শাহানা আজ বেশ দ্রুত পা চালাচ্ছে কিন্তু শারীরিক দুর্বলতার জন্য এগোতে পারছেনা, আশেপাশে রিকসাও নেই তেমন, সবাই ভাইরাসের ভয়ে সতর্ক,, যত কষ্ট সব এই নিম্নশ্রেণীর মানুষের! এমনিতেও পার্লার টা তে যেতে রিকশা খুব একটা লাগেনা, এইত বাসার কাছের মোড়েই, মধুমিতা পার্লার, বাইরে থেকে বন্ধ মনে হলেও আগেই কল দিয়ে শেলিকে জানিয়ে রেখেছিল,,
ছোট্ট পরিসরের এক রুম, সাথে লাগোয়া একটা ঘর, আহারে! মেয়েটার জন্য বেশ মায়া হয়, শাহানাদের মত উচ্চমধ্যবিত্তদের হয়ত এই আপদকালীন সময়ে অভাব কড়া নাড়বে না কিন্তু শেলীর মত সামান্য পুঁজি নিয়ে গড়ে ওঠা পার্লারের মেয়েদের খাওয়া পড়ার কথা কয়জন ভাবেন? এমনিতেও শাহানা এখানে রেগুলার যাওয়া আসা করেন, অন্য নামি-দামি পার্লারের মত এখানে ভীড় কম থাকায় একটু বেশি সময় ধরে রূপচর্চা করে নিতে পারেন,,, কিন্তু যার জন্য এই চর্চা সেই মানুষ টাই আগের থেকে ভীষণ বদলে গেছে!
গতকাল ও ফরিদ, শাহানার গায়ে হাত তুলেছে, এরপর রাগারাগি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে! কোথায় গেছে কে জানে! শয়তান একটা! সারাদিন ব্যবসার কাজের জন্য বাইরেই থাকে, কোন কোন দিন তো বাড়িতেও ফেরেনা,, হারামজাদা নষ্টা মেয়ের সাথে থাকে আর বাড়িতে এলেই শাহানার সাথে যত অত্যাচার করে, আগে মুখ বন্ধ করে থাকলেও রাগের মাথায় শাহানাও মুখের উপর কথা বলে, তাই হয়ত কিল ঘুষির সাথে লাথিও খায়, আজকাল আবার হাতের কাছে যা পায় তাই দিয়ে পেটায়, গতকাল হ্যাংগার দিয়ে পিঠে মেরেছে!
শেলী মেয়েটা খুব ভালো ম্যাসাজ করে,প্রথম যেদিন শাহানা ম্যানিকিওর, পেডিকিওর করাতে এসেছিল সেদিন শেলীকে খুব করে ধমক দিয়েছিল শাহানা! ভুল বশতঃ পায়ের কেনি আংগুল টা একটু বেশি কেটে ফেলেছিল! আর যাবে কোথায়! শাহানা চিৎকার করে ওঠে, পার্লারের রেপুটেশন খারাপ হবার ভয়ে শেলি অবশ্য এক পর্যায়ে পায়ে ধরেই ক্ষমা চেয়েছিল সেদিন! পরে বাড়িতে এসে শাহানাও ভুল বুঝতে পারে, পরেরবার এসে শেলির উপর খুশি হয়ে কিছু বকশিস ও দেয়,,,
উপুড় হয়ে শাহানা শোবার পর শেলী যখন পিঠ ম্যাসাজ করে তখন শাহানার চোখে একপ্রকার আমুদে ঘুম ঘুম ভাব চলে আসে,,, গতকালের দাগের জায়গায় টাচ লাগতেই অস্ফুটস্বরে উফ! শব্দ মুখ থেকে বেরিয়ে আসে শাহানার!অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে দুই ফোঁটা! কিন্তু এই সময় টা শাহানা চোখ বন্ধ করে পুরনো স্মৃতি হাতড়ায়,,,,
একটা সময় ছিল কত কত সুখ উথলে উঠত শাহানার মনে, ভালোবেসে বিয়ে করেছিল ফরিদ কে, নিম্নবিত্ত পরিবারের ফরিদ কে কোনভাবেই মেনে নেবে না শাহানার পরিবার তা জেনেও কি এক অমোঘ টানে ঘর ছেড়েছিল,শ্বশুর বাড়ির কাউকেই ভালোমত চেনেনা, শুধুমাত্র ফরিদকেই চাই শাহানার, ভালোবেসে এতটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল! ফরিদ নিজেই বিয়ের প্রস্তাব দেয়াতে শাহানার বাবা ফরিদ কে বলেছিল, তোর মুরোদ আছে আমার মেয়ে কে খাওয়ানোর, ! ছোটলোকের বাচ্চা!
কিজানি! সেদিন কি শাহানার প্রতি ভালোবাসার পরিবর্তে প্রতিশোধ জন্ম নিয়েছিল ফরিদের মনে! কিন্তু ভালোবাসা তো ভালোবাসাই, কেউ কাউকে মন থেকে ভালোবাসলে আর যাই হোক তার অসম্মান করতে পারেনা, এমনটাই ভাবত শাহানা,
ফরিদের বন্ধু তালেবের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে গুটিকয়েক বন্ধু বান্ধব নিয়ে কাজী অফিসে বিয়ে করে দুজন, শাহানার মনে হয়েছিল আজ থেকে আমরা দুজন শুধুই দুজনার, আর কেউ আলাদা করতে পারবেনা তাদের, সেদিনও কি জানত দুজনের মাঝে অসংখ্য পরনারীর আগমন ঘটবে আগত দিনগুলোতে!
শেলী খুব আস্তে আস্তে ম্যাসাজ করতে থাকে, ব্যাথার জায়গাতে আলতো করে পাশ কাটিয়ে যায়, কি একটা মলম লাগিয়ে দেয়, ঠান্ডার আবেশে চোখ বুজে আসে! আবারও শাহানা হারিয়ে যায় অতীতে,,,,
বিয়ের পর পড়াশোনা একেবারে লাঠে ওঠে শাহানার, ফরিদ অবশ্য আগেও ভালো ছাত্র ছিলোনা, বিয়ের পর ব্যবসা করবে বলে এক বন্ধুর সাথে পরামর্শ করে, তিনি হলেন শামীম ভাই, খুব ভালো একজন মানুষ, শুরুতে তিনি পুরো টাকা দেন, ফরিদ আস্তে আস্তে দেনা শোধ করবে বলে চুক্তি করে।সেই দিনগুলো ছিল শাহানার জীবনের সোনালী দিন, সারাদিন ঘরের কাজ করে সন্ধ্যার পর সাজুগুজু করে অপেক্ষা করত ফরিদের জন্য! ফরিদও সন্ধ্যায় এসেই ঘরের দরজা লাগিয়ে পেছন থেকে শাহানার কোমড় জড়িয়ে ধরে মুখ টা কানের কাছে এনে বলত, আমার মেম সাহেব রে তো সুন্দর লাগতেছে! উম,, আইজ তো ছাড়মু না কয়া দিলাম,,,
শাহানা কপট রাগের সুরে হাত দুইটা ছেড়ে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করত আর বলত ছাড় তো! অসভ্য! কিন্তু মনে মনে সে এটাই চাইত যে ফরিদ তাকে প্রতিদিন এভাবেই জড়িয়ে ধরুক!
একবার শাহানা ফরিদ কে বলেছিল, এই চলনা এবার একটা বাবু নেই, তুমি সারাদিন বাইরে থাকো, আমার একা একা ভালো লাগেনা! ফরিদ সেদিনও কথার ছলে বিষয়টাকে আর পাত্তাই দেয়নি, তখনও অবশ্য ব্যবসাতে এত উন্নতি হয়নি, এখন তো আংগুল ফুলে কলাগাছ টাইপ অবস্থা! যে শামীম ভাই তাকে এতদূর নিয়ে এসেছেন সেই ভাই ই আজ তার প্রতিপক্ষ!
শাহানা অনেক ভেবেছে,এই মানুষ রুপি জানোয়ারের সাথে আর নয়, কিন্তু দুনিয়ার কতজন মানুষ আছে যারা শাহানার পাশে এসে দাঁড়াবে! বরং উল্টো দূর্বলতার সুযোগ নেবে,, তবুও ভেবেছে,ভেবে ভেবে ক্লান্ত মন স্বার্থপর হতে বাঁধা দিয়েছে, আর্থিক অবস্থার উন্নতির পর শাহানার বোন শানুর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছে, বাবার এক্সিডেন্ট হবার পর শাহানাদের আর্থিক অবস্থার বেশ পরিবর্তন হয়, নিয়তির কি আজব খেলা! প্রতি মাসে দশ হাজার করে টাকা পাঠায় শাহানা, মায়ের ঔষধ, শানুর পড়াশোনার খরচ বলতে গেলে এখন ঐ টাকাতেই চলে, কিন্তু শাহানার বাবা আজ পর্যন্ত কথা বলেন না মেয়ের সাথে,,,
এটাই হয়ত দুনিয়ার খেলা! জুতার দোকানে সহকারী কর্মচারী হিসেবে কাজ করতে করতে কোন একদিন সেই কর্মচারী নিজেই দোকানের মালিক হয়ে যায়, এতে দোষের কিছু নাই, তবে টাকার গরমে অধঃপতন হওয়া মানুষগুলোর ক্ষেত্রে ফয়সালা কি হবে তা কেউ আগে থেকে জানেনা!
শাহানার আজ বাড়িতে যেতেও মন চাচ্ছেনা, অন্যদিন হলে হয়ত ফ্লাটের অন্য কোন ভাবীর বাসায় গিয়ে কিছু সময় গল্প করে কাটাতে পারত! কিন্তু এই মুহূর্তে কারো বাসায় যাবার মত পরিস্থিতি ও নাই! ইচ্ছে হচ্ছে শেলীর সাথে আরও কিছুক্ষণ থাকতে,,, আজ শেলীকে দুই হাজার টাকা হাতে গুঁজে দিল শাহানা! শেলী খুব ইতস্তত করছিল, শাহানা যখন বাইরে যাবার উদ্দেশ্যে পায়ের স্যান্ডেল পরতে যাচ্ছিল এমন সময় ভেতরের ঘর থেকে কেউ একজন বলল — আর কতক্ষণ??
মুহূর্তেই শাহানার ভেতরের সকল ভালোলাগা উধাও হয়ে গেল! এ কার গলার আওয়াজ শুনল! বাইরে বের হয়ে শাহানার পা আটকে যাচ্ছিল! আরেক বার কি দরজা খুলে শেলিকে ডাকবে? নিজের বিবেকবোধ বাঁধা দেয়,,, অথচ মানুষ কত সহজেই বিবেকহীনতার পরিচয় দেয়!
বাইরের শরীরের জন্য কত যত্ন, কত কিছু! অথচ ভেতরের এই কষ্ট, ক্ষতবিক্ষত মনের যত্ন নেবার জন্য কোন স্পা নেই,,, ভাইরাসের থেকেও ভয়ংকর এই মানুষ নামের কীটগুলো! মনের গহীনে আঘাত দিয়ে তারা ক্ষতবিক্ষত করে সমস্ত অন্তরের শিরা উপশিরা গুলোকে দুঃখ ভারাক্রান্ত করে তোলে ,,,,
লেখাটি এপ্রিল মাসে লেখা যখন করোনা নিয়ে সবার মাঝেই বেশ আতংক ছিল,,, এখন তো বাইরে বের হলে সবার হাব ভাবে মনেই হয়না করোনা বলে কিছু আছে!! করোনার মত ক্রান্তিকালীন সময় দূর হবার পাশাপাশি সমাজের নোংরা কীট গুলোও দূর হয়ে যাক।।
Leave a Reply