আমি তখন কাজ করি খবর হাউজের সাপ্তাহিক ছয়াছন্দে। অফিসটা শান্তিনগরে। ছায়াছন্দ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক শহীদুল হক খান। যদিও পত্রিকায় এই পরিচয়টা মুদ্রিত হয় না। খবর হাউজের সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোয় সম্পাদক হিশেবে মিজানুর রহমান মিজান কিংবা ফুল্লরা বেগম ফ্লোরার নাম মুদ্রিত হওয়ার রেওয়াজ।
সময়কাল আশির দশক।
ছায়াছন্দের আমি সহকারী সম্পাদক। শহীদ ভাই আমার বস। যদিও পত্রিকায় কোনো বসিং চলে না। তাছাড়া শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করার মজাও অনেক। মহা ইন্টারেস্টিং একজন মানুষ এই শহীদুল হক খান। চলচ্চিত্র সাংবাদিক পরিচয়ের চাইতে বড় পরিচয় তিনি একজন বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালকও। ছুটির ফাঁদে এবং কলমীলতা তাঁর পরিচালিত দু’টি আলোচিত সিনেমা।
শহীদুল হক খানের খরচের হাতটা ভয়ংকর রকমের। ওখানে কোনো লাগাম ছিলো না। বিশেষ করে অন্যকে খাওয়ানোর ব্যাপারে মানুষটা দিল দরিয়া টাইপের। অন্যকে খাইয়ে বিমলানন্দ লাভ করতেন শহীদ ভাই। পকেটে পাঁচ হাজার থাকলে পাঁচ হাজারই খরচ করে ফেলতেন নির্দ্বিধায়। পত্রিকায় জয়েন করেই চিত্রবাংলার গোলাম কিবরিয়া এবং আমাকে নিয়ে লাঞ্চ করতে গেছেন কাছাকাছি কোনো রেস্টুরেন্টে। তারপর সেই রেস্টুরেন্টে সেইদিনের সবচে বড় মাছটার তিন পিস অর্ডার করে বসতেন। একজনের পক্ষে এক পিস হজম করাই দুষ্কর এমন পেল্লায় সাইজের মাছ। দু’তিনদিন পর আমি আর যেতে রাজি হইনি দুপুরের সেই লাঞ্চ অভিযানে। অনেক জোরাজুরি অবশ্য করেছিলেন তিনি। কিন্তু আমি যাইনি। বলেছি–দিস ইজ টু মাচ শহীদ ভাই!
সেইরকম সময়ের গল্প।
একদিন দুপুর বারোটার দিকে ছায়াছন্দ অফিসে আমাদের ছায়াছন্দের কামরায় আমি একলা একা আমার টেবিলে ঘাড় গুঁজে লিখছি। সহকর্মীরা আউটডোরে যার যার এসাইনমেন্ট অনুযায়ী কাজ করছে। দুপুরে আমাকে রামপুরা বিটিভিতে যেতে হবে। ছায়াছন্দে লেখালেখির বাইরে বিটিভিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট লেখা, নাটক লেখা, রিহার্সাল-রেকর্ডিং-সম্পাদনা ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় আমাকে। কারণ শুধু ছায়াছন্দের মাইনেতে সংসার চলে না। আমার সংসার খরচের মূল টাকাটা আমি আয় করি বিটিভি থেকেই। আর শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার বোঝাপড়াটা অন্যরকমের। আমি অফিসে কখন আসবো কখন যাবো সেই বিষয়ে তিনি ইন্টারফেয়ার করেন না। আমার ওপর অর্পিত প্রতি সপ্তাহের দায়িত্বটা সময় মতো পালন করলেই হলো। চাকরিতে জয়েন করার সময়েই শহীন ভাইয়ের সঙ্গে এই ফয়সালাটা আমি করে নিয়েছিলাম।
সেই দুপুরে আমি যখন নিবিষ্টচিত্তে নিউজ প্রিন্টের প্যাডে ক্ষিপ্র গতিতে সস্তা ইকনো বলপেনে লিখছি পাতার পর পাতা, তখন কেউ একজন দরোজায় এসে দাঁড়ালেন–আইচ্ছা এইটাই তো ছহিদ ভাইয়ের অফিস নাকি?
একেবারে অরিজিনাল ঢাকাইয়া এক্সেন্ট শুনে আমি দৃষ্টি ফেরাই বাঁ দিকে দরোজার প্রতি–
মেদহীন লম্বা গড়ন। মাথায় কোঁকড়া এবং খানিকটা কার্লি উস্কোখুস্কো চুল। দু’দিকে সাইডপকেট সমৃদ্ধ জলপাই রঙের গ্যাভার্ডিন প্যান্ট লোকটার পরনে। কিছুটা খাকি ধরণের হালকা রঙের ফুলস্লিভ শার্টের বুকের বোতাম তিন চারটেই খোলা। গলায় একটা চেইন ঝুলছে। কাঁধে একটা ছোট্ট ব্যাগ। লোকটার গায়ের রঙ আর শারীরিক গঠন গ্রিক ভাস্কর্যের মতো পেটানো। লোকটাকে প্রথম দেখায় গুন্ডা মনে হয় না। মনে হয় আর্ট কলেজ পড়ুয়া কিংবা সদ্য পাশ করা একজন বোহেমিয়ান আর্টিস্ট। আমার চোখে চোখ রেখে একই প্রশ্ন আবার করলেন তিনি–এইটা ছহীদ ভাইরের অফিস না?
আমি না সূচক মাথা নাড়াই–এইটা শহীদ ভাইয়ের অফিস না, ছায়াছন্দের অফিস।
স্মার্ট লোকটা কিঞ্চিৎ টাল খেলেন–অইটাই, ছহীদ ভাইয়ের ছায়াছন্দ অফিস।
ফের মাথা নাড়াই আমি–না, এইটা মিজানুর রহমান মিজানের ছায়াছন্দ অফিস শহীদুল খান খান এখানে চাকরি করেন।
লোকটা হেসে ফেললেন–আপ্নে ভাই মজা লিতাছেন! আমি তাইলে ঠিক জায়গাতেই আইছি! হালায় কৈ? আইজকা ঠিক পিটামু অরে।
শহীদ ভাইকে পিটানোর ঘোষণা শুনে উঠে দাঁড়ালাম আমি–জ্বি জ্বি আপনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন। আসেন আসেন ভেতরে আসেন। বসেন এইখানে। আমি আমার সামনে থাকা চেয়ারটার দিকে ইংগিত করি।
তিনি বসলেন। আমিও বসলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন–হালায় গেছে কৈ?
আমি বললাম–হালায় তো আইজকা অখন্তরি আহে নাইক্কা! তয় আয়া পড়বো। আপ্নে বহেন। ইট্টু অপেক্ষা করেন। আপ্নেরে চা খিলাই। এইটাই তাঁর আহোনের টাইম।
আমার কণ্ঠে পিওর ঢাকাইয়া সংলাপ শুনে ভীষণ উল্লসিত লোকটা–আপ্নে ভাই জিনিছ একখান! ক্যাঠা আপ্নে ভাইজান? আপ্নের পরিচয়টা?
–ছহীদ ভাই আমার বস। আমি তাঁর কলিগ। জনাবের পরিচয়টা? আর আপ্নে শহীদ ভাইরে পিটাইতে চাইতাছেন ক্যালা? কী করছে ওস্তাদে?
–আমার নাম নাজির আহমদ। আর্টিস্ট নাজির। ফিলিমের পোস্টার আর বিজ্ঞাপনের ডিজাইন করি। ট্যাকা পাই ছহীদ ভাইয়ের কাছে। আইজকা দিমু কাইলকা দিমু কইয়া বহুত ঘুরাইছে। আইজকা অরে খাইচি।
শুনে আমি খুশি হয়ে উঠলাম–ঈমানে কৈ ভাইজান ছহীদ ভাইরে তাঁর অফিসে আইসা কেউ একজন পিটাইতাছে এইরম একটা সিন জিন্দেগিতে বারবার আহে না। ঐ দুইকাপ চা দে রে জলদি……আমি হাঁক দিই পিওনকে।
পিওন চা দিয়ে গেলো। তিনি চা পান করতে করতে আমাকে নীরিক্ষণ করছেন। দুইটা চুমুক দিয়েই আমাকে প্রশ্ন করলেন–আইচ্ছা আপ্নেও তাইলে আপ্নের বসের উপ্রে বিলা?
–না তো!
–আপ্নেরে কি দিগদারি পেরেশানি করে?
–না তো!
–তাইলে আপ্নে আপ্নের বসরে পিটানির কথা হুইন্যা খুছি হইলেন ক্যালা?
–খুশি হইলাম এই কারণে যে শহীদ ভাইকে কেউ পেটাতে পারবে না। মানুষকে সম্মোহিত করার অদ্ভুৎ ক্ষমতা আছে মানুষটার।
–বাজি লাগবার পারি আপ্নের লগে।
–বাজি লাইগেন না হারবেন। যাক। লাগাইলাম বাজি। তবে আমি চাই আপনি জেতেন। শহীদ ভাইকে কেউ মারছেন এমন একটা দৃশ্যের আমি সাক্ষী হতে চাই।
–আইজকা আপ্নের মনোবাছোনা পূর্ণ হৈবো।
কিছুক্ষণ পজ দিয়ে লোকটাকে চমকে দিতে পরের সংলাপটা ছুঁড়ে দিলাম আমি–কী অপূর্ব লেটারিং আপনার! আমি আপনার হাতের লেখার একজন গোপন অনুরাগী।
লোকটা আসলেই চমকে উঠলেন–আরে কন কি! আপ্নে আমার লেটারিং-এর কথা কইলেন?
–হ্যাঁ, ইত্তেফাকে ছাপা হওয়া সিনেমার বিজ্ঞাপনগুলোয় সিনেমার নাম মোটা কলমে অথবা তুলিতে আর পরিচালক এবং নায়ক নায়িকাদের নাম চিকন কলমে লেখেন আপনি। তারপর বিজ্ঞাপনের কোণা কাঞ্চিতে দুই লাইনে ছোট্ট করে আপনি আপনার নামটা খোদাই করে দেন। কী যে অপূর্ব একেকটা বিজ্ঞাপন! বিজ্ঞাপনের লে আউট, নায়ক নায়িকার ছবি সাঁটানো আর আপনার দুর্দান্ত লেটারিং-এর ম্যাজিকে বিজ্ঞাপনগুলো কী যে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে! আমি তো আপ্নের মানে আপ্নের লেটারিং-এর একজন ডেঞ্জারাস ভক্ত ভাইজান!
আমার লেকচারে হতভম্ব তিনি। বললেন–এতো বচ্ছর ধইরা এই কাম করতাছি কেউ কুনুদিন আপ্নের লাহান রিকগনাইজ করে নাই আমারে। প্রশংসা তো দূর কি বাৎ ক্যাঠা আপ্নে ভাইজান? নামটা তো কইলেন না!
–আমারে চিনবেন না আপ্নে। আমার নাম লুৎফর রহমান রিটন।
হেসে ফেললেন তিনি–আরে ভাইজান আপ্নেই পোলাপাইন গো লিগা ছড়া অরা লেহেন নিকি? আপ্নে তো মিয়া ফেমাছ আদমি। আপ্নের নাম বহুত দেখছি পত্রিকায়। আর আপ্নের চেহারাটাও কেমুন চিনা চিনা লাগে। অনেক দেখছি আপ্নেরে। মাগার কৈ দেখছি মনে নাই।
আমি বললাম–জীবনে একবার আপ্নের কলমে আপ্নের হাতের লেখায় নিজের নামটা দেখবার চাই ওস্তাদ। দিবেন্নি লেইখা?
–কন কী! অক্ষণই দিমু। দেন দেন কাগজ দেন লেইখ্যা দেই। আপ্নে তো আমার দিলখোস কইরা দিলেন ভাইজান! আর্ট কার্ড হইলে ভালো হয়। নাইলে যে কুনু শাদা কাগজেই চলবো।
আমি ড্রয়ার থেকে কয়েকটা বড় খাম বের করলাম। আমন্ত্রণপত্র। এক পিঠ মুদ্রিত অন্য পিঠ শাদা।
তিনি তাঁর ব্যাগ থেকে সেটস্স্কয়ার পেন্সিল ইরেজার ইত্যাদি বের করলেন। তারপর রুল টেনে পেন্সিলে আমার নামটা লিখলেন। বানান নিশ্চিত হয়ে অতঃপর মোটা মার্কার পেন, মাঝারি সিগনেচার পেন আর চিকন ডটপেনে চকচকে কালো পেলিক্যান কালিতে আমার নামটা লিখলেন, তিনবার। লিখে ফুঁ দিয়ে কালিটা দ্রুত শুকালেন।
মহা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলাম আমি–
–কাইয়ুম চোধুরী-হাশেম খান-কাজি হাসান হাবিব-হামিদুল ইসলাম আর আপ্নের হাতের লেখা বা লেটারিং আমার প্রিয়।
শুনে কী যে খুশি হলেন নাজির আহমদ!
আমাদের এইসব কথাবার্তার ফাঁকে শহীদুল হক খান প্রবেশ করলেন কক্ষে। এবং প্রবেশ করতে করতে শহীদ ভাই উচ্চ স্বরে বলতে থাকলেন–আমাদের অফিসে আজকে মহা বিখ্যাত একজন আর্টিস্টের পদধুলি পড়েছে। রিটন আজকে দুপুরে সম্মানিত অতিথিকে নিয়ে আমাদের লাঞ্চটা আমরা কোথায় করবো এবং ম্যেনুতে কি কি আইটেম থাকবে সেটা নির্ধারণ করবে তুমি।
বলতে বলতে তিনি তাঁর হাতের কাগজপত্র-ব্যাগ ইত্যাদি তাঁর টেবিলের ওপর রাখলেন।
আর্টিস্ট নাজির ঘাড় ঘুরিয়ে শহীদ ভাইকে দেখলেন–আমি আপ্নের লগে লাঞ্চ করতে আসি নাই। আইজকা একটা দফারফা কৈরা ছাড়ুম ছহীদ ভাই। বহুত হৈছে আর না! আইজকা ফাইনাল।
শহীদ ভাই তাঁর টেবিল ছেড়ে এসে আমার টেবিলের অপজিটে থাকা নাজির আহমদের কাঁধে হাতটা রাখলেন–আসেন আপনি আমার সঙ্গে।
শহীদ ভাইয়ের হাসিমুখ।
কিন্তু নাজির আহমদের চেহারায় রাগান্বিত ও উত্তেজিত এক্সপ্রেশন।
ওরা দু’জন কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন।
তিন মিনিটের মাথায় দেখলাম ফিরে আসছেন দু’জনে।
দু’জনের কাঁধে দু’জনের হাত। অতি হাস্যোজ্জ্বল দু’জন মানুষ এগিয়ে আসছেন আমাদের কক্ষের দিকে।
এইবার নাজির আহমদ গিয়ে বসেছেন শহীদ ভাইয়ের টেবিলের সামনে থাকা চেয়ারে।
আমার দিকে একটিবারও তাকাচ্ছেন না আর্টিস্ট নাজির আহমদ। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা–
–এই যে ভাইজান যাওনের স্যুম বাজির ট্যাকাটা রাইখ্যা যাইয়েন কৈলাম……হাহ্ হাহ্ হাহ্
অটোয়া ০৭ জুন ২০২১
ক্যাপশন/ ‘ফেরারী’ সিনেমার পোস্টারে নাজির আহমদের সেই অপূর্ব লেটারিং-এর নমুনা।
Leave a Reply