আমি কেনে বা পিরীতিরে করলাম।
আমার ভাবতে জনম গেলরে,
আমার কানতে জনম গেলরে।
সে ত সিন্তার সিন্দুর নয় তারে আমি কপালে পরিব,
সে ত ধান নয় চাউল নয় তারে আমি ডোলেতে ভরিবরে,
আমি কেনেবা পিরীতিরে করলাম।
আগে যদি জানতাম আমি প্রেমের এত জ্বালা,
ঘর করতাম কদম্বতলা, রহিতাম একেলারে ;
আমি কেনেবা পিরীতিরে করলাম…”
মধুর কন্ঠে এই গান গাইতেন আমার দাদী। এটা আমাদের অঞ্চলের মুর্শিদী গান। দাদীর কন্ঠে এতো দরদ আর গানের কথায় এতো মায়া, আমাদের চোখ জলে ভরে যেত। মনটা হতো ভার। প্রেমে আনন্দের চেয়ে বিচ্ছেদের বেদনাই বেশি। কি ভাবতাম আর কি বুঝতাম মনে নেই, চোখ বেয়ে জল গড়াতো। গানের কথাগুলো কানে বেজেই যেত।
এখনো মন খারাপ হলেই সেই সুর বুকের মাঝে বেজে চলে। একটানা। আমি একলা কেঁদে যাই। নীরবে। গোপনে। কষ্ট কাউকে দেখাতে নেই সেটা কিভাবে যেন প্রকৃতি সবাইকে শিখিয়ে দেয়।
দাদী খুব হাসিখুশি ছিলেন। গোমরা মুখে কেউ তাঁকে দেখেনি কিন্তু গভীর বেদনার কোন গান গাইবার সময় তাঁর চোখও ছলোছলো হয়ে যেত। কি মমতা দিয়ে, হৃদয় দিয়ে গাইতেন। গ্রামের কারোর গায়েহলুদ, ক্ষীর খাওয়ানো, বিয়ে, খতনা, নাক কান ফোঁড়ানোর অনুষ্ঠানে দাদীকে জোর করে হলেও গাইতে নিয়ে যেত। মুগ্ধ হয়ে শুনতো সকলে। কোন গানে হেসে গড়াগড়ি, কোন গানে কেঁদে জারেজার। সেসব সেই কবেকার কথা! বেঁচে থাকলে দাদীর বয়স একশো পেরোতো কবেই।
আমার ছিল দীঘল চুল। ছেলেবেলা থেকেই। সাতসকালে গোসল করিয়ে দুপুরের রোদে পিঠ মেলে বসে বিলি কেটে কেটে সেই চুল শুকিয়ে দিতেন দাদী, যেন ভেজা চুলে ঠাণ্ডা না লেগে যায়। এরপর বিকেলে বসতেন তাঁর বাসনা (সুগন্ধি) তেলের শিশি নিয়ে। বারান্দার ঝিরিঝিরি বাতাসে পিড়ি পেতে বসে পরম যত্নে সেই তেল লাগিয়ে দিতেন আমার চুলের গোড়ায় গোড়ায়। তারপর হাতির দাঁতের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে বেণি বাঁধতে বাঁধতে দাদি “কমলা সুন্দরী” কাব্যের গান সুর করে গাইতেন-
“শ্রাবণ মাসেতে যেন কালো মেঘ সাজে,
দাগল-দিঘল কেশ বায়েতে বিরাজে।
কখন খোঁপা বান্ধে কন্যা কখন বান্ধে বেনি,
কূপে রঙ্গে সাজে কন্যা মদনমোহিনী…”
আমার দাদী সু্স্হ শরীরে দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন। স্বামীর ভালোবাসা, সন্তানদের যত্ন, নাতিদের আদর, পুতিদের মিষ্টিমুখে ভরা সংসার ছিল তাঁর। বেঁচে থাকার আনন্দ নিংড়ে নিয়ে বেঁচেছেন পৃথিবীতে। সম্মানের সাথে। তারপর, বেলাশেষে, একদিন নিঃশব্দে চলে গিয়েছেন। তাঁর ছাঁয়াটা কিন্তু ঠিকই আছে। মায়াটাও। আমার মনে। সযত্নে। আমি ভালোবাসায় সেই মায়া বেঁধে রাখি।
“উইড়া যায়রে হংস পক্ষি, পইড়া রয়রে ছায়া ;
দেশের মানুষ দেশে যাইব- কে করিবে মায়া…”
Leave a Reply