বিদায় নিয়ে আসার সময় মা বলেছিলেন, ‘এত দেরী করে আর কখনও এসো না, কেমন?’
উত্তরে বলেছিলাম, ‘ঠিক আছে, মা ৷’
কিন্তু সেই কথাটা আমি রাখতে পারিনি!
বিয়ের পরে বছরে দু’বার মাকে কাছে পাবার সুযোগ হতো আমার, গ্রীষ্মের ছুটিতে আর রমজানের ঈদের পরে ৷ সে বছর গ্রীষ্মের ছুটির ঠিক আগে নোটিশ এলো, নতুন পরীক্ষা পদ্ধতির উপর ট্রেনিং করতে হবে এবং অবশ্যই এই ছুটিতে ৷ বদলানোর চেস্টা করলাম ‘অনেক কিন্তু না, সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছের কাছে পরাজিত হলাম ৷
ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা বেড়েই চললো ৷ বাড়িতে ফোন করলেই মা বলতেন, ‘তোমার মুখটা মনে করতে পারছি না, অস্পস্ট লাগে খুব! এতদিন না এলে কি হয়?’
আমার কষ্ট মাকে বুঝতে দিই না ৷ বলি, ‘এই তো, আর মাত্র কয়েকটা দিন ৷ ঈদের ছুটিতে কেউ আর আমাকে আটকে রাখতে পারবে না ৷’
এখন আমার স্কুলে চাকরির সুবাদে প্রতিদিন অনেক মায়ের সাথে দেখা হয়, যারা তাদের সন্তানের জন্য নানারকম কাজে পথেপথে ব্যয় করেন প্রায় সারাটাদিন ৷ আমার মায়ের অবশ্য তেমন সুযোগ ছিল না, নয়টা ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়ে ভরা সংসারে সাংসারিক জটিলতায় কেটে গেছে নিত্যদিন । মায়ের অনুভূতিগুলো ছিল একেবারে অন্যরকম, আমাদের পৌঁছে দিতে বা নিয়ে আসতে স্কুলে যেতো না ঠিকই কিন্তু সেই ছেলেবেলা থেকে দেখে এসেছি, আমাদের যে কোন পরীক্ষার জন্য মা রোজা রাখতেন! এই তো সেদিন, ২০০৯ এ, আমার এম.এড এর মিডটার্ম পরীক্ষা ছিল, ক্লাসে গিয়ে শুনি স্যারের বিশেষ কোন সমস্যার কারণে তিনি পরীক্ষাটা সেদিন বাতিল করেছেন । অন্যান্য সহপাঠিরা খুশিতে উল্লাস করছিল, আমার ভীষন মন খারাপ হয়েছিল সেদিন, আহ্ ! মায়ের রোজাটা বিফলে যাবে!
সারাবছর কতো কী যে জমিয়ে রেখে দিতেন মা আমার জন্য! সে বছরও বাড়ি গিয়ে পেলাম তালের বড়া, হাঁসের মাংস, ঝুরি পিঠা, আমের ঝুরা আচার, লেবুর আচার, তেজপাতা, বিছানা ঝাড়ু, নকশী কাঁথা … ।
ভীষণ সাহসী আর বিনয়ী ছিলেন মা ৷ প্রচন্ড মায়া ছিলো সবার জন্য ৷
হয়তো রান্না করতে যাচ্ছেন, হাতে মাছের পাত্র ৷ ভিখারী এসে বললো, ‘মাগো, অনেকদিন মাছ খাই না ।’
অমনি রান্নার পাত্র থেকে মাছ তুলে দিয়ে দিতেন তাকে ৷ কারো কষ্ট
মায়ের সহ্য হতো না ৷
নিখাদ ভালবাসা ছিলো সন্তানদের জন্য ৷ কোনো একটা জিনিস তৈরী করলেই সাথে সাথে সমান ভাগ করে সবাইকে দিয়ে দিতেন, যারা দূরে থাকে, তাদের ভাগেরটা প্যাকেট করে নাম লিখে রেখে দিতেন ৷ বাড়ির ছোট মেয়ে হবার কারণে আমার সবকিছু নিয়ে একটু বেশি চিন্তা করতেন মা ৷ শেষের সময়টাতে মনের দিক থেকে খুব দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন ৷ মা চলে যাবার
ঠিক পঁয়তাল্লিশ দিন আগে আমার একমাত্র মামা মারা যান, তখনও আমি বাড়ি যেতে পারিনি ৷ সে কী দুঃখ মায়ের! বড্ড অভিমান করে বলেছিলেন, ‘সবাই এসেছিল, শুধু তুমিই এলে না ৷ ‘
তখন বাড়ি যেতে পারলেও মাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারতাম! বিধাতা এখানেও বাধ সাধলেন ৷
রোজা শুরু হলো, ছুটির অপেক্ষায় দিন গুনছি ৷ ঈদের কেনাকাটা চলছে ৷ মাকে ফোন করলেই বারবার বলতেন,’আমার জন্য এ বছর শাড়ি কাপড় কিছু কিনবে না, যা আছে সেগুলোই পরে শেষ হবে না ৷’
প্রায় প্রতিদিনই মা এসব কথা বলতেন ৷ বিশতম রোজার দিন সকালে ফোন করে বললাম, ‘এবার কিন্তু সত্যিই শাড়ি কেনা হয়নি, মা । এতবার নিষেধ করলে কি সেটা করা যায়? তবে আপনাকে কিছু না দিতে পারলে তো আমার অনেক খারাপ লাগবে ৷ অন্য কোনকিছু দরকার হলে লিস্ট করে রাখবেন, আমি এসে কিনে দেবো ৷’
মায়ের সাথে এটাই আমার শেষ কথা ৷ সত্যি সত্যি লিস্ট করে রেখেছিলেন আমার জন্য, ‘দুধওয়ালাকে দাম হিসেবে পাঁচশ পঁচাত্তর টাকা তুমি দিয়ে
দিয়ো ৷’
আমি জানি, পৃথিবীর সব সন্তানের কাছে তার মা-ই শ্রেষ্ঠ মা ৷ কিন্তু আমার মায়ের মতো এতো সহজ সরল মাটির মানুষ এখনকার দিনে তেমন একটা দেখা যায় না ৷ বাবার কাছে বা আমাদের কাছে তেমন কোন চাহিদা ছিল না কখনও ৷ নিজের দামী জিনিসটাও খুব সহজে অন্যকে দিয়ে দিতে পারতেন ৷ বাবার প্রতি ছিলেন প্রচন্ড দায়িত্বশীল ৷
অদ্ভুত ভাবে বিদায় নিয়েছেন মা, ঠিক যেন জেনেশুনে বুঝে চলে গেছেন ৷ নিজের শাড়ি গয়না সবার জন্য ভাগ করে রেখেছেন ৷ বাবা যখন বিশ রমজানে ইতিকাফের উদ্দ্যেশে মসজিদে রওনা করলেন, তখন মা হাতটা ধরে বলেছিলেন, ‘আপনার সাথে বোধহয় আর দেখা নাও হতে পারে, আমাকে একবার তওবা পড়িয়ে দিয়ে যান ৷ ‘
সেদিন শেষরাতে সেহরির পর কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন, এ অবস্থায় হটাত করেই চলে গেলেন মা ৷ পাশে বসে থাকা আট বছরের নাতিকে শুধু বলে গেছেন, ‘আমি চলে যাচ্ছি দাদু, সবাইকে গিয়ে বলো ।’
নিজের জীবন থেকে সবকিছু গুছিয়ে বিদায় নিয়েছেন মা ৷ নির্মমতা হয়েছে কেবল আমার সাথে ৷ আমার কাছ থেকে তো বিদায় নেননি! সবাই বলে – মা কী কারও চিরকাল বেঁচে থাকে? এ কথা আমিও অনেককে বলেছি কিন্তু সে তো কেবল কথার কথা ৷ পুরো বছরটাতে একবারও কেনো মায়ের সাথে দেখা হবার সুযোগ হলো না আমার! আজও উত্তর মেলে না কিছুতেই ৷
সারাটা বছরে কতো কি যে যোগাড় করে রেখেছিলেন মা আমার জন্য ৷ আমিও রেখেছিলাম অনেক কিছু ৷ সব পড়ে আছে, এসবের ভার বহন করা যে কি কষ্টের!
শেষ দিকে মা নাকি আমার লাগানো জবা গাছের পাশে বসে জোরে জোরে নাম ধরে ডাকতেন ৷ এসব কথা কেউ আমাকে বলেনি আগে ৷ ছোটআপু একদিন ওই অবস্থায় মা’কে দেখে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কি হয়েছে? ওর কি কোনো সমস্যা?’
মা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ওর জন্য বুকের ভেতরটা ভীষণ জ্বলছে, তাই জোরে জোরে ডাকছি, যদি এতে জ্বালা কিছুটা কমে!’
মা আমাকে সারাজীবনে একটি মাত্র চিঠি লিখেছিলেন, বিশ বছর আগে ৷ যার সম্বোধন ছিল ‘কলিজার টুকরা’ …কি করে পারলো সেই টুকরাকে ছিন্ন করে চলে যেতে! বেঁচে থেকেও দীর্ঘদিন মাকে কাছে না পাওয়া, এমন শাস্তি যেন পৃথিবীর কোনো সন্তান কোনদিন না পায় ৷
আজও অনুভব করি, মা আমার জীবনের সব আলো নিয়ে চলে গেছে দূরে,বহুদূরে, যেখানে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করার সাধ্যি আমার নেই ৷ তাঁর সাথে শেষ দেখা হয়েছিল, চলে যাবার ৩৫৪ দিন আগে ৷ এত দীর্ঘ সময় আর কোনদিন মাকে ছেড়ে থাকা হয়নি ৷
চলে যাবার পর মায়ের সাথে আমার শেষ দেখা ৩৫৪ দিন পর এক নির্মম সন্ধ্যায় ৷ সাদা ধবধবে পোশাকে জড়িয়ে মা আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন ৷ যে মানুষটি বাড়িতে ঢুকলেই এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে বলতেন, ‘পানি খেয়ে একটু জিরিয়ে নাও, মুখটা একেবারে শুকিয়ে গেছে ৷’
সেদিন বলেনি কিছুই, বলবেও না আর কোনদিন ৷
নরম শীতল মুখটা স্পর্শ করে ধীরেধীরে অনেক ডেকেছি, মনেমনে ক্ষমাও চেয়েছি বহুবার ৷ এক আকাশ শূন্যতা একমুহূর্তে যেন গ্রাস করেছিল আমার সমস্ত অনুভূতিকে, কেন একটিবার জোর করে বললো না, একবার আমার কাছে আয় । অভিমানে বুকের ভেতরটা জ্বলে ছাই হয়ে গেছে, মা কিভাবে পারলো আমার কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে চলে যেতে!
#সাহিত্য সওগাত, ৪-৫ পৃষ্টায় লেখাটি পাবেন ।
ছোট বেলায় বাবা-মা আর নয় ভাই-বোনের একটা বিশাল পরিবার ছিল আমাদের ৷ ছয় বোন, তিন ভাইয়ের মধ্যে আমি অষ্টম, বোনদের মধ্যে ছোট ৷ অনেকটা বড় হয়ে জেনেছি, আমরা আসলে দশ ভাই-বোন ছিলাম, বড় ভাইটা জন্মের কয়েকমাসের মধ্যেই নাকি মারা গিয়েছিল । সবাই তার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল, এমনকি সংখ্যার হিসেবেও অস্তিত্ব ছিল না, কেবল মাঝেমাঝে প্রসঙ্গক্রমে মা তার কথা বলতেন ।
বড় বোনদের কাছ থেকে জেনেছি, ছয়মাস বয়সে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের নাম ছিল সাইফুল ইসলাম, তার আকিকা অনুষ্ঠানের ব্যাপক আয়োজন করা হয়েছিল বাড়িতে, দূর-দুরান্ত থেকে অনেক লোক এসেছিল সেই অনুষ্ঠানে, আগতদের মধ্যে একজনের নাকি টাইফয়েড ছিল । যদিও এটা কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়, তবুও টাইফয়েড আক্রান্ত ব্যক্তির স্পর্শের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া স্থানান্তর হলে রোগটি অন্যদেরও হতে পারে । জানিনা কিভাবে কি হয়েছিল, তবে টাইফয়েড জ্বরে গুরুতর অসুস্থ হয়েই আমাদের বড় ভাই শিশু বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিল ।
আব্বা-মা ঐ সময়টাতে আমাদের গ্রামের বাড়িতে (বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলায় অবস্থিত হেদায়েতপুর গ্রামে ) থাকতেন । শুনেছি ঐ ঘটনার পর দুঃখ-কষ্ট সইতে না পেরে আব্বা ছয়মাস গৃহ ত্যাগ করেছিলেন । সে বছর বি.এ পরীক্ষাটাও আর দিতে পারলেন না তিনি । বাগেরহাট শহরের সন্নিকটে খানজাহান আলীর দরগাহ শরীফের পাশে অবস্থিত এক চাচার বাড়িতে অবস্থান করেছিলেন সেই সময় । প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর থেকে কান্না শুরু করতেন তিনি, সারাক্ষণ মনের ব্যথায় কাতর হয়ে থাকতেন । একদিন খুব ভোরে খানজাহান আলীর দরগাহ শরীফের মিনারের উপরে উঠে আজান দিলেন নিজেই, তারপর কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহকে বললেন, ‘তোমার আমানত তুমি নিয়ে গেছ, আমি কেন এত কষ্ট পাচ্ছি ?’
এরপর থেকে না কি আব্বা শরীরটা ধীরেধীরে হালকা বোধ করছিলেন এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিলেন ।
মায়ের প্রকাশভঙ্গি অবশ্য ঠিক এর উল্টো ছিল । স্বাভাবিক নিয়মে সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব একা হাতে সামলে নিয়েছেন তিনি । যৌথ পরিবারে শাশুড়ি, দেবর, জা, তাদের সন্তান, সবার দিকেই খেয়াল রাখতে হতো মাকে, কারণ তিনি ছিলেন বাড়ির বড় বৌ । তখন আমাদের সবার বড় বোনটার বয়স মাত্র তিন বছর । তের বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া একটা কন্যা শিশু ষোল বছর বয়সে প্রথম মা হন, সবাই ভেবেছিল, আঠার বছরে প্রথম ছেলে সন্তানটিকে হারানোর ব্যথা তিনি কন্যা শিশুটিকে বুকে আগলে রেখে কিছুটা কমিয়ে ছিলেন হয়তো, কিন্তু না পন্চাশের দশকে জীবন থেকে হারিয়ে ফেলা শিশুটির ছোট ছোট কাঁথা-কাপড় তিনি অতিযত্নে সংগোপনে একটা ছোট মটকিতে মুখ আটকে রেখে দিয়েছিলেন নিজের কাছে, যেটা নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত আমাদের বাসায় ছিল! কোন পরিবর্তনের হাওয়া বা ঝড়-ঝাপটা মায়ের কোল থেকে তাকে উড়িয়ে নিতে পারেনি কখনও । নিজের ভেতর তোলপাড় করা সেই আবেগ তিনি কাউকে কখনও দেখাননি, কেবল একান্ত নিভৃতে জীবন্ত স্মৃতিটুকু আগলে রাখার নিরন্তর চেষ্টা করে গেছেন ।
উনষাট সালে আমার মেজো বোনের জন্ম হয়, একষট্টি সালে আমার মায়ের কোলে আসে আর একটি ছেলে, যাকে আমরা বড় ভাই বলে জেনে এসেছি চিরকাল । আব্বা আর ঝুঁকি নেননি, উনিশ’শ একষট্টি সালেই তিনি নিজের পরিবার নিয়ে গ্রাম থেকে বাগেরহাট শহরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন ।
এরপর একে একে পৃথিবীতে আসেন সেজো আপা, মেজো ভাই, তারপর আমিসহ তিন বোনের আগমন । সর্বশেষ উনিশ’শ একাশি সালে কনিষ্ঠ ভাইটির জন্ম হয় । আমাদের বাড়িটিও ছিল চমৎকার, ভেতরে প্রবেশ করলে পুরোপুরি গ্রামের ছোঁয়া, বাইরে শহরের আবহ । সেখানেই মায়া মমতায় জড়াজড়ি করে কাটিয়েছি জীবনের প্রায় চব্বিশটি বছর । সেখানে না হয় সবাইকে আর একদিন নিয়ে যাবো…।
আমার আব্বা অতি মেধাবী কিন্তু অতি সাধারণ একজন ভালো মানুষ ছিলেন ৷ জীবনে কোনো পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় হননি ৷ লেখাপড়ার ক্ষেত্রে সবসময় প্রথম হয়েছেন, সেরাদের সেরা! তিনি তাঁর গ্রামের প্রথম গ্রাজুয়েট ছিলেন । শিক্ষাজীবনে তিনি মাদ্রাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন, সাথে বি.এড এবং এম.এডও করেছিলেন । বিভিন্ন সময়ে তাঁর স্বনামধন্য বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি হয়েছে, মদিনায় চাকরির জন্য চিঠি এসেছিল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও একবার শিক্ষকতার সুযোগ হয়েছিল, সেসব চাকরি তিনি করেননি, তাঁর অজুহাত ছিল,’এতগুলো ছেলে-মেয়ে রেখে দূরে গেলে কে ওদের দেখবে?’
মনের পিছুটান আর প্রিয় স্যারের অনুরোধে স্থানীয় একটা বেসরকারী হাই স্কুলে ( বর্তমান নাম বাগেরহাট কলেজিয়েট স্কুল ) শিক্ষকতা শুরু করেন আব্বা ৷ সেখানেই পেশা জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন তিনি ৷
ছোট বেলায় এসব কথা জানার পর আমি ভাবতাম -আব্বা কী খুব বোকা, না কি বুদ্ধিমান! হিসেব মিলতো না ৷ তবে এতটুকু বুঝতাম, যে বাবা তার সন্তানদের থেকে দূরে না থাকার জন্য নিজেকে নিয়ে, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে এতটুকু ভাবেনি, সে বাবার স্থান নিঃসন্দেহে ভালো বাবাদের শীর্ষে ৷
আব্বার পেশা প্রসঙ্গে এত কথা লিখতে হলো এজন্য যে, তাঁর সততা, পেশার প্রতি আন্তরিকতা এসব ঠিক রাখতে গিয়ে আমাদের পরিবারে খুব একটা সচ্ছলতা ছিল না কখনোই ৷ সারাক্ষণ অভাব অভিযোগ ছিল না ঠিকই কিন্তু এর পরোক্ষ প্রভাব পড়ত সবার লেখাপড়ার উপর ৷
স্কুল জীবনের পড়াশুনা সবাই আব্বার স্কুলে শেষ করেছি, কলেজ পর্যায়ে গিয়ে সবার পড়াশুনার ব্যয়ভার বহন করা উনার জন্য ভীষণ কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল ৷ আমরা ভাই-বোনেরা অতি মেধাবী না হলেও মেধাবী ছিলাম ৷ তাই বেশ কষ্ট করে হলেও সবাই পড়াশুনা শেষ করেছি ৷ তিনি আমাদেরকে অনেক শক্ত ভাবে মানুষ করেছেন ৷ সব সময় বলতেন – ‘সব কাজই মন দিয়ে করবে, আমি যেন বলতে পারি আমার ছেলে-মেয়েরা সব কাজ পারে ‘ ৷
আট বছর বয়সে এতিম হয়ে যাওয়া একজন মানুষ কিভাবে শিক্ষা-দীক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছিলেন – আব্বার সেই সব বাস্তবতা আমাদের কাছে আজও শ্রেষ্ঠতম আদর্শ ৷
ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়গুলো যেমন-নামাজ, রোজা ছাড়াও সত্য বলা, বিপদে মানুষকে সহযোগিতা করা, অন্যের দুঃখে ব্যথিত হওয়া প্রভৃতি নৈতিক শিক্ষাগুলো আব্বার কাছ থেকেই পেয়েছি ৷ তিনি খুবই ধর্মভীরু ছিলেন, তবে গোঁড়া নন ৷ আধুনিক মন মানসিকতার ছিলেন এবং সেই বিষয়গুলো আমাদের মাঝেও সঞ্চারিত করেছেন ৷ বাড়ির সামনে নারকেল গাছ ঘেরা একটা বিশাল পুকুরসহ প্রায় একবিঘা জায়গা ছিল আমাদের ৷ সেটা দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল গনি মিয়াকে ৷ কয়েক বছর পর আমরা জেনেছিলাম,গনি মিয়া কিভাবে যেন জায়গাটা জাল দলিল করে নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছে ৷
আব্বা খুব দুঃখ পেলেন কিন্তু ভেঙে পড়েননি! আমাদেরকে ডেকে সান্তনা দিলেন, যেন নিজের মনটাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন! বুঝিয়ে বললেন – ‘দিয়ে ধন, বুঝে মন, কেড়ে নিতে কতক্ষণ? তোমরা চিন্তা করো না, পরকালে ঐটুকুই আমাদের থাকবে ৷’
কি অপরিসীম ধৈর্য ছিল তাঁর…!
(মাসিক সওগাতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে আমার লেখা স্মৃতিবিলাস । প্রিয় পাঠক, আপনিও পড়ে দেখতে পারেন এবং আপনার মতামত নিঃসঙ্কোচে জানাতে পারেন ।পৃষ্টা নম্বর ১১-১৩)
আজকাল অনেকেই জানতে চান- কী হতে চেয়েছিলেন? কী হলেন? ছেলেবেলার সেই স্বপ্ন বা অপূর্ণ স্বপ্নের কথা বলি তবে-
শিশুকালে আমার সঙ্গী অনেকেই পুতুল নিয়ে খেলতে পছন্দ করতো, কিন্তু আমার দোকানদার সাজতে খুব ভালো লাগতো ।পুকুরের পাড় থেকে মাটি তুলে হাত দিয়ে বিভিন্ন আকৃতির মিষ্টি তৈরী করতাম, সেগুলো রোদে শুকিয়ে একটু শক্ত হলে তারপর লম্বা মিষ্টিগুলোর গায়ে ইটের গুঁড়া মাখিয়ে চমচম আর গোল মিষ্টিগুলোর গায়ে গুঁড়া চুন মাখিয়ে রসগোল্লা নাম দিতাম । রসগোল্লাগুলোকে আবার বাটিতে পানি দিয়ে রসে ভেজাতাম । পানের দোকান দিতেও খুব ভালো লাগতো । বাড়ির পেছনদিকের বাগানে এক ধরণের লতানো গাছ পাওয়া যেতো, যার আণ্চলিক নাম জার্মানির লতা, এই গাছের পাতাগুলো দেখতে অনেকটা পানপাতার মতো । সেই পাতাগুলো বোটাসহ ছিঁড়ে উল্টো করে করে সাজিয়ে রাখতাম, খেজুরের বীচি দিয়ে সুপারি বানাতাম, একটা কাপড় বা চট ভাঁজ করে বিছিয়ে তার উপর বসতাম । চটের ভাঁজে কাগজের কৃত্তিম টাকাগুলোকে বিভিন্ন আকার অনুযায়ী মহাজনের মতো সাজিয়ে রাখতাম!
স্কুলে ভর্তি হবার পর স্যার, আপারা বেশ আদর করতেন কারণ আমি বরাবরই শ্রেণিতে প্রথম হতাম । পরবর্তীতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার কারণে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী স্কুলের শিক্ষকরা ডাক্তার বা ইন্জিনিয়ার হবার স্বপ্ন দেখাতেন ।
আমাদের দশ ভাই-বোনের সংসারে তখন পেশা নির্বাচনের কথাটা মাথার উপর দিয়ে চলে যেতো কারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে সবকিছু সামলে শেষ পর্যন্ত পড়াশোনাটা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে কি না, সেই দুরাশা-ই তখন জোরালোভাবে জায়গা করে নিয়েছিল মনের ভেতর ।
কলেজে ভর্তি হবার পর অশোক স্যার আমার ইংরেজির প্রতি আকর্ষণ দেখে আব্বাকে ডেকে বলেছিলেন, “মেয়েটাকে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াবেন, সে চেষ্টা করলে ইংরেজির ভালো শিক্ষক হতে পারবে ।”
কিছুদিনের জন্য সেটাই তখন স্বপ্নে পরিণত হয়েছিল ।
এইচএসসি পরীক্ষার পর উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হওয়া নিয়ে আবার ঝামেলা শুরু হলো । আব্বা দূরে কোথাও ভর্তি করাতে রাজি নন । তাছাড়া আবার বড় পাঁচ বোনেরই এসএসসি বা এইচ এস সি পরীক্ষার পরপরই বিয়ে হয়ে গেছে, সেসব নিয়ে বেশ দুঃশ্চিন্তা হতো, মনে হতো দূরে গিয়ে পড়ার বিষয়ে জোর করলে আব্বা যদি আবার বিয়ে দিয়ে দেন! তারচেয়ে খুলনাতেই পড়তে রাজি হয়ে গেলাম, প্রাণিবিজ্ঞানে অনার্স । ভেতরে ভেতরে খুব আফসোস হতো, ইস! যদি আমাকে মেডিকেলে একটিবার ভর্তি পরীক্ষা দিতে দিতো অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে!
বিয়ের আগেই অনার্স, মাস্টার্স শেষ করলাম । মাস্টার্স পরীক্ষার এক মাসের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেলো, ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে । স্বামী ভদ্রলোক অত্যন্ত ভালো মানুষ! সে যেন আমার মনের আকুতির কথা বুঝতে পারতো । ঘরের কাজকর্ম বা নতুন নতুন রেসিপি নিয়ে রান্না- বান্না করতে গেলে সবসময় বলতো, ‘তুমি পড়াশোনা জানা মেয়ে, শুধু ঘরের কাজ করে সময় নষ্ট করো না, চারিদিকে চোখ কান খোলা রেখে দেখো, অনেক কিছু করার আছে তোমার, যেটা ভালো লাগে সেটাই করার চেষ্টা করবে ।’
ওর মুখে কথাগুলো শুনে খুব ভালো লেগেছিল সেদিন । সাহস করে বলেছিলাম, ‘আমি আরও পড়তে চাই ।’
সেও খুশি হয়ে বলেছিল, ‘ঠিক আছে ।’
কুমিল্লায় বাসা ভাড়া নিয়ে সংসার জীবন শুরু করলাম ২০০১ সালে । একা একা বাসায় থেকে সারাদিন সময় আর কাটে না । এক সপ্তাহ পর থেকেই বায়না শুরু করলাম, ‘কিছু একটা করতে চাই ।’
সেও হন্যে হয়ে বউয়ের জন্য খোঁজ শুরু করে দিল, কোথায় কী করানো যায় । সে বছরই ভর্তি
হলাম কুমিল্লা সরকারী টিচার্স ট্রেনিং কলেজে, বি এড -এ । আমাদের বাসা ছিল শুভপুর, সেখান থেকে রিকশায় করে টমছম ব্রিজ যেতে হতো । ওখান থেকে বাস বা বেবিট্যাক্সিতে চড়ে টিটি কলেজে যেতে প্রায় এক ঘন্টা সময় লাগতো । বিকেল পাঁচটায় ক্লাস শেষ করে আবার একই নিয়মে বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা । রাতে রান্না-বান্না শেষ করে পড়তে বসতে হতো ।
ওখানেও পাঁচজন মনের মতো বন্ধু খুঁজে পেয়েছিলাম, রুপা, মুনা, সোমা,অনু ও শিমুল । এরমধ্যে তিনজনই নতুন সংসার শুরু করেছি তখন, সবাই সবাইকে খুব ভালো বুঝতাম, মিলেমিশে পড়াশুনা করতাম, নোটগুলো একে অন্যের সাথে শেয়ার করতাম । সবকিছু মিলিয়ে কষ্টগুলো অনুভব করিনি কখনও ।
সেখানেও আমার ভালো রেজাল্ট হলো, স্কলারশিপ পেয়েছিলাম । তখনও খেলাধুলা, আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা… সবই করতাম । ওখানকার শিক্ষকদের কেউ কেউ ভাইবা বোর্ডেও প্রশ্ন করা বাদ দিয়ে আবৃত্তি শুনতে চেয়েছিলেন । বিদায়বেলা প্রিয় শিক্ষকদের কমেন্টসগুলো আমার মনের মধ্যে তখনই পেশা নির্ধারণের জন্য স্বপ্নের বীজ বপন করে দিয়েছিল, বিশেষ করে মাইনুদ্দিন স্যারের কথাটা,”আপনি যদি শিক্ষকতা পেশায় না আসেন, তাহলে দেশ একজন ভালো শিক্ষককে হারাবে ।”
কুমিল্লা থেকে প্রচুর আত্মশক্তি জমিয়ে নিয়ে ২০০৩ সালে ঢাকায় এলাম, চাকরির জন্য পড়াশুনা শুরু করেছি তখন নতুন উদ্যমে । বিসিএস-এর জন্য প্রস্তুত হতে হবে, আমার চেষ্টার কোন কমতি ছিলনা কখনও, আর আমার হাজব্যান্ড অনু, এমন বিশ্বস্ত, পরোপকারী বন্ধু পাশে থাকলে হাজার আলোকবর্ষ হেঁটে পাড়ি দেয়া যায় । যখন যে বই দরকার হয়েছে, বলার সাথেসাথেই হাজির করেছে, ২৪তম বিসিএস এর শেষ পর্যন্ত গিয়েছিলাম, মৌখিক পরীক্ষাও খারাপ হয়নি, আমি প্রায় ৯৯% নিশ্চিত ছিলাম, চাকরিটা হবে । কিন্তু শেষ পর্যন্ত হলো না, টানা তিন বছরের চেষ্টা বিফলে গেল! আমার ভাগ্যে ছিল না হয়ত । সেবার ভেতরে ভেতরে আমি খুব ভেঙে পড়েছিলাম, মনে হতো আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না!
কাউকে কিছু না বলে একাই বায়োডাটা তৈরী করে কাগজপত্র রেডি করলাম অনেকগুলো, মনেমনে স্থির করলাম, আশেপাশের যত স্কুল-কলেজ আছে, নিজে গিয়ে সেখানে বায়োডাটা দিয়ে আসবো, মানসিক অস্থিরতা থেকে পরিত্রাণ দরকার । কিছু একটা করতেই হবে । মধুবাগে বাসা ছিল তখন, একদিন দুপুরে বাসার সন্নিকটে অবস্থিত শহীদ (লেঃ) সেলিম স্কুল এন্ড কলেজে গিয়ে অফিসরুমে বায়োডাটা জমা দিয়ে এলাম ।
বাসায় এসে কেবল দুপুরের খাবার খেতে বসেছি, এরমধ্যে ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফোন করেছেন, ‘আপনি কি এখন একটু আসতে পারবেন?’
যাবার পর একটা কাগজে লেখা গনিত প্রশ্ন দিয়ে উপস্থিত মতো আমার একটা পরীক্ষা নেয়া হলো, এরপর একঘন্টা বসিয়ে রেখেছিলেন । সন্ধ্যায় একেবারে জয়েন করেই বাসায় ফিরলাম । মাত্র ১৫০০ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করলাম । কিছুদিন পরে অবশ্য একটা ক্লাসের সার্বিক দায়িত্ব পালন করার জন্য বেতন বাড়িয়ে ৩০০০টাকা করা হয়েছিল । স্বল্প বেতন ছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা কখনও মাথায় রাখিনি, নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি । তাইতো চলে আসার পনের বছর পরেও সেখানকার সহকর্মীরা একইভাবে মনে রেখেছে আমায়, প্রতিষ্ঠানের বর্ষপূর্তিতে বা স্কুলের কোন ভালো-মন্দ সময়ে ঠিকই আমাকে মনে পড়ে তাদের!
২০০৫ সালের শেষ দিকে ইস্পাহানি গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ এর মগবাজার শাখায় কলেজ সেকশনে জয়েন করি । মাত্র তিনমাস সেখানে চাকরি করার সুযোগ হয়েছিল, কারণ কিছুদিন পরই ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের সার্কুলারটা চোখে পড়ে । নানারকম যাচাই বাছাইয়ের পর চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হই । ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে পেলাম ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে মানুষ গড়ার দায়িত্ব! একই দিনে দুটো বিশেষ ক্ষণ পালনের সুযোগ আসে আমার জীবনে ।
২০০৭ সালেই ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এম এড করলাম । টানা দুটো বছর সংসার, চাকরির পাশাপাশি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা, সব মিলিয়ে প্রচুর কষ্ট করতে হতো, কষ্টগুলো কোথায় যেন মিলিয়ে গেল যখন দেখলাম ফলাফল প্রথম শ্রেণিতে প্রথম ।
আজও পেছন ফিরে তাকালে একটাই শুধু আফসোস, মনে হয় সুযোগ পেলে হয়তো আরও ভালো কিছু করতে পারতাম জীবনে । এখনও তাই যে কাজটাই করি, শতভাগ চেষ্টা করি সবসময়, অন্তত কোনো আফসোস যেন আর না থাকে ।
Leave a Reply