থায়ী কাজ দিবে শুধু ধানের মৌসুমে ছিল তার কাজ, তাই দিয়ে মা মেয়ে কাটাত দিন। শেষে এই কষ্টের জীবনে আবার নতুন করে শুরু হল ক্যান্সার। শেষে বিক্রি করলো শখের বাড়িটা, কি হল ফিরল না তো মেয়েটা, ফিরল না আর ফিরবেও না।” কথাগুলো কাঁপা কাঁপা গলায় বলছিল রেশমা, কথা শেষ হতেই সে হাওমাও করে কাঁদতে শুরু করলো। জসীম নির্বিকার পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছে।
“বড়লোক হতে চেয়েছিলে না হয়েছ তো, গায়ে তো অনেক দামি কাপড় দেখছি। কিন্তু জানো তো তোমার মতো বড়লোক আমি হতে চাইনা, আমার মনে হয় কেউই হতে চায়না। অভাগা দেখেছি কিন্তু তোমার মতো অভাগা একটাও দেখিনি।” রেশমার শ্লেষযুক্ত কথা জসীম আর সহ্য করতে পারছে না। সে পুকুরের পারে বাঁধানো সিঁড়িতে বসে পরে, বর্তমানে শরীরে তার দাড়িয়ে থাকার শক্তিটুকু নেই। রেশমা কিছুক্ষণ দাড়িয়ে জসীমের দিকে তাকিয়ে থাকে একটু পরেই শ্লেষের হাসি হেঁসে পা বাড়ায় বাড়ির দিকে। তারপর কি মনে করে আবারো আগের জায়গায় ফিরে আসে।
“আমার তিন বছরের একটা ছেলে আছে। আমার উনি কিন্তু খুব বড়লোক না এইতো গ্রামের যেই কলেজটা আছে না ওখানেই পড়ায়। আল্লাহর রহমতে কিন্তু আমি ভালোই আছি, অনেক ভালো আছি।” জসীম অশ্রুসিক্ত নজরে তাকায় রেশমার দিকে কিন্তু রেশমা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে পা বাড়ায় বাড়ির পানে।
একাকীত্ব মুহূর্তটা খুব কষ্টের। যখন আপনার মনে হয় আপনি একা এ জগতে আপনার পাশে কেউ নেই তখনকার কষ্টটা আপনি নিজে ছাড়া কেউ অনুভব করতে পারবে না। জগতের কষ্টগুলোর মধ্যে একাকীত্ব একটি। আজ জসীমও একা, খুব একা। আশেপাশে হাজারো মানুষ আছে তবুও সে একা। ঠিক পুকুরের স্থির জলরাশির মতো, নিঝুম রাত্রির মতো, উদাস আকাশের মতো। মনকষ্টে জ্বলতে থাকা হৃদয় অনুতাপের তীক্ষ্ণ বানে আরো বেশী রক্তাক্ত হচ্ছে। এ ঘা শুকানোর নয়, এই কষ্ট ভোলার নয়, এই ভুল শুধরাবার নয়।
এক বিশাল আকাশ দিয়েছে তোকে ডাক
তোর নিয়তে ছিল হয়তো ফাঁক,
অতীত তখন দিয়েছিল তোকে ব্যর্থ হাঁক
আজ তুই একলা একাই থাক।
পুকুরপাড় থেকে বাড়ির ভেতরের চিৎকারের আওয়াজে ধ্যান ভাঙ্গে জসীমের। জসীম তাড়াহুড়োই দাড়িয়ে পরে। তার হৃদপিণ্ড খুব জোরে স্পন্দন করতে শুরু করে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলে সে বাসার দিকে। সবাই তার মায়ের কাছে ভিড় করে আছে। জসীম দৌড়ে সেখানে গেলো। দেখল মা তার কেমন যেন ছটফট করছে। কারেন্টে শক করলে মানুষ যেমন করে ঠিক সেভাবে। মাকে এমন করতে দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠে জসীম।
“আম্মা আম্মা ও আম্মা এমন করতাছ কেন। খারাপ লাগে তোমার। কেউ ডাক্তার ডাকো, তাড়াতাড়ি ডাকো কেউ।” জসীমের আর্তনাদে সকলের মনে হয়তো একটু কষ্টের দানা বাঁধে। তাদের মাঝে তখন কারো গলার আওয়াজ পাওয়া যায়।
“ওরে আবদুল্লা যা দেহি লতিফ ডাক্তার রে লইয়া আই, তাত্তাতারি যা দেহি।” তবে সময় বোধহয় আর বেশী পেলো না কেউ হাতে। আবারো শোকের মাতমে নামলো প্রকৃতি। শান্ত দেহে মুক্ত চোখের মনি আসমানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে, এ দেহের আত্মা দেহ ছাড়িয়া চলে গেছে। নিথর দেহের দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে জসীম। এ জীবনে বোধহয় আর তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে না। অপরাধের অনলে জ্বলতে থাকবে তার বাকি জীবন। কি করে বাঁচবে সে এতো অপরাধ বোধ নিয়ে? কি করে বাঁচবে সে এই পীড়া নিয়ে। আমৃত্যু তাকে দৌড়ে বেড়াবে এই যন্ত্রণা, যা তাকে অহর্নিশ পীড়া দিবে।
(সমাপ্ত)
Leave a Reply