শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছিলো । কোন শব্দই ভালো লাগছিলো না। ফেদি কানের পাশে বসে গুনগুন করছে । ভীষণ বিরক্ত বোধ করছি। হঠাৎ খুব রাগ হলো উঠেই বাবার মত ফেদির গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলাম । কারো গালে চড় বসাতে খারাপ লাগে না, আনন্দ আনন্দ বোধ হয় , মনে হলো এক কাপ গরম কফি খেয়ে উঠলাম ! ফেদি আমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে এই মাত্র সে সামনে বাঘ দেখেছে । আমি শুয়ে ফেদির মতো গুন গুন করে গাইলাম, আজি এ বসন্তে …
ফেদি আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলো আজ কার্তিকের ত্রিশ তারিখ, শীত পড়তে শুরু করেছে !
ফেদি কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালো। আমার মনে হলো ও আমাকে বিচ্ছু বলেছে ।
বললাম,-তুই কী আমাকে বকলি ফেদি ?
—না ।
—–আমার মনে হলো ।
—–জগতে হগল মানুষের এমন মনে হয়, মনে হয় যার মুখে সে চড় মারছে, সে তাকে অভিশাপ দিচ্ছে ।
—–কী বলে অভিশাপ দেয় ?
—–জানি না, এক একজন এক এক রকমভাবে দেয় । তুই কীভাবে দিস ?
ফেদি মাথা নিচু করে বের হয়ে গেলো রূম থেকে, হয়তো বাবার কাছে যেয়ে বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদবে । ও হয়তো বলবে , জানো জানু, তোমার মাইয়া আজ আমারে চড় মারছে ।
আমার হাসি পেলো, বারান্দায় আসলাম,ফেদি নিচে নেমে গেছে। বাবার রুমের দিকে যায়নি।
আমি জানলায় কাছে গেলাম। ফেদি নিচেই।
সত্যি শীত পড়তে শুরু করেছে, ফেদি নীচেই নিম গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে আকাশের দিকে তাকিয়ে ।
ফেদির মুখটা ঘনকালো কুয়াশার মত আচ্ছন্ন। নিমগাছের ভিতর যাদু আছে। দুঃখ পেলে সবাই চলে যায় নিম গাছটার ধারে। আমার মা রিতি তার গভীর কালো চোখে নিম গাছের দিকে তাকিয়ে থাকতো। অসম্ভব সুন্দরী ছিলো আমার মা। আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী।
অথচ বাবা নামের মানুষটা তাকে অবহেলা করতো খুব। একজন রহস্যময়ী নারীকে বুঝবার জন্য বিশাল বড়ো একটা দিল লাগে। বাবার মনটা ছোট ছিলো। মাকে বুঝবার চেষ্টা করেননি। সহজে পেয়ে যাওয়া অনেক মূল্যবান জিনিস মানুষ হেলায় হারায়। বাবা হারিয়েছেন আর দত্তকাকু জাত ধর্ম চুলোই দিয়ে মাকে লুফে নিয়েছেন। শোনা যায় মা অনেক সুখে আছেন। কেবল মাঝে মাঝে অন্যমনষ্ক হয়ে যান তার একমাত্র সন্তানের জন্য। সেও সাময়িকের জন্য । মার মুখে দুঃখের ছায়া পড়া মাত্র দত্তকাকু সব মুছে দেন।
দত্তকাকু বাউন্ডুলে ছিলেন। সংসারের প্রতি উদাসীন ছিলেন। সাংস্কৃতিক জগতের ভিতর তিনি মগ্ন থাকতেন। জীবনের মধু ক্ষণে অনেক ফুল কুমারী তাকে আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি ব্যতিক্রমী মানুষ খুঁজে বেড়িয়েছেন। উপযুক্ত বয়সে বিয়ে সাদী করেননি। ফলে কুমার জীবন তাকে টেনে এনেছিল আনন্দ ভিলায়। আর আনন্দ ভিলায় তিনি সেই ব্যতিক্রমী মানুষটিকে দেখতে পেয়েছিলেন রিতির মধ্যে।
দত্তকাকু প্রায় আমাদের বাড়িতে পার্টি করতেন। উপলক্ষ প্রয়োজন হতো না তিনি নিত্য নতুন উপলক্ষ তৈরি করতেন। আজ কলির মুখে ভাতের তারিখ ছিলো, দত্ত কাকু বাবাকে বলতেন, বকুল হয়ে যাক পার্টি।
বাবা বিপুল উৎসাহ বলতেন, চল বাজারে যাই।
পোলাও বিরিয়ানি রান্না শুরু করতেন মা। আর বাবা দত্তকাকুর অন্ধ ভক্ত ছিলেন। চাঁদ চাইলেও বাবা বোধহয় দত্তকাকুকে তাই এনে দিতেন। বন্ধুর প্রতি যে কী প্রচণ্ড মমতা তা বাবাকে দেখলে বোঝা যেতো। দত্তকাকুও বাবার জন্য এক ধাপ এগিয়ে ছিলেন। বাবার প্রিয় খাবার ইলিশ পোলাও। প্রায় দেড় দু কেজি ওজনের ইলিশ নিয়ে হাজির হতেন।
মা সাথে সাথে বটি নিয়ে নিজে হাতে কুটতেন। মাছের মাথাটা মা বাবার পাতেই দিতেন। কোনো দিন তার ব্যত্যয় হয়নি। কিন্তু বাবা মৃদুস্বরে বলতেন, বউ নেই আর কাকীমাও বেঁচে নেই ওকে খাওয়াবে। বলে মাথাটার গোড়ার দিক থেকে একটু ভেঙে রেখে দত্তকাকুর পাতে তুলে দিতেন।
দত্তকাকু মাথের মুড়ো থেকে মাকে ভেঙে দিতেন। বাবা খুশি হয়ে বলতেন, খাও রীতি দত্ত দিয়েছে বলে কথা, দত্ত আমার পেটের ভাই থেকে অধিক।
মা খুশি হয়ে খেতেন। আমি মাছ ছাড়া খাই না। দত্তকাকু এটাও জানতেন মাকে বলতেন, রিতি কলিকে পেটির মাছটা দাও, কাঁটা বেছে দাও
সবার প্রতি দত্তকাকুর খেয়াল ছিলো। কখনো এক পেশে শুধু মার জন্যই করতেন না। মার জন্য শাড়ি আনলে মিল করে বাবার জন্য শার্টও আনতেন। বাবা খুব খুশি হয়ে মাকে বলতেন, যাও রিতি পরে এসো, দত্ত আমাদের একটা ছবি তুলুক। দত্তকাকুর ক্যামেরায় বাবা মার অনেক যুগলবন্দী ছবি রয়েছে।
সেই দত্তকাকুই একদিন বাবার কলিজা ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেলেন। বাবা ঠুটোঁ জগন্নাথের মতো নিথর হয়ে গেলেন। করিম সাংবাদিকের মাধ্যমে রিতির শেষ একটা চাওয়া ছিলো। তার মেয়েটার যেন দিয়ে দেন বাবা। বাবা করিম সাহেবকে সাফ জানিয়ে দিলেন, মেয়ে ছাড়া আমারতো কিছু নেই, মেয়েকে আমি দিবো না।
সাংসদ বলেছিলেন, কলি যদি যেতে চায়?
বাবা বলেছিলেন, সে ক্ষেত্রে আমি ওর নিরাপত্তা চেয়ে কোর্টে মামলা করবো।
বাবা সেই দিন সন্ধ্যা বেলায় ছোট্ট শিশুর মতো আমাকে বুকে আগলে ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি, বল যাবি।
আমিও বাবার বুকের ভিতর ডুকরে ডুকরে কেঁদেছিলাম। সেদিন বাবা আমাকে ছাড়তে চাননি একা হয়ে যাবার ভয়ে। আজ বাবা খেয়েছি কীনা এই খবরটা নিতেও ভুলে যান। ফেদি নিম তলায় দাঁড়িয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। ফেদিও চরম ভুল করে ফেলেছে।
চলবে————-
শীত পড়তে শুরু করেছে, শিরিষ গাছ দুটো কান্নার মত অবিরত পাতা ঝরিয়ে যাচ্ছে । সারা উঠোন জুড়ে রাজ্যের পাতা। সব গাছগুলোতে বাতাস দুলছে। আর সব গাছগুলো আপন মনে তাদের শুকনো পাতা গুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। কেমন খেলা এই প্রকৃতির। ফেদি আমার পাশে এসে পাতা ঝরা দেখে। বিষন্ন সন্ধ্যার মতো ঘোর অন্ধকার মুখ নিয়ে দাঁড়ায় আমার কাছে। চোখে মুখে অজস্র প্রশ্ন অজস্র কান্না ওর মুখে খেলে বেড়ায়। আমিও ফেদিকে দেখি আর ভাবি, যেদিন প্রথম এই বাড়িতে এসেছিলো স্বামীকে হারিয়ে। সেদিন ওর মনে যে দুঃখ ছিলো তা ছিলো হালকা। আজ ওর মনে গভীর দুঃখের ছায়া খেলা করছে তা গভীর। এই দুঃখের কথা সে কাউকেই বলতে পারছেনা। ভিতরে ভিতরে ওর ক্ষরণ হচ্ছে।
নিচ থেকে বিলকিস খালা করকর করেই যাচ্ছে।
চিৎকার, চেঁচামেচি করেই যাচ্ছে , ইদানিং বিলকিস খালা বাতাসের সাথে ঝগড়া করে । আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুনি আর হাসি। বিলকিস খালার গুরুত্ব কম নয়। উনি না থাকলে বাড়িটিকে মৃত্যুপুরী মনে হতো। ফেদিকেও খালা দেখলেই বলে উঠবেন, নবাবের বেডি, বেশ্যা। বিশ্রী ভাষায় আমি জিহ্বা কাটি। বিলকিস খালা একদম সয্য করতে পারছে না ফেদিকে।
ফেদি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। কিছুই বলে না। এটা যেন তার পাওনা এরকম ভাব করে ফেদি চেয়ে থাকে। খালা বকবক করেই চলে। ফেদির গুষ্ঠি বিনা কারণে উদ্ধার করা ঠিক নয়।
আমি হাত ইশারায় খালাকে উপরে ডাকলাম । খালা বাঁকা দৃষ্টিতে তাকালো, ডাকছিস কেনো বল ?
—-তোমার মন খারাপ ?
——না, মনে ফুর্তি লাগতিছে !
—–কেনো খালা ?
—–এমনি সুখের হাওয়া বইছে এ বাড়ি, শিরিষ গাছের পাতায় উঠোনের কী অবস্থা দেখেছিস ?
আমার হাসি পেলো, প্রতি বছর পড়ে, খালা যত্নের সাথে কুঁড়িয়ে সখিনা খালা ও নাজমা খালার জন্য বস্তায় ভরে রাখে । নাজমা খালা জুলকারদের বাড়ি কাজ করে, কাজ শেষে যাওয়ার সময় উঠানটা ঝাঁট দিয়ে পাতা বস্তায় ভরে নেয়। পাতার বস্তা ঘাড়ে করে নিয়ে ছোটে । সখিনা খালা বিলকিস খালার প্রাণের সই। অথচ আজ খালার মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে ।
নেমে এলাম নীচে । খালাকে বললাম,-কার পরে ক্ষেপেছো ?
—ঐ মাগিটা কই ?
—মাগি ?
বিলকিস খালা বললো, চারিপাশে ঢিঢি পড়ে যাচ্ছে , মাগি লিয়াকত ভাইয়ের ঘরে নাকি রাত বিরেত ঢোকে?.
অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম,তোমাকে কে বললো ফেদি বাবার ঘরে রাতে যায়?
বিলকিস খালা ফিসফিস করে বললো,মর্জিনাকে সফেদা বু বলেছে, বলে আবার কিরেকেত্তন দিয়ে বলে দিয়েছে তার নাম বলতে।
তারপর গলাটাকে আরও খাঁদে নামিয়ে বললো, ফেদিটা কোথায় এখন?
—-বোধ হয় বাবার রূমে ?
—–ঐ ছেড়ি ভাইজানের মাথা খাইছে ।
——খালা তোমার মজা লাগে না ?
——কী জন্য ?
—-এই যে বাবা আর ফেদি প্রেম করছে, এটা দেখে ?
খালা অবাক হয়ে তাকায় আমার দিকে। আমি যেন সপ্তার্যের একটি। বাবার অধঃপতনের কথা কেমন নির্বিঘ্নে বলে চলেছি। বললাম, হা করে কী দেখো খালা আমিতো এনজয় করছি
বিলকিস খালা বললো, এনজয়, তোর এসব শুনতে ভালো লাগে তোর?
বললাম, আমিও জানি ফেদি বাবার রুমে যায়
বিলকিস খালা অবাক হয়ে তাকালো,তুই দেখেছিস ?
——হু ।
——কী দেখেছিস?
—–বাবা ফেদিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায় ।
আমি এসব দেখিনি, বানিয়ে বললাম । বিলকিস খালার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য ।
বিলকিস খালার মেজাজ সত্যি এখন সপ্তমে চড়ে গেছে, বাঘিণীর মতো আমার দিকে তাকালো , বললো, তোর করিম চাচাকে খবর দে ।
আমি আবার বিলকিস খালাকে ক্ষেপালাম।-চাচা কিসের? আমিও তো উনার সাথে ওইসব করি,
আমিও উনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায় ।
বিলকিস খালা অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো, —–কখন ?
——রাতে ।
—–রাতে উনি আসে ?
—-হা, আমি যেয়ে চুপচাপ গেট খুলে দিই, উনি আমার সাথে উপরে উঠে আসেন ।
—–তারপর ?
আমরা রূমে যায়, তারপর ঐ সব করি ।
হা হয়ে তাকিয়ে আছে বিলকিস খালা। জানি বিলকিস খালার ইচ্ছে করছে আমার মুখে থাপ্পড় লাগাতে। খুব সম্ভব উনি মূর্ছা যাবে । আমি গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে উপরে উঠে যাই, বিলকিস খালাকে মিথ্যে বলতে পারায় মনের ভেতর তৃপ্তি পাই ।
বিলকিস খালা থপথপ করে উপরে উঠে আসছে। উনি হয়তো আমাকে খুব করে বকে দিবে। কিন্তু বিলকিস খালা সোজা বাবার রুমের দিকে চলে গেলো থপথপ করে। বাবার ঘরে ফেদি আছে। অঘটন ঘটাবে নাতো সন্দেহ দানা বাঁধলো।
আশঙ্কা সত্যি হলো। বিলকিস খালা ফেদির গলার কাছে জামা ধরে বাইরে এনে উল্টা পাল্টা মারছে।
আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বাবা মুখ বের করে আবার রুমে ঢুকে গেছেন। বাগান বিলাসের সফেদা বু দোলনায় দোল খাচ্ছে আর এদিকে তাকিয়ে বলছে, খালা আরও মারেন, জোরে দেন, ফাজিল মেয়ে।
বাবার নিরপেক্ষ ভুমিকা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। বাড়ির মুরব্বি কাজের মহিলা তার অধীনস্থদের বকাঝকা করতে পারে। তাই বলে বাবার রুম থেকে ধরে এনে এরকম মারবে। তাও বারান্দায় দাঁড়িয়ে। বাগান বিলাসের সফেদা বু খুব খুশিতে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। বাবা আর ফেদির বিষয়টা কানাকানি হতে হতে না মুখেমুখে হয়ে যায় এরকম ভাবনাও আমাকে ভাবাচ্ছে। দৌঁড়ে গিয়ে ধমক দিলাম খালাকে। উনি মায়ের মতো স্নেহ করেন আমাকে যদিও তা জানি। কিন্তু এটা খালার বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। বললাম, এসব কী হচ্ছে খালা?
খালা আচমকা ফেদিকে ছেড়ে দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো, আনন্দ ভিলা যে ভাইঙা পড়তিছেরে কলি, তুই ঠ্যাকা।
বলেই বিলকিস খালা কাঁদতে কাঁদতে নিচে নেমে গেলেন।
আমি ফেদির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর মুখে বিলকিস খালার সদ্য খামচির দাগ। লাল হয়ে চেয়ে আছে। ফেদির চুল গুলো এলোমেলো। আমি মৃদুস্বরে বললাম, ফেদি বিলকিস খালা মুরব্বি মানুষ, আমি তোকে সংযত হতে বলেছিলাম। কিন্তু দিন দিন তুই আরও অসংযত হয়ে যাচ্ছিস, একেবারে নিচে চলে যেয়ে চুপচাপ খালার কাছে মাপ চেয়ে নিস
ফেদি বলতে পারতো যে সে মারও খেয়েছে আবার মাপও চাইবে সে কেমন বিচার। কিন্তু ফেদি কিছুই না বলে স্তম্ভিতের মতো ধীর পায়ে নিচে নেমে গেলো। বুকের ভিতর আমারও লেগেছে। বাবা নামের মানুষটা দিন দিন অমানুষ হয়ে যাচ্ছে ভেবে।
চলবে——-
বাবার সঙ্গে ইদানীং দেখা হচ্ছে কম, ইচ্ছে করে বাবার রূমে যাই না, মনে হয় দেখা হলে বাবা বিব্রত বোধ করেন। বাবার দিকে ভালো তাকাতে নিজেও কম লজ্জা পাই না। মনে হয় বাবার শরীরে শুঁয়াপোকা কিলবিল করছে। বাবা মানুষটা আর সেই অন্যরকম বাবা নেই। সস্তা বাবাদের মতো রহস্যহীন ব্যক্তিত্বহীন ননসেন্স বাবা।
বিলকিস খালা এসে বললেন, তোর বাবাকেও কী মার মতো পর করে দিয়েছিস?
— কেনো খালা এরকম বলছো কেনো?
— তোর বাবার দিকে খেয়াল করিস না, লিয়াকত ভাই গাঁদা গাঁদা বই কিনে ঘর ভরে ফেলছে, খোঁজ খবর নিয়ে দেখ বই দিয়ে কী করছে?
তারপর গলাটাকে খাঁদে নামিয়ে ফিসফিস করে বললো, ফেদি ঠিক যায় ভাইয়ের ঘরে।
বললাম, তুমি দেখোছো?
— হা, নিজের চোখে দেখেছি, মর্জিনা, সখিনা ওরাও সফেদাদের ছাদ থেকে দেখেছে, জানালা খোলা রেখে ফেদির সাথে, ছিঃ আমি তা মুখে আনতে পারছি না।
বললাম, খালা তুমি এখন যাও আমার মাথা ধরেছে।
সত্যি সত্যি মাথা ধরে যাচ্ছে। না পারছি বাবাকে কিছু বলতে না পারছি ফেদিকে তাড়াতে। করিম সাহেবকে বলা যেতে পারে। কিন্তু বাবা সম্পর্কে বলতে দ্বিধা হচ্ছে। মা আর বাবাতে আজ কোনো ফারাক নেই। পাড়ার লোকরা নিজে চোখে দেখছে বাবার অপকর্ম।
বারান্দায় এসে দাঁড়াই। জুলকার মেরি আর জনের সাথে লাটিম ঘোরাচ্ছে। কী সাংঘাতিক সুখী পরিবার। বাবা মায়ের ভিতর অন্যরকম মিল ওদের । গলা বাড়িয়ে ডাকলাম, এই জুলকার ভাই
এক ডাকেই সাড়া পাওয়া গেলো, কলি কিছু বলছো?
আসলে কোনো ঘটনা নেই এমনি ডেকেছি। কী বলবো ভাবছি। বললাম, আমাকে নেবে লাটিম খেলতে?
এই কথা শুনে অন্য সময় হলে বাবা এসে থাপ্পড় মারতেন। আজ বাবার ঘর থেকে বাবা বের হলেন না। জুলকার বললো, মেয়েরা লাটিম ঘুরাই না
— তাহলে মেয়েরা কী করে?
—- কুতকুত খেলে।
— কার সঙ্গে খেলবো?
ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, ফেদির সাথে মেরীর সাথে
— ফেদিকে চিনেন?
জুলকার ভাই এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো, পাড়ার সব্বাই চেনে।
— কেনো, কীভাবে চেনে?
জুলকার ভাই ফিসফিস করে বলার মতো গলাটা চেপে চিল্লাইয়ে বললো, পরে বলবো।
জানি জুলকার ভাই বাবাকে ইঙ্গিত করে বলেছে। যে জুলকার ভাই বাবার ভয়ে কথা বলতো না তার ভিতর থেকে সে ভয় উবে গেছে। শ্রদ্ধা চলে গেলে ভয়ও যে চলে যায় জুলকার ভাইকে দেখে বুঝলাম।
বাবার শখ জেগেছে মহা মনিষীদের নিয়ে গবেষণা করবেন। তাও ভালো। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম বাবা এই গবেষণার কাজে ফেদিকে বিশেষ সহায়তা দান করছে। আমাকে পর্দার ফাঁকে মুখ গলাতে দেখে ফেদি দাঁড়িয়ে গেল সে বই গুছাচ্ছিল। আমি ফেদিকে বললাম, যে কাজ করতে হয় তা প্রাণ ভরে করতে হয়, বিফল হলেও দুঃখ থাকে না। বই গোছাচ্ছিলি তাই গোছা, কাঁদবি যখন প্রাণ ভরে সুখটাও উপলব্ধি করেনে।
ফেদি মাথা নিচু করে বের হয়ে গেল। বাবা বইয়ের ভিতর মুখ গুঁজে প্রশ্ন করলেন, কলি মনিষীর স্ত্রীলিঙ্গ কী?
আমি নিরুত্তাপ উত্তর দিয়েছি,স্ত্রী মনিষী!
বাবা পূর্বের ন্যায় আচমকা খাট থেকে নেমে আমার মুখে একটা চড় মেরে বেয়াদব বলে খাটে যেয়ে বসলেন । বাবার এই চড়টা আস্তে থাকলে একটু ভিন্ন ছিলো। অযাচিত অধিকারের মতো।
ডাইরি, ডিক্সেনারি খুঁজছিলেন। বললেন,আমার শব্দকোষ বইটি সেল্ফে নেই কেনো?
আমি নিরুদ্বেগ গলায় বললাম, বোধ হয় ফেদি সরিয়েছে।
বাবা বইয়ের ভিতর মুখ গুঁজে বললো, ওর কী দরকার ও সরাবে কেনো?
আমি বললাম, ও উপন্যাস লিখছে।
বাবা বিড়বিড় করতে থাকলেন,মনে হয় আমাকে আর চড় মারতে ইচ্ছে করিনি ওনার।আমি বের হয়ে গেলাম।
করিম সাহেব সামনে দিয়ে বাবার রূমে গেছেন। উনার গায়ে একটা নীল রঙের উপর সাদা গোল গোল ফোটা দেওয়া শার্ট পরা। অসাধারণ লাগছিলো উনাকে। একবার ডাকতে ইচ্ছে করেছিলো। কিন্তু পারিনি ! কোথায় যেন বেঁধেছে।
বিলকিস খালা ধপ ধপ করে সিঁড়ি দিয়ে উপরে আসছে,উনার চলার শব্দ হাতির মত!
হাফাতে হাফাতে আমার রূমের সামনে থামলো।
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো এক মিনিট, মনে হলো উনি মনে মনে ষাট পর্যন্ত গুনেছেন। তারপর মুখ খুললেন,বাড়িঘরের দিকে একবার নজর দিবি?
—কেনো কী হলো?
—-ওর বাড় বেড়েছে।
—–ওকে?
——ফেদি।
——–তো?
——ওকে তাড়াতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
——কীভাবে?
——তুইতো খেয়াল করিস না কিছু।
——-কী করেছে ফেদি সেটা বলো।
—–দুটো শাড়ি কিনেছে।
আমি হাসলাম। কিনতেই পারে। কেনো কিনবে না। ওতো বাবার বইয়ের তাকের অধিকার পেয়ে গেছে। শাড়িতো সামান্য ব্যাপার। খালাকে চটাতে বললাম, গয়না তো কেনেনি শাড়ি কিনেছে ভালো করেছে,তোমার সমস্যা?
বিলকিস খালা কোমর বেঁধে এসেছে। এসপারওসপার কিছু একটা করেই যাবে এরকম অবস্থা তার। বললো, টাকা পেলো কোথায়?
—–বাবা দিয়েছেন।
——কেনো এসব করে বুঝিস না?
আমি ফিকফিক করে খালার গা জ্বলানো হাসি দিয়ে বললাম, আজকাল খুব দেয়া নেয়া চলছে সবার মাঝে। তুমিতো জানো না খালা করিম সাহেব গত মাসে আমাকে চারটে থ্রিপিছ দিয়েছে।
খালা রাগত্ব স্বরে বললো, একদম মিথ্যা বলবি না
কলি,তুই এতো মিথ্যে বলিস কেনো?
আমার চোখ ছলছল করছে। খুব কান্না পাচ্ছে। বুকটা ফেটে যাচ্ছে। একা হয়ে যাওয়ার নিদারুণ কষ্টে চোখ থৈথৈ করছে জলে। খালা টের পেয়েছে। তার চোখ ভরে পানি উপচে পড়ছে। আমি চোখে জল নিয়ে বিলকিস খালাকে দেখছি।
বিলকিস খালা চোখ আঁচলে মুছলেন। উনি কাঁদছেন।
চলবে—–
হাল্কা শীত সাথে ঝিরঝির বাতাস ।আমার মাথার উপর খোলা ছাঁদ ।ছাদে হরেকরকম গাছ ।বেলী গোলাপ, জুই ।মা বাগান ভালোবাসতেন, নিজে হাতে পানি দিতেন । ফুলের সাথে কথা বলতেন । আমি হাসতাম, মাও । খিলখিল করে হেসে উঠতেন, মনে হতো মার হাসির সাথে বাতাস হেলে দুলে নাচছে । মা দত্ত কাকার ওখানে কতটা সুখে আছে, জানি না । ভাবতে কষ্ট হয় । মার কী এই ফুলের বাগানের সাথে থাকা উচিত ছিলো ? নাকী দত্ত কাকার সাথে । মা ই ভালো জানেন । আজ খুব প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, মা, তুমি কেমন আছো ? দত্ত কাকার ওখানেও কী তোমার একটা বাগান আছে ? খোলা ছাঁদ ? কলির মত একটা মেয়ে ? নীম গাছ ? বড় লোহার গেট ? গেটের পাশের শিরিষ গাছ ? বাবার রূমের সামনের ক্যাকটাস ? তুমি কী এখনো বলো , রূমের সামনে ক্যাকটাস কেনো ?
তোমাকে কী দত্ত কাকা খুব আদর করে ? তোমার সাথে দোলনায় বসে দোল খায় ? তোমার শাড়ির আঁচল মাটি ছুঁতে ছুঁতে আকাশে উঠে যায়, আবার নামে ?
জানি না, কিন্তু জানতে ইচ্ছে করে । কিন্তু আমি পারি না । ছাদের গেটে তালা খুলে আজ ছাদে উঠে এসেছি । বাবা জানেন না । জানলেই বাবার আর কী করার থাকতো। আগের মতো পারতেন না চুল ধরে নিয়ে যেতে ।
আমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে। বিয়ে দিতে বাবার আগ্রহ দেখিনা। আর মনে মনে আমিও বিয়ের প্রতি নাখোশ। যার মা ইয়াং মেয়ে ঘরে রেখে স্বামীর বন্ধুর সাথে চলে যায় তার মেয়ের জীবনের বিয়েটা কাল হয়ে ওঠে। পাড়ার সব্বাই জানে মা দত্ত কাকুর সাথে লিভ টুগেদার করে। হয়তো কোর্ট ম্যারেজ সেরে নিয়েছেন। কখনো ইচ্ছে করে না জানতে কলি কী খাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে। মায়ের অভাব বোধ কলিকে কষ্ট দেয় কীনা। আর বাবার কথাতো আমলেই আসে না।
বাবার বাতিকের অভাব নেই। এক এক সময় এক এক বাতিক। ছাদের পরের অধিকাংশ ফুল গাছ বাবা লাগিয়েছেন। যত্ন আত্মি ফেদি করে। ফেদি খুব আনন্দের সাথে করে। থরে থরে সাজানো ফুলের গাছে স্প্রে মেশিনে পানি দেয় আর গান গায়। আমি দ্বিতলা থেকে শুনি ফেদি ইদানিং অদ্ভুত অদ্ভুত গান করে। কাল প্রশ্ন করেছিলাম, কী গাইলি ফেদি?
– গান আফা, নতুন বান্ধিছি
— গাতো ফেদি।
ফেদি গাল বাঁধে তাতে সুরও করে নির্বিধায় তাই সে গায়। নির্জন ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। আমি বলতেই শুরু করে দিলো, বন্ধু ছাইড়া যাবো, চইলা যাবো
আর তো ফিরে আইবো না
আমারে খুঁজিও বন্ধু উড়াইয়া মন পাখনা
ছাইড়া যাবো চইলা যাবো
আরতো ফিরে আইবো না।
যদি তুমি না পাও তোমার
ফুলের বনে খুঁইজা
পাইবা বন্ধু পাইবা খবর
দুইটা চোখ বুইজা
দেখো তখন খুইলা মনের আয়না
বন্ধু ছাইড়া যাবো চইলা যাবো
আরতো ফিরে আইবো না।।
ওর কণ্ঠ দিয়ে মধু ঝরে। মায়া হয়। কিন্তু সেই মায়াটাও শেকলে বাঁধা। সীমালঙ্ঘন সম্ভব নয়।
এই অন্ধকার ছাদে আমারও ইচ্ছে করে গলা ছেড়ে গান ধরতে। সেই রবীন্দ্রনাথের গান চিরদিন কেন পাই না, মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
করিম সাহেবকে একটা ফোন দিতে ইচ্ছে করছে । ইচ্ছে আজ ডানা মেলে দিক না ! কী হবে ফোন করলে । কেনো ফোন করেছি জানতে চাইলে একটা মিথ্যে কিছু বলে দিবো ।
হ্যালো?
রিংটোন বাজতেই খপ করে ধরে ঘুম জড়িত কণ্ঠে বললো সাংবাদিক। বুকটা আমার কাঁপছে। কী বলবো। সাংবাদিক বললেন, কলি এতো রাতে?
আমি প্রশ্ন করলাম,আমি কোথায় বলেন তো?
সাংবাদিক আড়মোড়া ভেঙে বললেন, কেন তোর ঘরে
—- না
—- তবে?
— আমি ছাদে
— এতো রাতে ছাদে কেনো কলি?
—- ভালো লাগছিল তাই এলাম
—- ঘরে যা কলি
বলেই ফোন কেটে দিলো করিম সাহেব। ফোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। ভীষণ বিতৃষ্ণায় ছেয়ে ধরলো মনটা। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে যেন পা।ভাবছি ফোন না করাটাই ভালো ছিলো।
সকালে ঘুম থেকে উঠতে ভালো লাগলো না। কিন্তু বিলকিস খালা চাপাস্বরে ডাকছে, কলি এই কলি
আমি কানে বালিশ চেপে শুয়ে রইলাম। বালিশের ছিদ্র দিয়ে ঠিক খালার কণ্ঠ ভেসে আসছে, কলি, এই কলি।
অগত্যা উঠে এলাম। জানি বলবে ফেদি বাবার ঘরে। সাত সকালে ফেদির কী কাজ বাবার ঘরে এরকম প্রশ্ন করবে বিলকিস খালা। দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে খালা গায়ের উপর পড়লো। খুব সম্ভব দরজাতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো খালা। কোনো মতে নিজেকে সামলাতে পারলাম। তারপর ও হাত খাটে বাঁধিয়ে। খালার পতন ঠেকাতে পারলাম না। আমি সরে যেতেই খালা ধপাস করে পড়ে গেলো মেঝেতে। সাত সকালে এরকম পতনের জন্য ফেদিই দায়ী। মনে মনে হাসলাম।
খালা খাটের বাতা ধরে ঠেলে উঠে বললো, কোমরটা গেলো, ঐ মাগিটার জন্য।
আমি ভালাভোলা ভাব নিয়ে বললাম, কে?
খালা মুখ বিকৃত করে বললো, মাগীটা আজ তোর বাবার ঘরে দরজা লাগিয়েছে
আমি ভ্রু কুঞ্চিত করে বললাম, মাগীটা নয়, ওটাতো বাবার ঘর, বাবার ঘরের দরজা বাবাই লাগিয়েছে।
বিলকিস খালা আমার হাত ধরে বললো, চল মাগীটাকে আজ আচ্ছা মতো দিবো
বলেই কোমর ডলতে লাগলো। আমি হাত ছাড়িয়ে বললাম, খালা আমার এই সব পঁচা কাজ করতে একদম ভালো লাগেনা, তুমি নিচে যাও , সকালের নাস্তা দাও আমাকে আর শোনো এগুলো ঐ করিম সাহেবকে শোনাও, মন দিয়ে উনি শুনবেন প্রতিকার ও করবেন উনি এনেছিলেন ফেদিকে, ঠিক আছে।
খালার মনের ভিতর এখন কিছু না বলতে পারার কষ্ট লাফ ঝাপ করছে। মন খারাপ করে নিচে নেমে গেলো।
চলবে———-
মোবাইলে হাত উঠে গেলাম, রাত একটা বাজে । আকাশে অসংখ্য তারা । মিট মিট করে জ্বলছে । আচ্ছা তারা গুলোর অস্তিত্ব এখনো কী আছে ?
হাজার কোটি মাইল দূর থেকে আসতে আসতে সময় লাগছে, তারাটি জ্বলেছিলো বহু বছর আগে । এখন হয়তো তারা গুলো নিস্ক্রিয়া হয়ে গেছে । আলবার্ট আইন স্টাইন তার আপেক্ষিক তত্বে এমন কিছু বলছিলো হয়তো । তারাগুলো হয়তো এখন ধ্বংশ হয়ে গেছে ।পৃথিবী আর তারার ভিতর কয়েক কোটি বছরের দুরত্ব, একদিন আলো ছেড়ে তারপর কোথায় সরে গেছে ।
করিম সাহেব , আমি, বাবা, মা, দত্ত কাকু কেউ থাকবেন না, একদিন । আমরা তো কোনো দিপ্তি ছড়িয়ে যেতে পারলাম না, আমরা তাই তারা হতে পারবো না । ধ্বংশ হয়ে যাবো, বহু বছর আগে কেউ জানবে না এই কলিকে । মোবাইলে আঙুল চলে গেলো । করিম সাহেবের নম্বরটাতে বারবার হাত উঠে যায়। খুব ইচ্ছে করছে আজও ফোন দিতে এই নির্জন ছাদে করিম সাহেবের সাথে কথা বলতে খারাপ লাগবে না ।
করিম সাহেব কী ফোন ধরবেন ? ফোনটা বাজছে । নির্ঘুম কণ্ঠ অবাক করে করে দিয়ে বললো, ঘুমাসনি, কলি ?
না ।
কেনো ?
ঘুম আসে না ।
কী হয়েছে তোর ?
জানি না !
কোথায় আছিস ?
ছাঁদে,
এতো রাতে আবার কেনো ছাদে উঠেছিস ?
আপনি বোঝেন না কিছু ?
কলি
বলেন ,
অনেকদিন রবি ঠাকুরের গান শুনি না, তুই ছোট বেলায় খুব গাইতিস
তোমার খোলা হাওয়ায়…………গাইবি ?
শুনবেন ?
হা।
আমি কাঁপছি, কণ্ঠ উঠছে না, তবু বহু কষ্টে গেয়ে উঠলাম
তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে
টুকরো করে কাছি,
আমি ডুবতে রাজি আছি ।
তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে…………
তোমার খোলা হাওয়া……
সকাল আমার গেলো মিছে……বিকেল যে যায় তারি পিছেগো
রেখো না আর, বেঁধো না আর
কুলের কাছাকাছি আমি ডুবতে রাজি আছি, আমি ডুবতে রাজি আছি ।
তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে তোমার খোলা হাওয়া ,
মাঝির লাগি আছি জাগি সকল রাত্রিবেলা
ঢেউ গুলো যে আমায় নিয়ে করে কেবল খেলা
মাঝির লাগি আছি জাগি সকল রাত্রিবেলা
ঢেউ গুলো যে আমায় নিয়ে করে কেবল খেলা ।
ঝড়কে আমি করবো মিতে, ডরবো না তার ভ্রুকুটিতে……
দাও ছেড়ে দাও ওগো আমি তুফান পেলে বাঁচি
আমি ডুবতে রাজি আছি, আমি ডুবতে রাজি আছি ।
তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে ………।
করিম সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কলি পৃথিবীর অনেক অসমাঞ্জস্যতাকে আমাদের এড়িয়ে চলতে হয়। খুব ইচ্ছে করে তোকেও বলি
কিছু কথা। কিন্তু সব কথা সবার জন্য না। তোর সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। আমি তোর বাবার বন্ধু এই কথা গুলো আমার মাথা থেকে বের হয় না। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করি। ইয়োগা কর। আত্ম নিয়ন্ত্রণে আন। সব দেখিস পরিস্কার হয়ে যাবে। মানুষ হিসেবে আমরা আসলে অসম্ভব সব কিছু কামনা করি। এটাই আমাদের বিভ্রান্তি। বিভ্রান্তি থেকে বের হতে আত্মনিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই।
এতো রাতে আমার ভালো লাগছিলো না করিম সাহেবের বক্তব্য শুনতে। সব সত্যের মধ্যে আরও কিছু সত্য লুকিয়ে থাকে মানুষের অবচেতন মনে।
সেই সত্য অন্ধ। অকাট্য যুক্তি প্রমাণ দিয়ে তাকে দূরে ঠেলে ফেলানো সম্ভব নয়। বহুদিন থেকে আমার অবচেতন মনে যে ভালো লাগা জমেছিল তাকেতো অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
অস্বীকার করা যেমন অসম্ভব তেমনি অবচেতন মনে করিম সাহেবের প্রতি যে,আক্রোশ তৈরি হয়েছে তাকেও অস্বীকার করা সম্ভব নয়। আমার ভিতরের কলিটা এখন করিম সাহেবকে ভালো বাসে না, বিতৃষ্ণায় ভরে থাকে। কিন্তু কলির যে হারলে চলবে না। জিতেই ফিরে আসতে হবে। এই আমার হেরে যাওয়া মানে নিজেকে সব সময় করিম সাহেবের নিকট ছোট করে রাখা। কিন্তু করিম সাহেবের সামনে আমি মাথা উঁচু করে চলতে চাই।
ফোনের উপর আমারও দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়লো। বললাম, আমার প্রেম তো দুদিনের নয়।
করিম সাহেব বিছানা থেকে উঠলেন বোধ হয়। হাঁটছেন তিনি। হয়তো অন্য ঘরে আসলেন।
বললেন, কলি
— জ্বি
— সম্পর্ক যা ছিলো সেটাই তো ভালো ছিলো
— ভালো মন্দ বিচার করে প্রেম হয় না, সাংবাদিক
— কিন্তু
— কোনো কিন্তু আমি শুনতে চাই না, সাংবাদিক
— তাহলে?
—– লাভ ইউ বলেন
— এখনই?
—- হুম
—- এটা বলা কী জরুরী?
—-হা
—- লাভ ইউ কলি।
সাংবাদিক আবেগাপ্লুত হয়ে গেছে। আর্দ্র কণ্ঠে বললেন, কলি।
— বলুন
—- এর পরিণতি?
—-কিছুই না
—- তবে?
আমি কিছুক্ষণ নিরব থেকে ফোন কেটে দিলাম। এ ছিলো আমার নিরব প্রতিশোধ। মানুষের ভিতরে অদ্ভুত রকম আক্রোশ কাজ করে। আক্রোশের কারণ যখন মিটে যায় তখন তৃপ্তি লাগে মনে। অনেক তৃপ্তিতে ছাদ থেকে নামলাম। জানি কাল থেকে করিম সাহেব আমাকে দেখলে মাথা নিচু করে চলবে।
চলবে————–
মা এসেছেন । নীচে নীম তলায় মোড়া পেতে বসে আছেন । খবর দিলো ফেদি । মা আসবেন ঢাক বাজবে না। গেটে ফিতে কাটা হবে না। নিরবে আসবেন। চোরের মতো। অথচ এখানে তার দাপিয়ে সাড়া জাগিয়ে আসার কথা ছিলো। অধিকার ছেড়ে দিয়ে সেই অধিকার ফলানো আর সাজে না। সরাসরি আমার রুমে না এসে খবর পাঠিয়েছেন তিনি দেখা করবেন এর থেকে বিড়ম্বনা আর কী হতে পারে। ফেদিকে বললাম, মা এসেছে তুই জানিস, তোকে বললো কে?
ফেদি বললো, আমাকে বিলকিস খালা বললো
—তাহলে তুই ডাকতে আসলি কেনো ?
——বিলকিস খালা পাঠালো ।
মা এসেছে । এই বিশাল বাড়ির রানী এসেছেন, বসে আছেন নীম তলায় । উপরে আসলে কী হতো । এর প্রতি তার আজ আর অধিকার নেই ! বাবাকে খবর দেওয়া জরুরি। দিলেই বা বাবা কী করবেন!
তবু্ও প্রাণের ভিতর উসখুস করছে। ফেদিকে বললাম, ফেদি ।
—-বলেন, আফা ,
—–যা বাবাকে খবর দে, বল মা এসেছে, আচ্ছা আমার মায়ের নাম জানিস তো ? যেয়ে বল রিতি এসেছে !
ফেদি বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকালো । সে খবর দিতে চায় না। ভাব দেখে মনে হয় ওর প্রতিদ্বন্দ্বী এসেছে। কষে একটা থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু ওরই বা দোষ কী! বাবা যদি রিতির আসনে আর কাউকেই বসাতেই চায় বাবার অপরাধ কোথায়। অবশ্য তাই বলে বাড়ির কাজের মেয়েকে বরদাস্ত করা যায় না।
—–শুনতে পাচ্ছিস না, ফেদি
—–জ্বী, আফা ।
—–যা, বাবাকে বল, রিতি নামের এক মহিলা নীম তলায় মোড়া পেতে বসে আছে ।
—-আফা ।
—–বল ,
—–আপনে খবরটা দ্যান !
—–তোর অসুবিধা কোথায় ?
ফেদি দাঁড়িয়ে আছে , আমি মায়ের দেওয়া সাদার উপরে খয়েরী কাজ করা জামাটা খুঁজছিলাম, মাকে দেখাতে চাচ্ছি আমি সারাক্ষণ মাকে জড়িয়ে থাকি । ফেদি নড়ছে না । বললাম, ফেদি কাছে আয় তো ।
ফেদি কাছে আসতেই ঠাস করে ওর মুখে একটা চড় দিলাম । ফেদি মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে । আমি রুক্ষ্ম স্বরে বললাম, যা, বাবাকে খবরটা দে ! আর মনে রাখিস তুই আমার দাসী, আমার আদেশ চুড়ান্ত। ভুলে যাসনে কোনো পুরুষের কোলে শুলেই তার বউ হওয়া যায়। বেশ্যা তারা,বুঝলি বেশ্যা! যাহ এবার বাবাকে যেয়ে বল কলি আপার মা এসেছে।
ফেদি ধীর পায়ে বাবার রূমের দিকে যাচ্ছে । জামাটা পেয়ে গেলাম, পরে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম । ঠোঁটে সুন্দর করে লিপস্টিক লাগালাম, চোখে কাজল । যেনো, কণে দেখতে এসেছে কেউ ।
সিঁড়ি বেয়ে নামছি, পাটা চলছে না, নীম তলায় এক মহিলা বসে আছেন, তিনি আমার মা হন ।
মায়ের জন্য তার মেয়ে মায়ের প্রিয় সালোয়ার কামিজ পরেছে। কেমন যেন নিজেকে অচেনা লাগছে। আমি যে মাঝে মাঝে মেয়ে হয়ে উঠি। প্রয়োজনে আমার ভিতরও হিংস্রতা জেগে ওঠে।
নীমতলায় রিতি নামের একজন মহিলা বসে আছে। এক সময়কার আনন্দ ভিলার মহারানী এখন অপরিচিত মানুষের মতো এবাড়ির ড্রয়িং রুমে ও জায়গা হয়নি। হয়তো ড্রয়িং রুমে গেলে তাকে কেউ নিষেধ করতো না, বাবার রুমে যেয়ে বাবার সামনে যেয়ে বসলেও কেউ বাঁধা দিতো না। এ বাড়ির সব কিছু ভেঙে তছনছ করে ফেললেও কেউ বলতো না, কেনো ভাঙছো এসব?
কিন্তু রিতি নামের এই মহিলাটা আত্মহংকারী। প্রচণ্ড হিপোক্রেট। ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না। আমি অবাক হয়ে দেখলাম। অত্যন্ত শান্ত নির্লিপ্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাত পা কাঁপছে না। কোনো রকম সংকোচ অস্বস্তি কাজ করছে না।
সেই লম্বাটে মুখে সামান্য মাংস লেগেছে। ভারি ভারি গর্জিয়াছ লাগছে। নীল রঙের একটি শাড়ি পরেছে। খুব ম্যাচিং। কানের দুলে যে পাথর তাও নীল রঙের । লম্বা চুল কোমর ছাড়িয়ে প্রায় মাটি ছুঁয়েছে। চেহারার ভিতর কোনো ক্লান্তি অবসন্নতা নেই। ঠোঁটের উপর পাতলা লিপস্টিক। মার্জিত সাজগোজ। অসাধারণ লাগছে। বাবা এতো সুন্দর মানুষটাকে সহজে হারিয়ে ফেললো! আমার মন মায়ের মতো শক্ত নয়। দুচোখ ছাপিয়ে জলের ঢল উঠলো।
মা দুহাত বাড়ালেন। আমি ধীর পায়ে মায়ের কাছে গেলাম। মায়ের পায়ের কাছে বসে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা খুব যত্নের সাথে আমাকে আগলে ধরে রাখলেন। তারপর শাড়ির আঁচল তুলে আমার চোখ মুছিয়ে দিলেন। মার মুখে ম্লান হাসি।
মায়ের মুখ খুব কাছ থেকে দেখছি। অদ্ভুত দৃঢ়তা সারা মুখে খেলা করছে। ভুল হয়েছে অথবা ভুল করেছে এরকম কোনো ভাব মুখের কোথাও নেই।
এই বাড়ির কেউ নয় যেন। আমাকে মা তার দুটো টানা টানা চোখে দেখছে। আর আমি আমার মাকে। প্রচণ্ড কান্না আসছে। কিন্তু জোর করছি নিজের সাথে।
মায়ের চোখে অদ্ভুত চাহনী ,ড্যাব ড্যাব চোখে মা আমাকে দেখছেন, মা অনেক সুন্দর হয়েছে, ছোট মানুষের মত লাগছে, যেন কিশোরী এক । এত বয়স কমেছে মার ! মাকী এখন অনেক সুখে আছে ? দত্ত কাকু কী মায়ের সকল দুঃখ শুষে নিয়েছেন ! মা আমাকে আমার হাত ধরে পাশে বসানেল, সেজেছিস কেনো এত ?
অদ্ভত প্রশ্ন, আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, এমনি ।
মাষ্টার্স শেষ, বিয়ের কথা ভাবছে না তোর বাবা?
আমি অবাক হবার ভান করলাম। কিছুটা অভিনয় ও।বললাম, বাবার বিয়ের কথা ?
—খুব ফাজিল হয়েছিস নারে, তোর বিয়ের কথা ?
ফেদি পাশে দাঁড়িয়ে এসেছে কখন। টের পাইনি ফেদি ফিক করে হেসে উঠলো, মা কঠিন চোখে তাকিয়ে বললো, ছ্যামড়িটা কে ?
বিলকিস খালা নাক কুচকে বললো, কলির দেখা শোনার জন্য রেখেছিলেন এখন তো এ বাড়ির কর্তাকেই ——
কথা কয়টি বলে খালা থেমে গেলো
মা চুপ হয়ে গেলেন । অন্য প্রসঙ্গ টেনে এনে
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার হাতে একটা ছেলে আছে,তোর দত্ত কাকুর বন্ধুর ছেলে, ছেলে ডাক্তার ।
—–আমি আপাতত বিয়ের কথা ভাবছি না, মা ?
——কেনো ?
——ভাল্লাগে না।
—–কী ভালো লাগে না ?
—–এই বিয়ে বিয়ে খেলা !
মা ম্লান চোখে তাকালো । মৃদু স্বরে বললো,জীবনে সব্বাই সব কিছু পাই না, উদাহরণ ধরে জীবন চলেও না,কলি ।তোর বয়স হচ্ছে, তোর বাবার সাথে কী এ ব্যাপারে আমি কথা বলবো ?
——তোমার লজ্জা করবে না ?
—–মানে ?
——এই যে ছাড়াছাড়ি, তারপর আবার তার সাথে কথা ?
—-মেয়ে তো আমাদের দুজনের ,না ?
আমার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
হয়তো,আমার বাবা এখনও আছেন, মা আছেন কীনা জানি না ।
—–কলি ?
——-বলো
——-জীবনের কিছু সিদ্ধান্ত এভাবেই নিতে হয়,তোর বাবা আমাকে কী দিয়েছিলো ?
——আমি কী করে জানবো ?
—এখন জানবি না, কিন্তু একদিন বুঝবি, সামান্য শান্তির জন্য আমি ঘর ছাড়িনি, একটু সুখও চেয়েছিলাম ।
—–তুমি সুখে আছো তাহলে ?
মা উঠে দাঁড়ালো, আমাকে বুকে টেনে নিলো, আমি জড়োসড় হয়ে মার বুকের কাছে গেলাম । মা কাঁদছে, আমি টের পাচ্ছি । আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মার কান্না মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, করিম সাহেবকে আমি রাতে গান শুনাই ।তাকে আমি পছন্দ করি ।
মা হতভম্ব হয়ে চোখ মুছলেন । তারপর ঠাস করে আমার মুখে চড় মারলেন । বোধ হয় মা এখন বাবা হয়ে উঠেছেন !
বাবা কখন বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন জানি না, খুক করে কেশে উঠলেন বাবা । দুহাতে মুখ ঢেকে দৌঁড়ে উপরে উঠলেন । বাবা কাঁদছেন। তার রিতির জন্য কাঁদছেন। আমি খুব রুক্ষ্ম স্বরে মাকে বললাম,মিসেস দত্ত, আপনি এবার যেতে পারেন ।
মা, ঘুরে দাঁড়ালেন, তারপর ধীর পায়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন । আমি পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছি, আমি জানি, মা প্রচন্ড আঘাত পেয়েছেন, হয়তো খুব কাঁদবেন আজ ।
চলবে———–
Leave a Reply