অক্টোবরের তিন তারিখটি আমার জীবনের মোড় পালটে দেয়া একটি বিশেষ দিন। এই দিনে শার্লির কোল আলো করে নদী এসেছিলো পৃথিবীতে। এবং এই দিনে নদী জন্মেছিলো বলেই আমিও বাবা হিশেবে আত্মপ্রকাশ করার গৌরব অর্জন করেছিলাম। শার্লিরও নবজন্ম ঘটেছিলো ‘মা’ হিশেবে।
করোনার কারণে নদী-ডেভিড-কিটক্যাট আর ক্যাটবেরির সঙ্গে দেখা হলো পাক্কা এক বছর নয় মাস পর। নদীরা হিউস্টনে থাকে আর নদীর মা শার্লিকে নিয়ে আমি থাকি অটোয়ায়।
বহু বছর ধরেই নদীর জন্মদিনে আমরা থাকি দুই দেশে। মাঝখানে থাকে কানাডা আমেরিকার সীমান্ত প্রাচীর। বহুদিন পর নদীর জন্মদিনে আমরা একসঙ্গে জড়ো হয়েছি! উপচে পড়া আনন্দে তাই টইটম্বুর আমি। হ্যাপি বার্থ ডে মামনি।
‘আমাদের ছোট নদী’ নামে একটা বই আছে আমার। চন্দ্রাবতী একাডেমি থেকে বেরিয়েছিলো। একজন তরুণ লেখকের প্রথম বাবা হবার বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার পাশাপাশি একটা ছোট্ট মেয়ের বড় হয়ে ওঠার আনন্দ-বেদনার উপাখ্যান আমি রচনা করেছিলাম। ওখানে নদীকে নিয়ে আমার অনেকগুলো গল্প আছে।
আমাকে লেখা নদীর চিঠির গল্পটা বলি আজ।–
০২
সেই ছোট্টবেলা থেকেই দুর্দান্ত স্মৃতিশক্তি নদীর। বিটিভির বিজ্ঞাপনগুলো মুখস্ত বলতো, যখন সে কথা বলতে শেখেনি তখন থেকেই। একটা পূর্ণ বাক্য বলতে না পারা নদী পুরো বিজ্ঞাপনটা হুবহু লাইন বাই লাইন বলে তাক লাগিয়ে দিতো সে আমাদের। বিটিভির ছায়াছন্দের কল্যাণে সিনেমার গানও মুখস্ত শোনাতো সে। ওর শেখা প্রথম গান—‘বাবা বলে গেলো আর কোনোদিন গান করো না/কেনো বলে গেলো, সেই কথাটি বলে গেলো না।’ আমজাদ হোসেনের ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ সিনেমার গান ছিলো সেটা। গেয়েছিলো শিশুশিল্পী শামীমা ইয়াসমিন দীবা নামের একটা মেয়ে। এই গানটা ভীষণ প্রিয় ছিলো নদীর। কারণ গানটায় ‘বাবা’র উল্লেখ আছে।
বিটিভিতে ঈদ উপলক্ষ্যে ছোটদের বিশেষ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান রচনা ও পরিচালনার দায়িত্ব পেলাম। প্রযোজক রিয়াজউদ্দিন বাদশা। প্রযোজক হিশেবে বাদশা ছিলেন দারূণ মেধাবী ও পরিশ্রমী। বড়দের আনন্দমেলা স্টাইলে আমরা অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনা করেছিলাম। অডিটোরিয়মভর্তি খুদে দর্শক এবং ওদের বাবা মায়েদের প্রাণবন্ত উপস্থিতিতে নানা রকম আইটেম ধারণ করা হচ্ছিলো ৩ নম্বর স্টুডিওতে। সর্বকনিষ্ঠ একজন খুদে পারফর্মার হিশেবে নদীকে কাজে লাগানোর চিন্তা করলাম। সিদ্ধান্ত হলো—অডিটোরিয়ামে দর্শকদের সামনে দাঁড়িয়ে নদী ওর প্রিয় ‘বাবা বলে গেলো’ গানটা গাইবে। কিন্তু বাদশা ভাই খানিকটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত—রেকর্ডিং-এর সময় নদী যদি বেঁকে বসে বা অডিটোরিয়ামভর্তি দর্শককে দেখে নদী যদি ঘাবড়ে যায়! আমি খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বললাম–আমি পাশে থাকলে নদী ভয় পাবে না।
কথাটা বাদশা ভাইয়ের মনঃপুত হলো। সিদ্ধান্ত হলো—স্টেজে আমি নদীর পাশে থাকবো। এমন ভাবে থাকবো যাতে অনুষ্ঠানের কোনো ছন্দপতন না ঘটে। আমাকে যেনো টিভি পর্দায় দেখা না যায়। পেছন থেকে সাইড থেকে এবং সামনা সামনি তিনটি ক্যামেরাকে বাদশা ভাই এমন পজিশনে স্ট্যান্ডবাই করে রাখলেন যাতে একটায় সমস্যা দেখা দিলে নদী জায়গা থেকে সরে গেলে অন্য পজিশনে থাকা ক্যামেরায় সেটা ম্যানেজ করে ফেলা যায়। শার্লি নদীকে স্টেজে আমার কাছে দিয়ে গেলো। আমি নদীর পাশে অবস্থান নিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম। এটা পূর্ব পরিকল্পিত ছিলো। যাতে আমাদের কথার সময় ওপর দিক থেকে ঝুলন্ত মাইক্রোফোনটাকে ক্যামেরা লেভেলের সামান্য উঁচুতে যথাস্থানে ফিক্সড করে ফেলা যায় দ্রুত। তাতে অডিও আসবে পারফেক্ট। রোল শুরু হলো। বাদশা ভাই বললেন—ফাইভ ফোর থ্রি টু ওয়ান জিরো একশান। আমি নদীকে বললাম—মামনি ‘বাবা বলে গেলো’ গানটা শোনা দেখি আমাকে! নদী মুহূর্ত বিলম্ব না করে ওর বাবার উদ্দেশ্যে মিষ্টি পবিত্র একটা কণ্ঠে গাইতে শুরু করলো—বাবা বলে গেলো আর কোনোদিন গান করো না…তারপর গান থামিয়ে সামনে দর্শসারিতে বসা ওর বয়েসী ছোট্ট একটা ছেলেকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ‘বাবুকে বলি বাবুকে’ বলেই ফের ফিরে এলো গানে—বাবা বলে গেলো আর কোনোদিন গান করো না/কেনো বলে গেলো সেই কথাটি বলে গেলো না/গান যদি পিথিবীতে নাই থাকতো/আরে বাবা পাধানিসা কী করে হতো?…(সারেগামা-র জায়গায় নদী বলেছিলো ‘আরেবাবা’) এই ‘কী করে হতো’ অংশটুকু নদী এমন নিজস্ব একটা ভঙ্গিতে ডেলিভারি দিলো যে অডিটোরিয়ামভর্তি দর্শক মুখর হয়ে উঠলো করতালিতে।
ওদিকে প্রডিউসার রিয়াজউদ্দিন বাদশা ক্ষিপ্র গতিতে ক্যামেরা পালটে পালটে এমন নিখুঁতভাবে গানটাকে ধারণ করলেন যে বিখ্যাত কণ্ঠিশিল্পীদের সলো পারফরম্যান্স রেকর্ড করার মতোই ঘটনাটা উঠে এলো পর্দায়। পেছন দিক থেকে নদীকে ক্যামেরায় ধরে সামনের দর্শকদেরসহ দৃশ্যটা শ্যুট করা হলো। বিশাল স্টেজ আর সামনের বিপুল দর্শকসমেত দৃশ্যটায় নদীকে একটা এইটুকুন পিঁপড়ের মতো লাগছিলো। এই ভাষ্যটা বাদশা ভাইয়ের। একজীবনে এইরকম শট অসংখ্যবার ধারণ করেছেন বাদশা তাঁর প্রযোজিত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে। কিন্তু নদীর বয়েসী কোনো খুদে শিল্পীর জন্যে এরকম শট কখনোই নেবার সুযোগ হয়নি তাঁর। প্যানেল থেকে নেমে এসে বাদশা ভাই বললেন—‘অই শটটায় নদীকে একটা পিঁপড়ার মতোন লাগতেছিলো। আরে মিয়া ক্যামেরায় দেখি দেখাই যায় না এমন একটা পিচ্চি দর্শকগো মাতায়া দিলো। আমি তখন স্টেজ আর অডিটোরিয়ামের বিশালতাটা বুঝাইতে এবং আমার আর্টিস্ট যে একটা এইটুকুন পিচ্চি সেইটা বুঝাইতে সেইভাবে শটটা টেক করলাম। ফাটাফাটি আসছে এডিটিং-এর সময় দেইখো।’
নদী যখন গান থামিয়ে সামনে দর্শকসারিতে বসে থাকা বাচ্চাটাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলছিলো—বাবুকে বলি বাবুকে, বাদশা ভাই তখন ক্ষীপ্র গতিতে সেই বাচ্চাটাকেও ক্যামেরায় ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। এবং তাতে করে দৃশ্যটা ভিন্ন একটা মাত্রা পেয়েছিলো। ছোটদের সেই ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে গান গাইতে এসেছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন। তিনি ছুটে এসে নদীকে কোলে তুলে নিলেন—‘কী যে সুন্দর লাগলো রিটন আপনার মেয়েটার পারফরম্যান্স’ বলতে বলতে। সেদিন নদীকে অনেক আদর করেছিলেন চিত্রা সুলতানাও। চিত্রার কন্যা নওরীনও সেই অনুষ্ঠানে একটা বিদেশী গান গেয়েছিলো। নওরীন নিজেই ছিলো একজন শিশুশিল্পী, নদীর থেকে মাত্র তিন চার বছরের বড়। ছোট্ট নওরীনও নদীকে আদর করে দিয়েছিলো। শার্লির খুশি দেখে কে! সেই থেকে দীবার গাওয়া গানটা আমার অন্যতম প্রিয় একটা গান হয়ে আছে। এখনও, প্রবাস জীবনে স্মৃতিকাতরতা পেয়ে বসলে ইউটিউব থেকে গানটা শুনি আর সেদিনের পিচ্চি নদীটাকে অনুভব করি।
একটু বড় হলে, কথা বলতে শেখার পর, সিনেমার আরেকটা গান ও আমাকে গেয়ে শোনাতো—‘মন্দ হোক ভালো হোক বাবা আমার বাবা/পৃথিবীতে বাবার মতো আর আছে কেবা’। ওর মায়ের সঙ্গে আমার প্রচন্ড ঝগড়া হলো একবার। ঝগড়ার পর ওর মা পাশের ঘরে বসে কাঁদছিলো। অন্য ঘরে বসে আমি চিৎকার করে কথা বলেই যাচ্ছিলাম ওর মায়ের উদ্দেশ। এমন সময় নদী এসে আমার সামনে হাত জোর করার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে অনেক মন খারাপ করা চেহারা নিয়ে গানটা গাইলো–‘মন্দ হোক ভালো হোক বাবা আমার বাবা/পৃথিবীতে বাবার মতো আর আছে কেবা। আমার চিৎকার মুহূর্তেই থেমে গিয়েছিলো নদীর এপ্রোচ দেখে। ঝগড়ায় ক্ষ্যান্ত দিয়ে ওকে একটা চুমু খেয়ে দ্রুত বেরিয়ে গিয়েছিলাম আমি ঘর থেকে। সিনেমায় এরকম একটা দৃশ্য ছিলো। বাবা মায়ের ঝগড়ার মাঝখানে ছোট্ট একটা বাচ্চা ওরকম হাত জোর করে গানটা গেয়েছিলো। আমাদের অনেক ঝগড়া থামানোর ব্যাপারে নদীর বিশাল একটা ভূমিকা থাকতো। নদী আমাকে বলতো—‘তুমি একটা রাগী ছেলে।’
নদী আমাকে চিঠি লিখতো। আমাকে লেখা ওর জীবনের প্রথম চিঠিটা ছিলো খুব মজার। বলপেন দিয়ে একটা কাগজে ছোট্ট একটা গোল্লা মতোন এঁকে কলমটাকে এলোমেলো ঢেউয়ের মতো আঁকাবাঁকা পথে ডানদিকে খানিকটা এগিয়েই বাক্যটির সমাপ্তি টেনেছিলো সে। এক লাইনের চিঠি। ওকে ওর মায়ের কাছে রেখে সপ্তাহ খানেকের জন্যে আমি গিয়েছিলাম সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে আসবার সময় প্রচুর খেলনা কিনে এনেছিলাম নদীর জন্যে। এয়ারপোর্টের কাস্টমস কর্মকর্তা ট্রলিভর্তি তিনটি বিশাল লাগেজ দেখে আমার দিকে এগিয়ে এসে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করেছিলেন—সিঙ্গাপুর থেকে কী এতো এনেছেন? ট্রান্সপারেন্ট একটা লাগেজভর্তি পুতুল দেখে নিজেই বলেছিলেন—ছেলে না মেয়ে আপনার? আমি বলেছিলাম—মেয়ে। একটাই মেয়ে। শুধু খেলনা ছাড়া আর কিচ্ছু কিনিনি। মিষ্টি একটা হাসিতে উদ্ভাসিত মুখে ভদ্রলোক আমাকে সসম্মানে গ্রিন চ্যানেলে পার করিয়ে দিয়েছিলেন—খুব খুশি হবে আপনার মেয়েটা…।
হ্যাঁ, ভীষণ খুশি হয়েছিলো নদী এতো এতো খেলনা একসঙ্গে পেয়ে। ওর জন্যে একটা টিথার এনেছিলাম, ব্যাঙের অবয়বের। কারণ নতুন দাঁত উঠবার সময়ে যত্রতত্র বাচ্চারা খুব কামড়ায়। আমি সামনে থাকলে অন্য কিছু না কামড়ে নদী বেছে নিতো বাবার হাতটা। আমি ডান হাতে লিখতাম আর নদী আমার বাম হাতের কব্জির নরোম অংশটা কামড়াতে থাকতো। ওর ওপর নিচের দুই পাটিতে তখন চারটে মাত্র দাঁত। ইঁদুরের দাঁতের মতো ধারালো আর তীক্ষ্ণ সেই দাঁত কয়টা। আমার হাতের কব্জির অংশটা কামড়ে লাল করে দিয়ে এক পর্যায়ে আমার বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটাকে বেছে নিতো সে। তারপর আঙুলের ডগায় কষে এমন কামড় দিতো যে মনে হতো সেই মুহূর্তে বাবার হাতের ওই আঙুলটাকে বিচ্ছিন্ন করাই ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। এই লেখাটা লিখবার সময় বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের ডগায় আমি আমার ছোট্ট মেয়েটার ঠোঁট আর দাঁতের স্পর্শ পাচ্ছি!
সিঙ্গাপুর থেকে আনা বিপুল খেলনা সামগ্রী দেখেটেখে নদী ওর চিঠিটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো—তোমাকে একটা চিঠি লিখেছি। আমি ওর হাত থেকে নিউজপ্রিন্টের প্যাডের পাতায় লেখা চিঠিটা নিয়ে ভাঁজ খুলে দেখি—বলপেন দিয়ে একটা কাগজে ছোট্ট একটা গোল্লা মতোন এঁকে কলমটাকে এলোমেলো ঢেউয়ের মতো আঁকাবাঁকা পথে ডানদিকে খানিকটা এগিয়েই বাক্যটির সমাপ্তি টেনেছে সে। এক লাইনের চিঠি। কী যে মজা পেলাম! জিজ্ঞেস করলাম—এই চিঠি তুই নিজে লিখেছিস!
–হ্যাঁ লিখেছি।
–কী লিখেছিস এখানে?
–লিখেছি—‘আসো না ক্যানো বাবা’…
ওকে জড়িয়ে ধরে থাকলাম অনেকক্ষণ। ওর ছোট্ট বুকের ধুকপুকি আমার বুকে অনুভব করলাম অনেকক্ষণ ধরে। আমাকে লেখা নদীর জীবনের প্রথম চিঠিটা অনেক যত্নে রেখে দিয়েছি কোনো একটা ফাইলে। দেশ-বিদেশ এইদেশ-সেইদেশ ছুটতে ছুটতে চিঠিটা আপাতত হাতছাড়া হলেও আমি জানি ওটা আছে কোনো একটা বক্সে। আমার সচেতন চোখ ওটা খুঁজছে অনেকদিন ধরে। একদিন পেয়ে যাবো মূল্যবান সেই চিঠিটা। বেশি যত্নে রাখা জিনিস অনেক সময় এমন করে হাতের নাগাল থেকে লুকিয়ে থাকে।
এরপর নদী স্কুলে ভর্তি হলো। অ আ ক খ চিনতে ও লিখতে শিখলো। তারপর লিখতে শিখলো পুরো বাক্য। আমাকে চিঠি লেখা অব্যাহত রাখলো নদী। প্রচুর চিঠি লিখেছে নদী, আমাকে। ওর একেকটা চিঠির মধ্যে মিশে আছে একেকটা গল্প। আমার দেখাদেখি ছড়াও লিখতে শুরু করলো এক সময়। তাও আবার চিঠি-ছড়া। আমাকে ছড়ায় ছড়ায় চিঠি লিখতো নদী। একটা চিঠি সেদিন উদ্ধার হলো। নদীর বয়েস আট/নয় বছর। আমরা থাকি আজিমপুরের ভাড়া বাড়িতে। আমার পত্রিকা ‘ছোটদের কাগজ’ নিয়ে মহা ব্যস্ততায় কাটে আমার দিবস রজনী। সকালে বেরিয়ে যাই ফিরি গভীর রাতে। চিঠিটা সেই সময়ের। এক রাতে বাড়ি ফিরে দেখি ডায়নিং টেবিলে পেপারওয়েটের নিচে আমাকে লেখা একটা দু’পাতার চিঠি। ছড়ায় ছড়ায় চিঠি লিখেছে নদী—
[ ‘হাবা বাবা/নদী
এই যে বাবা,
তুমি একটা হাবা।
সারাদিন শুধু কাগজ,
উলটে দেব তোমার মগজ।
আর আমি কোনো কথা শুনব না,
দেরী করে ফিরবে তা মানব না।
মনে রেখ বাবা
তুমি একটা হাবা।
ইতি
লুৎফর রহমান রিটনকে টারগেট করে
নদী
১৫,৯,৯৫
ছড়ায় ছড়ায় উত্তর দেবে তা জন্য একটি পৃষ্ঠা।’ ]
ওই সময়টায়, আমার ধুন্দুমার ব্যস্ততার সময়টায় আমাদের আজিমপুর শেখ সাহেব বাজার রোডের বাড়িতে নতুন একটা কাজের মেয়ে এলো। নদীর থেকে বয়েসে বড় হলেও মেয়েটা তো একটা বাচ্চা মেয়েই। বাড়িতে শার্লির কাজকর্মে টুকটাক সাহায্য আর নদীকে সার্বক্ষণিক সময় দেয়াই ওর কাজ। নদীর একজন খেলার সঙ্গীও তো প্রয়োজন। গ্রাম থেকে আসা মেয়েটাকে নদী পছন্দই করলো। তখন শীত পড়েছে। নদী আমাকে বললো—বাবা, মেয়েটার জন্যে একটা লেপ কিনে এনো। আমি বললাম—আচ্ছা মামনি আনবো। কিন্তু আমি ভুলে গেলাম। রাতে ফিরলাম শুন্য হাতে। নদী একটু মন খারাপ করলো। আমি বললাম—কালকে নিয়ে আসবো মা।
পরের দিনও ভুলে গেলাম। বাড়িতে ঢোকার পর মনে পড়লো লেপ কেনার কথা। নদীর কাছে প্রতিজ্ঞা করলাম—আর ভুল হবে না। কাল আনবোই আনবো।
পরের দিন রাতে বাড়ি ফেরার পথে মনে পড়লো লেপ কেনার কথা। আমার লাল হোন্ডাটা নিয়ে নিউমার্কেট নীলক্ষেত চক্কর দিলাম। সব বন্ধ। এতো রাতে নীলক্ষেতের লেপ-কম্বলের দোকানগুলো খোলা থাকে না। খুব অপরাধীর ভঙ্গিতে বাড়িতে ঢুকলাম। আমার সঙ্গে কোনো লেপের লক্ষণ না দেখে অভিমানী মেয়েটা মন খারাপ করে চলে গেলো পাশের ঘরে। আমি বললাম—আমি তো গিয়েছিলাম কিনতে কিন্তু দোকান তো বন্ধ হয়ে গেলো আমি যাবার খানিকক্ষণ আগে। আগামীকাল আনবোই আনবো। কিন্তু নদী আমার সঙ্গে এই বিষয়ে কোনো কথাই বললো না।
শার্লি বললো—দোকানগুলো তো আর তোর সুবিধার কথা ভেবে মধ্যরাত পর্যন্ত খোলা থাকবে না। একদিন একটু আগে ফিরলে কী হয়! তোর আচরণে মেয়েটা হতাশ।
এমনিতেই টায়ার্ড ছিলাম। খুব অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে ভাত খেলাম। তারপর ‘আগামীকাল আনবো’ বলে নদীর কাছে ফের একটা প্রতিজ্ঞা করে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে পেপারওয়েট দিয়ে চেপে রাখা নদীর একটা চিঠি পেলাম। আমাকে লেখা নদীর চিঠিগুলো সাধারণত মজার হয়। কিন্তু এই চিঠিটা মজার না। নদী লিখেছে—‘বাবা, তুমি না একজন শিশুসাহিত্যিক? একজন শিশুসাহিত্যিক হয়ে তুমি একজন শিশুর কষ্টের কথা ভুলে যাও! প্রতিদিন বল লেপ কিনে আনব লেপ কিনে আনব কিন্তু আন না। রাতে মেয়েটা শীতে কষ্ট পায়। কাঁপে। ইতি নদী।’
চিঠিটা পড়ে কী যে লজ্জা পেলাম! একজন শিশুসাহিত্যিক হিশেবে একটি শিশুর প্রতি আমার দায়িত্বহীনতার বিষয়টি সরাসরি উত্থাপন করে আমাকে রীতিমতো আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে নদী। আমি জানি ওই মেয়েটার জন্যে শার্লি কাঁথা-কম্বলের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু নদী ঘুমোয় লেপের নিচে। নদীর ধারণা কম্বলে শীত থেকে বাঁচা যায় না। শীত থেকে বাঁচতে লেপই লাগবে। যেহেতু সে নিজে লেপ গায়ে ঘুমোয় তাই ওই মেয়েটাকেও একটা লেপই কিনে দিতে হবে। গ্রাম থেকে আসা ছোট্ট মেয়েটা জানতেই পারলো না ওকে কেন্দ্র করে কতো বড় একটা কাণ্ড ঘটে গেছে এই বাড়িতে। ওর কারণে একজন শিশুসাহিত্যিকের মর্যাদা আজ হুমকির মুখে।
আমি জানি আজও আমার ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। আজও আমি পৌঁছার আগেই নীলক্ষেতের লেপ-বালিশের দোকানগুলো যথারীতি বন্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং আর ভুল করা চলবে না। আমি অফিস যাবার আগে সকালেই নীলক্ষেত চলে গেলাম। একটা চকমকে হরিৎ রঙা শার্টিন কাপড়ে নির্মিত ‘ছোটদের লেপ’ কিনে বাড়িতে এসে শার্লির হাতে লেপটা গছিয়ে তারপর আমি অফিস যাত্রা করলাম। আমি জানি, উদয়ন স্কুল থেকে ফিরে এই ঝলমলে লেপটাকে দেখে ভীষণ খুশি হবে নদী। কারণ নদীর জন্যে কেনা লেপটাও ঠিক একই রকমের, একই দোকান থেকে কেনা। ওর শিশুসাহিত্যিক বাবাটাকে নদী আজ ক্ষমা করে দেবে।
হরিৎ রঙা শার্টিন নির্মিত একটা ‘ছোটদের লেপ’ একজন শিশুসাহিত্যিকের মর্যাদা রক্ষায় বিশাল ভূমিকা রেখেছিলো সেদিন!
রচনাকাল/ ঢাকা ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪
Leave a Reply