ছোট ভাসুর পৌরসভার কমিশনার। প্রতিদিন দুই চারটা সমস্যার সমাধান বাড়ির বারান্দায় তিনি করেন। প্রতিটা সমস্যার পেছনে একএকটা হৃদয়বিদারক গল্প থাকে, যেগুলো সাজিয়ে লিখলে দিনেই একটা গল্পগ্রন্থ লেখা যাবে।
আমার রুম বারান্দার সাথে থাকায় মাঝেমাঝে টুকটাক আমার কানে আসে, আমি শুনতে চাই না, এড়িয়ে যাই। বেশির ভাগই পারিবারিক কলহ বা নারী পুরুষের হৃদয়ঘটিত ব্যাপার স্যাপার। আমি ঘটনার গভীরে যাই না। যদিও যেতে ইচ্ছে হয়। কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে সেসব গল্প এককানে শুনে আরেক কানে বের করে দেই। মস্তিস্কে বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে দেই না।
আজ আর এড়িয়ে যেতে পারিনি। একটা সমস্যা ভীষণভাবে মনে নাড়া দিয়ে গেল।
সমাজে ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকা এক সুশীল পরিবার। যারা নিজেরদেরকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত, শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত বলে দাবী করেন। তারা পরিবারের বউয়ের কোনো অসুখ হলে চিকিৎসা করায় না। বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। না হয় বাবার বাড়ি থেকে পাঠানো টাকায় সব রোগের চিকিৎসায় কেবল নাপা খাওয়ায়। একটু ভেঙেই বলি। ভাসুরের কাছের এক বন্ধু বাসায় এলেন। তিনি ভীষণ ডিস্টার্ব। কিছুক্ষণ পরপর কল আসছে। আর তিনি ফোন রিসিভ করে বারান্দায় চলে যান। নিচু গলায় কিছু বলে আবার চলে আসেন। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন আসে। তার চেহারায় পরিবর্তন হয়ে যায়। মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। পুরো কপাল কুচকে থাকে। তিনি কিছু লুকানোর আপ্রান চেষ্টা করেন।
সবাই কারণ জানতে চায় অথচ তিনি কিছুই বলতে চান না।
অবশেষে জানতে পারি তার একমাত্র বোন, যিনি শিক্ষিতা, সুন্দরী, গুণী। যাকে বিয়ে করার জন্য একসময় সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছেলেদের লাইন ছিল। তাকে তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত ছেলের কাছেই বিয়ে দেয়া হলো, ছেলে ইউনিভার্সিটির টপার, নিজেদের বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, সব ভাই সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত।
অথচ মেয়েটার মোবাইল বিল ও বাবার বাড়ি থেকে দিতে হয়। অসুখ হলে ঔষধ কিনে দিতে হয়। এভাবেই চলছে বিয়ের পর থেকে, বিশ বছর হয়ে গেলো বিয়ের অথচ অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। তারা লোকলজ্জার ভয়ে কাউকে কিছু বলছেও না। আজ চারদিন ধরে জ্বর, তারা নাপা ছাড়া আর কোনো চিকিৎসা করাচ্ছে না। এখন বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে, চিকিৎসা করানোর জন্য।
আসল ঘটনা ভদ্রতার মুখোশধারী শয়তান বর ড্রাগ এডিক্টেড, সেজন্য স্ত্রী -সন্তানের প্রতি উদাসীন।
২)
আমার শ্বশুর বাড়িতে জামাল মিয়া নামের ষাটোর্ধ এক কেয়ারটেকার ছিলেন। তিনি তিন বিয়ে করেছেন। তিন বউই জীবিত। তিনি থাকেন মূলত ছোট বউয়ের কাছে। ছোট বউয়ের ঘরে দুই ছেলে -মেয়ে। কোনো এক বিশেষ কারণে তিনি তিন বিয়ে করলেও পূর্বের ঘরের ছেলে – মেয়ে কিন্তু তার উপর অসন্তুষ্ট বলে মনে হয়নি।
একদিন তিনি রান্না ঘরে বসে ফোনে কার সাথে যেন উচ্চস্বরে কথা বলছিলেন
” ববিতার মা তুই কোনো চিন্তা করিছ না। আঁই দরকার অইলে জাগা -জমি বেচি অইলেই তোর চিকিৎসা করামু।”
মোবাইল রেখে জামাল মিয়া শিশুর মতো করে কান্না করছিলেন। তার তৃতীয় স্ত্রীর জরায়ুর ক্যন্সার ধরা পড়েছে। তিনি মরে যাওয়ার ভয়ে সারাক্ষণ স্বামীর কাছে ফোন করে কান্নাকাটি করছেন। জামাল মিয়াও স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, ভরসা দিচ্ছেন দূরে থেকে। অবশেষে তিনি ছেলেদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, কারো সহযোগীতা ছাড়াই নিজের ভিটে মাটি বিক্রি করে স্ত্রীর চিকিৎসা করিয়েছেন।
সাতহাজার টাকা বেতনের কর্মচারী জামাল মিয়ার তৃতীয় স্ত্রী হওয়া অনেকে বেশি সম্মানের নয়-কি। যার স্ত্রী অসুস্থতার সময় স্বামীকে ভরসা করেন। স্বামী নিজের সর্বাত্মক দিয়ে স্ত্রীর ব্যয়বহুল চিকিৎসা করান। প্রাসাদসম অট্রালিকায় বসবাস করে মুখে মেকি হাসির রেখে টেনে নিজের চিকিৎসার ব্যয় বাবার বাড়িতে ছোট ভাইদের কাছে চাওয়ার চাইতে।
৩) শ্বশুর বাড়িতে আসার পর আমার উল্লেখযোগ্য কোনো শারীরিক সমস্যা হয়নি, যেজন্য ডাক্তারেরর কাছে যেতে হবে। আমি খুব করে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি হায়াত শেষ হলে যেন হুট করে মরে যাই। স্বামীর কোনো টাকা চিকিৎসাবাবদ খরচ করাতে চাই না। আমি এমন অনেক দাম্পত্য দেখেছি, নিজের পরিবার ছেলে -মেয়ে সবার চিকিৎসা দেশের বাইরে প্রফেসার লেভেলের ভালো ডাক্তার দিয়ে করান। শুধু ঘরের বউ অসুস্থ হলেই সরকারী হাসপাতালের সিরিয়ালে দাঁড় করিয়ে রাখেন। এমন নির্মমতা যেন কখনো দেখতে না হয়।
নারীরা সারা জীবন শ্রম, মেধা স্বামীরবাড়িতে দিলেও পায়ের নিচের মাটি কখনো শক্ত হয় না। কচু পাতার পানির মতো টলটলে জীবন তাদের। সবার বর জামাল মিয়ার মতো হয় না। আবার জগৎ সংসারে জামাল মিয়ার মতো পুরুষও আছেন। তবে এদের সংখ্যা অতি নগন্য।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply