-তুই আমার বাসায় এসেছিস কেন!!!!
-আপা আমার কথা শুন,
-না, আমি তোর কোন কথা শুনবো না। তুই আমার বাসা থেকে বের হয়ে যাবি এখনই।
-আপা আমার মেয়েটা ………….
-তোর মেয়ে,বউ এদের কথা বলার জন্য তুই আমার বাসায় এসেছিস ?? তোকে কে ঢুকতে দিল?? মিলির মা, মিলির মা তুমি কেন ওকে আমার বাসায় ঢুকতে দিয়েছ??
– কে এসেছে শায়লা ? তুমি এমন চিৎকার করছ কেন। আরে শালা বাবু যে। কি ব্যাপার তুমি কাঁদছ কেন শাহিন ??
– দুলাভাই আপাকে একটু বুঝান না। আমার মেয়েটার ব্রেন টিউমার হয়েছে………..
– তোর মেয়ের কি হয়েছে সে কথা আমি শুনতে চাই না শাহিন।
– আঃ শায়লা তুমি এমন করছ কেন? শাহিনের কথাটা একবার শুন। ও তো তোমার ভাই নাকি ?
-না, আমার কোন ভাই নেই। যে তার নিজের মাকে অত্যাচার করে মেরে ফেলে তার আবার বোন কিসের?
-আপা আমার ভুল হয়েছে। আল্লাহ আমাকে শাস্তি দিচ্ছে। আপারে আমার মেয়েটির অবস্থা খুব খারাপ। অপারেশনের জন্য অনেক টাকা লাগবে। আপা তুই আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিস না।
– ও আচ্ছা টাকার জন্য এসেছিস আমার কাছে !! তোকে তো এক সময় আমি অনেক টাকা দিয়েছি। তোর মনে আছে ? আমার মায়ের চিকিৎসা করানোর জন্য। চিকিৎসা দূরে থাক। আমার মাকে ঠিক মত খাবার পর্যন্ত দিস নাই। আমার পাঠানো টাকা দিয়ে তুই গাজীপুরে জমি কিনে আলিসান বাড়ি করেছিস। আমার মা কে ভাত খেতে দিতি না। ভাত খেলে মা বাথ্রুম করবে। আর সেই বাথ্রুম পরিস্কার করতে হবে। তাই শুধু লিকুইড খাবার দিতি। তাও দিনে দুইবার। মনে আছে এসব কথা শাহিন ?? মনে আছে তোর ??
আমার মনে আছে জানিস তো। আমি এখনও ভাতের লোকমা মুখে দিতে গেলে আমার মনে হয়; আমার মা মারা যাবার আগে একবার ভাত খেতে চেয়েছেন কিন্তু …………… আমি আর কথা বলতে পারলাম না। হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ড্রয়িংরুমের ফ্লোরে বসে পড়লাম। মিলির মা এসে আমাকে শক্ত করে ধরে ফেলল। সবুজ মিলির মাকে সরিয়ে দিয়ে আমার পিঠে হাত রাখল। শাহিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আগের মত চোখের পানি মুছছে।
হ্যাঁ; শাহিন আমার ছোট ভাই। আমরা দুই ভাইবোন। আব্বা সরকারী চাকুরে ছিলেন। সবুজের সাথে আমার বিয়ের পরে আমি কানাডায় চলে গিয়েছিলাম। কানাডা যাবার তিন মাস পরেই আব্বা মারা যান। তারপরে শাহিন আর ওর বউকে নিয়ে আম্মা থাকতেন ওয়ারীর টিপু সুলতান রোডে আমাদের নিজেদের বাড়িতে। শাহিন পড়ালিখা করলেও কোন চাকরি করতো না। আব্বা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন আব্বার চাকরির টাকায় সংসার চলতো। আব্বা মারা যাবার পরে আব্বার পেনশনের পাওয়া এককালীন টাকা দিয়ে শাহিন কি সব ব্যবসা শুরু করে। কিন্তু কয়েকদিন পর পরই আম্মাকে ফোন করলে শুনতাম, ওর নাকি ব্যবসায় শুধু লস হয়ে যায়। আব্বার সব পাওনা টাকা এভাবেই ও নষ্ট করল। আম্মার হাত খরচের জন্য আমি কিছু টাকা দিতাম সেই সময়। সেই টাকাও আম্মা সংসারের কাজে খরচ করতেন।
আব্বা মারা যাবার দুই বছর পরে আম্মা ব্রেনস্টোক করে প্যারালাইজড হয়ে গেলেন। তারপর থেকেই শুরু হল আমার টাকা পাঠানো। সবুজ স্বামী হিসেবে খুবই ভালো একজন মানুষ। আমি কাজ করে যে টাকা পেতাম সেই টাকায় ও কখনো হাত দিত না। আমি আমার ইচ্ছা মত সেই টাকা খরচ করতাম। আম্মার অসুস্থ হবার পর থেকেই কয়েকদিন পর পর শাহিন ফোন করে আম্মার চিকিৎসার কথা বলে টাকা চাইত। আমিও আমার উপার্জনের বেশিরভাগ টাকাই ওকে পাঠিয়ে দিতাম। আর বারবার ওকে বলতাম আম্মার যেন ভালো চিকিৎসা হয়। ও বলতো আম্মার কোন অবহেলা হচ্ছে না। খুব ইচ্ছা করত আম্মার সাথে কথা বলতে। কিন্তু আম্মা কথা বলতে পারতেন না।
এভাবে এক বছর চলে গেল। আমি আসতে চাইলাম ঢাকায়। শাহিন আমাকে বলল আপা তুই এসে কি করবি ? শুধু শুধু বাচ্চাদের একা ফেলে আসার দরকার নেই। আম্মার দিকে খেয়াল রাখার জন্য আমি আর রিতা তো আছিই। আমিও চিন্তা করলাম ; আমি দেশে গেলে তো টাকার ব্যবস্থা হবে না। বরং আমি এখানে থাকলে টাকা পাঠাতে পারবো। এভাবে টানা ৩ বছরের কিছু বেশি সময় পর্যন্ত আমি আমার বেতনের বেশিরভাগ টাকা শাহিনের নামে পাঠিয়ে দিতাম। ও কয়েকদিন পরেই ফোন করে বলতো – আপা, আম্মাকে ব্যায়াম করানোর জন্য এই মেশিন লাগবে, সেই মেশিন লাগবে। ডাক্তার দেখানোর জন্য, ঔষদ কিনার জন্য টাকা নেই। আমি দেরি বা করে আমার কাছে টাকা না থাকলেও সবুজের কাছ থেকে নিয়ে টাকা পাঠিয়ে দিতাম।
এভাবে তিন বছর চলে গেলেও আম্মার কোন উন্নতি হলনা দেখে আমার মনে খটকা লাগলো। শাহিন বলছে আম্মার এত চিকিৎসা হচ্ছে, নিয়মিত ব্যায়াম করাচ্ছে। কিন্তু আম্মা ঠিক আগের মতই আছে। আমি শাহিন কে না বলে একাই ঢাকায় আসলাম। ঢাকায় এসে আমাদের বাসায় গিয়ে দেখি বাসায় কেউ নেই। কাজের মেয়ে জানালো শাহিন গাজীপুরে নিজের বাড়ি করেছে । সেই বাড়িতে আজকে মিলাদ দিতে গেছে সবাই। আমি বাসায় ঢুকে দেখি আম্মাকে আমাদের কোনার দিকের রুমে রাখা হয়েছে। সেই রুমে কোন আলো যায় না। আম্মার রুমে ঢুকতেই বাজে একটা গন্ধ আমার নাকে লাগলো। আম্মার রুমে তো দূরে থাক। সারা বাসা খুঁজেও কোন ব্যায়ামের মেশিন আমি খুঁজে পেলাম না। আম্মা আমাকে দেখেই গোঁ গোঁ শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন। আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে লাগলো। কাজের মেয়েকে টাকা দিয়ে ওর মুখ খুলালাম। জানতে পারলাম আম্মা অসুস্থ হবার পর থেকে আর একবারও আম্মাকে ডাক্তারের কাছে নেয়া হয় না। দীর্ঘদিন থেকে আম্মাকে শক্ত খাবার দিচ্ছে না। কারন শক্ত খাবার খেলে আম্মা বাথ্রুম করলে পরিস্কার করতে হবে। দুইবেলা আম্মাকে লিকুইড খাবার দেয় শুধু। আম্মাকে কবে শেষ গোসল করিয়েছে মেয়েটা আমাকে বলতে পারলনা।
আম্মাকে চেনাই যায় না। শরীর শুকিয়ে বিছানার সাথে লেগে গেছে। কাজের মেয়েটি বলল আম্মা নাকি প্রথম প্রথম একটু একটু কথা বলতে পারতেন। সেই সময় ভাত খেতে চাইতেন। কিন্তু ওরা দিত না। ঠিক মত না খেতে পেরে আম্মার অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। সেইদিনও আমি আম্মাকে জড়িয়ে ধরে এমন করে হাউমাউ করে কেঁদেছি। ঠিক করলাম আম্মাকে নিয়ে আলাদা বাসায় চলে যাব। কিন্তু তার ঠিক দুইদিন পরেই আম্মা মারা গেলেন। শাহিনের কাছে টাকার হিসাব চাইলাম। ও অস্বীকার করল। আমি নাকি ওকে কোন টাকাই দেই নাই।
আমিও আর ঝামেলা করলাম না। আম্মাকে যখন বাঁচাতে পারলাম না তাহলে আর টাকার হিসেব করে কি লাভ?? আমি কানাডায় চলে গেলাম। কিন্তু আমার মন কানাডায় বসল না। সপরিবারে বাংলাদেশে চলে আসলাম। আম্মা মারা যাবার পর থেকে শাহিনের সাথে আমার সব রকম যোগাযোগ বন্ধ ছিল। আর আজকে সে এলো তার মেয়ের অপারেশনের টাকা চাইতে। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে; সবুজের আপত্তি উপেক্ষা করে শাহিনকে বাসা থেকে বাহির করে দিলাম। যাবার সময় শাহিন বারবার মেয়েটার কথা বলে কাঁদছিল। ওর মেয়ে নাকি কাকরাইলের ইসলামিয়াতে আছে। ওর কথা বিশ্বাস না করলে আমরা যেন গিয়ে খোঁজ নেই ।
রাতে ছেলে মেয়েরা নিজেরা খেয়ে শুয়ে গেল। সবুজ আমাকে খাবার জন্য অনুরোধ করেও খাওয়াতে পারলনা। আমি বিছানায় ঘুমের ভান করে পড়ে থাকলাম। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। বারবার আম্মার মুখ চোখে ভেসে উঠছিল। আম্মা শাহিনকে বেশি আদর করত। সেই শাহিনের আম্মার জন্য মায়া হল না। অথচ আজকে নিজের মেয়ের জন্য কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। অপমান হবে জেনেও টাকা পাবার আশায় আমার বাসায় এসেছে। আচ্ছা ও কি একবার ও ভেবেছে ও এখন যেমন নিজের সন্তানের জন্য কাঁদছে আম্মাও ওকে আর আমাকে এমন করেই বড় করেছে। আমি খুব সাবধানে উঠে বারান্দায় গেলাম। যাতে সবুজের ঘুম না ভেঙ্গে যায়। আমি ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে লাগলাম। শাহিনের মেয়েটাকে আমি তেমন কাছে পাই নাই। শেষবার যখন আসি সেই সময় ওর বয়স ছিল ৪ কি ৫ বছর। দেখতে অবিকল আম্মার মত হয়েছে। আম্মা মারা যাবার পরে আম্মার লাশ ধরে মনে হয় ও আর আমিই কেঁদেছি।
-ঘুম আসছে না শায়লা ? আমি চমকে উঠে সবুজের দিকে তাকালাম। ও কখন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আমি বুঝতেই পারলাম না। ও বলল – আমি জানি শায়লা শাহিন যেটা করেছে তার কোন ক্ষমা নেই। তুমি আজকে যে ব্যবহার ওর সাথে করেছ, সেটা তোমার জায়গায় অন্য কোন বোন হলেও করত। আমি সবুজকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম – সবুজ ; শাহিনের মেয়েটা দেখতে অবিকল আম্মার মত। অন্যায় করেছে শাহিন। বাচ্চাটার তো কোন দোষ নেই। আম্মা ওকে খুব ভালবাসতো।
ফজরের আজান দিচ্ছে। আমি অজু করে নামাজ পড়তে দাঁড়ালাম। কিন্তু কান্নার জন্য আমি ঠিক মত সূরা পড়তে পারছি না। কিছুক্ষন আগেই সবুজ টাকা নিয়ে কাকারাইলের হাসপাতালের দিকে গেল। শাহিনের মেয়েটা যেন বাঁচে তাই আমি মনে প্রানে দোয়া করতে লাগলাম। মেয়েটা বড় হলে শাহিন বুঝতে পারবে সন্তানের অবহেলা পাওয়া বাবা মায়ের কাছে কতটা কষ্টের।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply