আমার ছেলের প্রতি আমার উচ্চ মাত্রার আত্মবিশ্বাস। আমার মনে হয়ে তাকে অবলম্বনহীন কোনো গভীর সমুদ্রের তলদেশে একা ছেড়ে আসলে সে কোনো না কোনো উপায় বের করে নির্ধারিত সময়ে ঠিকই তীর পৌঁছে যাবে আল্লাহর রহমতে।
ছেলে মানসিকভাবে ভীষণ স্ট্রং, কিন্তু শারিরীকভাবে যে কী পরিমান দুর্বল বলে বুঝাতে পারব না। দুর্বলতার অবশ্য দৃশ্যমান কোনো লক্ষন নেই, ওজনও ঠিক আছে। মায়ের প্রত্যাশা মতো স্বাস্থ্যবান নয় হয়তো এই কারণেই দুর্বল মনে হয়। এই দুর্বল ছেলেটার প্রতি কেন আমার এত আত্মবিশ্বাস আমার জানা নেই।
আমি ছেলেরে হোম ওয়ার্ক করাই না, একা করতে দেই। কেন যেন মনে হয় সে পারবে! আমি তাকে স্কুলের জন্য রেডি করেও দেই না। সে একাই রেডি হয়। সে ড্রয়িং করার সময়ও আমি পাশে থাকি না। থাকলেও অবশ্য লাভ নেই, ড্রয়িং এ আমার অবস্থান আতুড় ঘরের শিশুর মতো। যার কাছে সরল রেখা, বক্র রেখা, বৃত্ত, হাতের ব্যায়াম সব এক রকম গোল গোল মনে হয়। ড্রয়িং ক্লাসে আমার নিজেকে কেমন যেন চিন্তা শূণ্য অসহায় মানুষ মনে হয়। কিভাবে হাতের কৌশলে একটা চিত্র জীবন্ত হয়ে উঠে আমার মাথায় ধরে না এসব।
আমার মেয়ে মাশাল্লাহ শারিরীকভাবে ছেলের তুলনায় স্ট্রং। সে স্কুলে ২০০ মিটার দৌড়ে প্রথম হয়েছে। অথচ তার প্রতি আমার কোনো কনফিডেন্ট নেই। আমার মনে হয় তাকে খাবার মুখে তুলে দিলে সে না চিবিয়ে বসে থাকবে। মা গিলতে বলছে না-কি চিবাতে বলছে এটা ভেবে সে দ্বিধান্বিত হবে। এটা অবশ্য আমার দোষ নয়।
আমি যদি স্কুলে যাওয়ার সময় হোমাকে বলি,
” হোমা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে যাও, একদম সময় নেই।”
দশ মিনিট পর এসে দেখি সে আগের জায়গায় বসে আছে। আমি তখন যদি রাগান্বিত হয়ে বলি,
“কী ব্যাপার হুমা, এখনো কাপড় পরোনি!”
” কোনটা আগে পরব, জামা না-কি প্যান্ট তুমি তো কিছু বলোনি।”
বাড়ির কাজ করার সময় যদি বলি,
” হোমা যোগ অংকগুলো করে ফেল, আমি রান্নাঘরে আছি।”
সে বই খাতা নিয়ে বসে থাকবে, দুষ্টামি করবে, খেলবে।
একঘন্টা পর এসে যদি বলি,
কী ব্যাপার এখনো লেখা শুরু করোনি?
” খাতার ডান সাইড থেকে লিখব না-কি বাম সাইড থেকে, তুমি তো কিছু বলোনি, সেকারণে লিখিনি।”
হাসব না-কি কাঁদব মাথায় আসে না। এগুলো তো ছোট উদাহরন। এরকম অসংখ্য ঠুনকো বিষয়ে মারাত্বক উদাহরন আছে হুমায়রার আমার প্রতি নির্ভরশীলতার।
স্কুলে নিয়ে গেলে গেইট পার হওয়ার সময় দুই গালে অসংখ্য চুমু দেবে, জড়িয়ে ধরবে। কয়েক কদম সামনে গিয়ে আবার দৌড়ে এসে টলটলে চোখে জড়িয়ে ধরে বলবে,
” মা, তুমি কিন্তু যেও না। আমি প্রতি ঘন্টায় বারান্দায় এসে তোমাকে গেইটের সামনে খুঁজব।”
তার অতিরিক্ত মাতৃভক্তিতে আমি যথেষ্ট বিরক্ত। মাঝে মাঝে বকাও দেই।
” মেয়ে তোমাকে পছন্দ করে, তোমার উপর ডিপেন্ড করে, এটা তো ভালো। এতো রাগ করো কেন?”
মায়ের প্রতি সন্তানের নির্ভরশীলতা, সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা এটা তো সূর্য উঠা, পাখি ডাকা, ভোর হওয়া, রাত হওয়ার মতোই স্বাভাবিক।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে হুমায়রার এই সমস্যা তো জেনেটিক।
তার বাবা, চাচারা ষাট বছর বয়সে মায়ের অনুমতি ছাড়া ঘর থেকেও বের হয় না। তারা কেউই কিন্তু ব্যক্তিত্বহীন নয়। সবাই আল্লাহর রহমতে মানসিক ও শারিরীকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু…
আপনি তাদের মাতৃভক্তির গল্প শুনলে হাঁফিয়ে উঠবেন। চোখের সামনে দেখলে ক্লান্ত হয়ে যাবেন। অথচ তারা দিব্যি মনের আনন্দে সেটা উপভোগ করছে।
পর্যাপ্ত পরিমান জায়গা ও টাকা থাকার পরও আমরা সবাই এক ঘরে থাকি।
” তোমরা এখনো ঘর করছ না কেন?”
না সেটা কেন থাকবে। আলাদা ঘরের কথা বলছি,
” কীভাবে করব? আম্মা এখনো তো কিছু বলছে না।”
যাই হোক সে ফিরিস্তি বর্ণনা আর না করি।
আমি আতঙ্কে আছি আমার মেয়েকে বিয়ে দিলে সে হয়তো ফুল শয্যার ঘরে নতুন বরকে বলবে,
” তুমি একটু পরে আমার পাশে বসো, আমি এক ফাঁকে গিয়ে আমার মায়ের অনুমতি নিয়ে আসি। আমার পাশে তুমি বসতে পারবে কি-না!”
আমার ছেলে সিরিয়াস অবাধ্যতা করে আমার। সে নিজের ইচ্ছে পড়বে, নিজের ইচ্ছে আঁকবে, নিজের ইচ্ছে খেলবে। আমার অনুমতির ধার ধারে না।
উল্টো আমি কোনো অর্ডার করলেও সেটা তার পছন্দ না হলে সে জীবনেও করবে না।
আমি তার এই অবাধ্যতা উপভোগ করি।
একই মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া এক একটা সন্তান এক এক রকম।
Leave a Reply