“যা ভয় করছেলম তা-ই হলো, ই সান্নিপাতিক জ্বর”
সদ্য প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের উপন্যাস ” আগুন পাখি” থেকে। উপন্যাসটি কিনেছিলাম কোনো এক বইমেলাতে। বইমেলা চলাকালীন সময়ে এক টিভি চ্যানেলে কোনো একটি অনুষ্ঠানে লেখকের আলাপচারিতায় এই উপন্যাসের নাম জানতে পেরেছিলাম এবং সেদিনই বইমেলাতে গিয়ে মেলা ঘুরে খুঁজে উপন্যাসটি কিনেছিলাম। মেলা শেষে বইটি পড়েছিলাম, তারপর বেশ কয়েকটা বছর চলে গেছে;কিন্তু উপন্যাসের সেই নারী যিনি অবিরাম কথা বলে গেছেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সেই নারীর কথাগুলো যেন আজও ফুরোয় না। এত কথা বলিয়েছে লেখকের কলম তাকে দিয়ে যে আসলে সে নারীর কোন কথাটিকে কোটেশনে আনা যায় আর কোনটাকে ফেলে দেয়া যায়। বলা যায় প্রতিটি কথাই কোট করা যায়।বইটি যখন পড়ছিলাম তখন সান্নিপাতিক জ্বর শব্দটি খুব করে দাগ কেটেছিলো মনে। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো, খুব ছোটবেলায় কার মুখে যে শুনেছিলাম সান্নিপাতিক জ্বরের কথা তা আর মনে আনতে পারিনি; কিন্তু খুব করে মনে আনতে চেষ্টা করেছি কখনোবা। এই উপন্যাসে নারী চরিত্রটি কিজানি কীভাবে যে একেকটি পর্বের এত সুন্দর নাম চয়ন করেছেন বা লেখক তাকে দিয়ে করিয়েছেন তা একজন সত্যিকার পাঠককে বড় বেশি ভাবায়।
কোটেশনের লাইনটি “আগুন পাখি” উপন্যাসের তেমনি একটি পর্বের নাম। এই পর্বে ফুটে উঠেছে সেকালের অসুখ বিসুখে কেমন চিকিৎসা হতো, কিভাবে চিকিৎসা হতো, কিভাবে একজন ডাক্তারের সন্ধান করা হতো বা কিভাবে একজন ডাক্তারের সেবাটি একজন রোগির জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠতো। সেই নারীর খোকার জ্বর হলো, সাতদিন জ্বরে ভোগেছে খোকা, তাই শহর থেকে ডাক্তার আনতে হবে। কিভাবে ডাক্তার আসতেন তখন রোগি দেখতে! কিছুটা তার বর্ণনা দেয়া যাক উপন্যাসের সেই পর্ব থেকে __
“কি করে শহর থেকে বড়ো ডাক্তার আনা সোম্ভাব হলো, আমি জানি না। বোধায় জমিই খানিকটা বেচতে হলো। যা-ই হোক পরের দিন বৈকালির টেরেনে ডাক্তার এল।ইস্টেশনে মোষের গাড়ি গেয়েছিল, কত্তা ডাক্তারকে নিয়ে বেলা থাকতে থাকতেই বাড়ি এল। হাত-মুখ ধোবে না, কিছু খাবে না, হ্যাট-কোট পরা ডাক্তার সোজা রোগির ঘরে চলে এল। ডাক্তারের বয়স খুব বেশি লয়, সোন্দর মুখ, ফরসা চেহারা। অনেকরকম করে রোগি দেখলে। দেখা হয়ে গেলে চুপ করে খানিকক্ষণ বসে থাকলে যি সি দেখে আমার হাত পা প্যাটের ভেতর সেঁদিয়ে যেতে লাগলো। হ্যাঁ, এ সান্নিপাতিক জ্বরই বটে!
একদম শেষ সোমায়টো আমার কিছুতেই মনে পড়ছে না। খুব জোরে হিঙুরে উঠে একবার কি নিঃশ্বেষ নিয়েছিল? কেউ যেন শুনতে না পায়, শুদু আমি শুনি এমনি করে কি বলেছিল , মা যাই।কিছুতেই মনে পড়ে না। আমার কোলে ছিল মাথা, শুদু দেখলাম কাত হয়ে কোল থেকে গড়িয়ে পড়ল। ঐ শেষ। খোকা চলে গেল! “
খোকা চলে যাবার পর কী নারী থেমেছেন ? না থামে্ননি। অবিরাম কথা বলেছেন, কথা বলতে বলতে এক পর্ব থেকে আরেক পর্বে চলে যাচ্ছেন এবং আরেকটা ইতিহাস রচনা করছেন তিনি লেখকের কলমের ছোঁয়ায়। পেরেছেন লেখক অনর্গল কথা বলাতে তাকে দিয়ে। কোন কথাটি তিনি বলেননি নিজের মত করে তাই ভাবার বিষয়।দীর্ঘ পরিসরের উপন্যাসটিতে পর্ব যায় পর্ব আসে গল্প বাড়ে, কথা বাড়ে, দুঃখ আসে, মরণ আসে, শোকের ছায়া নামে, শোক সরে যায়, আবার নতুন শিশু জন্মায়, সেই নারীর কথা তবু ফরায় না।নতুন পর্ব আসে, নতুন দুঃখ আসে, যুদ্ধ আসে, মরণ আসে্ দুর্ভিক্ষ আসে মহামারীর মতো জীবন স্তব্ধ হয়। সংসার ভাঙে, ঘর ভাঙে, মন ভাঙে, বাক্স পেটরা ভাঙে, জমিজমা ভাঙে, দেশ ভাঙে। ভাঙে কেবল ভাঙে আরেক পর্বে তিনি বলে ওঠে্ন __
“পিথিমির পেরজা আর কতো বাড়াব”, ” এবারের সন্তানটি পেটে নিয়ে আমি খুব পেরেশান।”
সময় ছিল সেসব দিন, বড় বেশি কঠিন ছিলো একটা সন্তান জন্ম দেয়া, তবুও একেকজন দম্পতি জন্ম দিতেন সন্তান জনমভর, সন্তান জন্ম দিতে দিতে নারীজন্মের শোধবোধ চুকে যেতো। উপন্যাসের সেই পর্বটি এমনি বিষয় আর সেসময়ের সময়- কাল-পাত্র-পাত্রীদের চিত্র এঁকেছেন লেখক ছবির মতো জীবন্ত করে।
বই পড়তে সময় এমন একটি অভ্যাস আছে যে কোনো বইতে খুব বেশি দাগ পড়ে যায়, এই উপন্যাসেও অনেক দাগ পড়েছে পেন্সিলের ছোঁয়ায়, তেমনি একটি দাগের কথা __
“দ্যাশ আ্লেদা হোক আমি চাই নাই অথচ আমারই ছেলেমেয়ে বিদ্যাশে চলে গেল আর আলেদা দ্যাশের লেগে যারা লাফাইছিল তারা যেমনকার তেমনিই রইল। বিনা কারণে শুদু হিঁদু মোসলমানের মাঝখানে একটা ছেঁয়া পড়ে গেল।”
কথাগুলো উপন্যাসের সবশেষের পর্ব থেকে, সেই পর্বটির নাম দিয়েছেন লেখক, __
” আর কেউ নাই, এইবার আমি একা”
” একদিন ল- দ্যাওরকে ডেকে বললাম, খুব তো লড়কে লেঙ্গে করে পাকিস্তান করলে। সি দ্যাশটি কিরকম, কোথা সি দ্যাশ তা কি জানো? তা এত কষ্ট করে, মারামারি করে যি দ্যাশটি করলে, এ্যাকন সি দ্যাশে যাবে না?
খেপেছ ?
ক্যানে, খেপেছ ক্যানে। এত লাফাইছিলে, এ্যাকন কি হলো?
দেশ ভাগ হয়ে গেছে, ছেলেমেয়ে একপারে থেকে গেছে, সেই নারী আরেক পারে পড়ে আছেন কত্তাকে নিয়ে, এখন তারা একা। কত্তার ইচ্ছে যে তিনিও চলে যাবেন ছেলেমেয়ের কাছে, কিন্তু সে নারী নাছোড়বান্দা।
কত্তা নম্র সুরে বললেন, ” নিজের নাতি-নাতনির কাছে যাবে না এমন আজগুবি কথা কেন বলছো তুমি? সেখানে গেলে আবার তোমার সব হবে। নিশ্চিন্তে বাকি জীবনটা কেটে যাবে।”
সেই নারীর পরিষ্কার কথা ” ঐ লোভ তুমি আমাকে আর দেখিও না। চারাগাছ এক জায়গা থেকে আর জায়গায় লাগাইলে হয়, এক দ্যাশ থেকে আরেক দ্যাশে লাগাইলেও বোধায় হয়, কিন্তু গাছ বুড়িয়ে গেলে আর কিছুতেই ভিন মাটিতে বাঁচে না।”
আসলে উপন্যাসটি ধারণ করে রয়েছে যেমন সেকালের কথা, তেমনি আজকের কথাও।তখন ছিলো ব্রিটিশ সময়, উপমহাদেশ জুড়ে রক্তারক্তি, হিন্দু-মুসলিম দাঙা, এপারের হিন্দু ওপারে যায়, ওপারের মুসলিম এপারে আসে। লাহোরের হিন্দু দিল্লি আসে, দিল্লির মুসলিম লাহোরে যায়। পশ্চিম বাংলার মুসলিম পূর্ব বাংলায় আসে পূর্ববাংলার হিন্দু পশ্চিম বাংলায় যায়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখকের লেখায় উঠে এসেছে তা, তেমনি একটি উপন্যাস “আগুন পাখি” হাসান আজিজুল হকের লেখায় ধারণ করে রেখেছে সেসব কথা।
সেসব কথা ধারণ করে রেখেছে খুশবন্ত সিং এর উপন্যাস ” ট্রেন টু পাকিস্তান -এ, অমৃতা প্রীতমের “পিঞ্জর” সিনেমাসহ আরো অনেক অনেক লেখায় পাওয়া যায় সেসব রক্তাক্ত সময় এবং সময় প্রবাহ। ঘটনা প্রবাহ, অনিশ্চিত জীবন, স্বজন হারানো বেদনা, পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু জীবন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখকদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যেমন তখন তেমন এখনো।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে দেশ বিভক্ত হলো, ভারত পাকিস্তান দুটি আলাদা দেশ হলো অনেক রক্তের ভেজা রক্তাক্ত মাটির ওপর। তারপর কি হলো ? শুরু হলো বৈষম্য। বাঙালির ওপর অত্যাচার। মুখের ভাষার ওপর অত্যাচার। অর্থ-সম্পদের ওপর অত্যাচার। এলেন আমাদের পিতা বঙ্গবন্ধু তর্জনী উচ্চ করে শোনালেন দেশকে মুক্ত করার অমর বাণী, অমর কথা, যে বাণী রক্তে তুলে দিতে পারলো ঝড়, সে ঝড়ে জেগে উঠলো দেশের মানুষ মুক্তি সংগ্রামের পণে। লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষের রক্তে ভিজলো পুনরায় এ দেশের মাটি, কত নারী হারালো সম্ভ্রম, সন্তান হারালো পিতা-মাতা, নয়মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ হলো। তারপর পৃথিবীর মানচিত্রে অঙ্কিত হলো নতুন দেশের নাম, সে আমাদের দেশ, বাংলাদেশ। জাতীয় সঙ্গীত হলো আমাদের নতুন করে, জাতীয় পতাকা হলো লাল সবুজের। তারপর এলো পঁচাত্তরের ১৫ই আগষ্ট, পুনরায় রক্তে রঞ্জিত হলো এ দেশের মাটি, জাতি হারালো পিতাকে। তারপর ইতিহাস থেমে থাকে না। সময় গড়ায়, নতুন ইতিহাস লেখা হয়।
আজো স্বাধীন দেশে ” আগুন পাখি” উপন্যাসের সেই নারী কিংবা সেই নারীর মতো অন্য কোনো নারী ডুঁকরে কেঁদে মরে ঘরের কোণে সন্তানের মাথা বুকে চেপে যেন থেকে থেকে বলে ওঠে, ” গাছ বুড়িয়ে গেলে কিছুতেই ভিন মাটিতে বাঁচে না।” তবুও তাকে নীরবে-নিভৃতে, রাতের অন্ধকারে মধ্য উঠোনের তুলসীতলায় চোখের জল রেখে দিয়ে চলে যেতে হয় ভিন দেশে; সে জানে ভিন দেশে সে বাঁচবে না, তবুও সে যায়, তবুও তাকে যেতে হয়, তবুও সে বাধ্য হয় চলে যেতে … … …
পথে যেতে যেতে তারও সন্তানের সান্নিপাতিকের জ্বর আসে, সেই নারীর চোখের জল শুকিয়ে যায়, সন্তানের মাথায় হাত রেখে নির্বাক কেটে যায় তার অনাহারী জীবন, বিনে চিকিৎসায় মরে যায় তারও সন্তান। সন্তান শোকের মত এমন ভারী পাথর আর কি তার সয়?
শেষে সেই নারীর অনর্গল কথা বলার মধ্যেই লেখাটির সমাপ্তি হোক কিন্তু তবুও যেন নারীর বলার শেষ হবে না, তিনি বলছেন, __ ” হাজার হাজার মানুষ ই দ্যাশ থেকে উ দ্যাশে যেছে, উ দ্যাশ থেকে ই দ্যাশে আসছে। ই দ্যাশ থেকে কজনা যেছে জানি না উ দ্যাশ থেকে লিকিন বেসুমার মানুষ সবস্ব হারিয়ে ইখানে এসে হাজির হচে।”
এই অপ্রিয় সত্যগুলো নিরন্তর ঘটছে, সেই নারীর কথার মতো যেন তারও বিরাম নেই। আগুন পাখির আগুন জ্বলছে, পাখি মরছে …
“আগুন পাখি” উপন্যাসের পাঠ ভাবনার মধ্য দিয়ে ছায়াবৃক্ষ কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক এবং তাঁর সৃষ্টির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
১৯নভেম্বর ২০২১
ঢাকা।
Leave a Reply